সব মফঃস্বল শহরের মত ডিমপুকুরও তার চরিত্র পাল্টাচ্ছে। একটা দুটো করে পুরোন বসতবাড়ি ভেঙে তৈরী হয়েছে ফ্ল্যাট বাড়ি। প্রথম প্রথম একটু অন্য রকম লাগত। কোথাও যেন ছন্দ পতন হল। আস্তে আস্তে চোখ সয়ে যাচ্ছে। সবুজে ঢাকা পাড়ায় কিছু বনেদী বাড়ি ছিল। না হলে, এক তলা বা দোতলা বাড়ি, সামনে এক চিলতে বাগান। অস্তিত্বে কোন ঔদ্ধত্য নেই। সেই বাড়ি ধুলিস্যাত হয় প্রাসাদের গর্বে। এই সাধারনের মধ্যে হঠাৎ আকাশ চেরা অতিগর্বী তিরিশ চল্লিশ তলার অট্টালিকাগুলো কে অহঙ্কারী দৈত্যর মতো মনে হয়।
খুব বেশিদিন নয়, যখন জমির এমন আকাল হয়নি। ইতস্ততঃ খালি বা পতিত জমি আর ডোবা চোখে পড়ত। সেখানে অযত্নে গড়ে ওঠে আগাছার জঙ্গল। সদ্য কৈশোর ছোঁয়া ছেলে মেয়েদের কাছে, এই রহস্যের অন্তরালটি যেন শঙ্করের চাঁদের পাহাড়। মাথা নিচু করে সেই সব অগভীর আগাছার ছায়াতে লুকোচুরি খেলা। কখন দেখা হয়ে যায় সাপের খোলস বা শিয়ালের গর্ত। ডোবার কচুরিপানার ওপর আলগোছে হেঁটে যাওয়া ডাহুক। কুবো পাখির একটানা ডাক। সব গাছপালা আর তাদের নাম না জানা অকুলিন ফুলের মিশেলে এক অদ্ভুত বন্য গন্ধ তৈরি হয়। স্বপ্নের মধ্যে যেন গাংচিলের ডাক আর ওই গন্ধ দাঁড়িয়ে যায়। কিছু না থাকার মধ্যেই প্রকৃতির অপার ঐশ্বর্য্যের ডালি। প্রাচুর্য্য না থাকলেও কোথাও এতটুকু কৃপণতা নেই। শীতের কালে দু-চারটে বেলেহাঁস সেই কোন বরফ পাহাড় পার করে এই অকিঞ্চিতকর আঙিনাকেও তার অস্তিত্বর ছোঁয়াতে করে তুলত বিশেষ। সন্ধ্যের মুখে শিয়ালরা একজন দুজন করে ডোবার ধার ঘেঁষে দাঁড়াতো। অন্ধকারে তাদের সবুজ চোখগুলো জ্বলছে দেখে ছেলেমেয়েদের সেকি ভয়! নিশ্চই বাঘ ভালুক বা অন্য কোন দৈত্য হবে।
এখনকার পাঁচিল ঘেরা আকাশ ছোঁয়া বাড়িগুলো অতি আলোকিত। রাত হলেও আঁধার নামে না। রহস্যময় বন্য গন্ধ স্মৃতির আড়ালে মুখ ঢেকে ফেলে। ঘোর বাস্তবতায় পিছু হটে জলজ শ্যাওলার ঘ্রাণ, সাপের খোলস, ডাহুকের ক্লান্তিকর ডাক। কি জানি মুখের রক্ত দিয়ে ডিম ফোটাতে পারল কিনা? তবে তাদের যে বাসা বদল হল, সে তো ঠিক। পিছু হটতে লাগল বন বাদার। চেষ্টা করলেও তাদের নিমন্ত্রণ করে আনা যাবে না। মানুষের ওপর অভিমান। সাপেদের, শিয়ালের, বেলে হাঁস বা শামুকেরও। এখানে রাস্তা অনেক চওড়া, শান বাঁধনো সুখ দুঃখ, এমনকি ভালোবাসাও। তবে তার মধ্যে অস্থির মুখ তোলে আবর্জনা। মানুষ পৃথিবী জুড়ে প্রায় দেড়শো কোটি টন বর্জ্য পদার্থ্য প্রসব করছে প্রতি বছর। এই ভার কে নেবে? ডিমপুকুরও তার ব্যতিক্রম নয়। সুন্দর চওড়া রাস্তার দুধারে পাহাড় জমছে আবর্জনার। সেখানে তৈরী হয়েছে এক নতুন প্রানী বৈচিত্র্য। কালো কুৎসিত ময়লার টিলা গুলোতে সাদা ফুলের মত ঘুরে বেড়ায় বক। পুকুরের মাছ ছেড়ে তারা বোধহয়, এখানেই খুঁজে পেয়েছে তাদের বেঁচে থাকার রসদ। আছে দঙ্গল বাঁধা কুকুর, মেঠো ইঁদুর, বিড়াল, কাক, চিল। আর অমৃতের পুত্র কন্যারাও। এক বিরাট সংখ্যার মানুষ এই বর্জ্য পদার্থ্যকে তাদের জীবিকা করেছে। পুরুষ নারী নির্বিশেষে, এই তীব্র গন্ধ মাখা নারকীয় কুন্ডটিই তাদের লীলাক্ষেত্র। রাত্রিদিন এখানেই কাজ করে। খালি হাতে সম্ভবতঃ তারা আলাদা করে জৈব আর অজৈব বর্জ্যকে। এই আবর্জনার পাহাড়ের পাশেই সেই অজৈব জিনিসপত্রের কেনাবেচার দোকান। সেখানেও ব্যাপারি আসে। সওদা করে। রুজির ব্যবস্থা হয়। আর তার পাশটিতেই তাদের বাসস্থান। বাসস্থান না বলে মাথা গোঁজার ছাউনি বলা ভালো। পুরো ঘরটাই ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়ে বানানো। ছেঁড়া প্লাস্টিক দিয়ে ছাদ। ভাঙা আসবাবের টুকরো দিয়ে খাট, উনোন, বাসন। এই মানুষদের ছেলেমেয়েরাও নিজেদের আনন্দের উপকরন খুঁজে নেয় এই আবর্জনার মধ্যেই। ফেলে দেওয়া পুতুল। পেটে ফেঁসে তুলো বেরনো টেডি, সিট ভাঙা সাইকেল। তবে সেই সবকিছু পরম মমতায় তারা আগলে রাখে। হয়তো মানুষ বলেই। শৈশবের স্বপ্নে বোধহয় কোন ধরতাই লাগে না। যে কোন পরিবেশে ভালো লাগার ইচ্ছে লতিয়ে ওঠে। না হলে পুতিগন্ধময় বর্জ্য পদার্থ্য, অনতিদূরে পচনশীল মৃত প্রাণীর শবদেহ, তার মধ্যে টায়ার কেটে দোলনা টানানো হয়। সেখানে অতি অনায়াসে দোল খায় শৈশবের কুঁড়িরা। তাদের পরনে ধুসর মলিন পোষাক। কারো আদুর গা, শুধুই ইজের পড়া। কারওবা সেটুকুও জোটেনি। কোন পায়েই জুতো নেই। এইসব ছেলেমেয়েদের বাড়িতে কিন্তু টিভি আছে আর তাদের ঘরের ছাউনি ওপর ডিস অ্যান্টেনা শোভা পায়। সব মিলিয়ে হঠাৎ মনে হতে পারে এরা বেঁচে আছে কি করে? সত্যি এই প্রশ্ন বড় কঠিন। মানুষ কি করে টিঁকে থাকে? সমস্ত প্রতিকূলতা এড়িয়ে জীবনের নিয়মে জীবন তার রাস্তা খুঁজে নেয়।
বিকেলের দিকে একটা গাড়ি আসে। সেখান থেকে নেমে আসেন এক সন্ন্যাসী। সেই গাড়িতে করে তিনি বেশিরভাগ বাচ্চদের তুলে নেন। বাচ্চাদের পিঠে এখন বইয়ের ব্যাগ। স্থানীয় এক আশ্রম থেকে ওনারা আসেন। সারাদিন কাজের পর বাচ্চাদের অক্ষরজ্ঞান করানোর এক অসম লড়াইয়ের ব্রত নিয়েছেন এই মানুষগুলো। তিন চার ঘন্টার ক্লাস শেষে রাতের খাবার খাইয়ে আবার বাসে করে ফেরত দিয়ে যায়।
সব কিছু ক্ষয়ে যাওয়া, ফেলে দেওয়া, বাতিল জিনিসপত্রের মধ্যে যেন একটু হলেও ভবিষ্যত বলে একটা শব্দ থাকে। সেটা হাল্কা হয়ে লেগে থাকে, যেমন টায়ার কাটা দোলনা টা একা একা দুলে চলে। চারপাশে ভীষণ খারাপ আর নোংরা পরিবেশ থাকা সত্যেও একটা স্বপ্নের বীজ কোথাও যেন উড়ে এসে পরে। তাতে জল হাওয়া লাগে, আবার কোন এক নতুন ভোরের আলো লতিয়ে উঠবে।
খুব বেশিদিন নয়, যখন জমির এমন আকাল হয়নি। ইতস্ততঃ খালি বা পতিত জমি আর ডোবা চোখে পড়ত। সেখানে অযত্নে গড়ে ওঠে আগাছার জঙ্গল। সদ্য কৈশোর ছোঁয়া ছেলে মেয়েদের কাছে, এই রহস্যের অন্তরালটি যেন শঙ্করের চাঁদের পাহাড়। মাথা নিচু করে সেই সব অগভীর আগাছার ছায়াতে লুকোচুরি খেলা। কখন দেখা হয়ে যায় সাপের খোলস বা শিয়ালের গর্ত। ডোবার কচুরিপানার ওপর আলগোছে হেঁটে যাওয়া ডাহুক। কুবো পাখির একটানা ডাক। সব গাছপালা আর তাদের নাম না জানা অকুলিন ফুলের মিশেলে এক অদ্ভুত বন্য গন্ধ তৈরি হয়। স্বপ্নের মধ্যে যেন গাংচিলের ডাক আর ওই গন্ধ দাঁড়িয়ে যায়। কিছু না থাকার মধ্যেই প্রকৃতির অপার ঐশ্বর্য্যের ডালি। প্রাচুর্য্য না থাকলেও কোথাও এতটুকু কৃপণতা নেই। শীতের কালে দু-চারটে বেলেহাঁস সেই কোন বরফ পাহাড় পার করে এই অকিঞ্চিতকর আঙিনাকেও তার অস্তিত্বর ছোঁয়াতে করে তুলত বিশেষ। সন্ধ্যের মুখে শিয়ালরা একজন দুজন করে ডোবার ধার ঘেঁষে দাঁড়াতো। অন্ধকারে তাদের সবুজ চোখগুলো জ্বলছে দেখে ছেলেমেয়েদের সেকি ভয়! নিশ্চই বাঘ ভালুক বা অন্য কোন দৈত্য হবে।
এখনকার পাঁচিল ঘেরা আকাশ ছোঁয়া বাড়িগুলো অতি আলোকিত। রাত হলেও আঁধার নামে না। রহস্যময় বন্য গন্ধ স্মৃতির আড়ালে মুখ ঢেকে ফেলে। ঘোর বাস্তবতায় পিছু হটে জলজ শ্যাওলার ঘ্রাণ, সাপের খোলস, ডাহুকের ক্লান্তিকর ডাক। কি জানি মুখের রক্ত দিয়ে ডিম ফোটাতে পারল কিনা? তবে তাদের যে বাসা বদল হল, সে তো ঠিক। পিছু হটতে লাগল বন বাদার। চেষ্টা করলেও তাদের নিমন্ত্রণ করে আনা যাবে না। মানুষের ওপর অভিমান। সাপেদের, শিয়ালের, বেলে হাঁস বা শামুকেরও। এখানে রাস্তা অনেক চওড়া, শান বাঁধনো সুখ দুঃখ, এমনকি ভালোবাসাও। তবে তার মধ্যে অস্থির মুখ তোলে আবর্জনা। মানুষ পৃথিবী জুড়ে প্রায় দেড়শো কোটি টন বর্জ্য পদার্থ্য প্রসব করছে প্রতি বছর। এই ভার কে নেবে? ডিমপুকুরও তার ব্যতিক্রম নয়। সুন্দর চওড়া রাস্তার দুধারে পাহাড় জমছে আবর্জনার। সেখানে তৈরী হয়েছে এক নতুন প্রানী বৈচিত্র্য। কালো কুৎসিত ময়লার টিলা গুলোতে সাদা ফুলের মত ঘুরে বেড়ায় বক। পুকুরের মাছ ছেড়ে তারা বোধহয়, এখানেই খুঁজে পেয়েছে তাদের বেঁচে থাকার রসদ। আছে দঙ্গল বাঁধা কুকুর, মেঠো ইঁদুর, বিড়াল, কাক, চিল। আর অমৃতের পুত্র কন্যারাও। এক বিরাট সংখ্যার মানুষ এই বর্জ্য পদার্থ্যকে তাদের জীবিকা করেছে। পুরুষ নারী নির্বিশেষে, এই তীব্র গন্ধ মাখা নারকীয় কুন্ডটিই তাদের লীলাক্ষেত্র। রাত্রিদিন এখানেই কাজ করে। খালি হাতে সম্ভবতঃ তারা আলাদা করে জৈব আর অজৈব বর্জ্যকে। এই আবর্জনার পাহাড়ের পাশেই সেই অজৈব জিনিসপত্রের কেনাবেচার দোকান। সেখানেও ব্যাপারি আসে। সওদা করে। রুজির ব্যবস্থা হয়। আর তার পাশটিতেই তাদের বাসস্থান। বাসস্থান না বলে মাথা গোঁজার ছাউনি বলা ভালো। পুরো ঘরটাই ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়ে বানানো। ছেঁড়া প্লাস্টিক দিয়ে ছাদ। ভাঙা আসবাবের টুকরো দিয়ে খাট, উনোন, বাসন। এই মানুষদের ছেলেমেয়েরাও নিজেদের আনন্দের উপকরন খুঁজে নেয় এই আবর্জনার মধ্যেই। ফেলে দেওয়া পুতুল। পেটে ফেঁসে তুলো বেরনো টেডি, সিট ভাঙা সাইকেল। তবে সেই সবকিছু পরম মমতায় তারা আগলে রাখে। হয়তো মানুষ বলেই। শৈশবের স্বপ্নে বোধহয় কোন ধরতাই লাগে না। যে কোন পরিবেশে ভালো লাগার ইচ্ছে লতিয়ে ওঠে। না হলে পুতিগন্ধময় বর্জ্য পদার্থ্য, অনতিদূরে পচনশীল মৃত প্রাণীর শবদেহ, তার মধ্যে টায়ার কেটে দোলনা টানানো হয়। সেখানে অতি অনায়াসে দোল খায় শৈশবের কুঁড়িরা। তাদের পরনে ধুসর মলিন পোষাক। কারো আদুর গা, শুধুই ইজের পড়া। কারওবা সেটুকুও জোটেনি। কোন পায়েই জুতো নেই। এইসব ছেলেমেয়েদের বাড়িতে কিন্তু টিভি আছে আর তাদের ঘরের ছাউনি ওপর ডিস অ্যান্টেনা শোভা পায়। সব মিলিয়ে হঠাৎ মনে হতে পারে এরা বেঁচে আছে কি করে? সত্যি এই প্রশ্ন বড় কঠিন। মানুষ কি করে টিঁকে থাকে? সমস্ত প্রতিকূলতা এড়িয়ে জীবনের নিয়মে জীবন তার রাস্তা খুঁজে নেয়।
বিকেলের দিকে একটা গাড়ি আসে। সেখান থেকে নেমে আসেন এক সন্ন্যাসী। সেই গাড়িতে করে তিনি বেশিরভাগ বাচ্চদের তুলে নেন। বাচ্চাদের পিঠে এখন বইয়ের ব্যাগ। স্থানীয় এক আশ্রম থেকে ওনারা আসেন। সারাদিন কাজের পর বাচ্চাদের অক্ষরজ্ঞান করানোর এক অসম লড়াইয়ের ব্রত নিয়েছেন এই মানুষগুলো। তিন চার ঘন্টার ক্লাস শেষে রাতের খাবার খাইয়ে আবার বাসে করে ফেরত দিয়ে যায়।
সব কিছু ক্ষয়ে যাওয়া, ফেলে দেওয়া, বাতিল জিনিসপত্রের মধ্যে যেন একটু হলেও ভবিষ্যত বলে একটা শব্দ থাকে। সেটা হাল্কা হয়ে লেগে থাকে, যেমন টায়ার কাটা দোলনা টা একা একা দুলে চলে। চারপাশে ভীষণ খারাপ আর নোংরা পরিবেশ থাকা সত্যেও একটা স্বপ্নের বীজ কোথাও যেন উড়ে এসে পরে। তাতে জল হাওয়া লাগে, আবার কোন এক নতুন ভোরের আলো লতিয়ে উঠবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন