বিরাট বিরাট মাঠ আর বড় বড় আম কাঁঠালের ছায়ায় মোড়া, এক স্বপ্নের প্রাঙ্গনের নাম, স্কুল। সেই সময় ভয় করত। হয়তো এখনও করে। স্কুলে পৌঁছানোর নির্দেশ-লিখন প্রায় তিন চার কিলোমিটার দূরে দূরে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার মোড়ে টাঙানো থাকত। আজও আছে। সেই সময় ছিল ভোরের স্কুল। শুরুতে বাবার হাত ধরে এসেছি। তারপর হাত বদল হতে হতে, একা একা সহজ সাইকেলে। কোন এক কুয়াশা মোড়া শীতের সকালে জীবনের এই অধ্যায়টি শুরু হয়েছিল, কারণ তখন জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর ছিল পড়াশুনার বৎসর। বেশিরভাগ শিশুরই স্কুলে যাওয়ার আগে ও পরে এক উত্তেজনা ও অনীহা তৈরী হয়। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ভোরের আলো আধাঁরিতে যখন প্রথম রাস্তার মোড়ে স্কুলের নাম লেখা বড় নির্দেশ-লিখন চোখে পড়ত, বুকের ভেতর ধড়াস করে উঠত এক অজানা আশঙ্কায়। না জানি আজ আবার কি আছে অপেক্ষায়? ক্রমে ক্রমে স্কুল কাছে আসতে থাকে, আর সেই ধুকপুকানিও বাড়তে থাকে।
সেই সময় শীত আসত মরসুমি ফুলের হাত ধরে। স্কুলের প্রধান ফটক পার করার পর, চোখে ধাঁধা লাগানোর মতো বড় বড় ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকায় আলো হয়ে থাকত। এত আলোতেও কিন্তু মনের সেই ধুকপুকানিটা যেত না। শুরুতে সরাসরি মন্দির প্রাঙ্গন। সেখানে শ্রীরামকৃষ্ণের মর্মর মূর্তি। খুব চট করে একটা প্রণাম ঠুকে স্কুলের পথে পারি। বাঁদিকে সদর আপিস, মঙ্কস কোয়ার্টার, টেলারিং, ডাইনে বিবেকানন্দ হল, রাজকুমার পাঠাগার পার হয়ে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চৌহদ্দি। সেখানে এক দৌড় সমান মাঠ। ঊৎসব মাঠ। সেখানে আশৈশবের ধূলো ছড়ানো। লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে চলার সহজ দিনগুলো। একপাশে প্রাক্ প্রাথমিকের ঘর। উঁকি দিতাম। আমাদের থেকেও ছোট ছোট ছেলেগুলো একরাশ পুতুল সাজানো ঘরে। কখনও ঘুমোনোর ক্লাসও করত। চোখ পিটপিট করে ফাঁকিও দিত। যেমন আমরা ধ্যানের ক্লাস ফাঁকি দিতাম। কেউ কেউ ঢুলেও পড়ত।
আশ্রম আর বাহির। দুটো শব্দ কে যেন দেগে দিল। কালো বোর্ড থেকে মনের ভেতর, সবখানে। একটা বড় সংখ্যার অনাথ শিশুদের আশ্রয়, আমাদের স্কুল, সেটা বোধের ভেতর আসতে সময় লেগেছে। কেন স্কুলের নাম ‘বালকাশ্রম’, সেই সময় অনুধাবনের ক্ষমতা ছিলনা। ক্লাস মনিটর যখনই দুষ্ট ছেলেদের শাসন করেছে, বা কোন খেলাধূলা বা প্রতিযোগিতায় অংশ নেবার সময় হয়েছে, আশ্রম আর বাহির দুটো দল তৈরি হয়ে গেছে। অবচেতনেই আমাদের মনে গেঁথে গেল, আমরা বাহিরের ছেলে আর যারা আশ্রমে থাকে তারা ঘরের ছেলে। ওই বয়সেই আশ্রমের ছেলেদের দৃশ্যতঃ তফাত চোখে পড়ত। পোশাক পরিচ্ছেদ, বইখাতা, পেন্সিল সব কিছুই যেন স্বতন্ত্র। অনেক পরে বুঝেছি আমরা স্কুলের জন্য তৈরি হতাম মায়ের আদরে। ওদের স্কুলে আসার পিছনে সেই যত্নমাখা স্নেহময়ীর হাত থাকত না।
প্রথম স্কুল, প্রথম দিন ব্যক্তি মননে ছাপ রেখে যায়। যদিও বালকাশ্রমের আগে আমার আরেকটি স্কুলের অভিজ্ঞতা ছিল। সে গল্পও অতি চমৎকার। যথা সময় সেই ঝুলি খোলা হবে। রামকৃষ্ণ মিশন বালকাশ্রমের প্রথম দিন, মহারাজ অমরশঙ্করের ঘরে। এক অদ্ভুত দর্শন ঘড়ি। দেয়াল জুড়ে একটি শিশুর মুখ। ঘড়ির কাঁটার সাথে তার চোখ নড়ে, সম্ভবতঃ জিভ নড়ে। সৌম্য দর্শন মহারাজ। প্রথম এমন পোশাক পরা কোন সন্ন্যাসীর সাথে আলাপ হল। আমাদের প্রধান শিক্ষক। তাঁর কক্ষটিতে ছড়িয়ে রয়েছে অনেকগুলি স্বামীজীর ছবি। আজও মনে পড়ে, জিজ্ঞেস করেছিলেন, কতগুলো স্বমীজীর ছবি? গুণে বলেছি, কয়েকটি হয়তো বাদ গিয়েছিল, এখন আর মনে নেই। স্থান হল দ্বিতীয় শ্রেণীর খ বিভাগে। দোতলায় উঠে, লম্বা বারান্দা হয়ে শেষ দিকে। প্রথম ঘরটি ক-বিভাগ, দ্বিতীয়টি খ-বিভাগ। সেদিন ভাস্করও ভর্তি হল। ও বসল গ-বিভাগে। ক্লাস তখন শুরু হয়ে গেছিল। আমি নাকি দেবাশিসের পাশে গিয়ে বসেছিলাম।
সেই সময়কার কয়েকজন শিক্ষককে আজও মনে পড়ে। বিনয় স্যার। খালি পায়ে আসতেন। বয়স্ক, ময়লা সাদামাটা ধুতি পাঞ্জাবী। বোর্ড মোছার জন্য, বোধহয় ডাস্টারের শুধু কাপড় ব্যবহার করতেন। বাংলা পড়াতেন। কি পড়িয়েছিলেন মনে নেই। তবে তাঁর মলিন চেহারার নিরাভরণ বিমর্ষ রূপটি কেন জানিনা চিরস্থায়ী হয়ে রইল। আরেকজন বয়স্ক শিক্ষক ছিলেন, বন্ধুস্যার। নাম জানিনা, এই নামেই পরিচিত ছিলেন। তবে বন্ধুত্বের কোন লেশ উপলব্ধি করতে পারিনি। কোন এক অজগর সাপের, আর ডাইনি বুড়ির ঘরে আটকে রাখার ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর অনুশাসনের ভয় দেখাতেন। মাটির কাজের ক্লাস নিয়েছেন। আর প্রার্থনার সময়, কে কে চোখ খুলে রেখেছে, নিজে চোখখুলে সেই নিয়মভাঙা ছেলেদের পাহারা দিতেন।
রামু আর মলয় দুইজন আশ্রম বালকের সাথে ঘনিষ্ঠতা হয়। রামুর গালে একটা বড় পোড়া দাগ ছিল। খুব ছোটবেলার কোন ভয়ঙ্কর দিনের স্মৃতি চিহ্নরূপে। অনেকে ওকে মুখপোড়াও বলত। আমার শুনতে ভালো লাগত না। ও তো ইচ্ছে করে পোড়ায়নি। আশ্রমের ছেলেরা আমাদের চেয়ে অনেক স্বাবলম্বী। বাবা মা ছাড়া একা একা সব করে। প্রতিদিন স্কুলে আসার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে, পড়া তৈরি করে, বিছানা গোছায় আরো কত কি? গরমের সময় মলয় ছোট ছোট আমের কুশি নিয়ে আসত। আর পিছনের বেঞ্চে বসে ব্লেড দিয়ে সেই আম ছোলা হত। ওদের সাথে নুনও থাকত। সেই নুন সহযোগে কষটে আমের স্বাদ স্বর্গীয় অনুভূতি এনে দিত।
নিম্ন বুনিয়াদী বিদ্যালয়ে এক লহমায় যিনি মন জিতে নিয়েছিলেন, তিনি দিন্দা স্যার। এই নামেই পরিচিত ছিলেন, প্রথম নামটি জানা হয়নি। তাঁর গল্পের ক্লাসে মোহ মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। কপালকুন্ডলা গল্পে, সেই যখন নবকুমার কে ফেলে রেখে, নৌকা চলে গেল। নবকুমার হাঁটু জলে দৌড়ে গিয়ে চিৎকার করে, “মাঝি নৌকা ভিড়াও”, কেউ সাড়া দেয় না। দিন্দা স্যারের সেই ডাক আজও মনের ভেতর ডুবে রয়েছে। ছেলেবেলায় প্রথম বঙ্কিম পড়ার নেশায বীজ খুব সন্তর্পনে বপন করে দিয়েছিলেন। পরে দিন্দা স্যারকে স্কুলের নানা নাটক যাত্রায় অভিনয় করতে দেখেছি। মনে মনে তাঁকে দেখার একটা আলাদা আকাঙ্খা তৈরি হয়েছিল।
অঙ্ক করাতেন শ্রীধর স্যার। এছাড়া পরের ক্লাসে বৈদ্যনাথ স্যার, বা বৃত্তি ক্লাসে গাঙ্গুলি স্যারের কাছেও অঙ্ক করেছি। বৈদ্যনাথ স্যারের কাছে তৃতীয় শ্রেণীতে অঙ্ক করলাম। সে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। আঙুলের ফাঁকে পেন্সিল ঘোরানো, ঝুলপি ধরে উল্টোদিকে টান আর মাটিতে বসিয়ে রাখার শাস্তি। আর সেই অমোঘ বাণী, “খেয়ে পারো, না খেয়ে পারো, ঘুমিয়ে পারো, না ঘুমিয়ে পারো, আমার পড়া চাই”। শুরু হল স্কুলের সাথে নানাবিধ ভয়ের অনুসঙ্গ।
আরও একটি ভয় সেই নয় বৎসরের শিশু মনে গেঁথে গেল। একেবার অন্যরকম ভয়। শিক্ষকের নাম করতে চাই না, কারণ তিনি শিক্ষক। ভয়ে হোক বা ভক্তিতে তাঁর পড়ানো বিষয়ে হঠাৎ করেই ভালো নম্বর পেতে শুরু করি। তিনি মাঝে মাঝে বাড়িতেও আসতেন। নিয়মিত গৃহশিক্ষকরূপে নয়, তবে আসতেন। মনে আছে, ছাদে মাদুর পেতে বসে আছি। নানা কথায় আমার প্যান্টের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিতেন আর বলতেন, “তাড়াতাড়ি বড় হয়ে ওঠ, আমরা বন্ধু হয়ে যাবো”। কেমন লজ্জায় ভয়ে ঘেণ্ণায় সিঁটিয়ে যেতাম। সেই সময় কাউকে বলতে পারিনি। অনেক পরে অন্য বন্ধুদের কাছ থেকেও এক অভিজ্ঞতার কথা জানতে পেরেছি।
ক্রমে স্কুলজীবন এক ভয়জীবনে পরিণত হল। প্রায় প্রতিটি শিক্ষক নিজের নিজের মত করে ভীতিপ্রদ। ক্লাসে বহু স্যারই, চক ডাস্টারের সাথে বেত নিয়ে আসতেন। নিয়মানুবর্তিতা শেখাতে গিয়ে কত যে বেতের বাড়ি, কিল চড়, ঘুঁষি আসেপাশে পড়ছে তার লেখাজোকা নেই। নিজের গায়ে না পড়লেও, সেই শব্দে কাঁটা হয়ে থাকতাম সর্বদা। কি জানি, কোন পান থেকে চুন খসে পড়ল?
ছবি আঁকার ক্লাস নিতেন কবিদত্ত স্যার। স্কুল ছেড়ে আসার অনেক পর তাঁর সাথে অন্য ভাবে আলাপ হয়েছিল, একবার বাড়িতেও গেছিলাম। সারা বাড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে তাঁর শিল্পকীর্তি, আমায় অবাক করেছিল। তবে একটু খ্যাপাটে স্যারটি যেন স্কুলের চৌহদ্দিতে বড় বেমানান ছিলেন। তবে মুগ্ধ হতাম ওনার ছবি আঁকার নৈপুণ্য দেখে। কত অনায়াসে বোর্ড জুড়ে ক্লাস ওয়ার্ক দিতেন। তখন রাস্তার দেওয়াল জুড়ে নানা রকম রাজনৈতিক পোস্টার আঁকা হত। এখনকার মতো ফ্লেক্স নির্ভর ছিলনা। স্টেশন সংলগ্ন একটা দেওয়াল জোড়া বড় ছবি ছিল। একদিন আবিস্কার করলাম আমাদের কবিদত্ত স্যার সেই পোস্টারটি আঁকছেন। খুব উৎকৃষ্ট শিল্পসৃষ্টি হয়তো ছিল না, তবে সেই দিনের পর থেকে স্যার সম্বন্ধে একটু খারাপ ধারনা তৈরি হয়ে গেল। এ বাবা! আমাদের স্যার রাজনৈতিক ছবি আঁকেন? পরে বুঝেছি, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত বিশ্বাসের জায়গা। স্কুল-শিক্ষকের গন্ডীর বাইরের একটা পরিচিতি।
এমনি করে নানা মানুষ নানা ভাবে ছাপ ফেলে যেতে লাগলেন, আমাদের জীবনে। নীলমণি স্যার, প্রণয় স্যার, পাল স্যার। গানের স্যার ছিলেন দুজন। অত্যন্ত সুন্দর ভাষায় আমাদের রচনা লিখিয়ে মুখস্থ করাতেন নীলমণি স্যার। বিশেষ করে সেই সময় মুখস্থ করা শরৎকালের কথা হয়তো আজও মগজের কুলুঙ্গীতে পাওয়া যাবে। তবে মজার ব্যাপার হল, কিছুদিন পর, আবিস্কার করলাম যে, ওনার ওই লেখাগুলো উঁচুক্লাসের একটা বই থেকে হুবহু অনুকরণ করা। যে স্যারকে তাঁর জ্ঞান আর ভাষার পরিধির জন্য একটা বিশেষ আসনে বসিয়েছিলাম, খুব সহজেই তিনি হয়ে গেলেন অত্যন্ত সাধারন।
তৃতীয় শেণীর ক্লাস হত, একটা টিনের শেড ওয়ালা টানা বারান্দার বাড়িতে। বৃষ্টির সময়, টিনের চালে এক অলৌকিক শব্দ হত। আজও সেই ঝমঝম শব্দ কানে লেগে আছে। তার এক পাশে ছিল পাল স্যারের ঘর। রোগা শ্যাম বর্ণ মানুষটি কি পড়াতেন মনে নেই, তবে ক্লাসে আসতেন বোগনভেলিয়ার কাঁটাযুক্ত ডাল ভেঙে। এই বোগনভেলিয়া গাছটি ছিল বারান্দার সিঁড়ির পাশে। টিফিনের সময়, দেবাশিসের সাথে এই গাছের নিচে বসে টিফিন খেতাম। একবার মনে আছে, দেবাশিস ওর পায়ে স্কেলের দাগ দেখায়। বাড়িতে বাবার কাছে মার খাওয়ার অভিজ্ঞতা শোনায়। সময়টা কেমন অদ্ভুত ছিল। স্কুলে, বাড়িতে মার খেতে খেতে আমরা মানুষ হবার চেষ্টা করতাম। পরিণতি কতটা ফলপ্রসু হয়েছে, কে জানে? এই তৃতীয় শ্রেণীতে আরেকটি বন্ধুর কথা মনে পড়ে, নাম কৃষ্ণগোপাল। ভালো অঙ্ক করতে পারত। কিন্তু অনেকদিন স্কুলে আসতে পারত না, অসুস্থতার জন্য। ক্রমে পিছিয়ে পড়তে লাগল। বহু অঙ্ক করা বাকি থেকে গেল। ওর কি হয়েছিল বুঝতাম না। একবার এলো, অনেক মোটা আর ফ্যাকাশে হয়ে। তারপর আর এল না। একদিন হঠাৎ স্কুল ছুটি হয়ে গেল, কৃষ্ণ নাকি আর নেই। খুব খারাপ লেগেছে। বেঞ্চে আমার পাশেই বসতো। এখন ফাঁকা হয়ে গেল।
প্রণয় স্যার আমায় নাম দিয়েছিলেন মাংসরুটি। কেন জানিনা, হয়তো টিফিনে মাংস রুটি নিয়ে যাবার জন্য। যদিও সে সুযোগ তখন ছিলনা। বাড়িতে আশ্রিত আত্মীয় নিয়ে অনেক ভীড়, তাদের সামলে মানির পক্ষে রুটি তরকারির বেশি কিছু দেবার সম্ভবনা ক্ষীণ। সব বিভাগের ভালো ছেলেদের নিয়ে একটা আলাদা বিভাগ তৈরি হয়, বৃত্তি পরীক্ষার জন্য। কিভাবে আমি সেই বিভাগে বসার সুযোগ পেয়ে গেলাম। অনেকগুলো নতুন বন্ধুদের সাথে আলাপ হল। পরবর্তিকালে বুঝেছি, এই বন্ধুরা ছিল স্কুলের প্রথম সারির ছাত্র।
স্কুল প্রাঙ্গনে ছিল একটা বড় সিমেন্ট নির্মিত স্লীপ আর লোহার বড় ঘূর্ণী। ক্লাসের ফাঁকে সেই দুটি খেলার অবলম্বন নিয়ে আমাদের হুড়োহুড়ির শেষ ছিলনা। সিমেন্টের স্লীপ চড়ে চড়ে বহু ছেলেদের প্যান্টের পিছনে ফেঁসে গিয়েছিল। আমারও হয়েছিল। তবে সেটা যখন বুঝলাম, তখন থেকে আর চড়তাম না। এক বছরের মধ্যে বারবার বাবার পক্ষে প্যান্টের যোগান দেওয়া সম্ভব ছিলনা। মানি ওই প্যান্টটাই রিফু করে দিয়েছিলেন, সেই বছরটা মেরামত করা প্যান্ট পরেই চালাতে হয়েছিল।
সেই সময় শীত আসত মরসুমি ফুলের হাত ধরে। স্কুলের প্রধান ফটক পার করার পর, চোখে ধাঁধা লাগানোর মতো বড় বড় ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকায় আলো হয়ে থাকত। এত আলোতেও কিন্তু মনের সেই ধুকপুকানিটা যেত না। শুরুতে সরাসরি মন্দির প্রাঙ্গন। সেখানে শ্রীরামকৃষ্ণের মর্মর মূর্তি। খুব চট করে একটা প্রণাম ঠুকে স্কুলের পথে পারি। বাঁদিকে সদর আপিস, মঙ্কস কোয়ার্টার, টেলারিং, ডাইনে বিবেকানন্দ হল, রাজকুমার পাঠাগার পার হয়ে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চৌহদ্দি। সেখানে এক দৌড় সমান মাঠ। ঊৎসব মাঠ। সেখানে আশৈশবের ধূলো ছড়ানো। লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে চলার সহজ দিনগুলো। একপাশে প্রাক্ প্রাথমিকের ঘর। উঁকি দিতাম। আমাদের থেকেও ছোট ছোট ছেলেগুলো একরাশ পুতুল সাজানো ঘরে। কখনও ঘুমোনোর ক্লাসও করত। চোখ পিটপিট করে ফাঁকিও দিত। যেমন আমরা ধ্যানের ক্লাস ফাঁকি দিতাম। কেউ কেউ ঢুলেও পড়ত।
আশ্রম আর বাহির। দুটো শব্দ কে যেন দেগে দিল। কালো বোর্ড থেকে মনের ভেতর, সবখানে। একটা বড় সংখ্যার অনাথ শিশুদের আশ্রয়, আমাদের স্কুল, সেটা বোধের ভেতর আসতে সময় লেগেছে। কেন স্কুলের নাম ‘বালকাশ্রম’, সেই সময় অনুধাবনের ক্ষমতা ছিলনা। ক্লাস মনিটর যখনই দুষ্ট ছেলেদের শাসন করেছে, বা কোন খেলাধূলা বা প্রতিযোগিতায় অংশ নেবার সময় হয়েছে, আশ্রম আর বাহির দুটো দল তৈরি হয়ে গেছে। অবচেতনেই আমাদের মনে গেঁথে গেল, আমরা বাহিরের ছেলে আর যারা আশ্রমে থাকে তারা ঘরের ছেলে। ওই বয়সেই আশ্রমের ছেলেদের দৃশ্যতঃ তফাত চোখে পড়ত। পোশাক পরিচ্ছেদ, বইখাতা, পেন্সিল সব কিছুই যেন স্বতন্ত্র। অনেক পরে বুঝেছি আমরা স্কুলের জন্য তৈরি হতাম মায়ের আদরে। ওদের স্কুলে আসার পিছনে সেই যত্নমাখা স্নেহময়ীর হাত থাকত না।
প্রথম স্কুল, প্রথম দিন ব্যক্তি মননে ছাপ রেখে যায়। যদিও বালকাশ্রমের আগে আমার আরেকটি স্কুলের অভিজ্ঞতা ছিল। সে গল্পও অতি চমৎকার। যথা সময় সেই ঝুলি খোলা হবে। রামকৃষ্ণ মিশন বালকাশ্রমের প্রথম দিন, মহারাজ অমরশঙ্করের ঘরে। এক অদ্ভুত দর্শন ঘড়ি। দেয়াল জুড়ে একটি শিশুর মুখ। ঘড়ির কাঁটার সাথে তার চোখ নড়ে, সম্ভবতঃ জিভ নড়ে। সৌম্য দর্শন মহারাজ। প্রথম এমন পোশাক পরা কোন সন্ন্যাসীর সাথে আলাপ হল। আমাদের প্রধান শিক্ষক। তাঁর কক্ষটিতে ছড়িয়ে রয়েছে অনেকগুলি স্বামীজীর ছবি। আজও মনে পড়ে, জিজ্ঞেস করেছিলেন, কতগুলো স্বমীজীর ছবি? গুণে বলেছি, কয়েকটি হয়তো বাদ গিয়েছিল, এখন আর মনে নেই। স্থান হল দ্বিতীয় শ্রেণীর খ বিভাগে। দোতলায় উঠে, লম্বা বারান্দা হয়ে শেষ দিকে। প্রথম ঘরটি ক-বিভাগ, দ্বিতীয়টি খ-বিভাগ। সেদিন ভাস্করও ভর্তি হল। ও বসল গ-বিভাগে। ক্লাস তখন শুরু হয়ে গেছিল। আমি নাকি দেবাশিসের পাশে গিয়ে বসেছিলাম।
সেই সময়কার কয়েকজন শিক্ষককে আজও মনে পড়ে। বিনয় স্যার। খালি পায়ে আসতেন। বয়স্ক, ময়লা সাদামাটা ধুতি পাঞ্জাবী। বোর্ড মোছার জন্য, বোধহয় ডাস্টারের শুধু কাপড় ব্যবহার করতেন। বাংলা পড়াতেন। কি পড়িয়েছিলেন মনে নেই। তবে তাঁর মলিন চেহারার নিরাভরণ বিমর্ষ রূপটি কেন জানিনা চিরস্থায়ী হয়ে রইল। আরেকজন বয়স্ক শিক্ষক ছিলেন, বন্ধুস্যার। নাম জানিনা, এই নামেই পরিচিত ছিলেন। তবে বন্ধুত্বের কোন লেশ উপলব্ধি করতে পারিনি। কোন এক অজগর সাপের, আর ডাইনি বুড়ির ঘরে আটকে রাখার ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর অনুশাসনের ভয় দেখাতেন। মাটির কাজের ক্লাস নিয়েছেন। আর প্রার্থনার সময়, কে কে চোখ খুলে রেখেছে, নিজে চোখখুলে সেই নিয়মভাঙা ছেলেদের পাহারা দিতেন।
রামু আর মলয় দুইজন আশ্রম বালকের সাথে ঘনিষ্ঠতা হয়। রামুর গালে একটা বড় পোড়া দাগ ছিল। খুব ছোটবেলার কোন ভয়ঙ্কর দিনের স্মৃতি চিহ্নরূপে। অনেকে ওকে মুখপোড়াও বলত। আমার শুনতে ভালো লাগত না। ও তো ইচ্ছে করে পোড়ায়নি। আশ্রমের ছেলেরা আমাদের চেয়ে অনেক স্বাবলম্বী। বাবা মা ছাড়া একা একা সব করে। প্রতিদিন স্কুলে আসার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে, পড়া তৈরি করে, বিছানা গোছায় আরো কত কি? গরমের সময় মলয় ছোট ছোট আমের কুশি নিয়ে আসত। আর পিছনের বেঞ্চে বসে ব্লেড দিয়ে সেই আম ছোলা হত। ওদের সাথে নুনও থাকত। সেই নুন সহযোগে কষটে আমের স্বাদ স্বর্গীয় অনুভূতি এনে দিত।
নিম্ন বুনিয়াদী বিদ্যালয়ে এক লহমায় যিনি মন জিতে নিয়েছিলেন, তিনি দিন্দা স্যার। এই নামেই পরিচিত ছিলেন, প্রথম নামটি জানা হয়নি। তাঁর গল্পের ক্লাসে মোহ মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। কপালকুন্ডলা গল্পে, সেই যখন নবকুমার কে ফেলে রেখে, নৌকা চলে গেল। নবকুমার হাঁটু জলে দৌড়ে গিয়ে চিৎকার করে, “মাঝি নৌকা ভিড়াও”, কেউ সাড়া দেয় না। দিন্দা স্যারের সেই ডাক আজও মনের ভেতর ডুবে রয়েছে। ছেলেবেলায় প্রথম বঙ্কিম পড়ার নেশায বীজ খুব সন্তর্পনে বপন করে দিয়েছিলেন। পরে দিন্দা স্যারকে স্কুলের নানা নাটক যাত্রায় অভিনয় করতে দেখেছি। মনে মনে তাঁকে দেখার একটা আলাদা আকাঙ্খা তৈরি হয়েছিল।
অঙ্ক করাতেন শ্রীধর স্যার। এছাড়া পরের ক্লাসে বৈদ্যনাথ স্যার, বা বৃত্তি ক্লাসে গাঙ্গুলি স্যারের কাছেও অঙ্ক করেছি। বৈদ্যনাথ স্যারের কাছে তৃতীয় শ্রেণীতে অঙ্ক করলাম। সে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। আঙুলের ফাঁকে পেন্সিল ঘোরানো, ঝুলপি ধরে উল্টোদিকে টান আর মাটিতে বসিয়ে রাখার শাস্তি। আর সেই অমোঘ বাণী, “খেয়ে পারো, না খেয়ে পারো, ঘুমিয়ে পারো, না ঘুমিয়ে পারো, আমার পড়া চাই”। শুরু হল স্কুলের সাথে নানাবিধ ভয়ের অনুসঙ্গ।
আরও একটি ভয় সেই নয় বৎসরের শিশু মনে গেঁথে গেল। একেবার অন্যরকম ভয়। শিক্ষকের নাম করতে চাই না, কারণ তিনি শিক্ষক। ভয়ে হোক বা ভক্তিতে তাঁর পড়ানো বিষয়ে হঠাৎ করেই ভালো নম্বর পেতে শুরু করি। তিনি মাঝে মাঝে বাড়িতেও আসতেন। নিয়মিত গৃহশিক্ষকরূপে নয়, তবে আসতেন। মনে আছে, ছাদে মাদুর পেতে বসে আছি। নানা কথায় আমার প্যান্টের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিতেন আর বলতেন, “তাড়াতাড়ি বড় হয়ে ওঠ, আমরা বন্ধু হয়ে যাবো”। কেমন লজ্জায় ভয়ে ঘেণ্ণায় সিঁটিয়ে যেতাম। সেই সময় কাউকে বলতে পারিনি। অনেক পরে অন্য বন্ধুদের কাছ থেকেও এক অভিজ্ঞতার কথা জানতে পেরেছি।
ক্রমে স্কুলজীবন এক ভয়জীবনে পরিণত হল। প্রায় প্রতিটি শিক্ষক নিজের নিজের মত করে ভীতিপ্রদ। ক্লাসে বহু স্যারই, চক ডাস্টারের সাথে বেত নিয়ে আসতেন। নিয়মানুবর্তিতা শেখাতে গিয়ে কত যে বেতের বাড়ি, কিল চড়, ঘুঁষি আসেপাশে পড়ছে তার লেখাজোকা নেই। নিজের গায়ে না পড়লেও, সেই শব্দে কাঁটা হয়ে থাকতাম সর্বদা। কি জানি, কোন পান থেকে চুন খসে পড়ল?
ছবি আঁকার ক্লাস নিতেন কবিদত্ত স্যার। স্কুল ছেড়ে আসার অনেক পর তাঁর সাথে অন্য ভাবে আলাপ হয়েছিল, একবার বাড়িতেও গেছিলাম। সারা বাড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে তাঁর শিল্পকীর্তি, আমায় অবাক করেছিল। তবে একটু খ্যাপাটে স্যারটি যেন স্কুলের চৌহদ্দিতে বড় বেমানান ছিলেন। তবে মুগ্ধ হতাম ওনার ছবি আঁকার নৈপুণ্য দেখে। কত অনায়াসে বোর্ড জুড়ে ক্লাস ওয়ার্ক দিতেন। তখন রাস্তার দেওয়াল জুড়ে নানা রকম রাজনৈতিক পোস্টার আঁকা হত। এখনকার মতো ফ্লেক্স নির্ভর ছিলনা। স্টেশন সংলগ্ন একটা দেওয়াল জোড়া বড় ছবি ছিল। একদিন আবিস্কার করলাম আমাদের কবিদত্ত স্যার সেই পোস্টারটি আঁকছেন। খুব উৎকৃষ্ট শিল্পসৃষ্টি হয়তো ছিল না, তবে সেই দিনের পর থেকে স্যার সম্বন্ধে একটু খারাপ ধারনা তৈরি হয়ে গেল। এ বাবা! আমাদের স্যার রাজনৈতিক ছবি আঁকেন? পরে বুঝেছি, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত বিশ্বাসের জায়গা। স্কুল-শিক্ষকের গন্ডীর বাইরের একটা পরিচিতি।
এমনি করে নানা মানুষ নানা ভাবে ছাপ ফেলে যেতে লাগলেন, আমাদের জীবনে। নীলমণি স্যার, প্রণয় স্যার, পাল স্যার। গানের স্যার ছিলেন দুজন। অত্যন্ত সুন্দর ভাষায় আমাদের রচনা লিখিয়ে মুখস্থ করাতেন নীলমণি স্যার। বিশেষ করে সেই সময় মুখস্থ করা শরৎকালের কথা হয়তো আজও মগজের কুলুঙ্গীতে পাওয়া যাবে। তবে মজার ব্যাপার হল, কিছুদিন পর, আবিস্কার করলাম যে, ওনার ওই লেখাগুলো উঁচুক্লাসের একটা বই থেকে হুবহু অনুকরণ করা। যে স্যারকে তাঁর জ্ঞান আর ভাষার পরিধির জন্য একটা বিশেষ আসনে বসিয়েছিলাম, খুব সহজেই তিনি হয়ে গেলেন অত্যন্ত সাধারন।
তৃতীয় শেণীর ক্লাস হত, একটা টিনের শেড ওয়ালা টানা বারান্দার বাড়িতে। বৃষ্টির সময়, টিনের চালে এক অলৌকিক শব্দ হত। আজও সেই ঝমঝম শব্দ কানে লেগে আছে। তার এক পাশে ছিল পাল স্যারের ঘর। রোগা শ্যাম বর্ণ মানুষটি কি পড়াতেন মনে নেই, তবে ক্লাসে আসতেন বোগনভেলিয়ার কাঁটাযুক্ত ডাল ভেঙে। এই বোগনভেলিয়া গাছটি ছিল বারান্দার সিঁড়ির পাশে। টিফিনের সময়, দেবাশিসের সাথে এই গাছের নিচে বসে টিফিন খেতাম। একবার মনে আছে, দেবাশিস ওর পায়ে স্কেলের দাগ দেখায়। বাড়িতে বাবার কাছে মার খাওয়ার অভিজ্ঞতা শোনায়। সময়টা কেমন অদ্ভুত ছিল। স্কুলে, বাড়িতে মার খেতে খেতে আমরা মানুষ হবার চেষ্টা করতাম। পরিণতি কতটা ফলপ্রসু হয়েছে, কে জানে? এই তৃতীয় শ্রেণীতে আরেকটি বন্ধুর কথা মনে পড়ে, নাম কৃষ্ণগোপাল। ভালো অঙ্ক করতে পারত। কিন্তু অনেকদিন স্কুলে আসতে পারত না, অসুস্থতার জন্য। ক্রমে পিছিয়ে পড়তে লাগল। বহু অঙ্ক করা বাকি থেকে গেল। ওর কি হয়েছিল বুঝতাম না। একবার এলো, অনেক মোটা আর ফ্যাকাশে হয়ে। তারপর আর এল না। একদিন হঠাৎ স্কুল ছুটি হয়ে গেল, কৃষ্ণ নাকি আর নেই। খুব খারাপ লেগেছে। বেঞ্চে আমার পাশেই বসতো। এখন ফাঁকা হয়ে গেল।
প্রণয় স্যার আমায় নাম দিয়েছিলেন মাংসরুটি। কেন জানিনা, হয়তো টিফিনে মাংস রুটি নিয়ে যাবার জন্য। যদিও সে সুযোগ তখন ছিলনা। বাড়িতে আশ্রিত আত্মীয় নিয়ে অনেক ভীড়, তাদের সামলে মানির পক্ষে রুটি তরকারির বেশি কিছু দেবার সম্ভবনা ক্ষীণ। সব বিভাগের ভালো ছেলেদের নিয়ে একটা আলাদা বিভাগ তৈরি হয়, বৃত্তি পরীক্ষার জন্য। কিভাবে আমি সেই বিভাগে বসার সুযোগ পেয়ে গেলাম। অনেকগুলো নতুন বন্ধুদের সাথে আলাপ হল। পরবর্তিকালে বুঝেছি, এই বন্ধুরা ছিল স্কুলের প্রথম সারির ছাত্র।
স্কুল প্রাঙ্গনে ছিল একটা বড় সিমেন্ট নির্মিত স্লীপ আর লোহার বড় ঘূর্ণী। ক্লাসের ফাঁকে সেই দুটি খেলার অবলম্বন নিয়ে আমাদের হুড়োহুড়ির শেষ ছিলনা। সিমেন্টের স্লীপ চড়ে চড়ে বহু ছেলেদের প্যান্টের পিছনে ফেঁসে গিয়েছিল। আমারও হয়েছিল। তবে সেটা যখন বুঝলাম, তখন থেকে আর চড়তাম না। এক বছরের মধ্যে বারবার বাবার পক্ষে প্যান্টের যোগান দেওয়া সম্ভব ছিলনা। মানি ওই প্যান্টটাই রিফু করে দিয়েছিলেন, সেই বছরটা মেরামত করা প্যান্ট পরেই চালাতে হয়েছিল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন