চেনা রাস্তা অনেক সময় অচেনা লাগে। কতবার হেঁটে গেছ, কত শত সাইকেল ভ্রমন এমন কি মোটর সাইকেল বা গাড়িতেও। হঠাৎ একদিন সেই রোজকার নেহাত আটপৌরে রাস্তা, যার কিনা আলাদা কোন বিশেষত্ব নেই, তাকেও অচেনা ঠেকে। আর পাঁচটা রাস্তার মতোই, সে সাতে পাঁচে থাকে না। বিপ্লব বা দুর্ভিক্ষ কোনোটাতেই নেই, কোনো কালে কোন রাজপুরুষ এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেছেন বলেও শোনা যায় না। সেই রাস্তা কিনা একদিন কাউকে কিছু না বলে রঙ বদল করে ফেলল। তার গা হয়ে উঠল মসৃণ, তার দুধারে জমে থাকা নোংরার ঢিবিগুলো কে যেন রাতারাতি পরিস্কার করে দিল। এতদিন একটা নেহাত এলেবেলে গাছ রাস্তাটার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, হঠৎ বেমক্কা একগাদা হলুদ ফুল ফুটিয়ে জায়গাটা কেমন আলো করে দিল। সেই আলো কতক গাছে, কতক গাছের তলায়, আর কিছু পথচলতি মানুষের মনের মধ্যেও ঢুকে গেল।
আলোটা ভেতরে নিয়ে গোবিন্দ একটু দিশেহারা হয় পরে। এই অভিজ্ঞতা তার আগে ঘটেনি। চাল ডালের জীবনে, এই আলোর বিড়ম্বনা ঘাড়ে নেওয়াও তো ঝামেলা। হঠাৎ করে যেন নিবিড় করে দেখার চোখ ফুটে যায়। কেন বাবা বেশ তো ইঁট কে ইঁট বা পাটকেল কে ধুসর, এই নিয়ে চলছিল। তারমধ্যে এই গাঢ় চোখে দেখাটা, কোথায় সে ব্যবহার করবে বুঝে উঠতে পারেনা। পাঁচিলের ওপর একটা লাল রঙের বিড়াল ঘুমোচ্ছিল, তা সে রোজই যেমন ঘুমায় আর কি? গোবিন্দ তার দিকে একটু তাকাবার চেষ্টা করে। সে বেচারাও অর্ধনিমীলিত চোখে দৃষ্টি ফেরত দেয়, তা বেড়াল যেমন করে তাকায়। ব্যাস গোবিন্দ ভাবে এ যেন তার ভেতরের আলোর ছটা। বেড়ালও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেল। বেশ সে না হয় মন্ত্রমুগ্ধ হল, তাতে কার কি কাজে লাগবে?
গোবিন্দ কিন্তু বেশ খুশি খুশি হয়। আজ তার মনের ভিতর এক অন্য উপলব্ধি, যা কিনা তাকে আর পাঁচজন থেকে আলাদা করে দিয়েছে। সারা গায়ে রোদ মেখে ঘোরে। মনের ভিতর, মাথার ভিতর একটা আলো দপদপ করে। গালে ঘাড়ে, দুই বাহুতে লেগে থাকে অন্তহীন স্বেদ বিন্দু। তাপিত শরীরের নিঁভাজ ক্লান্তি কোথাও থামার কথা বলে না। বাজার যায়, আনাজওয়ালার কাছে লঙ্কার দর করে। দোকানি শুধু গ্রীবা হেলিয়ে, “দশ টাকা শ”। গোবিন্দ পরের কথা বলার আগে হাঁ করে, কিছুটা বিষ্ময়ে, কিছুটা অভ্যেসে। “ওরে বাবা! এত কেন?” আনাজওয়ালার কম্পহীন নির্লিপ্ত উত্তর। “সমস্ত বোধবুদ্ধি, টাকা পয়সা, সব ওই লঙ্কা গাছের গোড়ায়, এবছর দাম আর কমবে না”। আকাশের আলো চাষীর জমিতে আর বাজারেও তার আঁচ। বাড়ির বাজারটা করে গোবিন্দ দু-চার পয়সা সরায়, আজ দেখছি উল্টে বেরিয়ে না যায়। মুরগি কিনতে যায়, দুশো টাকা। মাছ, ছশো টাকায় ট্যাংরা। ভারি মুশ্কিল হল। সেই হলুদ আলোটা তো কাজ করছে না। দোকানদার তো এই দৃষ্টির আওতায় মোটেই আসছে না। দিব্যি যে যার ইচ্ছে খুশি দাম হাঁকিয়ে চলেছে।
বাজারে আসার সময় যতটা আনন্দ পেয়েছিল ফেরার সময় আর তেমন লাগছে না। নাঃ এটা মোটেই ভালো হল না, যেখানে সেখানে আলো জ্বেলে কোন কাজের কিছু হয়না। দুই হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে বাড়ির পথে। আজ আর রিক্সা করবে না। আর যখন কোন কিছুতেই হাত ছোঁয়ানো গোল না, অন্ততঃ রিক্সা ভাড়াটা সঙ্গে থাকুক। পথে যেতে সেই বাড়িটা পরে। সেও তো রোজ পরে। গোপাদের বাড়ি। তাও ওরা এ পাড়া ছেড়ে চলে গেছে আজ কত বছর হয়ে গেল। তারপর থেকে বাড়িটাই যেন নিভে গিয়েছিল। আজ হঠাৎ কেন চোখে পড়ল? তবে কি এটা আলোর গুণ? গোবিন্দ একটু দাঁড়িয়ে যায়। খুব ছোটবেলায় গোপার সাথে তার খেলাধুলা দিন। সেখানে হাঁড়িকুরি নিয়ে মেয়েলি খেলা। সেই পুতুলের সংসারে গোবিন্দই বাজার করে আনত। ঘাস, লুচিপাতা নামক এক ছোটছোট চকচকে আগাছা, পুরোন পাঁচিল খুঁচিয়ে মোটা মোটা মসের আস্তরন, ইঁটের টুকরো গুড়ো করে লাল লাল মশলা, এমন আরো কত কি! গোবিন্দ বাজার করে আনলে, গোপা রান্না করত। সেই রান্না আরও অনেক কাল্পনিক আত্মীয় স্বজনের সাথে ভাগ করে খেত।
আজ বুকের ভেতর এই আলোটা নিয়ে গোবিন্দ খাবি খায়, আর ভাবে এই বুঝি সামনের গেট খুলে গোপা বেরিয়ে আসবে। ওর হাত থেকে বাজারের ব্যাগ কেড়ে নিয়ে বলবে, “এত দেরি করলে, আমি কখন থেকে বসে আছি। রান্না করব কখন বা খেতে দেব কখন?” সেই ছেলেবেলার খুনসুটি। বড় হয়ে বুঝে উঠবার আগেই গোপারা চলে গেল, বাড়িটাও কেমন অস্পষ্ট হয়ে গেল। পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও আর চোখে পড়ে না। ভীষণ রোদে চতুর্দিক খুব বাস্তব। সেখানে এতটুকু ভুল হবার সংশয় নেই। হলুদ ফুলগুলোই গোলমাল পাকিয়ে দিল। গোবিন্দ জানে ওই বাড়িতে কেউ নেই। গোপারা চলে গিয়েছে সে অনেক বছর আগে। তার আলো মাখা মুখটা খুব কাছে চলে আসে, যে হাত দিয়ে ছোঁয়া যায়। এমন কি ওর চুলের থেকে একটা ঘ্রাণও ভেসে আসে। তা কে অস্বীকার করা তো অসম্ভব। গোবিন্দ আবার বাজারের ব্যাগ হাতে তোলে, মাটির দিকে মুখ করে গোপাদের বাড়ির চৌহদ্দি পার হয়ে যায়। গন্ধটা পিছনে থেকে যায়। একবার মনে হয় পিছনে তাকায়, একবার তাকালে কি হবে? তবু মনে জোর আনে। সোজা এগিয়ে নিজের বাড়ির গেট খোলে। পাঁচিলের ওপর বসে থাকা বিড়ালটা ঠিক একই ভঙ্গীতে তাকিয়ে থাকে। গোবিন্দ অবাক হয়, তবে কি এখনও মুগ্ধতা কাটেনি!
আলোটা ভেতরে নিয়ে গোবিন্দ একটু দিশেহারা হয় পরে। এই অভিজ্ঞতা তার আগে ঘটেনি। চাল ডালের জীবনে, এই আলোর বিড়ম্বনা ঘাড়ে নেওয়াও তো ঝামেলা। হঠাৎ করে যেন নিবিড় করে দেখার চোখ ফুটে যায়। কেন বাবা বেশ তো ইঁট কে ইঁট বা পাটকেল কে ধুসর, এই নিয়ে চলছিল। তারমধ্যে এই গাঢ় চোখে দেখাটা, কোথায় সে ব্যবহার করবে বুঝে উঠতে পারেনা। পাঁচিলের ওপর একটা লাল রঙের বিড়াল ঘুমোচ্ছিল, তা সে রোজই যেমন ঘুমায় আর কি? গোবিন্দ তার দিকে একটু তাকাবার চেষ্টা করে। সে বেচারাও অর্ধনিমীলিত চোখে দৃষ্টি ফেরত দেয়, তা বেড়াল যেমন করে তাকায়। ব্যাস গোবিন্দ ভাবে এ যেন তার ভেতরের আলোর ছটা। বেড়ালও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেল। বেশ সে না হয় মন্ত্রমুগ্ধ হল, তাতে কার কি কাজে লাগবে?
গোবিন্দ কিন্তু বেশ খুশি খুশি হয়। আজ তার মনের ভিতর এক অন্য উপলব্ধি, যা কিনা তাকে আর পাঁচজন থেকে আলাদা করে দিয়েছে। সারা গায়ে রোদ মেখে ঘোরে। মনের ভিতর, মাথার ভিতর একটা আলো দপদপ করে। গালে ঘাড়ে, দুই বাহুতে লেগে থাকে অন্তহীন স্বেদ বিন্দু। তাপিত শরীরের নিঁভাজ ক্লান্তি কোথাও থামার কথা বলে না। বাজার যায়, আনাজওয়ালার কাছে লঙ্কার দর করে। দোকানি শুধু গ্রীবা হেলিয়ে, “দশ টাকা শ”। গোবিন্দ পরের কথা বলার আগে হাঁ করে, কিছুটা বিষ্ময়ে, কিছুটা অভ্যেসে। “ওরে বাবা! এত কেন?” আনাজওয়ালার কম্পহীন নির্লিপ্ত উত্তর। “সমস্ত বোধবুদ্ধি, টাকা পয়সা, সব ওই লঙ্কা গাছের গোড়ায়, এবছর দাম আর কমবে না”। আকাশের আলো চাষীর জমিতে আর বাজারেও তার আঁচ। বাড়ির বাজারটা করে গোবিন্দ দু-চার পয়সা সরায়, আজ দেখছি উল্টে বেরিয়ে না যায়। মুরগি কিনতে যায়, দুশো টাকা। মাছ, ছশো টাকায় ট্যাংরা। ভারি মুশ্কিল হল। সেই হলুদ আলোটা তো কাজ করছে না। দোকানদার তো এই দৃষ্টির আওতায় মোটেই আসছে না। দিব্যি যে যার ইচ্ছে খুশি দাম হাঁকিয়ে চলেছে।
বাজারে আসার সময় যতটা আনন্দ পেয়েছিল ফেরার সময় আর তেমন লাগছে না। নাঃ এটা মোটেই ভালো হল না, যেখানে সেখানে আলো জ্বেলে কোন কাজের কিছু হয়না। দুই হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে বাড়ির পথে। আজ আর রিক্সা করবে না। আর যখন কোন কিছুতেই হাত ছোঁয়ানো গোল না, অন্ততঃ রিক্সা ভাড়াটা সঙ্গে থাকুক। পথে যেতে সেই বাড়িটা পরে। সেও তো রোজ পরে। গোপাদের বাড়ি। তাও ওরা এ পাড়া ছেড়ে চলে গেছে আজ কত বছর হয়ে গেল। তারপর থেকে বাড়িটাই যেন নিভে গিয়েছিল। আজ হঠাৎ কেন চোখে পড়ল? তবে কি এটা আলোর গুণ? গোবিন্দ একটু দাঁড়িয়ে যায়। খুব ছোটবেলায় গোপার সাথে তার খেলাধুলা দিন। সেখানে হাঁড়িকুরি নিয়ে মেয়েলি খেলা। সেই পুতুলের সংসারে গোবিন্দই বাজার করে আনত। ঘাস, লুচিপাতা নামক এক ছোটছোট চকচকে আগাছা, পুরোন পাঁচিল খুঁচিয়ে মোটা মোটা মসের আস্তরন, ইঁটের টুকরো গুড়ো করে লাল লাল মশলা, এমন আরো কত কি! গোবিন্দ বাজার করে আনলে, গোপা রান্না করত। সেই রান্না আরও অনেক কাল্পনিক আত্মীয় স্বজনের সাথে ভাগ করে খেত।
আজ বুকের ভেতর এই আলোটা নিয়ে গোবিন্দ খাবি খায়, আর ভাবে এই বুঝি সামনের গেট খুলে গোপা বেরিয়ে আসবে। ওর হাত থেকে বাজারের ব্যাগ কেড়ে নিয়ে বলবে, “এত দেরি করলে, আমি কখন থেকে বসে আছি। রান্না করব কখন বা খেতে দেব কখন?” সেই ছেলেবেলার খুনসুটি। বড় হয়ে বুঝে উঠবার আগেই গোপারা চলে গেল, বাড়িটাও কেমন অস্পষ্ট হয়ে গেল। পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও আর চোখে পড়ে না। ভীষণ রোদে চতুর্দিক খুব বাস্তব। সেখানে এতটুকু ভুল হবার সংশয় নেই। হলুদ ফুলগুলোই গোলমাল পাকিয়ে দিল। গোবিন্দ জানে ওই বাড়িতে কেউ নেই। গোপারা চলে গিয়েছে সে অনেক বছর আগে। তার আলো মাখা মুখটা খুব কাছে চলে আসে, যে হাত দিয়ে ছোঁয়া যায়। এমন কি ওর চুলের থেকে একটা ঘ্রাণও ভেসে আসে। তা কে অস্বীকার করা তো অসম্ভব। গোবিন্দ আবার বাজারের ব্যাগ হাতে তোলে, মাটির দিকে মুখ করে গোপাদের বাড়ির চৌহদ্দি পার হয়ে যায়। গন্ধটা পিছনে থেকে যায়। একবার মনে হয় পিছনে তাকায়, একবার তাকালে কি হবে? তবু মনে জোর আনে। সোজা এগিয়ে নিজের বাড়ির গেট খোলে। পাঁচিলের ওপর বসে থাকা বিড়ালটা ঠিক একই ভঙ্গীতে তাকিয়ে থাকে। গোবিন্দ অবাক হয়, তবে কি এখনও মুগ্ধতা কাটেনি!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন