পাড়ায় আজকাল অনেকেই শপিং মলে যায় বাজার করতে। এলাকার বাজার তো আছেই, তবে মলের বাজারে মুদিখানার অনেক কিছু এক ছাদের তলায় পাওয়া যায়, যা পাড়ার দোকানে হয়তো দেখাই যায় না। যেমন নুডলের বিরাট প্যাক বা কর্নফ্লেক্সের এক বিশেষ মিশ্রন কিম্বা হিং-এর একটি পছন্দের ব্রান্ড। এমন কত কি! গোবির মলে আসতে খারাপ লাগে না। বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা। চারিদিকে সুবেশ মানুষজন। যদিও পাড়ার দোকান বাজারে বেশি স্বচ্ছন্দ। এখানে, বাজারের মত বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনা। তাও মাঝে মাঝে পাড়ার দাদা বৌদি বা মাসিমাদের ফরমাইসি কেনাকাটা করতে মলে চলে আসে। শপিংমলে দোকানদার বা সহ-ক্রেতাদের চালচলন আলাদা। এর মধ্যে একজন পাহারাদার কে দেখে গোবির মনে হল, কোথায় যেন দেখেছে। সবাই এক পোষাক পরে ঘুরে বেরায়, তাই আলাদা করে চিহ্নিত করা কঠিন। তবু খানিক চেনা লাগার ছুতোয় কাছাকাছি আসে। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে, “দাদা কি এখানকার?” মাথা থেকে টুপি খুলতেই লোকটির স্বরূপ বেরিয়ে পরে। এ বাবা! এ তো লোনামাটির লোক, তপন। গোবি একে ঢের চেনে, “আরে তুমি এখানে?” তপন বিড়ি খাওয়া কালো দাঁতগুলো বের করে হাসে। “এই এখন এখানে ডিউটি। তা তোমার বাড়ি এদিকে নাকি?” ব্যাস গোবি কে আর পায় কে? দোকান বাজারে একটা নিজস্ব লোক না থাকলে কি সুখ হয়? পাখনা নদীর ধার দিয়ে টানা ক্ষেত রয়েছে। সেই ক্ষেতের আল ধরে আর কিছুটা উত্তরে গেলে তপনদের বাড়ি। সেখানে তপনের বৌ, ছেলে, বুড়ো মা থাকে। গোবির মনে অনেক প্রশ্ন,
- তা তুমি এখানে রোজ আসো?
- এখন এখানে ডিউটি দিচ্ছে, আবার যখন বদলে দেবে চলে যাব। আমাদের এজেন্সির সাথে কন্টাক্ট।
- কতক্ষণ থাকতে হয়?
- তা বারো ঘন্টা তো হয়ই। নাইটও থাকে।
- ও বাবা তাহলে তো কষ্ট আছে। রাত জেগে থাকতে হয়?
- এখানে ঘুমোন যায় না। ছবি উঠে যায়। তখন কৈফেয়ত দিতে হয়। এই যে তোমার সাথে গল্প করছি তারও ছবি উঠছে।
- এ বাবা,মাটি করেছে। আমার জন্যে তুমি বকা খাবে নাকি?
- হওয়া উচিত নয়। তবে কাজ করি আমরা, আর ভুল ধরার অন্য লোক। তাই কি থেকে কিসের ভুল, সে তারাই বলতে পারে।
- তবে আমি যাই। পরে কথা হবে।
- বেশ যাও। আবার এসো।
তপনকে গোবি প্রথম আবিস্কার করেছিল মটরশুঁটির ক্ষেতে। মাথায় তালপাতার টোকা, খেটো করে লুঙ্গি পড়া, গায়ে একটা পুরাণ রঙচটা ফুলহাতা সোয়েটার। খুরপি হাতে একমনে জমি নিড়িয়ে যাচ্ছিল। আর খোলা গলায় গান গাইছিল। ওই দিকচক্রবাল পর্যন্ত ক্ষেত আর ক্ষেত। নানান রঙের সবুজে হলুদে মিশে আছে। দূরে দূরে আরও কেউ কেউ নিজের নিজের জমিতে কাজ করছে। দুয়েকটা দোয়েল ফিঙে উড়ে উড়ে ফড়িং ধরে খাচ্ছিল। আবার ছোট ছোট ঝোপের ভেতর কয়েকটা টুনটুনিতে নেচে বেড়াচ্ছে। সেই নির্লিপ্ত প্রশান্তির মাঝখানে তপনের গান কেমন মন কেমন করে দিচ্ছিল। “লোকে বলে বলেরে, ঘরবাড়ি ভালা নায় আমার...” এক আকাশ শূণ্যতায় ইতস্ততঃ পাখিদের ডাক আর “...কি ঘর বানাইমু আমি শূণ্যের মাঝার...”। গোবি তখন লোনামাটির পথে পাখনার পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে কখন জমিতে এসে পড়েছে। অবাক হয়ে শুনছিল গান। আলের ওপর বসে পড়ে। গান শেষ হয়, তপন আবার অন্য গানে যায়। যতক্ষণ ক্ষেতে রইল, প্রায় ততক্ষণই গান ঘিরে রইল। তপনকেই জিজ্ঞেস করে “তুমি গান শিখেছো কোথায়?” তপন হাসে, মাথা নাড়ায় “এই গান কে শেখায়? ওই আকাশের উপরে যে আছে, সে”। গোবি কতক বোঝে কতক বোঝেনা। এ তো শহুরে গানের ক্লাস না, যে সপ্তায় একদিন মাস্টামশাই বা দিদিমনি আসবেন। আর গান নিয়ে কিছু প্রশ্ন করেনা।
- এগুলো কি ফসল?
তপন হাসে, “আসো, খেয়ে দেখ”। এই বলে নিচু হয়ে কিছু শুঁটি ছিড়ে দেয়। গোবি তো অবাক! এইগুলো বাজারের তরকারিওয়ালার ঝুড়িতে দেখেছে। এমন আলাদা করে ক্ষেতে, এই প্রথম। যাকে যেখানে দেখে অভ্যস্থ, সেখানে না পেলে কেমন মন গুলিয়ে যায়। সেই থেকে তপনের সাথে গোবির সঙ্গত। এই শপিংমলের ঝাঁ চকচকে আবহাওয়াতে সেই মাথায় টোকা পড়া চাষীটিকে কোথায় পাবে? আর গান? কাজ করতে করতে যে সুরে ভরিয়ে রাখত, সেই বা কোথায় গেল। তাই চলে যাবার আগে, তপনের কাছে আবার যায়, জিজ্ঞেস করে,
- তুমি এখানে কি করে গান গাও?
তপন চোখ দিয়ে হাসে। বোধহয় কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না। ওদিকে চ্যানেল মিউজিক বেজে চলেছে। সেখানে মুম্বাই কাঁপানো সুরের দাপট। গান পুরো বোঝা না গেলেও দ্রিম দ্রিম তালের শব্দ পৌঁছে যাচ্ছে। তপন চট করে টুপিটা পড়ে নেয়। চোখের নিমেষে সেই তালপাতার টোকা মাথার অবয়ব হারিয়ে যায়। এই ইউনিফর্ম পড়া মানুষটি অন্য আর পাঁচটা পাহারাদারের মতোই। এক নির্দিষ্ট গেটে নির্দিষ্ট সময় ধরে ডিউটি। সেখানে খোলা মাঠের সুরের দুলুনি, যেন কোন তেপান্তরের ওপাশ থেকে ভেসে আসে। সেখানে স্বপ্নগাছ আছে আর তাকে ঘিরে রঙিন পালকদের ওড়াউড়ি। রূপকথারা ঘর বাঁধে ঝোপেঝাড়ের আবডালে।
- তা তুমি এখানে রোজ আসো?
- এখন এখানে ডিউটি দিচ্ছে, আবার যখন বদলে দেবে চলে যাব। আমাদের এজেন্সির সাথে কন্টাক্ট।
- কতক্ষণ থাকতে হয়?
- তা বারো ঘন্টা তো হয়ই। নাইটও থাকে।
- ও বাবা তাহলে তো কষ্ট আছে। রাত জেগে থাকতে হয়?
- এখানে ঘুমোন যায় না। ছবি উঠে যায়। তখন কৈফেয়ত দিতে হয়। এই যে তোমার সাথে গল্প করছি তারও ছবি উঠছে।
- এ বাবা,মাটি করেছে। আমার জন্যে তুমি বকা খাবে নাকি?
- হওয়া উচিত নয়। তবে কাজ করি আমরা, আর ভুল ধরার অন্য লোক। তাই কি থেকে কিসের ভুল, সে তারাই বলতে পারে।
- তবে আমি যাই। পরে কথা হবে।
- বেশ যাও। আবার এসো।
তপনকে গোবি প্রথম আবিস্কার করেছিল মটরশুঁটির ক্ষেতে। মাথায় তালপাতার টোকা, খেটো করে লুঙ্গি পড়া, গায়ে একটা পুরাণ রঙচটা ফুলহাতা সোয়েটার। খুরপি হাতে একমনে জমি নিড়িয়ে যাচ্ছিল। আর খোলা গলায় গান গাইছিল। ওই দিকচক্রবাল পর্যন্ত ক্ষেত আর ক্ষেত। নানান রঙের সবুজে হলুদে মিশে আছে। দূরে দূরে আরও কেউ কেউ নিজের নিজের জমিতে কাজ করছে। দুয়েকটা দোয়েল ফিঙে উড়ে উড়ে ফড়িং ধরে খাচ্ছিল। আবার ছোট ছোট ঝোপের ভেতর কয়েকটা টুনটুনিতে নেচে বেড়াচ্ছে। সেই নির্লিপ্ত প্রশান্তির মাঝখানে তপনের গান কেমন মন কেমন করে দিচ্ছিল। “লোকে বলে বলেরে, ঘরবাড়ি ভালা নায় আমার...” এক আকাশ শূণ্যতায় ইতস্ততঃ পাখিদের ডাক আর “...কি ঘর বানাইমু আমি শূণ্যের মাঝার...”। গোবি তখন লোনামাটির পথে পাখনার পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে কখন জমিতে এসে পড়েছে। অবাক হয়ে শুনছিল গান। আলের ওপর বসে পড়ে। গান শেষ হয়, তপন আবার অন্য গানে যায়। যতক্ষণ ক্ষেতে রইল, প্রায় ততক্ষণই গান ঘিরে রইল। তপনকেই জিজ্ঞেস করে “তুমি গান শিখেছো কোথায়?” তপন হাসে, মাথা নাড়ায় “এই গান কে শেখায়? ওই আকাশের উপরে যে আছে, সে”। গোবি কতক বোঝে কতক বোঝেনা। এ তো শহুরে গানের ক্লাস না, যে সপ্তায় একদিন মাস্টামশাই বা দিদিমনি আসবেন। আর গান নিয়ে কিছু প্রশ্ন করেনা।
- এগুলো কি ফসল?
তপন হাসে, “আসো, খেয়ে দেখ”। এই বলে নিচু হয়ে কিছু শুঁটি ছিড়ে দেয়। গোবি তো অবাক! এইগুলো বাজারের তরকারিওয়ালার ঝুড়িতে দেখেছে। এমন আলাদা করে ক্ষেতে, এই প্রথম। যাকে যেখানে দেখে অভ্যস্থ, সেখানে না পেলে কেমন মন গুলিয়ে যায়। সেই থেকে তপনের সাথে গোবির সঙ্গত। এই শপিংমলের ঝাঁ চকচকে আবহাওয়াতে সেই মাথায় টোকা পড়া চাষীটিকে কোথায় পাবে? আর গান? কাজ করতে করতে যে সুরে ভরিয়ে রাখত, সেই বা কোথায় গেল। তাই চলে যাবার আগে, তপনের কাছে আবার যায়, জিজ্ঞেস করে,
- তুমি এখানে কি করে গান গাও?
তপন চোখ দিয়ে হাসে। বোধহয় কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না। ওদিকে চ্যানেল মিউজিক বেজে চলেছে। সেখানে মুম্বাই কাঁপানো সুরের দাপট। গান পুরো বোঝা না গেলেও দ্রিম দ্রিম তালের শব্দ পৌঁছে যাচ্ছে। তপন চট করে টুপিটা পড়ে নেয়। চোখের নিমেষে সেই তালপাতার টোকা মাথার অবয়ব হারিয়ে যায়। এই ইউনিফর্ম পড়া মানুষটি অন্য আর পাঁচটা পাহারাদারের মতোই। এক নির্দিষ্ট গেটে নির্দিষ্ট সময় ধরে ডিউটি। সেখানে খোলা মাঠের সুরের দুলুনি, যেন কোন তেপান্তরের ওপাশ থেকে ভেসে আসে। সেখানে স্বপ্নগাছ আছে আর তাকে ঘিরে রঙিন পালকদের ওড়াউড়ি। রূপকথারা ঘর বাঁধে ঝোপেঝাড়ের আবডালে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন