বৃহস্পতিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

ভয় আর ভয়

ক্লাস শেষ করে সিঁড়ি দিয়ে নামছেন উমাদি, দুচোখ দিয়ে জলের ধারা। দৃশ্যতঃ বড্ড বেসামাল। টিচার্স রুমে সবাই খুব উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করে, কি হয়েছে? উমাদি বলেন, আজ তিনি ক্লাসে একজন কে শাস্তি দিয়েছেন। সবাই আরও অবাক হয়। শিক্ষক শিক্ষিকারা তো প্রয়োজনে শাস্তি দিতেই পারেন। উমাদি খুব বিষণ্ণ হয়ে বলেন, কাল হয়তো এই ছাত্রটি অনেক বড় হবে, তখন তার আত্মজীবনীতে লিখবে আজকের কথা। সেদিনের কথা ভেবেই তাঁর এই কষ্ট। ঘটনাটি অবেগ তাড়িত সন্দেহ নেই, তবে আরও যে সত্যটা বেরিয়ে আসে, তা হল বিশ্বাস। ছাত্রদের প্রতি বিশ্বাস। এই বিশ্বাসই ছাত্রছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করে, সত্যি সত্যি বড় হয়ে উঠতে। কোনদিন স্কুল জানালার ঘেরাটোপ ছাড়িয়ে, ওই আকাশের রঙিন ঘুড়িরটার মতোই সে উড়াল দেয়, চাল ডালের দৈনন্দিন একঘেয়েমিতার বাইরে গিয়ে মানুষের মতো মানুষ হবার আকাঙ্খায়।

ঘটনাটি শুনেছিলাম শুভেন্দ্রর কাছে। কলকাতার পাঠভবনে পড়ত শুভেন্দ্র। উমাদি ছিলেন সেই পাঠভবনের শ্রদ্ধেয়া প্রতিষ্ঠাত্রী। শুনে বড় ঈর্ষা হয়েছিল, ওর সৌভাগ্য দেখে। এমন শিক্ষকের সান্নিধ্যে সব ছাত্ররা কেন আসেনা? ভালো ছাত্রদের প্রতি স্যারেরা বেশি স্নেহপরায়ণ হন। ব্যক্তিগতভাবে সেই পরিধিতে ঢোকার যোগ্যতা ছিলনা। আমাদের চারপাশটা ছিল অন্য রকম। স্যারেদের আমরা ভয় পেতেই শিখলাম। ক্লাসের বারান্দা থমথমে, টীচার্স রুম থেকে অন্য শিক্ষকরা ছুটে এসে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছেন, কিন্তু পারছেন না। ধুলিশায়ী একটি ছাত্র, আর তার উপর উপর্যুপরি বেত্রাঘাত করে চলেছেন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মশাই।  সাদা জামা রক্তাভ হয়ে উঠেছে। কখনও মারের চোটে বেত ভেঙে গেল। এমন দৃশ্য একবার নয়, মাঝে মাঝেই পীড়া দিত। কোন বিশেষ একজন শিক্ষক নন, এমন ছিলেন অনেকেই বা প্রত্যেকেই। আজ সময়ের সরণীতে পিছন ফিরে দুয়েকজনকেই মনে পড়ে, যিনি থার্ড ডিগ্রী ব্যবহার করেন নি।

ভয় গেঁথে গেছিল মনের ভেতর। এত ভয় যে স্কুলে আসার পথে, স্কুলের সাইনবোর্ড দেখলে অন্তরের অন্তঃস্থল পর্যন্ত কেঁপে উঠত। সেদিনের শিক্ষকরা হয়তো বলবেন, এমনভাবে নিয়মানুবর্তিতা শেখানো হয়েছে বলে আজ কর্মক্ষম হয়েছি। হতে পারে, আমরা শিখেছি কি করে এক ছাঁচের কর্মী হতে পারি। তবে শৈশবের দিনগুলো যদি আরেকটু খোলামেলা হত, তবে স্কুল থেকে বড় চাকুরে, বা ডাক্তার ইঞ্জিনীয়ার ছাড়া, কয়েকটি খেলোয়াড়, শিল্পী, কবি  বা অন্য কোন উদ্ভাবনী পথে হাঁটার মানুষও তৈরী হত। কলকাতা ময়দানের বড় ক্লাবে খেলেছেন এমন স্বনামধন্য খেলোয়াড় আছেন যিনি আমাদের স্কুলে পড়তেন, তবে দুঃখের বিষয়, তিনি এই স্কুল থেকে মাধ্যমিকের গন্ডী পেরতে পারেননি। হয়তো শিক্ষককুল বলবেন এটা ছাত্রটির দূর্বলতা। তা নয়, স্কুলের শিক্ষা পদ্ধতির দূর্বলতা, তাঁরা প্রতিটি ছাত্রকে তাদের মতো করে বেড়ে ওঠার ব্যবস্থা করতে পারেননি। পেরেছেন কেবল একটিমাত্র নির্দিষ্ট ছাঁচ তৈরি করতে। সেই সাবধানী ছাঁচ থেকে এক ধরনের ছাত্রই প্রস্তুত হয়।

তখন বোধহয় ক্লাস সিক্স, হঠাৎ একদিন শুনলাম আমাদের সহপাঠী সম্রাট, নিজেকে ট্রেনলাইনে সঁপে দিয়েছে। কারণ একজন স্যার তাকে বলেছিলেন, পরেরদিন তিনি ওকে দেখে নেবেন। আজ মনে নেই, ঠিক কি দেখে নেবার কথা হয়েছিল। একটি বারো তেরো বছরের কিশোরের কাছে কিইবা দেখবার থাকে, পড়া সংক্রান্ত বাড়ির-কাজ ছাড়া? সম্রাট সেই স্যারের সম্মুখীণ হবার চেয়ে, চলন্ত ট্রেন কে কম ভীতিপ্রদ মনে করেছিল। আজও সম্রাটের মুখটা চোখের সামনে ভাসে। ছুটিছাটার দিনগুলোতে সম্রাট আমাদের বাড়িতে আসত। অনেক খেলাধুলায় সময় কেটেছে।

বিপ্লব বলে একটি ছেলে ছিল আমাদের ক্লাসে।  কোন পড়াতেই তার কোন আগ্রহ থাকতনা। একজন স্যার প্রতিদিন এসে তাকে গালমন্দ করতেন আর বলতেন, তুই বড় হয়ে ট্রেনে বাদাম ফেরি করবি। কারণ স্যারের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তার চেয়ে বেশি যোগ্যতা সে অর্জন করতে পারবে না। অন্যদিকে সেই স্যার শুনেছি সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে গেছেন। এত ঋণাত্মক চিন্তা নিয়ে তিনি নিজেই নিজের শিক্ষকতার জীবনে স্থির থাকতে পারেননি। আজ সেই বিপ্লব কে খুঁজে বের করতে বড় ইচ্ছ হয়। সময়ের খেলাতে সে এখন কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে জানতে পেলে ভালো হত।

ক্লাসে পড়া না পারাতে, এক শিক্ষক একটি ছাত্রকে ডাস্টার দিয়ে মাথায় আঘাত করেন। ছাত্র ঠ্যাঙাতে অনেকই কাঠের ডাস্টার ব্যবহার করতেন।  ক্লাস শেষ হয়ে গেছে, টিফিনের সময় সেই স্যার হয়তো অন্য কোন ক্লাস থেকে বেরিয়ে আগের ক্লাসের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ সেই ছেলেটিকে দেখে, ঘরে ঢুকে আরও বার কয়েক ডাস্টার সহযোগে মেরে যান। এমনি করে ছেলেটি দিনের মধ্য প্রায় তিন-চার বার এক কারণের জন্য শাস্তি পায়। শেষে বাড়ির ফেরার পথে রেল স্টেশনে যখন দাঁড়িয়ে, ওকে দেখতে পেয়ে স্যারটি ওইখানেও অজস্র বাইরের মানুষের সামনে আবার প্রহার করেন।

স্যারেদের দাপটের সাথে সাথে, কঠোরতা ছিল নম্বর দেওয়াতেও। অনেক স্যারকে গর্বের সাথে বলতে শুনেছি, আমি ছেলে কে তিরিশ দেব, সেই ছেলে মাধ্যমিকে নব্বই পাবে। তখন সেই কথাগুলোকেই বেদবাক্য মনে হত। আজ মনে হয়, যে ছেলে নব্বই পাবার যোগ্য, তাকে তিরিশ দিয়ে হয়তো স্যার নিজের বিচার শক্তির অবমাননা করেছেন। তিনি অতি সাবধানী হয়ে ছেলেটিকে উপযুক্ত মান দিতে পারেননি। এই জন্য অনেক ছাত্র ক্লাস নাইন পর্যন্ত থেকে, শেষ ক্লাস অন্য স্কুলে পড়ে মাধ্যমিক দিয়েছে। তাতে আমাদের স্কুলের পরিসংখ্যান ঠিক থাকত, গড়ে প্রায় প্রত্যেকে ফার্স্ট ডিভিশন বা স্টারমার্ক। এখন খোঁজ নিলে দেখা যেতে পারে সেই ছেড়ে যাওয়া ছেলেরাও কোন অংশে কম নয়, তারাও জীবনের পরীক্ষাতে সসম্মানে উত্তীর্ণ।

স্কুলের শেষ পরীক্ষা ছিল ‘টেস্ট’ পরীক্ষা। এই পরীক্ষার ফলাফল ছিল একটি বিশেষ ছাঁকনি। ক্লাস ওয়ান থেকে ছাঁকতে ছাঁকতে, শেষের পরীক্ষাতে প্রায় তিনভাগ ছাত্রকে ছেঁটে ফেলা হত, যাতে মাধ্যমিকে স্কুলের অসাধারণ এক পরিসংখ্যান তৈরী হয়। এই ‘টেস্ট’ পরীক্ষাটি যেমন শক্ত হত, তেমনই কড়া, তার খাতা দেখা। ফল প্রকাশের দিন, খুব দুরুদুরু বুকে স্কুল প্রাঙ্গণে লাইন করে দাঁড়িয়ে। শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষক মহাশয় এসে বললেন, এত খারাপ রেজাল্ট হয়েছে, ছাত্রদের সুইসাইড করা উচিত। সামনে পনেরো ষোলো বছরের ছেলেরা, আর তাদের কে প্রধান শিক্ষক এই সম্ভাষণে প্ররোচিত করছেন। সহকারী প্রধান শিক্ষক পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। হয়তো ঘটনার গাম্ভীর্য উপলব্ধি করেছিলেন। তৎক্ষণাৎ অন্য কথা বলে অবস্থার নিয়ন্ত্রণ করেন, না হলে আরও কয়েকজনের নাম সম্রাটের পাশে লেখা হয়ে থাকত।

তুলনা করা হয়তো ঠিক নয়। আরেকটি স্কুলের এমন শেষদিনে তাদের মাস্টার মশাই বলছেনঃ

“প্রস্তুতিটা কেমন হল কমিয়ে দিয়ে নাওয়া খাওয়া?
এতদিনের স্কুল জীবনের এত রকম চাওয়া পাওয়া দেয়া নেয়া
একদিনের এই খাতার পাতায় সম্ভব তার বিচার হওয়া?
এপ্রিলস্য প্রথম দিনে এমনভাবে বোকা হওয়া যায় না সওয়া
গেলেই তবে সহজ হবে জীবন স্রোতে তরী বাওয়া।
পাঠ ভবন ছাড়বে বলে রঙ্গিন মনের ডানায় বুঝি লাগছে হাওয়া?
যতই বল বিদায়, তোমার যাওয়া তো নয় যাওয়া”।

একটা অবিচ্ছেদ্য বাঁধনে ছাত্র ছাত্রীদের বেঁধে রাখেলেন। আমরাও বেঁধে আছি, ভয়ে জড়সড় হয়ে।

বৃহস্পতিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

উইঙসের ওপারে

ঠিক কতটা পেলে পাওয়া হয়? প্রশ্নটা সহজ। উত্তর খোঁজাটা একলার হয়না। মানুষের ভেতর বাহির ঘিরে রাখে আরও অনেক কিছু। সম্পর্কের বীজ, মায়া মমতার ছাল বাকল। সময়ের ডালপালায় নিজেকে ঢেকে রাখে। এতগুলো ঝুরি নেমেছে চারিদিক দিয়ে, তার মধ্যে ঠিক কোনটা আমার কান্ড, সেই অবয়বটি হারিয়ে যায়। কতকটা, “পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি', মূর্তি ভাবে 'আমি দেব'” অবস্থা। নিজের নানারূপ দেখে আমরা নিজেরাই অস্থির। অথচ এই অস্তিত্বর সঙ্কট থেকে উদ্ধার করবে কে? গেরুয়া বসনের সন্ন্যাসী? যিনি এই ছাল বাকলের পর্দা এড়িয়ে একক সত্যের পথে চলেছেন। নাকি গর্ভগৃহে অধিষ্ঠান রত কোন দেবতার মন্ত্রপূতঃ ঔজ্জ্বল্য? অথবা অতিদূর কষ্ট সহ্যকারী কোন দূর্গম পথ, যা পার হবার পর যুধিষ্ঠিরের মত বলতে ইচ্ছা করে, আমি এসেছি। সাথে চিরসাথী পোষ্যটি। কিন্তু পোষ্যর সাথে নিজের জীবনের আয়ু এক নয়, তাই তাকে ‘চিরসখা ছেড়না’ বলে জড়ালেও প্রাকৃতিক নিয়মেই সে থাকবে না। অতয়েব সারবত্তা হল একলা এসেছি একলা যাবো, মাঝের এই ভেজাল যত বাড়বে, তত একলা মানুষটি হারিয়ে যাবে।

মেলার মাঝে যেমনটা হয়। একলা একলা হারিয়ে যাওয়া। আসেপাশে এদিক ওদিক, এমনকি উপর নিচেও মানুষ থাকতে পারে। উপর নিচে থাকে না? নাগরদোলা ছাড়া মেলা হয়? তবে উপর নিচও হল। আর সব অচেনা মানুষ। অচেনা অর্থ, আগে দেখিনি। কথা কইনি। তবু তারা গা ঘেঁষে চলে যায়, আলগোছে কথাও কয়। জীবনের মতো, ভীড় রেলগাড়িতে কতশত মানুষের সাথে অন্তরঙ্গ গা ঘষাঘষি হল, তার কি কিছু রইল? না রাখা যায়। এ জগৎ তেমনটাই। তোমার আমার সুতোর বাঁধন জুড়তেও সময় লাগনা, ছিঁড়তেও না। এটুকুর জন্য এত মারপিট আর দাঙ্গা হাঙ্গামা করার কোন প্রয়োজন নেই। তাহলে কি সকলে দূরে দূরে থাকবে? এমনটাও হবার নয়। দূরে আছি মনে রেখে, কাছে থাকতে হবে। কি আব্দার! মায়ার বাঁধন কি একেই বলে? মহাত্মারা বলতে পারেন। আমি খুব সাধারন মাপের মঞ্চশিল্পী। না আছে ওজন, না আছে ছটা। যবনিকা না পড়া পর্যন্ত সহশিল্পীর সাথে সম্পর্ক, নাট্যকার, নির্দেশক যেমন বলে দিয়েছেন, তেমন। সে বাপ ছেলে, চোর পুলিশ, রাজা উজির যা কিছু হতে পারে। আবার উইঙস দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে অন্য ভাষা অন্য রূপ অন্য সম্পর্ক। তা জগৎএর উইঙস থেকে বেরিয়ে গেলে ঠিক কি হয়, সেটা জানিনা বলেই এত গোল। তা, থাকল না হয়, একটু রহস্য। চেনা স্টেশন পার হয়ে কোন অচেনা স্টেশনে গিয়ে নামব, সেটা সেই সময়ের জন্য তোলা থাকল। আবার কেউ কেউ বলেন, এই জগতে ঢোকা বেরনোর সময়গুলোতে স্মৃতি লোপ পায়, যন্ত্রে না কি এমনই প্রোগ্রাম করা আছে। বেশ তবে তাই থাকল। এত বছরে এত লোক ঢুকছে বেরচ্ছে, কই কেউ তো একবারের জন্য ঘুরে এসে বলছে না মঞ্চের অন্যদিকটা কেমন? তার নিশ্চিত কোন কারণ আছে। আর কিছু না-জানা থাকলেই ভয় জমতে থাকে। সেখানে নানা ব্যবসায়ী তাঁদের মতো করে ভয় দেখায় যাতে তাদের দুটো রোজগার হয়।

শেষের দিনে প্রশ্নটা অধরাই থাকল, আমি কে? আমার শরীরটা কি আমি? নিশ্চই তা নয়। তা না হলে, কেন বলি “আমার শরীরটা ভালো নেই”? আমার জামা, আমার জুতোর মতোই আমার শরীর। তাই আমি আর আমার জামা বা জুতো যেমন একজন নই, আমি আর আমার শরীরও আলাদা। কেমন হল তো? সেই কাক্কেশ্বরের হিসেবের মতো হল কি? তার মানে আমার শরীরটা যদি আমি না হলাম, তবে আমি কে? হতে পারে আমি এই শরীরটার মধ্যে থাকি। কিন্তু আমি যে শরীরটা নই, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। তা পরজন্ম থাকলেও নেই, না থাকলেও নেই।

অন্যদিকে সম্পর্কের সূত্র ধরা যাক। আমার সন্তানের পিতা কি আমি? স্ত্রীর স্বামী, পিতা মাতার সন্তান? যাঁরা আত্মা-তত্বে বিশ্বাসী, তাঁরা বলবেন আত্মার একটা আধার দরকার, সেই কারণে একজন পিতা মাতাকে প্রয়োজন। প্রকৃতির নিয়মে একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন সত্ত্বাকে তাঁরা ধারন করেছেন। এই স্বাধীন স্বত্ত্বাটির স্বরূপ কি? তিনি কোথায় থাকেন? জন্ম নেবার আগে ও পরে তাঁর অস্তিত্ব কেমন? লাল, হলুদ না গোলাপী? পৃথিবীর বুকে প্রায় চুরাশি হাজার জীব প্রজাতি আছে। তাদের মধ্যে একমাত্র মানুষ উপার্জন করে খায়। অন্যরা তেমন কিছু করে না। অথচ তারা কেউ না খেয়ে নেই। খেতে গিয়ে কাজ করতে হয়, কাজ করতে গিয়ে অবয়ব তৈরি হয়। সেই অবয়ব তখন আমার পরিচয় হয়ে চেপে বসে। উনি ডাক্তার, তিনি পুলিশ, সে দোকানদার এমন নানা রকমের কাজ আর নানা রকমের পরিচয়। তবে সে যে মানুষ, সেই ঘটনাটা গেল হারিয়ে। অতঃপর তিনি বৃদ্ধ হলেন, তাঁর শরীর থেকে ঝরে পড়ল পেশাগত মুখোশ। ব্যাস আর যায় কোথায়, ডাক্তার পুলিশ দোকানদার সব মিশে গেল। কখনও কখনও তাঁরা বিশ্বাস করতে চান না, কি শো শেষ হয়ে গেছে, মনে মনে নকল দাড়ি গোঁফ লাগিয়ে সংলাপ বলে যান। মধ্যিখান থেকে হারিয়ে যায় আমার আসল আমি-টা।

বড্ড গোলমাল বাধালে দেখছি। আচ্ছা একটু ওপর থেকে ভাবা যাক। এক্কেবারে ফাঁকা একটা জায়গা। অতীব অন্ধকার, বাতাস নেই, ধুলো নেই, কিচ্ছু নেই। সে এক অভাবনীয় নেই-রাজ্য। সেখানে অতিকায় পাথুরে, ধাতব, গ্যাসীয় গোলা। একটা দুটো নয়, কোটি কোটি তে। চিন্তার পরিধির সবচেয়ে বড় সংখ্যাটার চেয়েও বড়। পেল্লায় তার আকার। কেউ কেউ আবার খুব গরম, সততঃ প্রজ্জ্বলিত আগুন। কেউ কেউ হিম হিম শীতল ঠান্ডা। আর অমন অতিপ্রাকৃত পরিবেশে এই রাক্ষুসে গোলারা বাঁই বাঁই করে ঘুরে চলেছে। কে ঘোরায়, কেনই বা ঘোরায়? তাই যদি হয় সেখানে, আমরা তার তুলনায় তো ধুলোর চেয়ে ক্ষুদ্র। আর আমদের রণ রক্ত সফলতা কোন পরিমাপেই আসেনা। তবে কি ধরে দিনগুলো কাটাবো? যেটাই করি, তাতে গোলমাল এসে যায়। ওই অত কোটি কোটি গোলকের মধ্যে এই পৃথিবী নামক গোলকটিতে এমন কেন হল বা কি করে হল? আর সেখানে হঠাৎ করে নিজের অস্তিত্ব আবিস্কার করে এমন আহ্লাদিত হবার কি হল?  অত দূর পর্যন্ত, যখন একান্ত পৌঁছানো যাচ্ছেনা, তখন এটুকুই সই। চোখ মেলে তাকাই, কান ভরে গান শুনি। আর ভাব করি ক্ষণস্থায়ী সহযাত্রীদের সাথে, তারা শুধু যে মানুষ তা নন, আরো যারা রয়েছে। এই পৃথিবী তাদেরও বাড়িঘর। প্রজাপতি, পাখি, পশু, পোকা মাকড় এদেরও সমান অধিকার। প্রত্যেকের নিজের নিজের মঞ্চসময় নির্দিষ্ট করা আছে। অভিনয় সাঙ্গ হলে বেরিয়ে যাওয়া দস্তুর। আবার ঢুকতে হবে কি না জানা নেই, তাই যতটুকু হাততালি এই সময়ের কাজের জন্য বরাদ্দ। উইঙস পার করে গেলে, ধরাচূড়া খসে গেলে আর কে চিনবে?


মঙ্গলবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

জলছাপ

বর্ষা নামে হৈচৈ করে। কারো কথা শুনতে দেয় না। রাস্তা জুড়ে কালো জল আর দু ধারের সবুজ গাছপালার বিরামহীন ভিজে যাওয়া। বেশ কিছু গবাদী প্রাণী গাছের নিচে গায়ে গায়ে ঘেঁষে থাকে। নির্বিকার চোখগুলো ঠিক করে পড়াও যাচ্ছেনা। শহর থেকে একটু দূরে, নতুন শিল্প নগরী বলে চিহ্নিত। যাওয়া কাজের সূত্রেই। এক টানা দেওয়া লম্বা মাঠের ওপর আকাশ কেমন ঝুঁকে পরে জল ঢালছে। কাজের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে জলের ছাট এসে যায়। নিরালম্ব মন ভিজে কাকের মত জড়সড় হয়ে বসে। মাঠে উঁচু উঁচু ঘাস। তার গায় বেয়ে জল ডিঙিয়ে যাচ্ছে ঢোঁড়া সাপ।

টাকা তুলতে একটি এটিএম-এ। লম্বা লাইন। বৃষ্টি একক ভাবে জানান দিয়ে চলেছে। একটা মাত্র যন্ত্র কাজ করছে। বেশ ভীড় জমেছে। আসে পাশে লোকজন বেশিরভাগ শ্রমজীবি হিন্দিভাষী মানুষ। এমন দুটি অল্প বয়সী ছেলে গল্প করছে। হিন্দী বাচনভঙ্গীতে বলে, "বাবুরাম সাপুরে, কোথা যাস বাপুরে। আয় বাবা দেখে যা, দুটো সাপ রেখে যা।" আমি চমকে তাকাই। একটু আগের ঢোঁড়া সাপটি নিজের অস্তিত্ব রেখে গেছে।  আমার চোখের আতিথ্য দেখে, ছেলেটি উৎসাহ পায়। বলে, আরও একটা কবিতা জানি। বুঝতে পারি, অন্য ছেলেটি একেবারে বাংলা জানেনা। অতটা আনন্দ পাচ্ছে না। জিজ্ঞেস করে, ফারসি কোন কবিতা জানে কি না। প্রথম ছেলেটি অদমনীয়। এবার, বাইরে বৃষ্টি দেখে ভাঙা বাংলায় কবিতা বলে, "বিষ্টি পোরে টাপুর টুপুর নোদে আলো বান"। আমি মন দিয়ে ফেলি, ভাবি পরের লাইনগুলো ধরিয়ে দি। ছেলে ভোলানো ছড়া। কেউ কোনদিন হয়তো কানে দিয়েছিল। আবার নিজে থেকে বলে, "দুসরা লাইন ভি থা, ঝাপসা গাছপালা"। এবার আমার গা ছমছম করে ওঠে। এতো রবিঠাকুর! আমি এবার সত্যি ভিজে যাই। আমার প্রাণের একটি তার ছেলেটি হঠাৎ করে ছুঁয়ে দিল, নিজের অজান্তে।

“দিনের আলো নিবে এল,
সুয্যি ডোবে - ডোবে।
আকাশ ঘিরে মেঘ জুটেছে
চাঁদের লোভে লোভে।
মেঘের উপর মেঘ করেছে-
রঙের উপর রঙ,
মন্দিরেতে কাঁসর ঘন্টা।
বাজল ঠঙ ঠঙ।
ও পারেতে বিষ্টি এল,
ঝাপসা গাছপালা।
এ পারেতে মেঘের মাথায়
একশো মানিক জ্বালা।
বাদলা হাওয়ায় মনে পড়ে
ছেলেবেলার গান-

'বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর,
নদেয় এল বান' ”

দিন কাটিয়ে সন্ধ্যে নামার আগে শহরে ফেরার পথে। বর্ষার এখনও কোন বিরতি নেই।  সমস্ত জমে থাকা ভালো লাগা, না শুকোনো জামার মত তিতকুটে। শহরের চারিদিকে জল জল আর জল। তার মধ্য দিয়ে গাড়ি চলছে। জলযানের দুলুনি অকারণ ভীতিপ্রদ হয়ে যায়। আরেক দফা আলাপচারি শেষ হয়, তখন সন্ধ্যে গড়িয়ে যায়। ছড়িয়ে পড়া সর্ষেদানার মত ভেজা মানুষ, ভেজা ছাতা, ছপ ছপ। ফুটপাথ  কোথায়, কোথায় নিকাশি নালা আর কোথায় বা রাস্তা, সব একাকার। তার মধ্যেই হা পিত্যেশ করে ভাড়া-গাড়ির খোঁজ। ফোন-গাড়িরা বেপাত্তা। সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে, অনুনয় করলেও দাঁড়ায় না। শেষে এক বৃদ্ধ ট্যাক্সিওয়ালা রাজি হলেন।  আমরা সবে উঠেছি, কোথা থেকে আর একটি লোক দৌড়ে এসে বলল, একটু বড় রাস্তা অবধি নামিয়ে দিন, সামনে অনেক জল। তারপর যানজট জল পার হয়ে আপিস এলাম, রাত তখন আটটা। গাড়িতে ফোন ফেলে নেমে পড়েছি। সেই ট্যাক্সি চালক আবার এসে ফেরত দিয়ে গেলেন। তারপর আপিস করে, এক শহর ভরা জল ডিঙিয়ে, গাড়ি চালিয়ে বাড়ি আসা। গাড়ি ধীরে চলছে। প্রায় দু ঘন্টা লাগল ঘরে ঢুকতে। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ঘুরতে হল অনেক। আটকে যেতে পারতাম, যেকোন জায়গায়। ইষ্টনাম জপতে জপতে ফেরা। রাতের শহরে. সে আরেক রোমহর্ষক অধ্যায়।

বৃহস্পতিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

মাঠের স্কুল-১

আমাকে প্রধান শিক্ষকের ঘরে ডেকে পাঠানো হল, কেন আজ মনে নেই। সাথে নিম্নবুনিয়াদী থেকে প্রাপ্ত শেষ ফলাফলের কাগজটা ছিল। ওটাই সম্ভবতঃ মাঠের স্কুলে আমার প্রথমদিন। প্রধান শিক্ষক অমরশঙ্কর, যাঁর গেরুয়া প্রবর্তিত নাম হয়েছে স্বামী বোধাতিতানন্দ। তবে একেবারে ছেলেবেলায় তাঁকে অমরশঙ্কর নামে চিনেছিলাম, সেই নামটিতে তিনি সারা জীবন পরিচিত হয়ে ছিলেন, অন্ততঃ আমাদের সময়ের কাছে। ঘরের ভিতর আরেকজন বর্ষীয়াণ শিক্ষক ছিলেন। পরে জেনেছি, ওঁনার নাম শশাঙ্ক শেখর তেওয়ারি, ছোট করে এস.এস.টি স্যার। আমার ফলাফলের কাগজ হাতে নিয়ে বলেছিলেন, ‘মিডিওকার’। সেই মুহুর্তে মানে বুঝতে পারিনি। পরে বাংলা প্রতিশব্দ জেনে এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। নিজেকে নিয়ে ভাবতে আর গৌরবান্বিত হতে অনেকেরই ইচ্ছা থাকে। অবচেতনে হয়তো আমারও তেমন কোন আকাঙ্খা ছিল। মুখের ওপর কেউ আমায় নেহাত মাঝারি বলায়, দশ বছরের বালক মনে চিরস্থায়ী দাগ কেটে যায়। আজও সেই দিনটার কথা মনের মধ্যে বয়ে নিয়ে চলেছি। আবার পুরো স্কুল জীবনে, এই এস.এস.টি স্যারের কাছেই আরেকটি মন্তব্য পেয়ছিলাম। একই সাথে সেই দিনটাও স্মৃতিতে গেঁথে রয়েছে। এস.এস.টি স্যার বাংলা পড়াতেন। সেই সময়, আমাদের স্কুলে পড়ানোর ধরনটা ছিল, খুব সাবধানী। স্যারেরা নিজেরাই প্রশ্ন এবং উত্তর লিখে দিতেন। ছাত্রর দায়িত্ব ছিল সেটা মুখস্থ করে খাতায় ওগড়ানো। চেনা লেখা পেলে তবেই ভালো নম্বর আসত, নচেৎ নয়। আমি ছিলাম ফাঁকিবাজ ছাত্র। গড়গড়িয়ে স্যারের লেখা মুখস্থ করাতে বড় আলস্য। যা বুঝতাম নিজে নিজেই লেখার চেষ্টা করতাম। এমনই একদিন আমার কোন একটি উত্তর পত্র দেখে স্যার বলেছিলেন, “ক্লাসের মধ্যে একমাত্র ছাত্র, যে মৌলিক রচনা লিখতে পারে”। অচিরেই বুঝতাম স্যার আমায় একটু স্নেহের চোখে দেখছেন।

স্কুলের মধ্যেই সিনেমা হল। আমাদের কাছে ছিল বিষ্ময়! বিবেকানন্দ হল, শুধুমাত্র সিনেমা হল নয়। নিয়মিত আবৃত্তি, গান, বিতর্ক, বক্তৃতা প্রতিযোগিতার অঙ্গন। আর প্রতিটি অনুষ্ঠানের মূল কান্ডারী ছিলেন এস.এস.টি স্যার। ছেলেদের মধ্যে মৌলিক বিদ্যাবৃত্তির চর্চার প্রতি তাঁর অপরিসীম উৎসাহ। সঙ্গে আরেকজন অল্প বয়সী উদ্যোমী শিক্ষক যোগ দিলেন, তাঁর নাম স্বরূপ নন্দ, সংক্ষেপে এস.এন। একবার এস.এন স্যার দুই কবিয়ালের লড়াই করার মতো কবিতায় গান বেঁধে দিলেন। ব্যাস সেই নিয়ে তৈরি হল কবির লড়াই। আশ্রমের দিপক বাজাত ঢোল আর আরেকজন কাঁসর। কবিয়ালের ভূমিকায় কারা অভিনয় করত, এখন আর মনে নেই। তবে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল সেই পালা। বাৎসরিক উৎসব প্রাঙ্গন সহ একাধিকবার অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই কবির লড়াইএর মহড়ার সময় আমিও অনেক সময় থেকেছি কবিতা, বক্তৃতা বা অন্য কোন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির জন্য। শুনে শুনে পুরোটা মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। আজও বেশ কয়েকটা পদ মনে আছে। বিবেকানন্দ হলের প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানে নানা অজুহাতে মঞ্চে থাকার সুযোগ মিলত, কখনও প্রতিযোগী বা কখনও সঞ্চালক রূপে। এই অভ্যাসটি পরবর্তী ক্ষেত্রে মঞ্চভীতি কাটিয়ে দিতে পেরেছিল। ‘পাব্লিক স্পিকিং’ বা কোন দলের সামনে কিছু বলতে অনেক বিদগ্ধ মানুষেরও অনেক সমস্যা হয়, বিবেকানন্দ হলের সেই দিনগুলো ভিত গড়ে দিয়েছিল।

মাঠের স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যে সবচেয়ে ভীতিপ্রদ ছিলেন পি.এম স্যার। পুরো নামা জানার সহস হয়নি কখনও। স্যার কে তেমন মারধর বা বকাবকি করতেও কখনও দেখিনি। তবু ধুতি পাঞ্জাবী পরা এই স্যার ছিলেন যেন সাক্ষাৎ বিভীষিকা। বারান্দা দিয়ে হেঁটে গেলেই ক্লাসের কোলাহল থেমে যেত। এমন নৈঃশব্দ সৃষ্টিকারী তিনজন ছিলেন। পি.এম স্যার ছাড়া হাইস্কুলের সন্তোষবাবু এবং স্বয়ং অমর শঙ্কর। অন্য দুজন বেত হাতেও সমান দক্ষ ছিলেন।

দত্ত স্যার ভূগোল পড়াতেন। একবার বোর্ডে ভারতবর্ষের ম্যাপ এঁকেছিলেন। কেউ একজন খুব বিষ্ময়সূচক মুখে জিজ্ঞেস করেছিল, ওটা কোন পাখির ছবি কি না? স্যার রেগে তাকে ক্লাসের বাইরে বার করে দেন। নিম্নবুনিয়াদী তে শাস্তি পাওয়া ভয়ের ব্যাপার ছিল, একটু উঁচু ক্লাসে উঠে শাস্তিটাও বেশ মজার হয়ে উঠল। গৌর ভুঁইয়া (জি.বি.) নামে একজন শিক্ষক ছিলেন। তার কাছে শাস্তি পাওয়ার জন্য রীতিমত হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। খুব নিরীহ প্রকৃতির ছোটখাটো চেহারার মানুষ ছিলেন জি.বি.। বেশিরভাগ ছাত্র তখন তার চেয়ে উচ্চতায় বেশি হয়ে গেছে। ক্লাসে বেত নিয়ে আসতেন। বেত কে উনি ‘ছড়ি’ বলতেন। ছেলেরা অন্যায় করলে সেই ছড়ি দিয়ে হাতে আঘাত করতেন। বড় বড় ছেলেদের হাতের নাগাল পেতে তাঁকে লাফিয়ে লাফিয়ে প্লাটফর্মের ওপর উঠতে হত, সেই দেখেই আমাদের আমোদের শেষ ছিলনা।

শুভ্রজিৎ বলে এক সহপাঠী আমার পাশেই বসত। তার খাতাপত্র বই একটু অগোছালো থাকত। হাতের লেখাটি যত-না খারাপ ছিল, খাতাটি তার চেয়ে বেশি কাটাকুটি করে, কালি ফেলে, মলাট ছিঁড়ে, কাগজ কুঁচকে একটা অদ্ভুত দর্শন করে রাখত। ওর নিজের চেহারা ছবিতেও এমন ঈশারা থাকত। জামায় কালির দাগ, প্যান্ট থেকে অর্দ্ধেক গোঁজা বেরিয়ে পড়েছে, জুতোয় কালি নেই, ফিতে খোলা। সব মিলিয়ে এলোমেলো এই ছেলেটিকে সুকুমার বর্ণিত দাশুর সাথে তুলনা করা যেত। একদিন ক্লাসে এন.এন.এস. স্যার পড়াচ্ছেন। কিছু একটা লিখতে দিয়েছিলেন। সবাই খাতা জমা দিয়েছি। স্যার একে একে দেখছেন আর মন্তব্য করছেন। শুভ্রজিৎ-এর খাতাটি, মরা-ইঁদুর ধরেছেন এমন মুখ করে তুলে বললেন, “এটা কি? এমন খাতা দিবি তো, ছুঁড়ে ফেলে দেব”। বলে সত্যিই মাটিতে ফেলে দিলেন। শুভ্রজিৎ অম্লান মুখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ছুঁড়ে ফেললে, আবার কুড়িয়ে নিয়ে আসব”। এই বলে একহাতে মাথা চুলকাতে চুলকাতে গিয়ে খাতাটি মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়ে এল। আমরা প্রত্যেকেই যখন মোটামুটি ধোপদুরস্ত হয়ে স্কুলে যেতাম, এমন কিছু নিশ্চই ছিল যা শুভ্রজিৎ কে অমন আলুথালু করে রাখত। সে বয়সে অতটা বোঝা বা জানার উপায় ছিল না।

বীশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য বলে একজন অঙ্কের শিক্ষক ছিলেন। দীর্ঘদেহী এই মানুষটা অন্যদের থেকে আলাদা ছিলেন। খানিক আপনভোলা বিজ্ঞানীর মতো ছিল তাঁর ব্যবহার। একটি কাল্পনিক ছাত্রের গল্প তিনি খুব শোনাতেন, মূলতঃ আমাদের সেই ছাত্রটির সাথে তুলনা করতেই ছিল সেই গল্পের আয়োজন। তিনটি বিষয়ে পরীক্ষাতে ছাত্রটি একশোর মধ্যে যথাক্রমে শূণ্য শূণ্য এবং ছয় পেয়েছে। অথচ খুব আনন্দের সাথে নাচতে নাচতে “আমি শূণ্য শূণ্য ছয় পেয়েছি” বলে বাড়ি ফেরে। ছাত্রটির নম্বর সম্পর্কে কোন বোধ তৈরি হয়নি। ওই সময় আনন্দবাজার পত্রিকাতে সাপ্তাহিক শব্দজব্দ বা ক্রসওয়ার্ড বেরত। আর সঠিক জবাব দিয়ে চিঠি দিলে, ওরা পরবর্তী সপ্তাহে প্রথম কয়েকটি প্ররকের নাম ছাপাতেন। ওই সময় ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখবার দূরন্ত বাসনা ছিল। সঠিক উত্তর দেবার জন্য, মাঝেমাঝেই আমার নাম ছাপা হত। পড়াশুনায় ভালো হলে স্যারেদের কাছে আসা যায়। আমার বেলায় তা খুব একটা খাটেনি। লক্ষ্য করলাম বি.বি. স্যারও শব্দজব্দ করেন। ওই সূত্রে আমাদের মধ্যে কিছুটা ভাব হয়েছিল। অনেকবার আটকে যাওয়া শব্দের সমাধান ওনার কাছ থেকে জেনে নিতাম।

এইসবই খুব অকিঞ্চিৎকর অভিজ্ঞতা। পাঠকের কোন উপকারে আসবে না। ফিরে দেখার মধ্যে একটা অনুরণন হয়, যা কোথাও যেন ফেলে আসা সময় কে আবার ছুঁইয়ে দেয়।

বুধবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৬

বর্ষা দিনে

পশ্চিম পাড়ার ঝাঁকড়া কদম গাছটার নিচে বৃষ্টি অপেক্ষা করত। ছাতা খোলার অবসর নেই, ঝমঝম ঝমঝম। আর যেই বাঁক ঘুরে ব্যাঙ্কে-র মোড় পার হলাম, কোথায় কি? খটখট রোদে চারিদিক ঝকঝকে। অথচ ততক্ষণে অনেকেরেই পোশাকে জলছাপ, জুতো সপসপ। মনের কোণে রেইনি-ডের ইচ্ছের বাতিরা জ্বলতে শুরু করেছে। কিন্তু রেইনি-ডে হত না। স্কুলের খাতায় একটা নিয়ম ছিল, একটা নির্দিষ্ট শতাংশ অনুপস্থিতি হলে, তবেই নাকি রেইনি-ডে দেওয়া যায়। ব্যাস ওইখানেই আমরা মাত। আমাদের প্রায় এক তৃতীয়াংশ ছাত্র আশ্রমে থাকে। তাই বৃষ্টি হোক বা জলোচ্ছাস, তাদের তো স্কুল পৌঁছান আটকায় না, কারণ তারা স্কুলের মধ্যেই থাকে। বিভিন্ন ক্লাসে বাংলা বা ইংরাজিতে রচনা লিখেছি রেইনি-ডে, তবে পুরো স্কুলজীবনে একবারও  বৃষ্টিতে ক্লাস ছুটি হয়নি। আরেকবার তো এমন হল বেশির ভাগ ছেলে ভিজে সপসপে হয়ে এসে, ভাবল বুঝি অন্ততঃ তারা ছুটি পেয়ে যাবে। কয়েকজন তো, নিজে থেকে কলের নিচে দাঁড়িয়ে ভিজিয়ে নিল শরীর। ও বাবা! মহারাজ আশ্রম থেকে প্রত্যেকের জন্য শুকনো পোশাক আনিয়ে দিলেন। আমাদের ছুটি পাওয়ার ইচ্ছেগুলো ভিজে গলে ধুয়ে গেল।


বৃষ্টিদিন নানা অনুষঙ্গে ধরা দিত কৈশোরের দিনগুলোতে। ঝাঁকড়া হয়ে আসা কদমের ডাল আর নাগকেশরের গভীর কেশর সমৃদ্ধ বর্ষাবেলা আমাদের নতুন করে সিক্ত করত প্রতি বছর। টিফিনের সময় কদমের ফুল নিয়ে ফুটবল খেলা। হাতে পায়ে কদমের রেণু লেগে থাকত বুঝি। একদিন ঝপসা হয়ে আসা বৃষ্টিদিনে আপাদমস্তক বর্ষাতিতে ঢেকে চলেছি। পায়ে পায়ে জল ছপছপ। পাশ দিয়ে এক রিক্সা বোঝাই কিশোরীর দল। আমাদের লাগোয়া স্কুল ভবনাথের ছাত্রী সব। আমায় অমন বৃষ্টি-একা দেখে কেমন অকারণ হেসে ওঠে। সময়ের প্রলেপের ওপার থেকে সেই মুখগুলির কোনটাই মনে নেই। তবে রাস্তায় জল মেখে চলা বালককে দেখে কেন অমন হাস্যস্পদ মনে হয়েছিল, জানার উপায় নেই।


প্রত্যেক ক্লাসে বড়বড় নারকেল কাঠির এক জোড়া ঝাঁটা রাখা থাকত। আর পালা করে আমাদের দায়িত্ব পড়ত। সকালে দুজন আর স্কুল ছুটির পর দুজন। বেশ মজাই লাগত। বেঞ্চ সরিয়ে সরিয়ে ঝাঁট দিতে। একটা গুরুদায়িত্ব পড়েছে এমন ভাব। কখনও এদিক ওদিক কিছু ময়লা পরে থাকলে, দায়িত্ব প্রাপ্ত ছাত্রদের তলব করা হত। সেও ছিল বেশ ভয়ের ব্যপার।


ক্রমে আমাদের নিম্ন বুনিয়াদীর সময় ফুরিয়ে আসতে আরম্ভ করল। শুনলাম, আমরা সিক্সে উঠলে অন্য স্কুলে যাবো। সেখানে অন্য মাস্টারমশাই। তাদের সম্পর্কে অনেক রকম গা ছমছমে কথা ভেসে আসত। ‘মাঠের স্কুল’ আর ‘হাই স্কুল’, দুরকম নাম শুনলাম। সেগুলো কেন, কি জন্য বুঝিনি। তবে আমার যেসব সহপাঠীদের অভিভাবকরা, বিশেষ করে মায়েরা নিয়মিত স্কুলে আসতেন, তাঁরা জানতেন। আমায় সেই কোন কালে বাবা স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে গিয়েছিলেন। শুরুতে কয়েকদিন বাবা নিয়ে আসতেন, ক্রমে হাত বদল হয়ে গেল। মনে আছে শঙ্করদা বলে একজন আমায় পৌঁছে দেওয়া নেওয়া করতেন। তাই মাঠের স্কুল না হাইস্কুল, কোনটা আখেরে ভালো হবে, বোঝার উপায় ছিলনা। আজও জানিনা এই দুই স্কুলে ছেলেদের বিভাজনের কি নিয়ম ছিল। আমার ঠাঁই হল, জুনিয়ার হাই স্কুলে। যা মাঠের স্কুল বলে বিখ্যাত। তার কারণ, স্কুল সংলগ্ন বিরাট মাঠ। সেখানে আবার খেলা দেখার জন্য গ্যালারির ব্যবস্থাও আছে। এই মাঠে নাকি জেলার খেলাও হয়। তখনকার দিনের কলকাতা মাঠের বেশ কয়েকজন ফুটবলারের খড়দহ রহড়া অঞ্চলে বাড়ি ছিল। তাঁরা অনেকেই এই মাঠে নিয়মিত অনুশীলন করতেন। ওই বয়সে তারকা ফুটবলারদের দেখতে পাওয়া যেন পরম প্রাপ্তি।


ফুটবলপ্রমী বন্ধুরা মাঠের-স্কুলে এসে যেন প্রাণ পেল। এখন বুঝতে পারি, অমন সুন্দর মাঠওয়ালা স্কুল খুব কম জনের ভাগ্যেই জোটে। ফুটবলের সাথে বৃষ্টির যোগ চিরন্তন। কাদা মাঠে বলের সাথে সড়াৎ করে পিছলে যাওয়া, তারপর আর চিনতে না পারা কে কোন জন। আমার যেন মাঠের গ্যালারিটাই বেশি পছন্দ। ওখানে বসেই খেলা দেখতাম। গোল হলে চিৎকার করে গলা ফাটাতাম, মাঠে খুব কমই নামতাম। একমাত্র যখন ওদের খেলোয়াড় কম পড়ত, টেনে এনে গোলকিপার করে দাঁড় করিয়ে দিত।

গোলপোস্টের সুরক্ষার চেয়ে যেন আমার নিজের লুকিয়ে থাকাটাই বড়। যারা রক্ষণার্ধে দাঁড়িয়ে, তারাই গোল বাঁচানোর যাবতীয় কারসাজি করত। আমি কতকটা সাক্ষীগোপাল হয়ে, পুরো খেলাটা দেখতাম। এমনি করে গোটা জীবনে খানিক দূর থেকে খেলা দেখার একটা অভ্যেস কেমন করে তৈরি হয়ে গেল। সেখানে আমি যেন আমি নই, মাঠে ছুটোছুটি করা কোন তৃতীয় পক্ষ। গ্যালারি তে বসে, নিজেরই খেলা দেখছি। সে আমার থেকে বিযুক্ত হয়ে অন্যকেউ।

বুধবার, ২৭ জুলাই, ২০১৬

উৎসব

শ্রীরামকৃষ্ণের নামাঙ্কিত স্কুল। পড়াশুনার সাথে সাথে চিনতে শিখলাম স্বামীজী, মা সারদা, ভগনি নিবেদিতা, স্বামী ব্রহ্মানন্দ, লাটু মহারাজ থেকে রামকৃষ্ণানন্দজী আরও মনীষীদের। বাংলা অঙ্ক ইংরাজীর সাথে আরও একটা বিষয় আমাদের আগাগোড়া পড়ানো হত, তা হল ভারতীয় সংস্কৃতি। সেখানে শ্রীরামকৃষ্ণ স্বামীজীর কথা, জীবনীর পাশে পাশে উপনিষদের গল্প, গীতার শ্লোক, শঙ্করাচার্য্যের মোহমুদ্গর ইত্যাদি নানা বিষয় পড়তে হত। কতক বুঝে বা না বুঝে সেই সব কথার কিছু কিছু মনে ভেতর গেঁথে দিয়েছিল, যা পরিণত বয়সে চলার পথে আলো দেখায়। ছেলেবেলায় এই বিষয়টিকে অন্য পড়ার বিষয় হিসেবেই দেখেছি।  আর পাঁচটা স্কুলের থেকে আমাদের স্কুলের পরিবেশ নিঃসন্দেহে আলাদা। গাছগাছালিতে ঘেরা আশ্রমিক তপোবন যেন, গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীরা চতুর্দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কেউ ক্লাশ নেন তো কেউ পুজো করেন, তো কেউ অফিসের দেখাশোনা করেন। আমাদের বেড়ে ওঠা একটা অন্য আবহে। তবে সেখানে খুব বেশি ধর্মচর্চা হয়েছে, বলে কখনও মনে হয়নি। আমাদের মন্দিরে শ্রীরামকৃষ্ণের বিগ্রহের সাথে যীশুর ছবি, কাবার ছবি, বুদ্ধদেবের ছবি একই শ্রদ্ধায় পূজিত হত। আমাদের সাথে কয়েকজন অন্য ধর্মাবলম্বী সহপাঠিও পড়ত। ওই সময় তফাত বোঝার মতো মন ছিল না, বা আমাদের কখনও তফাত বোঝানোও হয়নি। যেমন মনে আছে শিবুদার কথা। নিম্নবুনিয়াদীর সহ প্রধান শিক্ষক। খুব বড় বাড়ির ছেলে। সংসার করেননি। স্কুলের ছেলেদের নিয়েই জীবন কাটালেন। শিবুদা বলতেন, "হয়তো তোদের বাবার ক্ষমতা আছে দামী কাপড়ের জামা কিনে দেবার, কিন্তু আমার আশ্রমের ছেলেদের কে দেবে?" তাই মোটা কাপড়ের পোষাক বরাদ্দ ছিল, আমাদের সকলের জন্যই।

শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মতিথি ফাল্গুন মাসে। ফি বছর ওই দিনটা ঘিরে আমাদের স্কুলে হত এক সপ্তাহব্যপী অনুষ্ঠান। মূল অনুষ্ঠানটা হত আমাদের নিম্নবুনিয়াদী বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে। পুরো মাঠ ঘিরে তৈরি হত প্যান্ডেল। যখন সেই প্যান্ডেল বাঁধার বাঁশ পড়তে আরম্ভ করত, আমাদের মনটা খুশিতে লাফিয়ে উঠত। নির্মীয়মান পান্ডেলের বাঁশ ধরে ঝুল খাওয়া ছিল পরম প্রাপ্তি। আর যারা ছিল আরেকটু ডাকাবুকো, তরতর করে এডাল ওডাল করে মগডালে উঠে যেত। প্রতিদিনের অনুষ্ঠানে একটি করে যাত্রা ছিল বাঁধা। আশ্রমের ছেলেরা একদিন করত, স্যারেরা করতেন একদিন, বাইরের প্রতিষ্ঠিত দলও আসত তাদের পালা নিয়ে। যারা পার্ট করত, অনুষ্ঠানের প্রায় একমাস আগে থেকে তাদের মহড়া চলত। কেমন ভিণগ্রহের প্রাণী বলে মনে হত। গোবিন্দ বলে একটি ছেলের কথা মনে পড়ে। আশ্রমে থাকত। আমাদের শ্রেণীতে পড়লেও, চেহারায় বেশ বড়সড় ছিল। ও একবার বোধহয় হিরণ্যকশিপু বা রাবণ হয়েছিল। টিফিন পিরিয়ডে মাঝে মাঝে চোখের কসরত আর অট্টহাসি সহ সংলাপ বলত। আমি তো চিরকেলে হাঁ-করা। সবকিছুতেই বিষ্ময়ে হতবাক হতাম। বিশেষ করে গোবিন্দকে যখন রাজপোশাকে মঞ্চে দেখলাম, কি বলব, বড় হয়ে ঠিক হিরণ্যকশিপু বা রাবণ হব বলে ঠিক করে ফেলেছিলাম।  দিন্দা স্যার কে মঞ্চে দেখার কৌতুহল ছিল খুব।

এই সপ্তাহটি আমাদের উৎসবের মেজাজ। উৎসব শব্দটি আমাদের বাল্য জীবনে এই অনুষ্ঠান ঘিরে আবর্তিত হত। পরে কথার মধ্যে, কোন বিশেষ আনন্দের অনুষঙ্গেও আমরা উৎসব বা শুধু উৎ শব্দটি ব্যবহার করে আমোদ পেতাম। উৎসব শুরু হত, এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা সহকারে। এই মিছিলে যোগ দেবার জন্য আমাদের সাতসকালে স্কুলে এসে হাজির হতে হত। মিশেনের প্রতিটি বিভাগ থেকে সবাই অংশগ্রহন করত। সে শোভাযাত্রার বহর আর বাহার ছিল দেখবার মতো। আজও একই উদ্দীপনার সাথে শোভাযাত্রা বার হয়। যার মাথাটি প্রায় এক কিলোমিটার এগিয়ে গিয়েছে, অথচ শেষটুকু স্কুল প্রাঙ্গন ছাড়েনি। আমাদের কাজ ছিল, ছোট ছোট প্লাকার্ডে মহাপুরুষদের বাণী লিখে আনা। আর শোভাযাত্রায় সেই প্লাকার্ডটি বয়ে নিয়ে যেতে হত। যারা গান গাইত, তাদের জায়গা হত গানের দলের সাথে। কেউ কেউ স্বামীজী, শ্রীরামকৃষ্ণ, বা রাম লক্ষণ ইত্যাদি বহু মনীষীদের মতো সেজে গুজে রথে চড়ে বসত। তাদের প্রতি শুরুতে প্রচ্ছন্ন ঈর্ষা হত, তবে পরে নিজেদের আনন্দ বিচারে, ওদের জন্য কষ্টই হত। আমরা যেমন খুশি বন্ধুদের সাথে মজা করতে করতে পুরো রাস্তা ঘুরতাম, ওরা বেচারা কাঠের পুতুলটি হয়ে ধরাচূড়া পরে বসে থাকত।

ওই সময়ে খুব বেশি বন্ধুরা গাড়ি চড়ে আসত না। স্কুলের দুটি বড় বাস ছিল, একটি টাটা কোম্পানীর অন্যটি অশোক লেল্যান্ড। যারা বাসে করে যাতায়াত করত, তাদের কাছে ওই বাসের সময়টি ছিল আরেক প্রস্থ আনন্দপীঠ। আমার কখনও সুযোগ হয়নি বাসে চড়ার। পথে যেতে কখনও স্কুলের নামাঙ্কিত বাসগুলোর দেখা পেলে, কেন জানিনা খুব রোমাঞ্চ হত। একটি লাল সাদা রঙ করা গোল মতো গাড়ি চড়ে একটি ছেলেকে আসতে দেখতাম। সম্ভবত ও তখন একাই অমন ব্যক্তিগত গাড়ি চড়ে আসত। আমাদের চেয়ে ছোট। পরে জেনেছি, বিখ্যাত যাত্রাশিল্পী শান্তিগোপালের ছেলে। শান্তিগোপাল কয়েকবার আমাদের উৎসব প্রাঙ্গনে পালাও করেছিলেন। মিলন স্যার গোঁফ কেটে, কোন স্ত্রী চরিত্রে অভিনয় করে ছিলেন। উৎসব শেষে তাঁকে গোঁফ ছাড়া গ্রহন করতে আমাদের বেশ মজা লাগত। বিরাট শোভাযাত্রায় আরেকটি মনে রাখার মত দৃশ্য ছিল, কবিদত্ত স্যারের ছবি তোলা। পুরো শোভাযাত্রাটির বিভিন্ন মুহুর্ত তাঁর ক্যামেরা বন্দী হয়ে থাকত। আর সে জন্য তিনি কখনও রাস্তার পাশে কোন গাছে চড়ছেন কখনওবা কারো বাড়ির ছাদে। শীর্ণকায় মানুষটির এই ছুটে ছুটে জায়গা বদল করাও আমাদের মনের খাতায় চির বন্দী হয়ে রয়েছে। এমন হাতে হাতে তখন ক্যামেরা ছিলনা, তার এই পরিশ্রম করে ছবি তোলার ছবি, কেউ তুলে রাখিনি।

সোমবার, ২৫ জুলাই, ২০১৬

লাস্ট বেঞ্চ

বিরাট বিরাট মাঠ আর বড় বড় আম কাঁঠালের ছায়ায় মোড়া, এক স্বপ্নের প্রাঙ্গনের নাম, স্কুল। সেই সময় ভয় করত। হয়তো এখনও করে। স্কুলে পৌঁছানোর নির্দেশ-লিখন প্রায় তিন চার কিলোমিটার দূরে দূরে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার মোড়ে টাঙানো থাকত। আজও আছে। সেই সময় ছিল ভোরের স্কুল। শুরুতে বাবার হাত ধরে এসেছি। তারপর হাত বদল হতে হতে, একা একা সহজ সাইকেলে। কোন এক কুয়াশা মোড়া শীতের সকালে জীবনের এই অধ্যায়টি শুরু হয়েছিল, কারণ তখন জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর ছিল পড়াশুনার বৎসর। বেশিরভাগ শিশুরই স্কুলে যাওয়ার আগে ও পরে এক উত্তেজনা ও অনীহা তৈরী হয়। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ভোরের আলো আধাঁরিতে যখন প্রথম রাস্তার মোড়ে স্কুলের নাম লেখা বড় নির্দেশ-লিখন চোখে পড়ত, বুকের ভেতর ধড়াস করে উঠত এক অজানা আশঙ্কায়। না জানি আজ আবার কি আছে অপেক্ষায়? ক্রমে ক্রমে স্কুল কাছে আসতে থাকে, আর সেই ধুকপুকানিও বাড়তে থাকে।

সেই সময় শীত আসত মরসুমি ফুলের হাত ধরে। স্কুলের প্রধান ফটক পার করার পর, চোখে ধাঁধা লাগানোর মতো বড় বড় ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকায় আলো হয়ে থাকত। এত আলোতেও কিন্তু মনের সেই ধুকপুকানিটা যেত না। শুরুতে সরাসরি মন্দির প্রাঙ্গন। সেখানে শ্রীরামকৃষ্ণের মর্মর মূর্তি। খুব চট করে একটা প্রণাম ঠুকে স্কুলের পথে পারি। বাঁদিকে সদর আপিস, মঙ্কস কোয়ার্টার, টেলারিং, ডাইনে বিবেকানন্দ হল, রাজকুমার পাঠাগার পার হয়ে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চৌহদ্দি। সেখানে এক দৌড় সমান মাঠ। ঊৎসব মাঠ। সেখানে আশৈশবের ধূলো ছড়ানো। লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে চলার সহজ দিনগুলো। একপাশে প্রাক্ প্রাথমিকের ঘর। উঁকি দিতাম। আমাদের থেকেও ছোট ছোট ছেলেগুলো একরাশ পুতুল সাজানো ঘরে। কখনও ঘুমোনোর ক্লাসও করত। চোখ পিটপিট করে ফাঁকিও দিত। যেমন আমরা ধ্যানের ক্লাস ফাঁকি দিতাম। কেউ কেউ ঢুলেও পড়ত।

আশ্রম আর বাহির। দুটো শব্দ কে যেন দেগে দিল। কালো বোর্ড থেকে মনের ভেতর, সবখানে। একটা বড় সংখ্যার অনাথ শিশুদের আশ্রয়, আমাদের স্কুল, সেটা বোধের ভেতর আসতে সময় লেগেছে। কেন স্কুলের নাম ‘বালকাশ্রম’, সেই সময় অনুধাবনের ক্ষমতা ছিলনা। ক্লাস মনিটর যখনই দুষ্ট ছেলেদের শাসন করেছে, বা কোন খেলাধূলা বা প্রতিযোগিতায় অংশ নেবার সময় হয়েছে, আশ্রম আর বাহির দুটো দল তৈরি হয়ে গেছে। অবচেতনেই আমাদের মনে গেঁথে গেল, আমরা বাহিরের ছেলে আর যারা আশ্রমে থাকে তারা ঘরের ছেলে। ওই বয়সেই আশ্রমের ছেলেদের দৃশ্যতঃ তফাত চোখে পড়ত। পোশাক পরিচ্ছেদ, বইখাতা, পেন্সিল সব কিছুই যেন স্বতন্ত্র। অনেক পরে বুঝেছি আমরা স্কুলের জন্য তৈরি হতাম মায়ের আদরে। ওদের স্কুলে আসার পিছনে সেই যত্নমাখা স্নেহময়ীর হাত থাকত না।

প্রথম স্কুল, প্রথম দিন ব্যক্তি মননে ছাপ রেখে যায়। যদিও বালকাশ্রমের আগে আমার আরেকটি স্কুলের অভিজ্ঞতা ছিল। সে গল্পও অতি চমৎকার। যথা সময় সেই ঝুলি খোলা হবে। রামকৃষ্ণ মিশন বালকাশ্রমের প্রথম দিন, মহারাজ অমরশঙ্করের ঘরে। এক অদ্ভুত দর্শন ঘড়ি। দেয়াল জুড়ে একটি শিশুর মুখ। ঘড়ির কাঁটার সাথে তার চোখ নড়ে, সম্ভবতঃ জিভ নড়ে। সৌম্য দর্শন মহারাজ। প্রথম এমন পোশাক পরা কোন সন্ন্যাসীর সাথে আলাপ হল। আমাদের প্রধান শিক্ষক। তাঁর কক্ষটিতে ছড়িয়ে রয়েছে অনেকগুলি স্বামীজীর ছবি। আজও মনে পড়ে, জিজ্ঞেস করেছিলেন, কতগুলো স্বমীজীর ছবি? গুণে বলেছি, কয়েকটি হয়তো বাদ গিয়েছিল, এখন আর মনে নেই। স্থান হল দ্বিতীয় শ্রেণীর খ বিভাগে। দোতলায় উঠে, লম্বা বারান্দা হয়ে শেষ দিকে। প্রথম ঘরটি ক-বিভাগ, দ্বিতীয়টি খ-বিভাগ। সেদিন ভাস্করও ভর্তি হল। ও বসল গ-বিভাগে। ক্লাস তখন শুরু হয়ে গেছিল। আমি নাকি দেবাশিসের পাশে গিয়ে বসেছিলাম।

সেই সময়কার কয়েকজন শিক্ষককে আজও মনে পড়ে। বিনয় স্যার। খালি পায়ে আসতেন। বয়স্ক, ময়লা সাদামাটা ধুতি পাঞ্জাবী। বোর্ড মোছার জন্য, বোধহয় ডাস্টারের শুধু কাপড় ব্যবহার করতেন। বাংলা পড়াতেন। কি পড়িয়েছিলেন মনে নেই। তবে তাঁর মলিন চেহারার নিরাভরণ বিমর্ষ রূপটি কেন জানিনা চিরস্থায়ী হয়ে রইল। আরেকজন বয়স্ক শিক্ষক ছিলেন, বন্ধুস্যার। নাম জানিনা, এই নামেই পরিচিত ছিলেন। তবে বন্ধুত্বের কোন লেশ উপলব্ধি করতে পারিনি। কোন এক অজগর সাপের, আর ডাইনি বুড়ির ঘরে আটকে রাখার ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর অনুশাসনের ভয় দেখাতেন। মাটির কাজের ক্লাস নিয়েছেন। আর প্রার্থনার সময়, কে কে চোখ খুলে রেখেছে, নিজে চোখখুলে সেই নিয়মভাঙা ছেলেদের পাহারা দিতেন।

রামু আর মলয় দুইজন আশ্রম বালকের সাথে ঘনিষ্ঠতা হয়। রামুর গালে একটা বড় পোড়া দাগ ছিল। খুব ছোটবেলার কোন ভয়ঙ্কর দিনের স্মৃতি চিহ্নরূপে। অনেকে ওকে মুখপোড়াও বলত। আমার শুনতে ভালো লাগত না। ও তো ইচ্ছে করে পোড়ায়নি। আশ্রমের ছেলেরা আমাদের চেয়ে অনেক স্বাবলম্বী। বাবা মা ছাড়া একা একা সব করে। প্রতিদিন স্কুলে আসার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে, পড়া তৈরি করে, বিছানা গোছায় আরো কত কি? গরমের সময় মলয় ছোট ছোট আমের কুশি নিয়ে আসত। আর পিছনের বেঞ্চে বসে ব্লেড দিয়ে সেই আম ছোলা হত। ওদের সাথে নুনও থাকত। সেই নুন সহযোগে কষটে আমের স্বাদ স্বর্গীয় অনুভূতি এনে দিত।

নিম্ন বুনিয়াদী বিদ্যালয়ে এক লহমায় যিনি মন জিতে নিয়েছিলেন, তিনি দিন্দা স্যার। এই নামেই পরিচিত ছিলেন, প্রথম নামটি জানা হয়নি। তাঁর গল্পের ক্লাসে মোহ মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। কপালকুন্ডলা গল্পে, সেই যখন নবকুমার কে ফেলে রেখে, নৌকা চলে গেল। নবকুমার হাঁটু জলে দৌড়ে গিয়ে চিৎকার করে, “মাঝি নৌকা ভিড়াও”, কেউ সাড়া দেয় না। দিন্দা স্যারের সেই ডাক আজও মনের ভেতর ডুবে রয়েছে। ছেলেবেলায় প্রথম বঙ্কিম পড়ার নেশায বীজ খুব সন্তর্পনে বপন করে দিয়েছিলেন। পরে দিন্দা স্যারকে স্কুলের নানা নাটক যাত্রায় অভিনয় করতে দেখেছি। মনে মনে তাঁকে দেখার একটা আলাদা আকাঙ্খা তৈরি হয়েছিল।

অঙ্ক করাতেন শ্রীধর স্যার। এছাড়া পরের ক্লাসে বৈদ্যনাথ স্যার, বা বৃত্তি ক্লাসে গাঙ্গুলি স্যারের কাছেও অঙ্ক করেছি। বৈদ্যনাথ স্যারের কাছে তৃতীয় শ্রেণীতে অঙ্ক করলাম। সে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। আঙুলের ফাঁকে পেন্সিল ঘোরানো, ঝুলপি ধরে উল্টোদিকে টান আর মাটিতে বসিয়ে রাখার শাস্তি। আর সেই অমোঘ বাণী, “খেয়ে পারো, না খেয়ে পারো, ঘুমিয়ে পারো, না ঘুমিয়ে পারো, আমার পড়া চাই”। শুরু হল স্কুলের সাথে নানাবিধ ভয়ের অনুসঙ্গ।

আরও একটি ভয় সেই নয় বৎসরের শিশু মনে গেঁথে গেল। একেবার অন্যরকম ভয়। শিক্ষকের নাম করতে চাই না, কারণ তিনি শিক্ষক। ভয়ে হোক বা ভক্তিতে তাঁর পড়ানো বিষয়ে হঠাৎ করেই ভালো নম্বর পেতে শুরু করি। তিনি মাঝে মাঝে বাড়িতেও আসতেন। নিয়মিত গৃহশিক্ষকরূপে নয়, তবে আসতেন। মনে আছে, ছাদে মাদুর পেতে বসে আছি। নানা কথায় আমার প্যান্টের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিতেন আর বলতেন, “তাড়াতাড়ি বড় হয়ে ওঠ, আমরা বন্ধু হয়ে যাবো”। কেমন লজ্জায় ভয়ে ঘেণ্ণায় সিঁটিয়ে যেতাম। সেই সময় কাউকে বলতে পারিনি। অনেক পরে অন্য বন্ধুদের কাছ থেকেও এক অভিজ্ঞতার কথা জানতে পেরেছি।

ক্রমে স্কুলজীবন এক ভয়জীবনে পরিণত হল। প্রায় প্রতিটি শিক্ষক নিজের নিজের মত করে ভীতিপ্রদ। ক্লাসে বহু স্যারই, চক ডাস্টারের সাথে বেত নিয়ে আসতেন। নিয়মানুবর্তিতা শেখাতে গিয়ে কত যে বেতের বাড়ি, কিল চড়, ঘুঁষি আসেপাশে পড়ছে তার লেখাজোকা নেই। নিজের গায়ে না পড়লেও, সেই শব্দে কাঁটা হয়ে থাকতাম সর্বদা। কি জানি, কোন পান থেকে চুন খসে পড়ল?

ছবি আঁকার ক্লাস নিতেন কবিদত্ত স্যার। স্কুল ছেড়ে আসার অনেক পর তাঁর সাথে অন্য ভাবে আলাপ হয়েছিল, একবার বাড়িতেও গেছিলাম। সারা বাড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে তাঁর শিল্পকীর্তি, আমায় অবাক করেছিল। তবে একটু খ্যাপাটে স্যারটি যেন স্কুলের চৌহদ্দিতে বড় বেমানান ছিলেন। তবে মুগ্ধ হতাম ওনার ছবি আঁকার নৈপুণ্য দেখে। কত অনায়াসে বোর্ড জুড়ে ক্লাস ওয়ার্ক দিতেন। তখন রাস্তার দেওয়াল জুড়ে নানা রকম রাজনৈতিক পোস্টার আঁকা হত। এখনকার মতো ফ্লেক্স নির্ভর ছিলনা। স্টেশন সংলগ্ন একটা দেওয়াল জোড়া বড় ছবি ছিল। একদিন আবিস্কার করলাম আমাদের কবিদত্ত স্যার সেই পোস্টারটি আঁকছেন। খুব উৎকৃষ্ট শিল্পসৃষ্টি হয়তো ছিল না, তবে সেই দিনের পর থেকে স্যার সম্বন্ধে একটু খারাপ ধারনা তৈরি হয়ে গেল। এ বাবা! আমাদের স্যার রাজনৈতিক ছবি আঁকেন? পরে বুঝেছি, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত বিশ্বাসের জায়গা। স্কুল-শিক্ষকের গন্ডীর বাইরের একটা পরিচিতি।

এমনি করে নানা মানুষ নানা ভাবে ছাপ ফেলে যেতে লাগলেন, আমাদের জীবনে। নীলমণি স্যার, প্রণয় স্যার, পাল স্যার। গানের স্যার ছিলেন দুজন। অত্যন্ত সুন্দর ভাষায় আমাদের রচনা লিখিয়ে মুখস্থ করাতেন নীলমণি স্যার। বিশেষ করে সেই সময় মুখস্থ করা শরৎকালের কথা হয়তো আজও মগজের কুলুঙ্গীতে পাওয়া যাবে। তবে মজার ব্যাপার হল, কিছুদিন পর, আবিস্কার করলাম যে, ওনার ওই লেখাগুলো উঁচুক্লাসের একটা বই থেকে হুবহু অনুকরণ করা। যে স্যারকে তাঁর জ্ঞান আর ভাষার পরিধির জন্য একটা বিশেষ আসনে বসিয়েছিলাম, খুব সহজেই তিনি হয়ে গেলেন অত্যন্ত সাধারন।

তৃতীয় শেণীর ক্লাস হত, একটা টিনের শেড ওয়ালা টানা বারান্দার বাড়িতে। বৃষ্টির সময়, টিনের চালে এক অলৌকিক শব্দ হত। আজও সেই ঝমঝম শব্দ কানে লেগে আছে। তার এক পাশে ছিল পাল স্যারের ঘর। রোগা শ্যাম বর্ণ মানুষটি কি পড়াতেন মনে নেই, তবে ক্লাসে আসতেন বোগনভেলিয়ার কাঁটাযুক্ত ডাল ভেঙে। এই বোগনভেলিয়া গাছটি ছিল বারান্দার সিঁড়ির পাশে। টিফিনের সময়, দেবাশিসের সাথে এই গাছের নিচে বসে টিফিন খেতাম। একবার মনে আছে, দেবাশিস ওর পায়ে স্কেলের দাগ দেখায়। বাড়িতে বাবার কাছে মার খাওয়ার অভিজ্ঞতা শোনায়। সময়টা কেমন অদ্ভুত ছিল। স্কুলে, বাড়িতে মার খেতে খেতে আমরা মানুষ হবার চেষ্টা করতাম। পরিণতি কতটা ফলপ্রসু হয়েছে, কে জানে? এই তৃতীয় শ্রেণীতে আরেকটি বন্ধুর কথা মনে পড়ে, নাম কৃষ্ণগোপাল। ভালো অঙ্ক করতে পারত। কিন্তু অনেকদিন স্কুলে আসতে পারত না, অসুস্থতার জন্য। ক্রমে পিছিয়ে পড়তে লাগল। বহু অঙ্ক করা বাকি থেকে গেল। ওর কি হয়েছিল বুঝতাম না। একবার এলো, অনেক মোটা আর ফ্যাকাশে হয়ে। তারপর আর এল না। একদিন হঠাৎ স্কুল ছুটি হয়ে গেল, কৃষ্ণ নাকি আর নেই। খুব খারাপ লেগেছে। বেঞ্চে আমার পাশেই বসতো। এখন ফাঁকা হয়ে গেল।

প্রণয় স্যার আমায় নাম দিয়েছিলেন মাংসরুটি। কেন জানিনা, হয়তো টিফিনে মাংস রুটি নিয়ে যাবার জন্য। যদিও সে সুযোগ তখন ছিলনা। বাড়িতে আশ্রিত আত্মীয় নিয়ে অনেক ভীড়, তাদের সামলে মানির পক্ষে রুটি তরকারির বেশি কিছু দেবার সম্ভবনা ক্ষীণ। সব বিভাগের ভালো ছেলেদের নিয়ে একটা আলাদা বিভাগ তৈরি হয়, বৃত্তি পরীক্ষার জন্য। কিভাবে আমি সেই বিভাগে বসার সুযোগ পেয়ে গেলাম। অনেকগুলো নতুন বন্ধুদের সাথে আলাপ হল। পরবর্তিকালে বুঝেছি, এই বন্ধুরা ছিল স্কুলের প্রথম সারির ছাত্র।

স্কুল প্রাঙ্গনে ছিল একটা বড় সিমেন্ট নির্মিত স্লীপ আর লোহার বড় ঘূর্ণী। ক্লাসের ফাঁকে সেই দুটি খেলার অবলম্বন নিয়ে আমাদের হুড়োহুড়ির শেষ ছিলনা। সিমেন্টের স্লীপ চড়ে চড়ে বহু ছেলেদের প্যান্টের পিছনে ফেঁসে গিয়েছিল। আমারও হয়েছিল। তবে সেটা যখন বুঝলাম, তখন থেকে আর চড়তাম না। এক বছরের মধ্যে বারবার বাবার পক্ষে প্যান্টের যোগান দেওয়া সম্ভব ছিলনা। মানি ওই প্যান্টটাই রিফু করে দিয়েছিলেন, সেই বছরটা মেরামত করা প্যান্ট পরেই চালাতে হয়েছিল।

বৃহস্পতিবার, ১৪ জুলাই, ২০১৬

দেরাজের ঘ্রাণ


আজ পুরোণ দেরাজ খুলে বসেছে গোবি। অনেকদিনকার না-ছোঁয়া কাগজপত্র ঘেঁটে দেখতে, মাঝে মাঝে মন্দ লাগে না। কেমন অন্য কারো গোপন তথ্যের মতো মনে হয়। এসব কাগজ তার নিজের সাথে সম্পর্কিত, আজ ভাবতেও কেমন লাগে। ছোট ছোট চিরকুট, বেশিরভাগ বাজারের ফর্দ। বাড়ির বাজার, আসেপাশের মানুষের চাহিদা। সময় অসময় গোবি ছাড়া তাদের আর কেইবা আছে? “গোবি একটু বাজারে যাবি বাবা?”, “গোবি ফাঁকা আছিস? একটু লন্ড্রিতে যেতে হত, শাড়িটা পালিশ করতে দেওয়া ছিল”। “গোবি দৌড়ে যা তো, নুন ফুরিয়ে গেছে”। এমন সব নানা অনুরোধ, উপরোধ, আদেশ। গোবির ভালোই লাগে। কত মানুষের কাজে আসছে, এটাও তো একটা কাজ, ব্রত বা সমাজসেবা, সে যাই নাম দেওয়া যাক।

চারিদিকে টুকরো কাগজ ছড়িয়ে তার মাঝখানে বসে ছিল। খুব হাবভাব, যেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত। আসলে সে সব কিছু নয়, পুরোণ সময়কে একটু ধরতে, হাতে নিয়ে নাড়তে চাড়তে ভালো লাগে। এই চিরকুট লেখকদের মধ্যে কয়েকজন মানুষ আছেন, যারা আর পৃথিবীতেই নেই। যেমন বোস বাড়ির রতন কাকা। গত বছর শীতে চলে গেলেন। আছেন বিন্দির ঠাকুমা। ফর্দতে বড়ি, কাসুন্দী, কালোজিরে আর হিঙ আনতে দিয়েছিলেন।

রতন কাকাদের বড় এজমালি বাড়ি। পুকুর বাগান। একসময় অনেক আয়-যায় ছিল। এখন লোকজন নেই। থাকার মধ্যে রতন কাকা, তার বিধবা দিদি, আর বাড়ির পুরোণ চাকর বংশী। সেদিন সকালে গোবি গিয়েছিল ওদের বাড়িতে খবরের কাগজ পড়তে। এমনি কোন মতে দিন গুজরান হয়, তবে তিনটে খবরের কাগজ রাখে। পাঁচিল ঘেরা চৌহদ্দি। জায়গায় জায়গায় ধসে গেছে। প্রায় দেড়শো বছরের তিন মহলা বাড়ি। বার দালান পেরিয়ে ভেতরে অন্দরমহল। বাড়ির বাইরে একটা পুকুর, আবার খিড়কী দুয়োরে আরেকটা। পিছনেরটা মূলতঃ বৌ-ঝিদের জন্য। চারিদিকে বড় বড় গাছের ছায়া। পুকুরের ঘাটে আবার একটা পাথরে নাম লেখা, পম্পা। রতনকাকা কে একবার গোবি জিগেস করেছিল, পম্পা কার নাম কাকা। কাকা হেসে জবাব দেন, “কোন মানুষের নাম নয়রে, পম্পা ওই পুকুরটার নাম। স্বর্গের পুকুরের নামও পম্পা”। গোবি ঘাড় নাড়ে, ভাবে তাহলে বাইরের পুকুরেরও একটা নাম হবে। জিজ্ঞেস করলে, রতন কাকা উত্তর করেন, “ওটা পুকুর নাকি? ওটাতে পাট জাঁক দেওয়া হত। এখন তো সে সব নেই, তাই ওভাবেই পড়ে আছে”। তবে শুধু শুধু ফেলে রাখার মানুষ নন, রতন কাকা। পুকুরে মাছ চাষ করান। সনাতন জেলে কে লিজ দেওয়া আছে। সনাতন নিজের নিয়মে আসে ভোর ভোর মাছেদের চারা ছেড়ে যায়। সপ্তায় একদিন করে পুকুরে নাড়াচাড়া দিয়ে দেখে, মাছেরা বাড়ছে কেমন। তারপর সময় হলে লোকলস্কর এনে জাল ফেলে মাছ তোলে। সে বাবাদ রতনকাকাদের প্রাপ্য টাকা আর কিছু মাছ ভেট করে যায়। সেদিন এমনি ছিল। গোবি ভেতর দালানে খবরের কাগজে মুখ গুঁজে আছে, একটা বেড়াল পায়ের কাছে চিৎপাত হয়ে ঘুমাচ্ছে। বুড়ি পিসি রান্না ঘরের পাট চুকিয়ে নিজের ঘরের ভেতর সেঁধিয়ে গেছে। বংশীকেও কাছে পিঠে দেখা যাচ্ছেনা। এত বড় বাড়ির বেশিভাগ ঘরেই তালা দেওয়া। এক ফালি রোদ এসে উঠানে এসে পড়েছে। যেন কোথাও আর যাওয়ার নেই। এখানে এসেই সময় স্থির হয়ে গিয়েছে। এবাড়িতে ঢোকার সময় দেখেছে পুকুর ধারে, মাদার গাছের নিচে একটা মোড়া পেতে রতন কাকা সনাতনের কাজ তদারক করছে। আজ সনাতন বোধহয় কিছু চারা ছেড়েছে। পুকুরে নেমে জলের মেরামত করতে গিয়ে পাকা জেলেরা এক আধটা মাছ ধরে নিজেদের গামছা বা কোমরের গেঁজে লুকিয়ে ফেলে। বিরাট কিছু নয়, ও সব নিয়ে কেউ তেমন ভাবে না। তবে রতন কাকা শুদ্ধাচারী মানুষ, চরিত্রের গোলমাল সহ্য করতে পারেন না। গোবি হঠাৎ শোনে বাইরে থেকে তার নাম ধরে রতনকাকা চিৎকার করে ডাকছে। আওয়াজ শুনে বেড়ালটা ধড়মড় করে উঠে পালাল। গোবি কাগজ ফেলে দৌড়ে বাইরে আসে। দেখে সনাতন হাত জোর করে কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আর রতন কাকা ডান হাতের আঙুল তুলে কি সব দেখাচ্ছে। বংশীও হাতের

কাজ রেখে ছুটে এসেছে। গোবি পৌঁছাতেই, রতন কাকা বলে উঠল,
- গোবি তুমি এখুনি পুলিশে খবর দাও, বংশী তুমি এখনি ওর হাত থেকে জাল কেড়ে নাও।
- কেন কি হয়েছে?
- কি হয়েছে? দেখ দেখ আমার সমস্ত মাছ চুরি করে নিয়েছে

গোবি তাকিয়ে দেখে, তিন চারটে বিঘৎ মাপের রুইমাছের বাচ্চা সনাতনের পায়ের কাছে পড়ে আছে। সনাতন হাত জোড় করে বলছে, “বাবু দুশোগ্রাম ওজনও হবে না”।
- ওজনের প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে? আমি কি বাজারের মাছওয়ালা? গোবি, বংশী ওকে এই মাদার গাছের সাথে বাঁধো।

গোবি আতান্তরে পরে। সনাতনের দশাসই নৌকা টানা শরীর, ওর সাথে পারবে কি করে? শেষে, রতন কাকার কথা মানতে গিয়ে নিজের হাড়গোড় ভাঙে আর কি? গোবিকে এগোতে না দেখে, রতনকাকা আরো রেগে যায়,
- এরা কেমন পেয়ে বসেছে, দিনে দুপুরে ডাকাতি? আমি তাই ভাবি প্রতিবার এত মাছ ছাড়া হয়, সব যায় কোথায়? এখন বোঝা যাচ্ছে, এই মালই সব হাতিয়ে নিয়েছে। কি ধরিবাজ! বাপরে!
সনাতন মিন মিন করে কিছু বলার চেষ্টা করে, রতনকাকা সেসব কানেই তুলল না। শেষমেষ জালটাল ফেলে সনাতন হঠাৎ করেই দৌড় মারে। জানে কদিন পর রতনকাকা এমনি ঠান্ডা হয়ে যাবে। তখন, হয়তো নিজে রতনের বাড়িতে জাল পৌঁছে দিয়ে আসবে।

রতনকাকার চিরকুটে লেখা ছিল, পাঁচ কিলো সরষের খোল, দুইগোছ বাংলাপাতা পান, একশো গ্রাম সুপুরী আর আড়াইশো বাতাসা।  মানুষটা চলে গেছে, তবু তার হাতে লেখা সামান্য কটা অক্ষর গোবি যত্ন করে তুলে রাখে। বন্ধ দেরাজের ঘ্রাণ একমুহুর্তে তাকে নিয়ে যায় কোন এক অপার্থিব আবহাওয়ায়।

মঙ্গলবার, ১২ জুলাই, ২০১৬

পথকথা-৭

মোর্তাজা সাহেব সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে স্থির হয়ে বসে। প্রত্যেকের শুভ্র পোশাক, গোছানো দাড়ি, মাথায় সুদৃশ তাজ। প্লেন নড়তে আরম্ভ করলে হাত জড়ো করে দুচার ছত্র আয়াৎ কবুল করিয়ে নেয়। হাজার মাইল আকাশ পথে পারি, কতরকম বিপদ আপদ হতে পারে। মুর্শেদ ছাড়া কার ওপরইবা এমন অখন্ড ভরসা রাখা যায়? কিন্তু একটু আধটু নড়ে উড়োজাহাজ আবার স্থির হয়ে গেল। কাপ্তেন সাহেব ঘোষনা করলেন, জমি-কর্মচারীর বিশেষ সাহায্য লাগবে। তাদের কাছে সাহায্য চাওয়া হয়েছে। আশা করা যায়, আগামী পনেরো মিনিটে সাহায্য এসে পৌঁছবে, তারপর ছাড়বে। সকলে বেশ আবার একটু ঢিলা হয়ে বসে। এমনি করে পনের মিনিট, তিরিশ মিনিট, এক ঘন্টা পার হয়ে গেল অবস্থার কোন পরিবর্তন হল না। সকলে উশখুশ করছে। আর কোন ঘোষনাও নেই। বিমান সেবিকাদেরও আর ধারে কাছে দেখা যাচ্ছে না। মোর্তাজা সাহেবের পাশের সিটগুলো ফাঁকা ছিল। তিনি সেইগুলো জুড়ে শুয়ে পড়লেন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে মৃদু মৃদু নাসিকাধ্বনি জানান দিল, তাঁর নিদ্রা অবতীর্ণ। তা হবে নাই বা কেন? রাত তো কম হল না। এই আন্তর্জাতিক উড়ানগুলো রাত করেই ছাড়ে। আজ তো আরো দেরী করছে, ওদিকে পরের বিমান ছুটে না যায়। বিসমিল্লা বলে হজের পথে পাড়ি দিয়েছেন। দলের অন্য সদস্যরা নতুন। শুধু তাই নয়, বাকিরা এই প্রথমবার বিমানে চড়ছেন। মোর্তাজা সাহেব আগে একবার ঘুরে এসেছেন। তাই প্রত্যাশিত ভাবে তিনিই এই দলের নায়ক। প্রায় আরো আধ ঘন্টা কাটল। হঠাৎ মোর্তাজা সাহেব ধরমড় করে উঠে বসলেন, হয়তো স্বপ্ন টপ্ন কিছু। জেগে উঠে দেখেন, গাড়ি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। এবারে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তার কারণ স্বাভাবিক, ওদিকে দুবাই থেকে সৌদি যাবার নির্দিষ্ট প্লেন ছেড়ে যাবে। শুনে বাকিরা অত্যন্ত দুশ্চিন্তায় পড়েন। তবে কি হবে? মোর্তাজা সাহেব আশ্বস্ত করেন, বিমান কোম্পানি পরের ফ্লাইটের ব্যবস্থা করে দেবে, চিন্তার কিছু নেই। নিজের সিটে উঠে বসে, সুন্দর মেহেদি করা দাড়ি আঁচড়িয়ে নিলেন। তারপর সাগরেদকে হুকুম করেন খানা লাগাতে। সাগরেদ এদিক ওদিক তাকায়, প্লেনে কি এমন ট্রেনের মতো নিয়ম আছে? যদি কোন গুনাহ হয়ে যায়। মোর্তাজা সাহেবের ক্ষুধা পেয়েছে, তাই তিনি খেতেই চান। আবশেষে টিফিন কৌটের ঢাকনা খোলা হল। উফ, অপরূপ বিরিয়ানির খোশবাই সারা উড়োজাহাজ ছড়িয়ে পড়ল। সাথে রেজালার হাল্কা আভিজত্য মাখা ঘ্রাণ। খাওয়ার মধ্যেই বাইরে ব্যস্ততা বোঝা যায়। প্লেনটিকে ঠেলে পিছনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। খুব বেশি নয়, হাত দশেক পিছোনোর পর, জমির গাড়িগুলো রানওয়ে ছেড়ে চলে গেল। এবার উড়োজাহাজ গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। নির্দিষ্ট সময়ের দু-ঘন্টা পর, প্রায় সাড়ে আটশো যাত্রীকে নিয়ে টুক করে আকাশে উঠে পড়ে। মোর্তাজা সাহেবের দল আরেকবার সমস্বরে বিসমিল্লাহ ই-রহমান ই-রহিম বলে দোয়া প্রার্থনা করে। নিচে পড়ে থাকে রাতের কলকাতা শহর, ঝপঝপ করে আলোগুলো ছোট হতে হতে মিলিয়ে যায়। মেঘেদের পেরিয়ে আরো ওপরে উঠে যায় ধাতব পাখি।   
 
একটা অপরিণত আলো ভাঙচুর হয়ে ছুঁয়ে যায়। কিছুতে বোঝা যায়না তার অস্তিত্বর অবয়ব কোথায়। চারিদিক কেমন সুসজ্জিত, বেশ লাগে! কেমন সুচারু পোশাক, পাটভাঙা স্যুট, মার্জিত নেকটাই! এসবের মধ্যেও একটা হেরে যাওয়া, ভয় পাওয়া অনুভব, যেখানে পা ফেলার অবলম্বন নেই। নেই মানে কখনওই যেন ছিলনা। এই যে এত আলো, এসব বানিয়ে তোলা আলেয়া। এত উচ্চকিত জগতে নিজের রঙের উদ্ভাস কতোটা এবং কোথায়? খুব সচেতন ভাবে ঠেলে দেওয়া মুহুর্ত, তারা সব কোথায় গেল? কখনও কাউকে জায়গা ছেড়ে দেওয়া হয়না। অধিকার করতে একটু লড়াই। যেমন সেকালের ক্রীতদাসেরা করেছে। মানুষে-মানুষে বা মানুষে-জানোয়ারে। কালের চলন বড় নির্মম। সেই ক্ষণগুলো অনায়াসে ঝুলি থেকে বার করে আনে। এই সময়ের গন্ডীতেও বকলেসের ঝুমঝুমি শোনা যায়। অলক্ষ্যে সেই বাজনা বাজে, দামী ডিজাইনার নেকটাইএর ভেতর, সোনার কাফলিংএর অন্দরে। এখানেও লড়াই চলতে থাকে। আর গ্যালারির অলিন্দ জুড়ে দর্শক বসে থাকে। প্রতিটা চাল মেপে নিচ্ছে। সরাসরি বাহবা না দিলেও, অতি সচতনতায় গুণে নিচ্ছে এগিয়ে বা পিছিয়ে যাওয়ার পরিমাপ। সেখানে আমি তুমির তুচ্ছতা ছাপিয়ে ওঠে, না-থাকা বা না-হয়ে ওঠার বোধ, যেখানে মাটির আলপনায় শুধু ঘাস নয়, থাকে রক্ত আর প্রতিহিংসার পান্ডুলিপি।



মার্থা ফিরছেন ছেলেমেয়েকে নিয়ে। দুবাইএ ওদের বাবা কাজ করেন। ভ্যাকেশান কাটাতে বাচ্চাদের সাথে কিছুদিন। ছুটির ছুটোছুটিতে ক্লান্তি আসে, বিশেষ করে ছুটি যখন ফুরিয়ে যায়। দুবাই থেকে ওয়াশিংটন ডিসি। লম্বা পথ। মধ্যে দুটি দুরন্ত শিশুকে নিয়ে মার্থা যে কি করে পৌঁছবে, সেই চিন্তাই সমানে ঘুরছে। ছেলেমেয়ে দুটির বয়স তিন থেকে পাঁচ। ছেলেটি বড়। দুজনের দৌরাত্মি এর মধ্যেই বিমানের এই অংশের যাত্রীরা টের পেয়ে গেছেন। খানিক পর পরই নানা বিষয় নিয়ে দুই ভাইবোনে খুনসুটি। দূর থেকে দেখে আনন্দ পেলেও, মার্থার যে কি যাচ্ছে, তা সেই-ই জানে। বিমান সেবিকারা ঘুরে ঘুরে নজরদারি করছেন, কার কি লাগবে। বাচ্চাদের খুশি করার জন্য নানা রকম পুতুলের সম্ভার এনে উপস্থিত। মার্থার ছেলে মেয়েরাও পেল। তবে সবাই যখন ঘুমোবার উদ্যোগ করছে, ওদের তখন চিল চিৎকার। লজ্জায় মাটিতে মিশে যাবা জোগাড়। মাথা ঠান্ডা রাখে। তিনটে পাশাপাশি সিটের, এপাশ ওপাশ কোন খালি সিটও নেই। বোঝাই যাচ্ছে পুরো গাড়ি ভরপুর। কোন রকমে বাচ্চাদের লম্বা করিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করে। এত অল্প পরিসরে কি আর শোয়া যায়! ওদের চেঁচামেচিতে এক বিমানসেবিকা চকোলেট নিয়ে আসে। মার্থা খুব নিরুপায় মুখ করে নেয় আর বলে, “আর দিও না। ওরা এতে আরো পেয়ে বসবে”। ক্লান্তি বড় বিষম দায়। হাজার চেঁচামেচিতেও এক সময় ঘুম ঠিক এসে যায়। দেখা গেল দুই বাচ্চাকে ধরে মার্থাও গভীর ঘুমে মগ্ন। এক সময় একজন বিমান সেবিকা এসে পরম যত্নে একটা চাদর দিয়ে ঢেকে দেয় তিনজন কে। ক্রমে আটলান্টিক পার হয়ে, উড়োজাহাজ ওয়াশিংটন পৌঁছয়। খুব বড় এয়ারপোর্ট তবে চেহারায় তেমন দম্ভ নেই। কেমন খালি খালি এক গ্রাম্য সরলতা নিয়ে দাঁড়িয়ে। মার্থা তখন মাল তোলার বেল্ট থেকে গুণে গুণে সাত সাতটা ঢাউস স্যুটকেস তুলছে। ছেলে মেয়েদুটি সারারাত কাটিয়ে আবার তরতাজা। আগের মতোই খুনসুটি চলে। একে সামলাতে গিয়ে অন্যজন ফস্কে যায়। কোনক্রমে সব কিছু গুছিয়ে যখন কাস্টমসের লাইনে দাঁড়ায়, দেখা গেল সারা পথ ছড়াতে ছড়াতে এসেছে, পুতুলের ছোট্ট ছোট্ট ঘর বাড়ি, কাপ ডিস, চামচ, ঘর গেরস্থালির নানা উপকরণ। সেই দেখে মায়ের মাথায় হাত। ট্রলির উপর সাতটা স্যুটকেস, তার ওপর দুটো বাচ্চাকে জড়ো করে, সে আবার চলল পিছন দিকে, একে একে সবকটি খেলনা কুড়িয়ে আনার জন্য। কষ্ট হলেও, এগুলে ফেলে যেতে একেবারেই মন চায়না। দুবাই থেকে ওদের বাবা শখ করে কিনে দিল। অন্ততঃ বাড়ি অবধি চলুক। এমনি করে সব কুড়িয়ে নিতে নিতেই দিন চলে যায়। কতক থাকে, কতক সঙ্গে চলে। সেও আবার কিছুদিন পর আপনা থেকেই পুরাণো হয়ে যায়। প্রয়োজনীয়তা হারায়। এমন একটা কিছু যে আদৌ ছিল, কারও আর মনেই পড়েনা। 

শুক্রবার, ১৭ জুন, ২০১৬

রাজকুমার

রাজকুমার বাজারে কুলির কাজ করে। চেহারা বেশ ধারালো। বোঝা যায় গায়ের রঙ কোন কালে ফর্সা ছিল, রোদজলে পুড়ে এখন তামাটে। নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রমের জন্য হাত পা পেশল এবং সুগঠিত। গোবিন রাজকুমার কে দেখে আর অবাক হয়। ভোর বেলা বাজারের ধার ঘেঁষে আলু বোঝাই লরি এসে দাঁড়ায়। বড় বড় আলুর বস্তা লরির ওপর থেকে নামিয়ে দেয়। রাজকুমার সেই আলু বোঝাই বস্তাগুলো অবলীলায় পিঠে নিয়ে নেয়। একটা ফাঁকা বস্তা চাদরের মতন মাথা থেকে পিঠের ওপর পাতা থাকে। তার ওপর অমন ভারি ভারি বস্তাগুলো চাপিয়ে, কেমন হেঁটে চলে যায়। একটু কুঁজো হয়ে, দুই হাত মাথার ওপর দিয়ে বস্তার দুই কোণা আঁকড়িয়ে ধরা। এটুকুই অবলম্বন। তারপর বাজারের ভেতরে বিভিন্ন দোকানদারদের কাছে গিয়ে নামিয়ে রাখে। রাজকুমারকে ভোরবেলা মাল টানা ছাড়া অন্য সময়ে বড় একটা দেখতে পায়না গোবিন। মনে মনে ভাবে, এ নিশ্চই কোন শাপগ্রস্ত সত্যিকারের রাজকুমার। খুব গোপনে ছদ্মবেশে এখানে রয়েছে। না হলে এমন চেহারা আর আভিজাত্য নিয়ে, সে কি করে এমন সামান্য কাজ করে! রাজকুমার কে সে বড় একটা কারো সাথে গল্পগাছা করতে দেখে না। একমনে নিজের কাজ করে যায়। এক বস্তার পর দুই বস্তা, দুই থেকে তিন, এমন চলতেই থাকে।

গোবিনের বেয়াড়া ইচ্ছা, এই রাজকুমারের বাড়ি যাবে। বা ওর রাজপ্রাসাদ দেখবে। একবার পুষ্পহাটিতে গিয়ে এমন একটা বড় প্রাসাদের মতো বাড়ি দেখেছিল। বাড়ির পাঁচিল জায়গায় জায়গায় ধসে গেছে। রঙ উঠে গিয়ে দাঁত বেরোন চেহারা। বেশ কয়েকটা বট অশথ্থের চারা এদিক ওদিক দিয়ে মাথা উঁচিয়ে রয়েছে। বাড়ির হাওদার মধ্যে এক বিশাল পুকুর। সেখানে একটা অল্প বয়সী মেয়ে বাসন মাজছিল। কে যেন বলেছিল, এদের পূর্বপুরুষ এই অঞ্চলের জমিদার ছিল। এখন অবস্থার বিপাকে পরে খাবি খাচ্ছে। শরিকি ভাগাভাগিতে বাড়ি মেরামত আর হয়না। যার কোথাও যাবার নেই, তারাই কোন মতে এই পোড়ো বাড়িতে ভুতের মতো টিঁকে আছে। গোবিন ভাবে, সে হিসেবে মেয়েটি রাজকুমারী। শাপগ্রস্ত হয়ে বাসন মেজে দিন গুজরান করছে। তেমনই দৃঢ় বিশ্বাস, বাজারের রাজকুমারেরও এমন কোন ইতিহাস আছে। কিন্তু রাজকুমারের সাথে আলাপ করার সুযোগ হয় না। সে কাজের বাইরে কারো সাথেই কথা বলেনা। হাসি ঠাট্টাও করেনা। কি করে যে কাছে ঘেঁষবে, বুঝে উঠতে পারে না।

সেদিন তেমন কাজ ছিল না, তাল ঠুকে রাজকুমারের পিছু নিল। একটু ভয় ভয় করছিল, যদি জানতে পেরে যায়! তবে রাজকুমারের একমনে রাস্তা চলা, তার কাজের মতোই। কোনদিকে তাকায় না। সোজা গড়গড়িয়ে হেঁটে যায়। এ রাস্তা সে রাস্তা পাড় হল। পথে জল ছিল, বাঁ ধারে পুকুর এল, ডান ধারে পুরোণ পোস্টাপিস, বাজার, স্কুল। এমন কতশত পথ ঘুরে শেষমেষ একটা পেল্লায় বাড়ির সামনে এসে থামল। সে বাড়ি যেমন মস্ত তার সদরও তেমন দশাসই। লোহার গেট পার হয়ে, ভেতরে বড় বড় গাছে ছাওয়া মোরাম বিছোনো রাস্তা। সেই নুড়ি পাড়িয়ে রাজকুমার গড়গড় করে ভেতর পানে হেঁটে চলে যায়। এই অবধি এসে, গোবিন থমকায়। এবার কি করবে? গেট দিয়ে, কি বলে ঢুকবে? একটু দূরে দাঁড়িয়ে সাতপাঁচ ভাবছিল, এমন সময় মাথায় পাগড়ি বাঁধা একটা লোক এল, হাতে তার তেল দিয়ে পাকানো একটা বাঁশের লাঠি। বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। “আপনাকে ভেতরে তলব করেছে”। গোবিন এবারে সত্যি ভয় পেয়ে গেল। তবে কি ধরা পরে গেল? আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে, “কে?” লোকটা জবাব দেয় না। ইঙ্গিতে সামনের দিকে দেখায়। গোবিন এবার মহা ফাঁপরে পড়ল। কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। একবার ভাবে, টেনে দৌড় লাগাবে কি না? তারপর মনে হয়, কোন দোষ তো করেনি, শুধুশুধু পালাতে যাবে কেন? একটু আড়ষ্ট হয়েই ভেতরে ঢুকলো। বাইরে থেকে যতটা মনে হয়েছিল, বাড়িটা তার চেয়েও বড়। বিশাল বাগান। বাঁ দিকে একটা টানা বারান্দা সহ দুচালার লম্বা বাড়ি। অনেকটা কাছারি বাড়ির আদল। বাগানের ডান দিকে বিরাট প্রাসাদ। বোধহয় দোতলা। তবে উচ্চতায় অনায়াসে এখনকার চারতলার সমান। বড় বড় থাম আর নক্সাকাটা জাফরি। বাড়ি পুরোণ তবে ভাঙাচোরা নয়। বোঝা যাচ্ছে নিয়মিত পরিচর্যা হয়। আর সোজা তাকালে চোখে পড়ে সতত প্রবহবান গঙ্গা। সুন্দর বাঁধানো ঘাট। বড় বড় গাছেরা ছায়া নিয়ে ঘিরে রেখেছে। গোবিনের মন ভরে গেল। ইচ্ছে করছিল ওই ঘাটে গিয়ে দু দন্ড বসে। এদিকে পাগড়ি পড়া লোকটা, ওকে নিয়ে ওই ঘাটের কাছেই নিয়ে এল। সেখানে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পড়ে এক বৃদ্ধ বসে আছেন। গোবিন কে রেখে সে আবার ফিরে গেল।

বৃদ্ধ গৌরবর্ণ। সাদা পোশাকে সৌম্যসুন্দর লাগছে। ইশারায় বসতে বলে। গোবিন মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে পরে।  বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করেন,
- বাড়ি কোথায়?
- ডিমপুকুর।
- তা এখানে কি মনে করে?
- মানে, এই বেড়াতে বেড়াতে চলে এসেছি।
- ও বাবা এটা বেড়ানোর জায়গা জানতুম না তো?
- বেড়ানোর কি জায়গা লাগে না কি? আমার যে রাস্তায় যেতে ভালো লাগে, সেখানেই বেড়ানো হয়।
- বাঃ বেড়ে বললে তো।

দুচার কথায়, গোবিনের আড় ভাঙতে থাকে। এবার নিজে থেকে জিজ্ঞেস করে,

- এটা কি আপনার বাড়ি?
- না না, এখানে আমি চাকরি করি।
- এটা কি অফিস নাকি?
- না অফিস নয়, তবে মহিলাদের পুনর্বাসন কেন্দ্র। আমি এর সম্পাদক।
- এটা রাজবাড়ি নয়?
- রাজবাড়ি? তুমি তাই ভেবেছো নাকি? তবে এটা এক ধনীব্যক্তির সম্পত্তি ছিল ঠিক। এখন হাত বদল হয়ে ট্রাস্টের হাতে। হোমটা ট্রাস্ট-ই চালায়।
- খুব সুন্দর জায়গাটা। একটু ঘুরে দেখতে পারি?
- যা ঘোরার তো ঘুরেই ফেলেছো। এদিকটাতেই আসাযাওয়া করা যায়, ওই বাড়ির দিকে নিষেধ আছে।
- কেন?
- কেন আবার বললাম না, মেয়েদের হোম। পুরুষ মানুষদের ঢুকতে দেওয়া হয়না। তাই তোমায় গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভেতরে নিয়ে এলাম। এতোগুলো মেয়ে এখানে থাকে, বুঝতেই পারছো। আমারও যাতায়াত ওই আপিস ঘর পর্যন্ত
- ও, আসলে আমি জানতাম না। তবে আমি একজন পুরুষ কে একটু আগে ঢুকতে দেখলাম।
কথাবর্তায় একটু সহজ হয় গোবিন। এবার মূল উদ্দেশ্যটা সিদ্ধ করতে চায়। যদি রাজকুমারের ব্যাপারটা জানতে পারে।
- তুমি রাজকুমারের কথা বলছ? ও তো হোমে রান্না করে।
- রান্না করে?
- হ্যাঁ, সকালের রান্নাটা মাসি করে দিয়ে চলে যায়। বিকেলেরটা ও করবে। আবার কখনও মাসি ছুটিছাটা নিলে, তখন দুবেলাই করে।
- ও এটা ওর বাড়ি নয়?
- তুমি রাজকুমারকে চেন?
- না তেমন ভাবে নয়, তবে বাজারে দেখেছি।
- বাড়ি যে ওর কোথায়, ও নিজেই জানে না। খুব ছোটবেলায় এক বন্যায় ভেসে যাওয়া দলে ওকে পাওয়া যায়। মা বাপের খোঁজ মেলেনি। ওই দলের দুয়েকটা মেয়ের সাথে এই হোমে আসে। সেই থেকে রয়ে গেছে। তবে মেয়েদের হোমে তো জায়গা হবে না। আমার সাথে থাকে। ট্রাস্টের খাতায় নাম তুলে দিয়েছি। মাইনে পায়, কাজ করে। কখনও মালি, কখনও রাধুনী, কখনও দারোয়ান, ইস্ত্রিওয়ালা, এই সব।

গোবিনের হিসেব গুলিয়ে গেল। রাজপ্রাসাদ যে কোথাও একটা রয়েছে, তার সম্ভাবনা রয়েই গেল। রাজকুমার কোন একদিন নিশ্চই তার হদিশ পেয়ে যাবে। তখন গোবিনেরও শান্তি হবে। ঘাটের সিঁড়িতে বসে অস্তগামী সূর্য্যের রংবাহার দেখতে থাকে। নদীর জল, সোনালী হয়ে ওঠে। স্রোত ক্রমান্বয়ে দৌড়ে চলেছে। সেই দৌড়ে সামিল সবাই। বাড়ি ঘর, এই হোমের সমস্ত মেয়েরা, এই বৃদ্ধ সম্পাদক সবাই। শুধু রাজকুমার একা। তার বাড়ি, ঘুম, রাজ্যপাট কোনটাই নেই।

বৃহস্পতিবার, ২ জুন, ২০১৬

শব্দ-গন্ধ

ডিমপুকুরে ভোর হতো কারাখানার ভোঁ-র সাথে। মানুষ ঘড়ি মিলিয়ে নিত। ওদিকে ফাঁড়িতেও একটা পেতলের পেটা ঘন্টা ঝোলানো। প্রতি ঘন্টায় একজন সেপাই গুণে গুণে হাতুড়ি মারত। অনেক দূর থেকে সেই ঘন্টা ধ্বনি ভেসে আসে। সকালের অপিসের ভাতের ঘ্রাণের সাথে জুড়ে থাকে ভোঁ-এর শব্দ। আর শীতের রাতে, আপাতঃ নিঝুম হওয়া পল্লীর বাতাসে রাত এগারোটা বা বারোটার লম্বা ঘন্টা ধ্বনি নীরবতাকেই যেন প্রলম্বিত করত। জুটমিলের ছিল বাড়বাড়ন্ত। তার শ্রমিক আর অফিসারদের ভিন্ন ভিন্ন আবাসন আর পল্লী। তাদের চরিত্র একেক রকম। ক্রমশঃ ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ল চট শিল্প। একের পর এক মিলগুলো তে তালা লাগল। দিশেহারা মানুষ কেউ কেউ ছোটখাটো দোকান দিল। মুদি বা সাইকেল সারানো। কেউ দেশে ফিরে গেল, যাদের ফেরার উপায় নেই তারা গলায় দড়িও দিল। অপরাধ বাড়তে থাকে। রাজনৈতিক নেতারা ডামাডোলের সুযোগ নিয়ে নেমে পড়ল ঘোলা জলে মাছ ধরতে।

গোবিনের এসব ছোটবেলার কথা। এখনও বেশ মনে পড়ে, দূর্গাপূজার চেয়ে বিশ্বকর্মায় জাঁক ছিল বেশি। প্রতিটি কারখানার গেট খুলে দেওয়া হতো। বড়দের হাত ধরে অপার বিষ্ময়ে সেই বিশাল বিশাল গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করত। কত রকম চোখ-স্থির হওয়া যন্ত্র। কনভেয়ার বেল্ট। স্পিনিং মিল। এক আধটা লোহা আর রাসায়নিক কারখানাও ছিল। তাদের বড় বড় হপার, সেখান থেকে লম্বা বেল্টের লাইন চলে গেছে এক শেড থেকে অন্য শেডে। এর মধ্যে কোথাও প্যান্ডেল খাটিয়ে বিশ্বকর্মার অধিষ্ঠান। দুই দিক দিয়ে হয়তো বড় বড় বুলডোজারের ধাতব হাত দিয়ে মালা ঝোলানো আছে। পাশাপাশি কোম্পানিতে রেষারেষি চলত, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিয়ে। কেউ টালিগঞ্জ থেকে শিল্পী নিয়ে এলেন তো অন্যজন ছুটলেন বম্বে। আর ছিল আকাশ ভরা ঘুড়ি। মন্ডপ সজ্জাতেও অনেক ঘুড়ি। সবকিছু ছাপিয়ে থাকত শ্রমজীবি মানুষের ঢল। যে যার সাধ্য মতো সাজায় নিজেকে, তারপর উৎসবের হাত ধরতে বাইরে আসে। সেখানে না আছে বিত্তের দম্ভ, না আছে প্রচুর্য্যের প্রতিযোগিতা। তাই, খুশি-ই এই উৎসব উদযাপনের প্রাথমিক শর্ত ।

সময় দাঁড়িয়ে থাকে না। সে চলতে থাকে তার নিজের তাগিদে। এক সময়কার এলাকা কাঁপানো মস্তান হঠাৎ করে বিয়ে করে আনল, এক শিক্ষিত সুন্দরী কে। তারপরে বদল ঘটল ধীরে ধীরে। এখন সে অটো চালায়, আর স্ত্রী স্কুলে পড়ান। পুরোণ কারখানার কঙ্কাল দাঁড়িয়ে থাকে পাশে তৈরি হয় নতুন উদ্যোগ। বিস্কুটের কারখানা, পাইপের কারখানা। সেখানে আবার নতুন করে শুরু হল কর্মযজ্ঞ। সকাল থেকে ঠিকা শ্রমিকদের লাইন পড়ে এই নতুন কারখানাগুলোর গেটে। একজন দুজন করে ফেরিওয়ালারা বসতে আরম্ভ করে। কেউ ছাতুর সরবত, কেউ চা, কেউ কচুরি, ডিম সেদ্ধ।

রাসায়নিক কারখানা থেকে মাঝে মাঝে ক্লোরিন গ্যাস বেরিয়ে আসত। তার উত্তেজক ঘ্রাণে নিঃশ্বাস নেওয়া ছিল ভারি মুশ্কিল। গাছের পাতাদের রাতারাতি হলুদ হয়ে মাটিতে ঝরে থাকতে দেখা গেছে। আসেপাশের জঙ্গল থেকে দিনের বেলাতেই শিয়ালরা বেরিয়ে এসে ডোবার জলে ডুবে রেহাই পেতে চাইছে। চিরশত্রু কুকুরদেরও এক দশা। তখন আর কেউ কাউকে তেড়ে যাচ্ছেনা। প্রাণের দায়ে একই সাথে ডোবার জলে। পরিবেশ বাঁচাতে মানুষ একত্রিত হয়েছে। আন্দোলন হয়, হৈচৈ, লেখালেখি। কয়েকদিন একটু ঠিক থাকে, তারপর আবার কোন একদিন টের পাওয়া যায় প্রবল গ্যাস ছেড়েছে। একদিন সেই কারখানা বন্ধ হয়ে গেল। বন্ধ কারখানার গেটে একটা ত্রিপল খাটিয়ে কিছু শ্রমিকরা অবস্থান ধর্মঘট করতেন। শুরু শুরুতে তাঁদের মাইক বাজত, দুয়েকজন ছোট বা মাঝারি নেতা এসে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। যাতায়াতের পথে রোজ দেখা হত। ওরা বসে আছেন, কখনও সময় কাটাতে তাস খেলছেন। ক্রমে সেই মঞ্চে বাতি দেবার লোক কমতে থাকে। ত্রিপল আর খুঁটিগুলোও কেউ কখন যেন খুলে নিয়ে গেছে, জানাও গেল না। আর সেই চাকরি হারানো মানুষগুলো কি করল? তাদের অন্নের কি ব্যবস্থা হল, তা কেউ জানল না। এখন আর সেই ক্লান্ত স্বপ্নহীন মুখগুলো মনেও পড়েনা। এক সময়ের সেই ত্রাস জাগানো কারখানাটিও হাড় পাঁজর বার করে জরাজীর্ণ অবস্থায়, এখন নেহাত ইতিহাস পাহারা দিচ্ছে। সেই গন্ধের স্মৃতি নিয়ে আর বসে নেই কেউ।

হাল আমলে, বিস্কুটের কারখানা থেকে নানা রকম সুখাদ্যের গন্ধ ভেসে আসে। পাশ দিয়ে যাবার সময় প্রত্যেকেই টের পায়। নতুন যারা এ পথে যায়, একটু অবাক হয়ে তাকায়। সেই গন্ধে কোথাও নিরন্ন মানুষের কথা লেখা থেকে যায়। গন্ধের পরিমাপে কারো গা গুলোয়, কেউবা আনন্দ পায়, কারো মন খারাপ হয়ে যায়। সময় এসে মানুষের হাত ধরে, কিছুটা পথ নিয়ে যায়। তারপর আবার অন্যকারো দিন শুরু হয়।

মঙ্গলবার, ২৪ মে, ২০১৬

রূপকথার পোষাক বদল

পাড়ায় আজকাল অনেকেই শপিং মলে যায় বাজার করতে। এলাকার বাজার তো আছেই, তবে মলের বাজারে মুদিখানার অনেক কিছু এক ছাদের তলায় পাওয়া যায়, যা পাড়ার দোকানে হয়তো দেখাই যায় না। যেমন নুডলের বিরাট প্যাক বা কর্নফ্লেক্সের এক বিশেষ মিশ্রন কিম্বা হিং-এর একটি পছন্দের ব্রান্ড। এমন কত কি! গোবির মলে আসতে খারাপ লাগে না। বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা। চারিদিকে সুবেশ মানুষজন। যদিও পাড়ার দোকান বাজারে বেশি স্বচ্ছন্দ। এখানে, বাজারের মত বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনা। তাও মাঝে মাঝে পাড়ার দাদা বৌদি বা মাসিমাদের ফরমাইসি কেনাকাটা করতে মলে চলে আসে। শপিংমলে দোকানদার বা সহ-ক্রেতাদের চালচলন আলাদা। এর মধ্যে একজন পাহারাদার কে দেখে গোবির মনে হল, কোথায় যেন দেখেছে। সবাই এক পোষাক পরে ঘুরে বেরায়, তাই আলাদা করে চিহ্নিত করা কঠিন। তবু খানিক চেনা লাগার ছুতোয় কাছাকাছি আসে। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে, “দাদা কি এখানকার?” মাথা থেকে টুপি খুলতেই লোকটির স্বরূপ বেরিয়ে পরে। এ বাবা! এ তো লোনামাটির লোক, তপন। গোবি একে ঢের চেনে, “আরে তুমি এখানে?” তপন বিড়ি খাওয়া কালো দাঁতগুলো বের করে হাসে। “এই এখন এখানে ডিউটি। তা তোমার বাড়ি এদিকে নাকি?” ব্যাস গোবি কে আর পায় কে? দোকান বাজারে একটা নিজস্ব লোক না থাকলে কি সুখ হয়? পাখনা নদীর ধার দিয়ে টানা ক্ষেত রয়েছে। সেই ক্ষেতের আল ধরে আর কিছুটা উত্তরে গেলে তপনদের বাড়ি। সেখানে তপনের বৌ, ছেলে, বুড়ো মা থাকে। গোবির মনে অনেক প্রশ্ন,

- তা তুমি এখানে রোজ আসো?
- এখন এখানে ডিউটি দিচ্ছে, আবার যখন বদলে দেবে চলে যাব। আমাদের এজেন্সির সাথে কন্টাক্ট।
- কতক্ষণ থাকতে হয়?
- তা বারো ঘন্টা তো হয়ই। নাইটও থাকে।
- ও বাবা তাহলে তো কষ্ট আছে। রাত জেগে থাকতে হয়?
- এখানে ঘুমোন যায় না। ছবি উঠে যায়। তখন কৈফেয়ত দিতে হয়। এই যে তোমার সাথে গল্প করছি তারও ছবি উঠছে।
- এ বাবা,মাটি করেছে। আমার জন্যে তুমি বকা খাবে নাকি?
- হওয়া উচিত নয়। তবে কাজ করি আমরা, আর ভুল ধরার অন্য লোক। তাই কি থেকে কিসের ভুল, সে তারাই বলতে পারে।
- তবে আমি যাই। পরে কথা হবে।
- বেশ যাও। আবার এসো।

তপনকে গোবি প্রথম আবিস্কার করেছিল মটরশুঁটির ক্ষেতে। মাথায় তালপাতার টোকা, খেটো করে লুঙ্গি পড়া, গায়ে একটা পুরাণ রঙচটা ফুলহাতা সোয়েটার। খুরপি হাতে একমনে জমি নিড়িয়ে যাচ্ছিল। আর খোলা গলায় গান গাইছিল। ওই দিকচক্রবাল পর্যন্ত ক্ষেত আর ক্ষেত। নানান রঙের সবুজে হলুদে মিশে আছে। দূরে দূরে আরও কেউ কেউ নিজের নিজের জমিতে কাজ করছে। দুয়েকটা দোয়েল ফিঙে উড়ে উড়ে ফড়িং ধরে খাচ্ছিল। আবার ছোট ছোট ঝোপের ভেতর কয়েকটা টুনটুনিতে নেচে বেড়াচ্ছে। সেই নির্লিপ্ত প্রশান্তির মাঝখানে তপনের গান কেমন মন কেমন করে দিচ্ছিল। “লোকে বলে বলেরে, ঘরবাড়ি ভালা নায় আমার...” এক আকাশ শূণ্যতায় ইতস্ততঃ পাখিদের ডাক আর “...কি ঘর বানাইমু আমি শূণ্যের মাঝার...”। গোবি তখন লোনামাটির পথে পাখনার পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে কখন জমিতে এসে পড়েছে। অবাক হয়ে শুনছিল গান। আলের ওপর বসে পড়ে। গান শেষ হয়, তপন আবার অন্য গানে যায়। যতক্ষণ ক্ষেতে রইল, প্রায় ততক্ষণই গান ঘিরে রইল। তপনকেই জিজ্ঞেস করে “তুমি গান শিখেছো কোথায়?” তপন হাসে, মাথা নাড়ায় “এই গান কে শেখায়? ওই আকাশের উপরে যে আছে, সে”। গোবি কতক বোঝে কতক বোঝেনা। এ তো শহুরে গানের ক্লাস না, যে সপ্তায় একদিন মাস্টামশাই বা দিদিমনি আসবেন। আর গান নিয়ে কিছু প্রশ্ন করেনা।

- এগুলো কি ফসল?
তপন হাসে, “আসো, খেয়ে দেখ”। এই বলে নিচু হয়ে কিছু শুঁটি ছিড়ে দেয়। গোবি তো অবাক! এইগুলো বাজারের তরকারিওয়ালার ঝুড়িতে দেখেছে। এমন আলাদা করে ক্ষেতে, এই প্রথম। যাকে যেখানে দেখে অভ্যস্থ, সেখানে না পেলে কেমন মন গুলিয়ে যায়। সেই থেকে তপনের সাথে গোবির সঙ্গত। এই শপিংমলের ঝাঁ চকচকে আবহাওয়াতে সেই মাথায় টোকা পড়া চাষীটিকে কোথায় পাবে? আর গান? কাজ করতে করতে যে সুরে ভরিয়ে রাখত, সেই বা কোথায় গেল। তাই চলে যাবার আগে, তপনের কাছে আবার যায়, জিজ্ঞেস করে,

- তুমি এখানে কি করে গান গাও?

তপন চোখ দিয়ে হাসে। বোধহয় কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না। ওদিকে চ্যানেল মিউজিক বেজে চলেছে। সেখানে মুম্বাই কাঁপানো সুরের দাপট। গান পুরো বোঝা না গেলেও দ্রিম দ্রিম তালের শব্দ পৌঁছে যাচ্ছে। তপন চট করে টুপিটা পড়ে নেয়। চোখের নিমেষে সেই তালপাতার টোকা মাথার অবয়ব হারিয়ে যায়। এই ইউনিফর্ম পড়া মানুষটি অন্য আর পাঁচটা পাহারাদারের মতোই। এক নির্দিষ্ট গেটে নির্দিষ্ট সময় ধরে ডিউটি। সেখানে খোলা মাঠের সুরের দুলুনি, যেন কোন তেপান্তরের ওপাশ থেকে ভেসে আসে। সেখানে স্বপ্নগাছ আছে আর তাকে ঘিরে রঙিন পালকদের ওড়াউড়ি। রূপকথারা ঘর বাঁধে ঝোপেঝাড়ের আবডালে।

সোমবার, ২৩ মে, ২০১৬

পথকথা-৬ (লোনামাটি)

ট্রেনে চেপে বেশ গুছিয়ে বসে গোবিন্দ। অনেক পথ যেতে হবে। এই ট্রেনটা মাঝারি পাল্লার। শহর পেরিয়ে প্রায় প্রতিটি স্টেশনেই থামে। গড়ন এক্সপ্রেস ট্রেনের মতোই। উপরে বাঙ্ক। সেখানেও মালপত্রের সাথে বহু মানুষ নিজেদের যত্ন করে গুঁজে নিয়েছে। শুধু শহরের মধ্যেকার স্টেশনগুলোতে থামে না। তাই যাত্রীরা মূলতঃ গ্রামীন মানুষ। তাদের বেশভুষা আচারন সবই স্বতন্ত্র এবং আন্তরিক। চোখের দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে কথা বলে, যেন কতদিনের পরিচিত। আজ বোধহয় ট্রেনটি একটু লেট চলছে। এইসব মানুষরা নিত্য এই গাড়িতেই যাতায়াত করেন। গাড়ির গতিবেগ দেখে বলে দিতে পারেন ড্রাইভারে বয়স বা অভিজ্ঞতার পরিমাপ। কিম্বা আজ ড্রাইভার সাহেবের তাড়া আছে কিনা। গোবিন্দ কোন আপিস করতে যাচ্ছেনা, তাই ট্রেনের দেরী হলেও কিছু যায় আসে না।

জানালার বাইরে চোখ চালিয়ে নিশ্চিন্তে থাকে। বাইরেটা যে এত মনোরম লাগে! কেমন মায়াবী সবুজে মোড়া। ছোট ছোট জনপদগুলো দ্রুত পার হয়ে যায়। দেখলেই কেন যেন মনে হয়, দু দিন এখানে থেকে গেলে হয়। তবে ট্রেনের ভিতরটিও অতীব রঙীন। একের পর এক নানান ফেরিওয়ালার মিছিল। পুরো পথটাকে কেমন ঘটমান করে রাখে। একজন গজাওয়ালা এলেন। এসেই বলেন, “আজ আপনাদের ধরতেই দেব না। কারণ ধরলেই ছ্যাঁকা লাগবে, এ এমন টাটকা। সদ্য কড়াই থেকে নামিয়ে আনা”। তার বাচন ভঙ্গী আর বলার ভাষাতে যাত্রীরা আমোদ পায়, বিক্রিও হয়। এক প্রৌঢ় হাত পাতে একটা নমুনা সংগ্রহের জন্য। বোঝা যায়, গজাওয়ালা খুব খুশি হয়নি। অনেক ফেরিওয়ালা নিজে থেকেই নমুনা বিতরণ করে। তারা আবার অপমানিত হয়, যদি কেউ নমুনা নিতে অস্বীকার করেন। গজাওয়ালা তেমন নয়। সে নেমে গেলে পরে, আরেক সহযাত্রী একটি গল্প বলতে শুরু করে। যেন গোবিন্দকেই শোনাচ্ছেন।

দুই বন্ধু ছিল। তাদের একজন পাশ-টাশ দিয়ে একটা চাকরি জুটিয়ে ফেলে। অন্য বন্ধুটি স্টেশনে একটি পানের দোকান দেয়। ছোট গুমটি আর কি! চাকুরে বন্ধু প্রতিদিন সকালে ট্রেন ধরতে স্টেশনে আসে, পানওয়ালা বন্ধুর সাথে একটু খোশগল্প করে, তারপর ট্রেন এলে চলে যায়। প্রতিদিনের আড্ডার মাঝে, সে একটি এলাচ চেয়ে নিয়ে খায়। এমন করে অনেকদিন যায়। সকালে আসে, গল্প করে, এলাচ মুখে নেয়, ট্রেন ধরে, চলে যায়। প্রায় বছর পাঁচেক পর কোন এক ঘটনা নিয়ে দুজনের মনোমালিণ্য ঘটে। তখন পানওয়ালা বন্ধুটি অন্যজনের কাছে কিছু টাকা ফেরত চায়। চাকুরে বন্ধুটি তো অবাক। সে চাকরি করে বলে প্রচ্ছন্ন গর্ব আছে। পানওয়ালা বন্ধুটির চেয়ে, তার আয় যায় বেশি। তারপরও পানওয়ালা উত্তমর্ণ্য, ভাবতেই পারে না। পানওয়ালা বন্ধু তখন হিসেবের খাতা নিয়ে বসে, গত পাঁচ বছরে চাকুরে বন্ধুটি প্রায় ১৩২৮টি এলাচ নিয়ে খেয়েছে। সব মিলিয়ে এলাচের গড়দাম অনুসারে ৫৩৭টাকা মতো পাওনা।

গল্পের শেষে সহযাত্রীটি সেই গজা-র নমুনা প্রার্থী প্রৌঢ়র দিকে ফিরে বলেন, “চেয়ে খাবেন না। কারণ যে দিচ্ছে, সে খুব যে খুশি মনে দিচ্ছে, তা নয়”। গোবিন্দর বেশ লাগে, কেমন সুন্দর ভাবে ভদ্রলোককে শিক্ষা দিলেন। এরমধ্যে আরো অনেক ফেরিওয়ালা ওঠেন, একজন বৃদ্ধদের আবার করে কবাডি খেলার ওষুধ বিক্রি করছেন। কত রকম চোরাগোপ্তা কথা, ঠাঁই পেতে হলে নিয়মিত রেলযাত্রা করতে হবে।  একজন তার পসরা বিক্রি করতে গিয়ে বলে ফেলেন, “আজ টাকাপয়সা কম থাকলে নেবেন না। কোন অসুবিধা নেই। পরে সময়মতো নিলেই হবে”। সম্ভবতঃ বদহজমের ওষুধ। এইসব ফেরিওয়ালারাও প্রতিনিয়তঃ তাদের মতো করে সৃষ্টিসুখে আছেন। নিতান্ত পেটের তাগিদ বলেই উপাচারের বাহুল্য নেই, উপস্থাপনা দৃঢ় এবং সরাসরি।

অবশেষে গন্তব্য, লোনামাটি পৌঁছায় গোবিন্দ। শহর ছাড়িয়ে তিন ঘন্টার দূরত্বে যে এমন জায়গা আছে, না এলে বোঝাই যায়না। একটা মোবাইলেও সিগনাল নেই। কি যে ভালো। একরত্তি নদীটা বয়ে চলে, কেউ এল, দু দন্ড পাশে বসল ওর বুঝি গায়েই লাগে না। বিকেলের আলো নৌকাকে টেনে নিয়ে যায়, অস্তমিত সূর্যের দিকে। বড় বড় উলুর ঝোপে হাঁসগুলো কি যেন খোঁজে আবার ছুটে এসে জলে ডুব দেয়। গোবিন্দ কাউকে না জানিয়ে মাঝে মাঝে এখানে চলে আসে। প্রথম প্রথম নতুন মানুষ দেখে, গ্রামের লোক জিজ্ঞেস করত, “কোন বাড়ি এসেছেন? কতদিন থাকবেন? কোথা থেকে আসছেন? কেন আসছেন? কি করেন?” ইত্যাদি নানা কথা। তা তো ঠিক। কে কোথা দিয়ে চলে আসে, কত রকম ফন্দি ফিকির নিয়ে। গোবিন্দ তেমন বলার মতো কিছু করেও না, যে গুছিয়ে বলবে। যদিও খুব ব্যস্ত থাকে, তবু কাউকে কি বলা যায়, যে সে বাজার করতে, ইলেক্ট্রিক বিল জমা দিতে বা ফেলে আসা জিনিস পৌঁছানোর কাজ করে। শহরে যেমন মানুষ আলগা আলগা, পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকছে, কে আসছে জানা থাকে না। গ্রামে ঠিক তেমনটা নয়। কার বাড়িতে কে এল, অন্যরাও খবর রাখে। শুরুতে গোবিন্দ এক খুড়তোতো দাদার পিসতুতো কাকা মাস্টারবাবুর নাম করে চলে এসেছিল। ওই ওদের পাড়াতে কোন এক সময় ভদ্রলোক নিমন্ত্রণ খেতে গিয়েছিলেন। তা ভুল করে সেই কাকার মেয়ে বাথরুমে কানের দুল ফেলে চলে আসে। পরে যখন খোঁজ মিলল, কে পৌঁছে দেবে? ব্যাস পাড়ায় এক অধটা কাঠ বেকার থাকার এই সুবিধে। সেই সুযোগে গোবিন্দও এই জায়গার খোঁজ পেয়ে গেল। এখন অবশ্য শুধু মাস্টারবাবুর কথা বলতে হয়না, এই গ্রামের সে অনেককেই চেনে।

এখানে আসতে ট্রেনে চাপতে হয়। তারপর বেশ কিছু বড় বড় জংশনে গাড়ি পাল্টে পাল্টে লোনামাটি স্টেশনে নামতে হয়। এই স্টেশনে এখনও প্ল্যাটফর্ম হয়নি। সিঁড়িওয়ালা ট্রেনই থামে। আজকাল অন্য গাড়িও থামে, তাতে ওঠা নামা বড্ড মুশ্কিল। গোবিন্দর এই স্টেশনের কাছাকাছি এলে মন ভালো হয়ে যায়। তড়াক করে লফিয়ে নামে। নিচে পাথরে খচমচ করে ওঠে। পুরো স্টেশন চত্বর কৃষ্ণচূড়ায় ঢাকা। এখন যদিও জৈষ্ঠ্য শুরু হয়ে গেছে, গাছেদের ফুলের বিরাম নেই। লাল ফুলের ফরাস পাতা যেন। ভজন পাল পিছন থেকে বলে, “ভাইপো, আমরা হাত একটু ধর। নিজে তো হুড়ুম দিয়ে নামলে, আমাদের বুড়ো হাড়। পারি নাকি?” ভজন পালের সাথে ট্রেনেই আলাপ রুমাল ফিরি করে। সকালের ট্রেনে শহরে গিয়ে এই বেলার গাড়িতে ফেরে। দিনের এক দুটো ট্রেনই আছে এই স্টেশনে দাঁড়ায়। মাস্টারবাবু কে কাকা বলাতে, গ্রামের মোটামুটি সব মাঝবয়সীদের কাছে গোবিন্দ গণ-ভাইপো হয়ে গেছে। লোনামাটি স্টেশন থেকে পায়ে হেঁটে একটা ছোট জঙ্গল পেরোতে হয়। আগে এই জঙ্গল ছিল ডাকাতদের আস্তানা। এখন অবশ্য ডাকাতরা গোয়ালা হয়ে গেছে। তারা মোষ পোষে। সাইকেলের দুপাশে দুধের ক্যান ঝুলিয়ে গ্রামে গ্রামে বিক্রি করে। জঙ্গলের মাঝে সেই ডাকাতে গোয়ালাদের ছোট বসত। সেইখানে পথে ওপর সার দিয়ে বড় বড় মোষরা বসে জাবর কাটে। তা ডিঙিয়ে আসে ছোট্ট নদী, নাম তার পাখনা। পাখনা পেরোতে নৌকা নেয় একটাকা। তারপর আসবে মাস্টারবাবুর গ্রাম। জঙ্গল লাগোয়া বলে পাখিদের ডাকে চতুর্দিক মেতে থাকে। যতবার গোবিন্দ আসে ওরা যেন ঠিক চিনে ফেলে। তাই তো এত ডাকাডাকি করে। কিন্তু গোবিন্দর আর পাখিদের চেনা হয়ে উঠল না। প্রতিবার এখান থেকে ফিরে ভাবে লাইব্রেরিতে খোঁজ নেবে পাখি নিয়ে কোন বই আছে কিনা। কিন্তু সে আর হয় না। অবশ্য না জানার মধ্যেও একটা আনন্দ আছে। সব কিছু তো চিনে ফেলতে নেই।

বৃহস্পতিবার, ১৯ মে, ২০১৬

রাস্তার দিক

রাস্তা যখন সোজা পড়ে থাকে, সামনে থেকে কালো গভীর পথ। এলোমেলো বৃষ্টি এসে সেই কালিমা আরও গাঢ় করে দেয়। আতান্তরে পড়ে খোলা মন। সেখানে বাতাস ঘুলঘুলির ঘুর পথে নিয়ে আসে চড়াইয়ের ঠোঁটে করে খড়কুটোর সন্দেশ। একটা খবরেই মনের আঙিনায় আলপনা দেয়, সে খবর খুব বিরাট কিছু, যে তা নয়। গোবিন্দ এই সব দেখে আর ভাবে, ঠাঁই পায় না। বাজারে দেখা হয় মান্তু দার সাথে। ভদ্রলোক এই কাছাকাছি কোথাও থাকেন, বাজারে সহ-ক্রেতা হিসেবেই তাকে দেখেছে, অন্য কোথাও যে মান্তুদার অস্তিত্ব আছে মনেও হয় না। যেন মান্তু মানেই একটা পুরানো লুঙ্গি, হয়তো লাল ছিল কোনকালে, এখন রঙচটে একটা অন্যরকম কিছু হয়েছে। স্বভাবে একটু সখী ভাব। গলায় গান ও খিস্তি। সব দোকানদারের সাথে তার ঠাট্টার সম্পর্ক। কখনও মাত্রাতিরিক্ত কটু কথায় তিক্ততার সৃষ্টি হয়। গান শুনে মন ভরে। বিরক্ত দোকানদার কুকুরের ডাক ডাকে। মান্তুদা গায়ে মাখেনা অনায়াসে রাগী প্রতিপক্ষকে আলিঙ্গন করে।

আজ মান্তুদা খুব খুশি। তাদের বাড়ির কাজের মাসির মেয়ে সরকার থেকে থেকে সাইকেল পেয়েছে। সেই আনন্দে মিষ্টি কিনছে আর গান গাইছে। লোকে আড়াল নয়, সামনেই বলে, পাগল। মান্তুদা বাছা বাছা খিস্তি উচ্চারণ করে সেই পাগল উপাধি ফিরিয়ে দেয় বক্তার ঊর্দ্ধতন চোদ্দ পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে। সরকার বাইরে থেকে ব্যবসা আনলো কি আনলো না, তাতে মান্তুদা বা তার বাড়ির কাজের মাসির কিছু এসে যায় না। তবে এই সাইকেলটি হওয়াতে মেয়েটি প্রায় দুকিলোমিটার দূরের স্কুলে যেতে পারছে। এটা ওই পরিবারটি এবং ব্যাচেলার মান্তুদার বড় আনন্দের কথা। একই সাথে কন্যাশ্রীর টাকা পেয়েছে, পাচ্ছে দুটাকা কেজি চাল। এই জনমোহিনী কাজের গুঁতোয় হয়তো কোষাগার ফাঁকা হয়ে গেল। কাগজ পড়া মিষ্টির দোকানদার তিলক একবার বলার চেষ্টা করে। মান্তুদাকে সে কথা বলে, খাল কেটে কুমির আনা। খিস্তির এমন সম্ভার খুব কম মানুষের কাছে আছে। থাকলেও অনেকের তা প্রকাশ করার ক্ষমতা থাকে না। মান্তুদা অমায়িক অর্থাৎ বিনা মাইকে সারা বাজারের সকলকে শুনিয়ে তিলকের ভুত ভাগায়। শেষে অন্যরা মিলে তিলককেই থামায়, যাতে মান্তুদাকে আর উত্যক্ত না করে।

গোবিন্দ লক্ষ্য রাখে সব। বাজার ছাড়া আরেক জায়গায় মান্তুদাকে দেখে সেদিন চিনতে পারেনি। আসলে যে মানুষটাকে যেখানে দেখে অভ্যস্থ, তার বাইরে তার যে কোন পরিচয়, থাকতে পারে সেটাই আমাদের অজানা। লাল শালুর পতাকা কাঁধে মিছিলে চলা মানুষটাকে প্রথমে চেনা চেনা লাগলেও বুঝতে পারেনি কে? সেই লুঙ্গি নেই, হাতে বাজারের থলেও নেই। মান্তুদা ঠিক নজর করে গোবিন্দকে। দুরন্তবেগে গালি সহকারে জিজ্ঞেস করেন, “...মরণ, অমন হাঁ করে দেখছিস কি? আমায় তোর পছন্দ হল না কি?” গালি শব্দটি কানে যেতেই টনক ঠং করে বেজে, নড়ে ওঠে। তখন চিনতে আর ভুল হয়না, ইনি কিনি? লম্বা একটা মিছিল। সামনে হুডখোলা গাড়িতে, নেতা। পিছনে সার সার পদাতিক বাহিনীর একজন হয়ে মান্তুদা চলেছে। পরে এক অন্য সময়, দোকানদার তিলক জিজ্ঞেস করে, “কি গো দল বদল করে ফেললে?” গালি শব্দের স্রোত বাঁচিয়ে গোবিন্দ কান পাতে মান্তুদা কি বলে, শোনার জন্য। “...রাস্তা কি পাল্টায়? একসাথে চলার লোক হয়তো পাল্টে যায়”। শুনে তিলক বলে, “বাঃ সুযোগ বুঝে পাল্টি মারলে। এতদিন লাল শালু বয়ে বেড়ালে, আজ হঠাৎ জামা পাল্টে অন্যদলে!”

-“ ... তোরা বুঝিস না। আমাদের মতো মানুষের এক্তিয়ার কতটুকু? খাওয়ার জোগাড় করা, আর সেটুকু খেয়ে দিনটা পার করা। সেটা করতেই সময় চলে যায়। ভাবনা করার মত সময় বা ক্ষমতা কোনোটাই নেই। এতদিন যে দাদা এসে রুটি আলুরদম খাওয়াতে নিয়ে যেত, সেই আসছে ওই একই রকম বা তার চেয়ে ভালো টিফিনের ব্যবস্থা করতে। আমি কি তোদের মতো পাগল, যে যাবো না?” মান্তুদাকেই সবাই পাগল বলে, সে তিলককে পাগল বলায় আসেপাশে সবাই হেসে ফেলে।

মানুষ চলতে চায়, যেকোন ভাবে হোক। খুব বেশি ভাবতে হবে না কোথায় যাচ্ছি। তাদের চলার একমাত্র শর্ত দলবদ্ধ যাত্রা। গন্তব্য ঠিক করার দায়িত্ব তাদের নয়। একমনে হঁটে যাওয়া একমাত্র কাজ। অন্য কেউ হাল ধরে থাকবে। আমি ভার সঁপে দিয়ে হাল্কা হয়ে থাকব পালকের মতো। হাওয়া বয়ে নিয়ে যাবে, হাওয়ার মতো। সে যদি ঝড়ের হাওয়া হয়, তাই সই। ঘরের ঘুলঘুলিতে এক অধটা চড়াই এল বাইরের খবর নিয়ে। তাদের ঠোঁটে ধরা খড়কুটো। সেখানেই লেগে আছে অন্য খবর। রাস্তার খবর। সে রাস্তা বৃষ্টিজলে ভিজে আরো কালো হয়ে ওঠে। সেখানে মান্তুদার মতো অনেকেই। কাজের মাসির মেয়ে সাইকেল চালায়। রাস্তা থাকে রাস্তার মতোই, শুধু চলার সাথী বদল হয়। মান্তুদাদের কথা কোন স্বতন্ত্র কথা নয়। গোবিন্দ রাস্তার পাশে দাঁড়াবার চেষ্টা করে, যাতে দেখা যায় কে কোনদিকে যাচ্ছে। তবে রাস্তার পাশও একটা দিক। এই দিক না অন্যদিক?

সোমবার, ১৬ মে, ২০১৬

বসত

বিকেলের মোড়কে জলঙ্গীর জলে পাখিদের ডাক মেশে। পানকৌরিরা আজকের মতো ডানা শুকিয়ে নিচ্ছে, পাড় থেকে হেলে পরা বাবলাগাছের একটা ডালে। তিরের ফলার আকারে বকেদের সারি ঘরপানে চলল। চন্দ্রমাধব দাস তাঁর একতারা গুছোয় উঠবে বলে। গোবিন্দর সাথে তাঁর আজকেই আলাপ। নদীর পাড়ে বসে গল্প হচ্ছিল। খুব অমায়িক গলায় বলে, “আগামী মঙ্গলবার পূর্ণিমা, নতুন ঘর বেঁধেছি। ওইদিন একটু নামগান হবে। সেবা হবে। এসো কিন্তু”। সেই মঙ্গলবার পর্যন্ত থাকা সম্ভব নয়, তাই আগেই গেছে দেখা করতে। ছোট্ট বাড়ি। সুন্দর করে নিকোনো উঠোন। দরমার বেড়া আর করোগোটেড টিন দিয়ে ছাউনি। মাটির উনোন, দুয়েকটা হাঁড়ি কড়াই। ঘরে রাধামাধব। “এর চেয়ে আর বেশি কি লাগে?” বলতে গিয়ে চন্দ্রমাধবের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়। অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে এক মুঠো মুড়ি বাতাসা আর জল। “আমাদের সঞ্চয় করতে নেই। যা জুটেছে তাই দিলাম”।  এইসব দিন বা মানুষ খুব দূরবর্তী নন। তবে ক্রমশঃ অপসৃয়মান। একান্ত নিজস্ব দেশজ সম্পদকে ঠেলে দিচ্ছে আরও দূরে।

গোবিন্দর এমনই এলোমেলো ভ্রমন। যেখানে যত বেগার, সেখানে তার ডাক পরে। কোন ছেলেবেলায় অমৃতাদিকে ভালো লাগত। পাড়ায় ডাকসাইটে সুন্দরী থকলে যা হয়, সাইকেল যুবকদের আনাগোনা লেগেই থাকে। অমৃতা গোবিন্দকে প্রশ্রয় দিত। এলেবেলে বা দুধভাত। তাই সই, গোবিন্দর তা পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা। এর তার চিঠি এনে দিত। কখন কখন অমৃতাদিও তাকে দিয়ে কিছুমিছু পাঠাত। তারপর অনেকদিন কেটে গেল। ছেলেবেলার রূপোলি ঝালর কেটে এখন অমৃতাদি শহরে থাকে। স্বামী পুত্র কন্যা নিয়ে ভরপুর সংসার। সেদিন হঠাৎ ডাক আসে। অমৃতাদির বাবার সাথে বাজারে দেখা, “তোকে অমৃতা যেতে বলেছে”।

ঠিকানা জুটিয়ে গোবিন্দ ঠিক হাজির। ওরেবাব্বা! বত্রিশ তলায় অমৃতা থাকে। ওদের দুহাজার স্কোয়ারফুটের ফ্ল্যাট। বারান্দায় দাঁড়ালে মনে হয়, ঝড় হচ্ছে এমন হাওয়া। নিচের দিকে হারিয়ে যাওয়া শহর। কত ছোট! খেলনার বাড়িঘর, গাড়ি, ঘোড়া। তাকালে পা শিরশির করে। কি জানি যদি উড়ে যায়। মেঘগুলো কি জানালার কাছে চলে এল? অমৃতার নতুন বাড়ির সবকিছুই নতুন। আসবাবপত্র, আধুনিক ঝাড়লন্ঠন, নিচে দামি কার্পেট। শোকেসে সাজানো সারি সারি কাচের গ্লাস আর রকমারি পানীয়র বোতল। “তোমার তো মেঘের দেশে বাড়ি গো। খুব স্বপ্ন দেখ নিশ্চই”। কিন্তু অমৃতাকে দেখে আগের মতো লাগল না, কেমন চোখের তলায় কালি পড়েছে। চেহারার জৌলুশও যেন কম। অমৃতা দামি কাচের বাসনে খেতে দেয়, থালায় ভরা কত কি? গোবিন্দও না না করেও, করে না। পরিপাটি খেয়ে নেয়। শেষে একটা বড় প্যাকেট নিয়ে আসে। সেখানে সাজানো অনেক ফল মিষ্টি। “এগুলো কি হবে?” অমৃতাদি বলে, “বাবাকে দিবি। ওঁরা কেউ তো এ বাড়িতে আসেনা। আমারও আর যাওয়া হয়না”। গোবিন্দ কিছু জিগেস করেনা। না বলতেও অনেক কথা বুঝে যায়। সেই ছোটবেলার মতই। যখন চিরকুটগুলো বয়ে এনে দিত। কোনদিন খুলে দেখেনি। কিন্তু বুঝে যেত ভিতরে কি আছে। মানুষের মন খুলে দেখার দরকার হয়না। গোবিন্দ বুঝে যায়। হাসি মুখে বিদায় নেয়। “আবার আসবি কিন্তু। এবার একটা মোবাইল ফোন সাথে রাখবি। দরকারে ডাকা যায়”। গোবিন্দ নেমে আসে, বত্রিশতলা থেকে জমিতে। গোবিন্দ এখন জানে দরকারেই তার ডাক পরে, সেই ছেলেবেলার মত, এখনও এলেবেলে। ঘাড় উঁচু করে দেখার চেষ্টা করে। ব্যালকনিতে অমৃতা দাঁড়িয়ে যতক্ষণ চোখের আড়ালে না চলে যায়। 

আসার পথে একটা বস্তি চোখে পড়ে, খালের ওপর দিয়ে একটা ব্রিজ রয়েছে। তার নিচে প্লাস্টিকের আড়াল দিয়ে প্রায় ত্রিশ চল্লিশ ঘর থাকে। খাল দিয়ে বয়ে চলেছে শহরের ক্লেদ আবর্জনা। তার ঢালু জমিতে কালো নোংরা জলের খুব কাছাকাছি উদোম বাচ্চারা খেলছে। আর রাস্তার ধারে বেশকিছু ভ্যান, রিক্সা সার দিয়ে সাজানো। এইখানকার পুরুষদের জীবিকা, মেয়েরা হয়তো অমৃতাদিদের ফ্ল্যাটগুলোতে যায়।

এর বেশকিছুদিন পর আবার এক মেলাতে দেখা হয় চন্দ্রমাধবের সাথে। ইদানিং নাকি এখানেই তাঁর ডেরা। “জলঙ্গীর পাড়ে যাওনা?” উত্তরে হাসিতে ভরিয়ে দেয় চন্দ্রমাধব, “তা রাধামাধব নিয়ে গেলেই যাব। সারা দুনিয়াটাই তো ওনার। যখন যখানে বসি, সেখানেই বসত তৈরি হয়”। গোবিন্দ সবটা বোঝেনা। তবে ভালো লাগে। এই ডেরাটা আগেরটার চেয়েও ছোট। তবে ভিতরে রাধামাধব আর নিরাভরন তৈজস। এই মেলাতে শুধু হাঁড়িকুরি আর চন্দ্রদের গান হচ্ছে না। অনেক আধুনিক জিনিসের পসরা নিয়ে বসেছে দামি দোকান। সেখানে বড় বড় যন্ত্রে বাজছে একালের গান।

অমৃতাদির বাক্সটা ওর বাবাকে দিয়ে, গোবিন্দ খানিক বোকার মতোই জিজ্ঞেস করে, “তুমি ওর ওখানে গেলেই তো পারো। দুঃখ করছিল”। বৃদ্ধ চোখ দিয়ে হেসে বলে, “নিজের মাটি ছুঁয়ে না থাকলে কেমন অপমান লাগে, ও তুই বুঝবি না”। গোবিন্দ বোঝেনা। সত্যিই বোঝেনা। মানুষের তল কোথায়, তালুকইবা কোথায়, কে বলতে পারে?

বৃহস্পতিবার, ১২ মে, ২০১৬

বিকিকিনির সম্পর্ক

বিপণনের দুনিয়া আমাদের জীবনে নতুন মাত্রা আনে। নতুন ফ্যাশন নতুন বাহার নতুন শব্দ। আমদানীকৃত অলঙ্কার আসে সাগর পাড়ের লোনা হাওয়ার সাথে। বনিকের মানদন্ডে যুক্ত রাজদন্ড এখনও পা ফেলে, তবে খুব চুপিসারে আসে। এ রাজত্ব ফেলে আসা সময়ের মতো উচ্চকিত নয়। রাজত্ব বিস্তৃত হয় সমাজের অভ্যন্তরে মননে মেধায় জীবনে। অনায়াসে পরাধীন হয়ে পড়ি, নিজের অজান্তে।

ইংরাজির ‘শপ’ শব্দের অর্থ দোকান। এ শব্দের সাথে মুখ্য যোগ দোকানদারের, তারপর ক্রেতা। বিপণন বিজ্ঞান সংজ্ঞা পাল্টে দিচ্ছে। দৃষ্টিকোণ অনুসারিত হচ্ছে বিক্রেতা থেকে ক্রতার দিকে। ‘শপ’-এর ক্রিয়াকরনে ‘শপিং’, বিক্রি না বুঝিয়ে ক্রয়কে বোঝানো হল। আর ‘শপার’ বিক্রেতা না হয়ে হলেন ক্রেতা। কারন পরিবর্তিত পরিবেশে ক্রেতা ভগবান। তার ভজনা করাই তাবড় বিশ্ব বিপণন দুনিয়ার লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও মোক্ষ। আর এই শপিংএর পীঠস্থান হল ‘শপিংমল’। দরজা খুলে ঢুকতে না ঢুকতে গলে গলে পড়ে সুখ। রিনরিনে কোলাহল আর রঙিন আবহাওয়া মুহুর্তে ভুলিয়ে দেবে সমস্ত দুঃখ কষ্ট। পরিসংখ্যান বলে ২০১৩ পর্যন্ত ৫৭০টি এমন শপিংমল আমাদের দেশে তৈরি হয়েছে এবং বলাই বাহুল্য আরও হচ্ছে। আজকের প্রজন্মের কাছে এই দোকানপুজ্ঞগুলো শুধু কেনাকাটার জায়গা নয়, বেড়ানোর, প্রেম করার, সময় কাটানোর জায়গা। অন্যান্য দোকান বাজার ছাড়া সিনেমা, রেস্তোঁরা, হেল্থ ক্লাব, বাচ্চাদের কিডস জোন কি নেই। এক্কেবারে যাদুতে মোড়া সব পেয়েছির আসর বলতে যা বোঝায়, এ যেন তাই।

ইংরাজিতে আরেকটি শব্দবন্ধ আছে ‘মম এন্ড পপ শপ’। অর্থাৎ কিনা মা বাবার দোকান বা পরিবার পরিচালিত ছোট দোকান। ডিমপুকুরে গোবিন্দর বাড়ির পাশের দোকান। যাদের বিশ্বজোড়া শৃঙ্খলবদ্ধ দোকানমালা নেই। একটি ছোট দোকান ঘিরে তাদের বেঁচে থাকা। যে দোকানদার কে গোবিন্দরা সবাই চেনে দামোদর, সুভাষ, অনুপ, আশিস এবং তার বৃদ্ধা মা, শঙ্কর, মিলন, তুলসী, যোগেশ এমন সব কত নাম। অমল কাকুর মনিহারি দোকান তাকে বিজয়ায় প্রণাম করে। বাড়িতে গোবিন্দর বাবা অসুস্থ হলে ফলওয়ালা অনুপ তাকে দেখতে আসে। তিনদিন পরে বাজারে গেলে অনায়াসে ফেরত পায় আগের দিনে ভুল করে ফেলে আসা বিস্কুটের প্যাকেট। কখনো সাইকেল করে শঙ্কর বাড়ি বয়ে দিয়ে আসে ফেলে আসা মাছের থলি, কিম্বা ফেরত দেয় গত সপ্তাহে মাছের জন্য ভুল করে বেশি নিয়ে নেওয়া দুশো টাকা। গোবিন্দ বাজার করতে গেলে খোঁজ নেয়, জয়দেব দুদিন ধরে কেন আসছে না? নদীয়া জেলার সব্জী খুব সুস্বাদু। অনেক মানুষ অনেক দুর থেকে এই বাজারে সব্জি কিনতে আসেন, তার কারন জয়দেব সুদূর সমুদ্রগড় থেকে প্রতিদিন নানান পদ বয়ে নিয়ে আসে এই বাজারে। আবার নিতাইএর মতো ব্যবসায়ী আছে, যারা সুযোগ বুঝে পচা আলু দিয়ে দেয়। পড়শী দোকানদাররা আড়ালে সাবধানও করে দেয়। বাড়িতে বিয়ে বা পরবে এই অনাত্মীয় বাজারওয়ালাও নিমন্ত্রণ পায়। সব মিলিয়ে বাজার শুধু কেনাকাটার নয় একটা সম্পর্কের বুনোট।

পাশাপাশি মহার্ঘ্য শপিংমলের দোকানে যে সব বিক্রেতারা থাকেন, তাঁরা মূলত কর্মচারী। এক ইউনিফর্ম পরা প্রত্যেকে। আলাদা করে চেনার উপায় নেই। তাই বিকিকিনি বাইরে কোন সম্পর্ক গড়ে ওঠেনা। একটু খুঁটিয়ে দেখলে বোঝাই যায় দামি বা কেতা দুরস্ত পোষাকের অন্তরালে হয়তো একটি গ্রাম্য গৃহবধূ, যার সাধ্য নেই যে সব পণ্য ব্যবহার করার, সেই সমস্ত পণ্যের গুণকীর্তন করে বিক্রির চেষ্টা করছে। এখানে বিক্রেতাটি থাকেন আড়ালে। তিনি সর্বশক্তিমানের মতো, বিশ্বজোড়া তার বিস্তার, বহুজাতিক তার মালিকানা। তার অসংখ্য চোখ কান, যা প্রতি নিয়তঃ তার বিশ্বস্ত ক্রেতা আর সম্ভাব্য ক্রেতাদের পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। টেলিভিশন, রেডিও, খবরের কাগজ, সাইনবোর্ড ইত্যাদির মাধ্যমে। তাই শপিংমলে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ-বিক্রতাটি বুকে লেবেল লাগানো শুধুমাত্র সেই মহামহিমের প্রতিনিধিমাত্র। তার আলাদা পরিচিতি হতেই পারে না। ব্যক্তিগত সুখ দুঃখ অনেক অতীত স্বাক্ষর। খুব জটিল মনোবিজ্ঞান আর ব্যবহারিক তথ্য সংগ্রহ করে অনায়াসে বুঝে ফেলে, ক্রেতা কখন ঠিক কি চাইতে পারে বা কেন চাইতে পারে। তার যোগান অব্যর্থ উপায়ে ঠিক সময়ের আগেই তার চোখের সামনে সুদৃশ্য মোড়কে ঝুলিয়ে দেওয়াই এই বিপণন দুনিয়ার মূলমন্ত্র।

সময় তার নিজের নিয়মে গড়িয়ে চলে, যা আগে ঘটেনি তা যে এখন ঘটবে না, কেউ বলতে পারে না। হয়তো সময়ের নিজেরও সেটা বলার স্বাধীনতা নেই। তাই আমরা যা পাই, তাই নিয়ে হেসেখেলে দিন গলিয়ে এগিয়ে যাই। ফেলে আসা দশকের ফেরিওয়ালারা যেমন আজ আর নেই। বেলফুল, আতর, শোনপাপড়ি-সন্দেশ, কেক-লো, কুলফি বরফ এমন কত নানা প্রয়োজনীয় পসরা সাজিয়ে তারা আসতো। তারাও তো আজ বিস্মৃতির গহিনে। পাড়ার বাজারের আব্বাসের মা হরিয়ে গেলে কোন ক্ষতিবৃদ্ধি হবে-কি হবে-না, কেউ জানে না। তবে ঈদের পর শাকপাতার স্বল্প সম্ভারের মধ্যে থেকে টিফিন কৌটো বার করে কে দেবে? বাড়িতে গড়া পরবের মিষ্টি। সাথে ফোকলা দাঁতে একরাশ আশীর্বাণী। মানুষে মানুষে যোগাযোগ-ই একমাত্র উপায় পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তোলে। যদি সেই যোগাযোগ হয় কেবল মাত্র কৃত্রিম আর কোন অন্য উদ্দেশ্য প্রণোদিত তবে আশঙ্কা বেড়েই চলে।

মঙ্গলবার, ১০ মে, ২০১৬

সময় সরণী

গাঢ় সবুজের মাঝখানে একটা হলুদ প্রজাপতি উড়ছিল। তার ডানায় ডানায় লেগেছিল সময়।
পাইনের ডাল থেকে গোপন আঁধারে একটা মাকড়শা সুতো ছাড়তে ছাড়তে নামছে। হাল্কা
দোল খেয়ে পরের পাতায় পা দেবে। এডাল থেকে পরের ডালে সময় ছুঁয়ে চলে যায়। তার
সময়কে কি ভাবে ধরা যায়? একটা ভালো ঘড়ি হাতে দিয়ে বল, এই ধরলাম। একটা কাচের
বালি-ঘড়িতে একমুঠো বালি ভরে বললাম, এই ধরেছি। সব কেমন আঙুলের ফাঁক দিয়ে মসৃণ
ভাবে গলে যায়, টের পাওয়াও যায় না। আগের মুহুর্তের প্রজাপতি এই সময়ে অন্য কোন
ব্যপ্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল, তাকে ধরা যাবে না আর কোন দিন। ছোট্ট গুবরে পোকার জন্য যেমন
সত্যি, অতিকায় নীল তিমির জন্যেও তাই। আবার পৃথিবীর বাইরে থেকে দেখতে পেলে গোটা
গ্রহ উপগ্রহ সহ সৌরজগতের জন্য সত্যি। এখনকার ক্ষণের সঙ্গে পরের ক্ষণের কোন মিল
নেই। সে চলে গেছে ধরা ছোঁযার বাইরে। আর কোনদিন আসবে না।

রোজ রোজ চেনা মুখটাকে অয়নায় দেখতে দেখতে, হঠাৎ করেই একদিন মনে হয়, এই
মানুষটা তো আগে ছিল না। বা সেদিনের সেই মানুষটি কোথায় হারিয়ে গেল? এই তো এখানেই
ছিল! এমন করে কোথায় চলে গেল যে আর তাকে খুঁজেই পেল না কেউ। প্রজাপতি উড়ে
গেলে বাতাসে একটা দাগ থেকে যায়। শামুক হেঁটে গেলেও তার চিহ্ন রেখে যায়। মানুষের
হেঁটে চলা পথে পথে দাগ থাকে। সে দাগে কাটাকুটি হয়, আবার অন্য দাগে হারিয়ে যায়।
কোথাও কোথাও সে দাগ হয়তো স্থায়ী হয়ে যায়। হয়তো তার কাছের মানুষটির মনে ভেতর।
সেই ভালোবাসায় দাগ ধরে রাখে। যাত্রাকাল ছোট হোক বা লম্বা, সেই গতিপথের আসেপাশে
যাঁরা এলেন, তাঁরা ছুঁয়ে গেলেন। প্রত্যেকে প্রত্যেকের মতো। সবই যে ভালো তা নয়, কারো
মনে গভীর ভাবে গেঁথে গেল কোন ব্যথার দাগ। সেই নিয়েই চলল তার রথ।

বহুদিনের চেনা পথে হেঁটেও তাই মনে হয় এ রাস্তায় তো আগে আসিনি। কি করে হবে? আগে
এলেও সময়টা তো অন্য। এখনকার সময় দিয়ে সেইদিনের সময় কে ধরতে গেলে বিড়ম্বনা
তো হবেই। এই রহস্যটাই বেঁচে থাকার উৎসমুখ, যার ঝর্ণায় অঞ্জলি পেতে রসদ সংগ্রহ করি।
হঠাৎ করেই মনে হয়ে সামনের বাঁক ঘুরলেই হয়তো দেখব, সেই পরিচিত মানুষটা, মুখে
একরাশ হাসির নিমন্ত্রণ সাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। যদিও জানি একটা অনেক বড় ‘নেই’ শব্দে
ঢেকে গেছে চতুর্দিক। তবু ভুল করে বিশ্বাস করতে ভালো লাগে, কষ্টও হয়।

প্রথম শৈশবে, যে শিশুর হাত ধরে নতুন সময়ের সরনী তৈরী হয়, তার প্রতিটি অনন্দময় ক্ষণে
মনে কি অবিশ্রাম দাগ কাটে। যেন কোন নিপুণ শিল্পীর সঙ্গীতের স্বরলিপি, ভালো লাগার
সঙ্কেত। রেণু রেণু হয়ে জুড়ে থাকে প্রতিটি প্রাণ। যে সময়টা প্রত্যেকের একসাথে, সেই
সময়ের মূল্যে এই অভিজ্ঞতা শাশ্বত। তারপর ধীরে ধীরে কারো কারো সময় ফুরিয়ে আসে,
তাকে মঞ্চ থেকে বিদায় নিতে হয়। পরের দৃশ্য অন্য কুশীলব আসবেন। গত দৃশ্যের
হাততালির রেশ মিলাতে বেশিক্ষণ লাগে না।  এভাবেই দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে আমাদের চলন।
কাউকেই বলে দিতে হয় না। কেমন যেন আগে থেকে তৈরি করা সংলাপ ক্রম। কাকে কি
বলতে হবে, যেন শেখানোই আছে। সেই পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক। 

এর মধ্যে সময়ের মাইলফলক চিহ্নিত করে রাখি, তারিখের মাধ্যমে। পুরোন সময়ের
স্পর্শসুখে শুধু সেই সংখ্যা ছুঁয়ে থাকি। জন্মদিন, মৃত্যুদিন, বিয়ের দিন, এমন কত কি?
ব্যক্তিসত্তার পরিধির বাইরেও এমন অজস্র তারিখ। স্বধীনতা দিবস, শ্রম দিবস, মায়ের দিন,
বাবার দিন, ভালোবাসার দিন এমন আরো। বছরের প্রতিটা দিন-ই হয়তো বিশেষ কোন কারনে
দাগিয়ে দেওয়া যায়। কারন মানুষ বড় ভয় পায়, প্রতি নিয়ত হাত থেকে খসে পড়া সময়ের
বালি। ধরতে না পারার এক চরম অপ্রাপ্তি। তাই মাইলফলক রাখি, কোন মতে তাকে ঘরের
শো-কেসে সাজাবার জন্য। ভুল করেও যেন ভুলে না যাই, ওই সময়ে আমরা এই পথে চলেছি,
হাত হাত রেখেছি। আবার হরিয়ে গেছি সময়ের নিয়মেই।  

রবিবার, ৮ মে, ২০১৬

ডাকবাক্স

লাল কালো রঙে জড়ানো স্বপ্নের সুলুক সন্ধান। বাক্স ভরা খবর। আর তার জন্য প্রতীক্ষা। কতশত রোমান্টিস্ম। সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের কালজয়ী রানার কবিতার হাত ছুঁয়ে, সলিল চৌধুরির সুর আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠমাধুর্য্য। ডাকবাক্স আর ডাকপিওন। কেমন মন কেমন করা কুয়াশার গহিন ডুবে যাওয়া। প্রত্যেকের বাড়িতেও ছিল। হয়তো এখনও আছে। কাঠের তৈরী, এক দিকে ছোট একটা তালা। আজকাল চিঠি আসেনা, আসলেও তা ভীষণই পোশাকি লেখা। কোন কোম্পানির বিজ্ঞাপনের কাগজ, ফোন বা ইলেক্ট্রিকের বিল। তাও ই-মেল কিম্বা এস-এম-এস মারফত এসে যায়, তাই ডাকবাক্স খোলার আগ্রহ থাকে না। অবহেলায় পড়েই থাকে, টিকটিকি বা আরশোলা সংসার পাতে।

কৈশোর পেরোন ভোরে, যখন বিশেষ চিঠির প্রতীক্ষায় দিন যাপন। কখন সেই প্রার্থিত খামটি আসবে? বাইরের অবয়ব দেখেই অনেকটা মন ভরে যায়। তার রঙ, ওজন, গড়ন আর গন্ধ। মিলেমিশে আবহ তৈরী হয়। কেজো চিঠি ইনল্যান্ড, পোস্টকার্ড বা সরকারি খাম। এয়ার মেলের ওপর বিদেশি ডাকটিকিট। শুধু তার আগ্রহে এপাড়া থেকে অন্য পাড়া ছুটে চলে যেত সাইকেল। ডাকপিওন কে আগেভাগে হাত করে নেবার ছল। তার হতের দিস্তা বাঁধা বান্ডিল দূর থেকে দেখেই বোঝা যেত, নিজের বিশেষ চিঠিটি আছে কিনা। বাড়ির ডাকবাক্সে পড়লে অন্য হতেও পড়তে পারে। সেই অতীব গোপনীয় সব শব্দজাল। কিম্বা দুয়েকটা বিদেশি ডাকটিকিট হাতিয়ে নেওয়া। খামের ওপর থেকে মসৃণ ভাবে ছুড়ি দিয়ে চেঁছে নেওয়া। ডাকটিকিট নিয়ে বিশ্বজোড়া চর্চা। তার জন্য সুরম্য অ্যালবাম, প্রথম প্রকাশের খাম, এ সমস্ত অতি মহার্ঘ্য দখল। এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মতে হাত বদল হয় তার উত্তরাধিকার।

ডিমপুকুরের ফাঁড়ির গায়ে একটা লাল বাক্স ঝোলানো থাকত। পাড়ার লোককে পোস্টঅফিস অবধি উজিয়ে যেতে হতো না চিঠি ডাকে দেবার জন্য। ভারতবর্ষ জুড়ে দেড়লক্ষের বেশি পোস্ট অফিস আছে। ডাকবাক্স আছে আরো বহুগুণ। গাঢ় কালচে-লাল তাদের রঙ। পরবর্তিকালে সবুজ নীল অন্য রঙও হয়। কিন্তু স্বপ্নের রঙ অবশ হয়ে পড়ে। এ পাড়ার সেই লাল বাক্সটি ক্রমশঃ মরচে ধরতে শুরু করে। একসময় দেখা গেল নিচের পাতটি ভেঙে গেছে। কেউ কেউ হয়তো তখনও চিঠি পোস্ট করতেন, কিন্তু সে নিচ দিয়ে গলে যেত। কখন হয়তো দুষ্ট বালকের দল ইচ্ছাকৃত ভাবে চিঠি লোপাটও করে দিত। অন্যের চিঠি পড়ার মধ্যে একটা গোপন শিহরণ জাগানো রোমাঞ্চ থাকত। ক্রমে সেই ডাকবাক্সটাও সরিয়ে ফেলা হয়। তার বদলে আর নতুন কোন বাক্স ঝোলানো হয় না। শুধু একটা লোহার আংটা গাছের গুঁড়ির গায়ে পুরোন ক্ষতর মতো জেগে থাকল।

এখনকার প্রেম চিঠির অপেক্ষা করে না। তাৎক্ষনিক খাবারের মত, তাৎক্ষনিক খবরের আদান প্রদান। হয়তো অনেক সময় সঙ্কুলান হয়, মনের কাছে আসতে ডাকপিওনের হাত ধরতে হয় না। তবে ঢিমে আঁচে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা স্বাদের সাথে তাৎক্ষনিক খাবারের যেমন তফাত, চিঠি আর এস-এম-এস হয়তো কতকটা তেমনই। ক্রিয়া আর প্রতিক্রিয়ার দ্রুততায় সম্পর্ক বেড়ে ওঠে তরতর করে। বড় বড় ইমারতের ভিত নির্মাণে, সবচেয়ে বেশি সময় দেওয়া হয়। সিমেন্ট, বালি, পাথর, লোহার মত সময়ও এই নির্মাণের এক মস্ত জরুরী উপাদান। তাই সময় খাইয়ে খাইয়ে শক্ত ভিত্তি তৈরী করেন স্থপতিরা। সম্পর্কের তৈরিতে হয়তো সেই ভিত্তিটা চিঠি গড়ে দিত। এখন তাৎক্ষণিক সম্পর্ক যেমন দ্রুত তৈরি হয়, তেমনই দ্রুত ভেঙেও পড়ে।

টেলিগ্রাফের সরকারি মৃত্যু পরোয়ানায় শিলমোহর পড়ে গেছে অনেকদিন। আর বেশিদিন হয়তো নেই, যখন অবলুপ্ত হবে চিঠি আর ডাকবাক্সের এই ক্ষয়িষ্ণু সম্পর্ক। অনেক পত্র সাহিত্য কেবল ঐতিহাসিক উপাদান হয়ে জেগে থাকবে। পরিবেশ বান্ধবরা হয়তো খুশি হবেন। কতশত গাছ বেঁচে গেল, এই ভেবে। কি জানি কারা মরলো আর সে জন্য কারা বাঁচল? জগতের নিয়মে সে চলতেই থাকবে। যাদুঘরে যেমন পুরাতত্বের নিদর্শন সযত্নে সংরক্ষণ হয়, তেমনি ডাকটিকিট, খাম, চিঠিও থাকে। পরবর্তি প্রজন্ম সেই হলদে হয়ে যাওয়া কাগজের টুকরো তে সময়কে ছুঁয়ে দেখবে। বিদগ্ধ গবেষক মোটা চশমার ফাঁকে পর্যালোচনা করবেন সময়ের সরনীতে ফেলে যাওয়া মাইলফলক। ডাকটিকিট প্রকাশের কারন ও তার পারিপার্শিক সময়ের দলিল হিসেবে তার আদর জুটবে, বক্তৃতায় আর গবেষণপত্রে।

প্রতিটি ডাকটিকিটের পিছনে একটা করে গল্প থাকে। সে শুধু প্রকাশের ইতিহাস নয়, কবে কখন কে পাঠিয়েছিল? সব সময় যে খুব শুভ সংবাদ বয়ে নিয়ে এসেছে তা নয়, বহুবার চোখের জলে ভিজে খবর এসেছে। কাছের কোন মানুষের বিচ্ছেদের খবর। এতটা সময়ের পার থেকে আর ছুঁয়ে দেখার সাধ্য থাকে না। শুধু তার স্পর্শ মাখা খামটি থেকে যায় স্মৃতিচিহ্ন হয়ে। চোখের জলে বিধুর হয়, ফিকে হয়ে আসা হস্তাক্ষর। কবে যেন কে খুব যত্নে লিখেছিল। বুকের তলায় বালিশ দিয়ে উপুড় হয়ে। লিখতে গিয়ে হয়তো ভাঙলো কাচের চুড়ি, কব্জি চুঁয়ে চুনীর ফোঁটা এসে পড়ে লেখার পাতায়। সেই শোনিত চিহ্ন আর এক টুকরো ভাঙা চুড়ির টুকরো বুকে নিয়ে চিঠি ঊড়ে চলে। এ পোস্টাফিস থেকে অন্য পোস্টাফিস। হাত বদল হয় কত ডাক কর্মীর। অবশেষে তা যখন গ্রহকের হাতে পৌঁছয়, সে চিঠি আর চিঠি থাকে না। হয়ে ওঠে এক স্মারক, যা শাজাহনের হাত ধরে মুমতাজ কে অমরত্ব দিয়েছে। 

শনিবার, ৭ মে, ২০১৬

পথকথা-৫ (আকাশ পথ)

স্বয়ং অবন ঠাকুর বলে গেছেন, শামুকদের কাছে রাস্তার খবর থাকে, মাছেদের থাকে জলের। আর পাখিদের আকাশে। আকাশের খবর উড়োজাহাজ কোম্পানিদেরও থাকে। আকাশের কোনদিকে কেমন হাওয়া? টার্বুলেন্স আছে কি নেই? একই উচ্চতায় আর রুটে আরও কতজন ডানা মেলেছে। জাহাজের ভেতর যিনি ক্যাপ্টেন আছেন, তিনি নিমিত্ত মাত্র। আসল টিঁকি বাঁধা নিচে। যেখানে তারা রাডারে চোখ রেখে প্রতিটি পল অনুপল মেপে যাচ্ছেন। সেই দুরূহ পদ্ধতিটির মধ্যে যাতায়াত যতই আরামদায়ক মনে হোক, সহজ নয় এতটুকু। সোমনাথের পেট গুড়গুড় করে। এরোপ্লেনে চড়ার নাম শুনলেই হাত পা যেন সেঁধিয়ে যেতে চায়। বিমান উড়বার আগে সুবেশা সেবিকারা হাত নেড়ে, বিপদে পড়লে কি করবেন শেখায়। তারা ভাবলেশহীন হয়ে যন্ত্রের মতো এইসব কথা বলেন, সোমনাথের ততই ভয় বাড়তে থাকে। বলে কি রে, সমুদ্রে নামলে কি করবে? অক্সিজেন কমে গেলে কি করবে? মাঝ আকাশে যদি গাড়ি খারাপই হয়, ওইসব বুকনি কোন কাজে আসবে? কক্ষোণো নয়। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ওঠা আর নামার সময়। সোমনাথ, প্রায় হাঁটুর মাঝখানে মাথা গুঁজে ফেলে। ঈশ্বরে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কোনটাই ওর নেই, তবু এই মুহুর্তগুলোতে ভাবতে ভালো লাগে, আহা কেউ যদি অমন সর্বশক্তিমান হত, তবে খানিক নিশ্চিন্তি হতেই পারত। আর যদি টার্বুলেন্সে পড়ে, তবে তো হয়ে গেল। মাঝে মাঝে সে একেকটা ফ্রী-ফল যা হয়, প্রাণপাখি পালাবার জন্য ডানা ঝাপটেই চলে।

সেবার এক পাহাড়ি পথে চলেছে। তা আবার বর্ষার মরশুম। সকাল থেকে বেশ কয়েকবার নির্ধারিত সময় পার হয়েছে। কি না, সেই দেশে বৃষ্টি হচ্ছে। সে, এতো বৃষ্টি এরোপ্লেন নামতেই নাকি পারবে না। এই ঘোষনাগুলো কেন যে করে? এসব শুনলে তো আরো পিলে চমকে যায়। এমন ভাবে সময় পিছোতে পিছোতে, যখন ভাবছে এবার বুঝি আজকের মত উড়ান বাতিল হল, নিশ্চিন্তে হোটেলে ফিরতে পারবে। ঠিক তখন প্লেন ছাড়ার ঘোষনাটি হল। কি আর করা, রামনাম জপতে জপতে প্লেনে উঠে আসন গ্রহন করে। সমতলের ওপর দিয়ে যখন চলল, তেমন কোন ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে না। বাধ সাধল, পাহাড়ি এলাকায় প্রবেশ করে। ওরে বাবারে এ কি বিশাল বিশাল চূড়া। দুইদিকে এমন সব দুরূহ কঠিন দেওয়াল। তার ভেতর দিয়ে অলি গলি খুঁজে বেরোনর মত ধাতব পাখিটা উড়ে চলে। ক্রমশঃ নিচে নামতে থাকে। মেঘের আস্তরণ পার হতেই বৃষ্টির মধ্যে পড়ল। সে কি তুমুল আলোড়ন। এর মধ্যে পাইলট সাহেবের ঘোষনা। সবাই কে শান্ত হয়ে থাকার অনুরোধ। সান্ত্বনা বাক্যে একটি আশ্বস্ত বানী "আপনাদের যদি মনে হয় দুই দিকের পাহাড়ের দেওয়ালগুলো, আপনাদের পূর্ব অভিজ্ঞতার চেয়ে কাছে, একদম ভয় পাবেন না। এই দেশে এটা স্বাভাবিক"। এই ঘোষনায় কারা স্বস্তি পেল জানা নেই, সোমনাথের কলজে শুকিয়ে, পিলে চমকিয়ে, তালু গরম হয়ে ফেটে যাবার জোগাড়। তার মধ্যে অনুভব করে দুই দিকের পাহাড় এতটাই কাছে যে, ডানা সোজা করে ধাতব পাখি বেরোতে পারবেনা। বোঁ করে প্রায় পঁচিশ ডিগ্রী হেলে  গেল। বাস আর দেখতে হবেনা, এরোপ্লেন জুড়ে হাহাকার রব উঠল। এমন করে শেষমেষ এক ফালি রানওয়ের মত কিছু এল। তবে সে না দেখা যাবার মতো। বৃষ্টির তোড়ে সব সাদা। বিমান তিন বার চক্কর কাটে, তারপর আবার ক্যাপ্টেনে ঘোষনা, “ভয়ঙ্কর দুর্যোগের কারনে আপাততঃ আমারা নামার ঝুঁকি নিচ্ছিনা। আমরা প্রতিবেশী এক দেশে যাচ্ছি। আজ রাত কাটিয়ে কাল সকালে আবার চেষ্টা করব। এই অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির কারনে আমরা দুঃখিত”। যাত্রীদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ ভাবলেন নামলেই হত, কত কাজের লাইন ছিল। অনেকে ভাবলেন, পৈতৃক প্রাণটা অন্ততঃ রেহাই পেল। সোমনাথ বলা বাহুল্য দ্বিতীয় দলে।

পরদিন কিন্তু অসাধারন আকাশ। ঝকঝকে, কোথাও কোন মলিনতার মেঘ নেই। ভোরের আলোর সাথে ভাসতে ভাসতে ধাতব পাখি তার উড়ান সম্পুর্ণ করে। পথে পুরো হিমালয়। ক্যাপ্টেন উৎসাহ সহকারে চিনিয়ে দেন, কোনটা এভারেস্ট, কোনটা কাঞ্চনজঙ্ঘা আরো কত গগনভেদী নাম।
এমন একবার সোমনাথ দিল্লি চলছে আপিসের কাজে। বিজনেস ক্লাসে যাত্রা। আসন গ্রহন করেই বুঝতে পারে, ওর সহযাত্রীরা প্রত্যেকেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, এম-পি। পরেরদিন লোকসভার অধিবেশন শুরু হচ্ছে, সে উপলক্ষ্যে এই মানুষগুলো চলেছেন। যাইহোক, এঁদের সাথে, সোমনাথের কোন লেনা দেনা নেই। নিজের মনে, একটা বই বার করে পড়তে থাকে। চুপ করে থাকলেও আশেপাশের কথাবার্তা কানে এসেই যায়। এক পেশার বিভিন্ন মানুষ একত্রিত হলে খুব স্বাভাবিক ভাবে নিজেদের পেশা সংক্রান্ত আলোচনা বেশি হবে। অত্যন্ত নিরীহভাবে যে সব আলোচনা হচ্ছিল, শুনে সোমনাথের আক্কেল গুড়ুম। কেউ একজন জিজ্ঞেস করেন, অমুক এখন কোথায়? উত্তর আসে, তিনি এখন তিহারে সাজা কাটছেন। আগামী ইলেকশান জেল থেকেই লড়বেন। ইত্যাদি নানাবিধ সংবাদের আদান প্রদান হতে থাকে। প্রত্যেকটি মানুষ সাদা রঙের পোষাকে সজ্জিত। তাঁদের বেশভুষায় আভিজাত্যর ছাপ প্রকট। একই রকম ভাবে কথাবার্তায় অন্ধকারের হাতছানি। সোমনাথ অনুভব করে, কাদের হাতে দেশের শাসনভার, কারা আজ আমাদের ভারত ভাগ্যবিধাতা। 

বেশ কয়েকদিন অন্য শহরে ছিল সোমনাথ। ফেরার সময় মনে চাপা খুশি। কতদিন পর আবার সবার সাথে দেখা হবে। বাড়ির ভাত খাওয়া হবে। রাতের ফ্লাইট। বিমান সেবিকারা ঘুরে ঘুরে রাতের খাবার দিচ্ছেন। সোমনাথের কাছে এসে জিজ্ঞেস করেন, আমিষ না নিরামিষ কি পছন্দ? সোমনাথ খুব বিনীত ভাবে বলে, “অনেকদিন পর বাড়ি ফিরছি। তাই এখানে খাবো না। বাড়ি গিয়ে সবার সাথে খাবো। আমার জন্য আমার ছেলে মেয়েরা অপেক্ষা করছে”। মেয়েটি ফিরে গেল। সবাইকে খাবার দেওয়া হয়ে যাবার পর, আবার ফিরে আসে হতে রঙিন কাগজে মোড়া একটা বড় ঝুড়ি। মিষ্টি হেসে বলে, “আপনি বাড়ি যাচ্ছেন, আমাদের তরফ থেকে এটা আপনার ছেলে মেয়েদের জন্য”। সোমনাথ বুঝতে পারে নানা রকম মহার্ঘ্য খাবার সামগ্রী দিয়ে প্যাকেটটি সাজানো। হয়তো সবটাই ভীষণ ভাবে ব্যবসায়িক স্বার্থে ব্যবহৃত, তবু এই ঘটনাটি মন ছুঁয়ে যায়। মাটি থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট ওপরে হঠ্ৎ যেন মাটির গন্ধ নাকে আসে। ঠিক এই জন্যই যেন আরো একবার বেঁচে থাকা যায়।

বুধবার, ৪ মে, ২০১৬

গোলমেলে আলো

চেনা রাস্তা অনেক সময় অচেনা লাগে। কতবার হেঁটে গেছ, কত শত সাইকেল ভ্রমন এমন কি মোটর সাইকেল বা গাড়িতেও। হঠাৎ একদিন সেই রোজকার নেহাত আটপৌরে রাস্তা, যার কিনা আলাদা কোন বিশেষত্ব নেই, তাকেও অচেনা ঠেকে। আর পাঁচটা রাস্তার মতোই, সে সাতে পাঁচে থাকে না। বিপ্লব বা দুর্ভিক্ষ কোনোটাতেই নেই, কোনো কালে কোন রাজপুরুষ এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেছেন বলেও শোনা যায় না। সেই রাস্তা কিনা একদিন কাউকে কিছু না বলে রঙ বদল করে ফেলল। তার গা হয়ে উঠল মসৃণ, তার দুধারে জমে থাকা নোংরার ঢিবিগুলো কে যেন রাতারাতি পরিস্কার করে দিল। এতদিন একটা নেহাত এলেবেলে গাছ রাস্তাটার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, হঠৎ বেমক্কা একগাদা হলুদ ফুল ফুটিয়ে জায়গাটা কেমন আলো করে দিল। সেই আলো কতক গাছে, কতক গাছের তলায়, আর কিছু পথচলতি মানুষের মনের মধ্যেও ঢুকে গেল।

আলোটা ভেতরে নিয়ে গোবিন্দ একটু দিশেহারা হয় পরে। এই অভিজ্ঞতা তার আগে ঘটেনি। চাল ডালের জীবনে, এই আলোর বিড়ম্বনা ঘাড়ে নেওয়াও তো ঝামেলা। হঠাৎ করে যেন নিবিড় করে দেখার চোখ ফুটে যায়। কেন বাবা বেশ তো ইঁট কে ইঁট বা পাটকেল কে ধুসর, এই নিয়ে চলছিল। তারমধ্যে এই গাঢ় চোখে দেখাটা, কোথায় সে ব্যবহার করবে বুঝে উঠতে পারেনা। পাঁচিলের ওপর একটা লাল রঙের বিড়াল ঘুমোচ্ছিল, তা সে রোজই যেমন ঘুমায় আর কি? গোবিন্দ তার দিকে একটু তাকাবার চেষ্টা করে। সে বেচারাও অর্ধনিমীলিত চোখে দৃষ্টি ফেরত দেয়, তা বেড়াল যেমন করে তাকায়। ব্যাস গোবিন্দ ভাবে এ যেন তার ভেতরের আলোর ছটা। বেড়ালও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেল। বেশ সে না হয় মন্ত্রমুগ্ধ হল, তাতে কার কি কাজে লাগবে?

গোবিন্দ কিন্তু বেশ খুশি খুশি হয়। আজ তার মনের ভিতর এক অন্য উপলব্ধি, যা কিনা তাকে আর পাঁচজন থেকে আলাদা করে দিয়েছে। সারা গায়ে রোদ মেখে ঘোরে। মনের ভিতর, মাথার ভিতর একটা আলো দপদপ করে। গালে ঘাড়ে, দুই বাহুতে লেগে থাকে অন্তহীন স্বেদ বিন্দু। তাপিত শরীরের নিঁভাজ ক্লান্তি কোথাও থামার কথা বলে না। বাজার যায়, আনাজওয়ালার কাছে লঙ্কার দর করে। দোকানি শুধু গ্রীবা হেলিয়ে, “দশ টাকা শ”। গোবিন্দ পরের কথা বলার আগে হাঁ করে, কিছুটা বিষ্ময়ে, কিছুটা অভ্যেসে। “ওরে বাবা! এত কেন?”  আনাজওয়ালার কম্পহীন নির্লিপ্ত উত্তর। “সমস্ত বোধবুদ্ধি, টাকা পয়সা, সব ওই লঙ্কা গাছের গোড়ায়, এবছর দাম আর কমবে না”। আকাশের আলো চাষীর জমিতে আর বাজারেও তার আঁচ। বাড়ির বাজারটা করে গোবিন্দ দু-চার পয়সা সরায়, আজ দেখছি উল্টে বেরিয়ে না যায়। মুরগি কিনতে যায়, দুশো টাকা। মাছ, ছশো টাকায় ট্যাংরা। ভারি মুশ্কিল হল। সেই হলুদ আলোটা তো কাজ করছে না। দোকানদার তো এই দৃষ্টির আওতায় মোটেই আসছে না। দিব্যি যে যার ইচ্ছে খুশি দাম হাঁকিয়ে চলেছে।

বাজারে আসার সময় যতটা আনন্দ পেয়েছিল ফেরার সময় আর তেমন লাগছে না। নাঃ এটা মোটেই ভালো হল না, যেখানে সেখানে আলো জ্বেলে কোন কাজের কিছু হয়না। দুই হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে বাড়ির পথে। আজ আর রিক্সা করবে না। আর যখন কোন কিছুতেই হাত ছোঁয়ানো গোল না, অন্ততঃ রিক্সা ভাড়াটা সঙ্গে থাকুক। পথে যেতে সেই বাড়িটা পরে। সেও তো রোজ পরে। গোপাদের বাড়ি। তাও ওরা এ পাড়া ছেড়ে চলে গেছে আজ কত বছর হয়ে গেল। তারপর থেকে বাড়িটাই যেন নিভে গিয়েছিল। আজ হঠাৎ কেন চোখে পড়ল? তবে কি এটা আলোর গুণ? গোবিন্দ একটু দাঁড়িয়ে যায়। খুব ছোটবেলায় গোপার সাথে তার খেলাধুলা দিন। সেখানে হাঁড়িকুরি নিয়ে মেয়েলি খেলা। সেই পুতুলের সংসারে গোবিন্দই বাজার করে আনত। ঘাস, লুচিপাতা নামক এক ছোটছোট চকচকে আগাছা, পুরোন পাঁচিল খুঁচিয়ে মোটা মোটা মসের আস্তরন, ইঁটের টুকরো গুড়ো করে লাল লাল মশলা, এমন আরো কত কি! গোবিন্দ বাজার করে আনলে, গোপা রান্না করত। সেই রান্না আরও অনেক কাল্পনিক আত্মীয় স্বজনের সাথে ভাগ করে খেত।

আজ বুকের ভেতর এই আলোটা নিয়ে গোবিন্দ খাবি খায়, আর ভাবে এই বুঝি সামনের গেট খুলে গোপা বেরিয়ে আসবে। ওর হাত থেকে বাজারের ব্যাগ কেড়ে নিয়ে বলবে, “এত দেরি করলে, আমি কখন থেকে বসে আছি। রান্না করব কখন বা খেতে দেব কখন?” সেই ছেলেবেলার খুনসুটি। বড় হয়ে বুঝে উঠবার আগেই গোপারা চলে গেল, বাড়িটাও কেমন অস্পষ্ট হয়ে গেল। পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও আর চোখে পড়ে না।  ভীষণ রোদে চতুর্দিক খুব বাস্তব। সেখানে এতটুকু ভুল হবার সংশয় নেই। হলুদ ফুলগুলোই গোলমাল পাকিয়ে দিল। গোবিন্দ জানে ওই বাড়িতে কেউ নেই। গোপারা চলে গিয়েছে সে অনেক বছর আগে। তার আলো মাখা মুখটা খুব কাছে চলে আসে, যে হাত দিয়ে ছোঁয়া যায়। এমন কি ওর চুলের থেকে একটা ঘ্রাণও ভেসে আসে। তা কে অস্বীকার করা তো অসম্ভব। গোবিন্দ আবার বাজারের ব্যাগ হাতে তোলে, মাটির দিকে মুখ করে গোপাদের বাড়ির চৌহদ্দি পার হয়ে যায়। গন্ধটা পিছনে থেকে যায়। একবার মনে হয় পিছনে তাকায়, একবার তাকালে কি হবে? তবু মনে জোর আনে। সোজা এগিয়ে নিজের বাড়ির গেট খোলে। পাঁচিলের ওপর বসে থাকা বিড়ালটা ঠিক একই ভঙ্গীতে তাকিয়ে থাকে। গোবিন্দ অবাক হয়, তবে কি এখনও মুগ্ধতা কাটেনি!  

স্বপ্নের বীজ

সব মফঃস্বল শহরের মত ডিমপুকুরও তার চরিত্র পাল্টাচ্ছে। একটা দুটো করে পুরোন বসতবাড়ি ভেঙে তৈরী হয়েছে ফ্ল্যাট বাড়ি। প্রথম প্রথম একটু অন্য রকম লাগত। কোথাও যেন ছন্দ পতন হল। আস্তে আস্তে চোখ সয়ে যাচ্ছে। সবুজে ঢাকা পাড়ায় কিছু বনেদী বাড়ি ছিল। না হলে, এক তলা বা দোতলা বাড়ি, সামনে এক চিলতে বাগান। অস্তিত্বে কোন ঔদ্ধত্য নেই। সেই বাড়ি ধুলিস্যাত হয় প্রাসাদের গর্বে। এই সাধারনের মধ্যে হঠাৎ আকাশ চেরা অতিগর্বী তিরিশ চল্লিশ তলার অট্টালিকাগুলো কে অহঙ্কারী দৈত্যর মতো মনে হয়।

খুব বেশিদিন নয়, যখন জমির এমন আকাল হয়নি। ইতস্ততঃ খালি বা পতিত জমি আর ডোবা চোখে পড়ত। সেখানে অযত্নে গড়ে ওঠে আগাছার জঙ্গল। সদ্য কৈশোর ছোঁয়া ছেলে মেয়েদের কাছে, এই রহস্যের অন্তরালটি যেন শঙ্করের চাঁদের পাহাড়। মাথা নিচু করে সেই সব অগভীর আগাছার ছায়াতে লুকোচুরি খেলা। কখন দেখা হয়ে যায় সাপের খোলস বা শিয়ালের গর্ত। ডোবার কচুরিপানার ওপর আলগোছে হেঁটে যাওয়া ডাহুক।  কুবো পাখির একটানা ডাক। সব গাছপালা আর তাদের নাম না জানা অকুলিন ফুলের মিশেলে এক অদ্ভুত বন্য গন্ধ তৈরি হয়। স্বপ্নের মধ্যে যেন গাংচিলের ডাক আর ওই গন্ধ দাঁড়িয়ে যায়। কিছু না থাকার মধ্যেই প্রকৃতির অপার ঐশ্বর্য্যের ডালি। প্রাচুর্য্য না থাকলেও কোথাও এতটুকু কৃপণতা নেই। শীতের কালে দু-চারটে বেলেহাঁস সেই কোন বরফ পাহাড় পার করে এই অকিঞ্চিতকর আঙিনাকেও তার অস্তিত্বর ছোঁয়াতে করে তুলত বিশেষ। সন্ধ্যের মুখে শিয়ালরা একজন দুজন করে ডোবার ধার ঘেঁষে দাঁড়াতো। অন্ধকারে তাদের সবুজ চোখগুলো জ্বলছে দেখে ছেলেমেয়েদের সেকি ভয়! নিশ্চই বাঘ ভালুক বা অন্য কোন দৈত্য হবে।

এখনকার পাঁচিল ঘেরা আকাশ ছোঁয়া বাড়িগুলো অতি আলোকিত। রাত হলেও আঁধার নামে না। রহস্যময় বন্য গন্ধ স্মৃতির আড়ালে মুখ ঢেকে ফেলে। ঘোর বাস্তবতায় পিছু হটে জলজ শ্যাওলার ঘ্রাণ, সাপের খোলস, ডাহুকের ক্লান্তিকর ডাক। কি জানি মুখের রক্ত দিয়ে ডিম ফোটাতে পারল কিনা? তবে তাদের যে বাসা বদল হল, সে তো ঠিক। পিছু হটতে লাগল বন বাদার। চেষ্টা করলেও তাদের নিমন্ত্রণ করে আনা যাবে না। মানুষের ওপর অভিমান। সাপেদের, শিয়ালের, বেলে হাঁস বা শামুকেরও। এখানে রাস্তা অনেক চওড়া, শান বাঁধনো সুখ দুঃখ, এমনকি ভালোবাসাও। তবে তার মধ্যে অস্থির মুখ তোলে আবর্জনা। মানুষ পৃথিবী জুড়ে প্রায় দেড়শো কোটি টন বর্জ্য পদার্থ্য প্রসব করছে প্রতি বছর। এই ভার কে নেবে? ডিমপুকুরও তার ব্যতিক্রম নয়। সুন্দর চওড়া রাস্তার দুধারে পাহাড় জমছে আবর্জনার। সেখানে তৈরী হয়েছে এক নতুন প্রানী বৈচিত্র্য। কালো কুৎসিত ময়লার টিলা গুলোতে সাদা ফুলের মত ঘুরে বেড়ায় বক। পুকুরের মাছ ছেড়ে তারা বোধহয়, এখানেই খুঁজে পেয়েছে তাদের বেঁচে থাকার রসদ। আছে দঙ্গল বাঁধা কুকুর, মেঠো ইঁদুর, বিড়াল, কাক, চিল। আর অমৃতের পুত্র কন্যারাও। এক বিরাট সংখ্যার মানুষ এই বর্জ্য পদার্থ্যকে তাদের জীবিকা করেছে। পুরুষ নারী নির্বিশেষে, এই তীব্র গন্ধ মাখা নারকীয় কুন্ডটিই তাদের লীলাক্ষেত্র। রাত্রিদিন এখানেই কাজ করে। খালি হাতে সম্ভবতঃ তারা আলাদা করে জৈব আর অজৈব বর্জ্যকে। এই আবর্জনার পাহাড়ের পাশেই সেই অজৈব জিনিসপত্রের কেনাবেচার দোকান। সেখানেও ব্যাপারি আসে।  সওদা করে। রুজির ব্যবস্থা হয়। আর তার পাশটিতেই তাদের বাসস্থান। বাসস্থান না বলে মাথা গোঁজার ছাউনি বলা ভালো। পুরো ঘরটাই ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়ে বানানো। ছেঁড়া প্লাস্টিক দিয়ে ছাদ। ভাঙা আসবাবের টুকরো দিয়ে খাট, উনোন, বাসন। এই মানুষদের ছেলেমেয়েরাও নিজেদের আনন্দের উপকরন খুঁজে নেয় এই আবর্জনার মধ্যেই। ফেলে দেওয়া পুতুল। পেটে ফেঁসে তুলো বেরনো টেডি, সিট ভাঙা সাইকেল। তবে সেই সবকিছু পরম মমতায় তারা আগলে রাখে। হয়তো মানুষ বলেই। শৈশবের স্বপ্নে বোধহয় কোন ধরতাই লাগে না। যে কোন পরিবেশে ভালো লাগার ইচ্ছে লতিয়ে ওঠে। না হলে পুতিগন্ধময় বর্জ্য পদার্থ্য, অনতিদূরে পচনশীল মৃত প্রাণীর শবদেহ, তার মধ্যে টায়ার কেটে দোলনা টানানো হয়। সেখানে অতি অনায়াসে দোল খায় শৈশবের কুঁড়িরা। তাদের পরনে ধুসর মলিন পোষাক। কারো আদুর গা, শুধুই ইজের পড়া। কারওবা সেটুকুও জোটেনি। কোন পায়েই জুতো নেই। এইসব ছেলেমেয়েদের বাড়িতে কিন্তু টিভি আছে আর তাদের ঘরের ছাউনি ওপর ডিস অ্যান্টেনা শোভা পায়। সব মিলিয়ে হঠাৎ মনে হতে পারে এরা বেঁচে আছে কি করে? সত্যি এই প্রশ্ন বড় কঠিন। মানুষ কি করে টিঁকে থাকে? সমস্ত প্রতিকূলতা এড়িয়ে জীবনের নিয়মে জীবন তার রাস্তা খুঁজে নেয়।

বিকেলের দিকে একটা গাড়ি আসে। সেখান থেকে নেমে আসেন এক সন্ন্যাসী। সেই গাড়িতে করে তিনি বেশিরভাগ বাচ্চদের তুলে নেন। বাচ্চাদের পিঠে এখন বইয়ের ব্যাগ। স্থানীয় এক আশ্রম থেকে ওনারা আসেন। সারাদিন কাজের পর বাচ্চাদের অক্ষরজ্ঞান করানোর এক অসম লড়াইয়ের ব্রত নিয়েছেন এই মানুষগুলো। তিন চার ঘন্টার ক্লাস শেষে রাতের খাবার খাইয়ে আবার বাসে করে ফেরত দিয়ে যায়।

সব কিছু ক্ষয়ে যাওয়া, ফেলে দেওয়া, বাতিল জিনিসপত্রের মধ্যে যেন একটু হলেও ভবিষ্যত বলে একটা শব্দ থাকে। সেটা হাল্কা হয়ে লেগে থাকে, যেমন টায়ার কাটা দোলনা টা একা একা দুলে চলে। চারপাশে ভীষণ খারাপ আর নোংরা পরিবেশ থাকা সত্যেও একটা স্বপ্নের বীজ কোথাও যেন উড়ে এসে পরে। তাতে জল হাওয়া লাগে, আবার কোন এক নতুন ভোরের আলো লতিয়ে উঠবে।

ব্লগ এবং বই পাওয়ার ঠিকানাঃ https://souravstory.com

 এখন থেকে ব্লগ সহ অন্যান্য সব খবর এবং বই পাওয়ার ঠিকানাঃ https://souravstory.com