ক্লাস শেষ করে সিঁড়ি দিয়ে নামছেন উমাদি, দুচোখ দিয়ে জলের ধারা। দৃশ্যতঃ বড্ড বেসামাল। টিচার্স রুমে সবাই খুব উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করে, কি হয়েছে? উমাদি বলেন, আজ তিনি ক্লাসে একজন কে শাস্তি দিয়েছেন। সবাই আরও অবাক হয়। শিক্ষক শিক্ষিকারা তো প্রয়োজনে শাস্তি দিতেই পারেন। উমাদি খুব বিষণ্ণ হয়ে বলেন, কাল হয়তো এই ছাত্রটি অনেক বড় হবে, তখন তার আত্মজীবনীতে লিখবে আজকের কথা। সেদিনের কথা ভেবেই তাঁর এই কষ্ট। ঘটনাটি অবেগ তাড়িত সন্দেহ নেই, তবে আরও যে সত্যটা বেরিয়ে আসে, তা হল বিশ্বাস। ছাত্রদের প্রতি বিশ্বাস। এই বিশ্বাসই ছাত্রছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করে, সত্যি সত্যি বড় হয়ে উঠতে। কোনদিন স্কুল জানালার ঘেরাটোপ ছাড়িয়ে, ওই আকাশের রঙিন ঘুড়িরটার মতোই সে উড়াল দেয়, চাল ডালের দৈনন্দিন একঘেয়েমিতার বাইরে গিয়ে মানুষের মতো মানুষ হবার আকাঙ্খায়।
ঘটনাটি শুনেছিলাম শুভেন্দ্রর কাছে। কলকাতার পাঠভবনে পড়ত শুভেন্দ্র। উমাদি ছিলেন সেই পাঠভবনের শ্রদ্ধেয়া প্রতিষ্ঠাত্রী। শুনে বড় ঈর্ষা হয়েছিল, ওর সৌভাগ্য দেখে। এমন শিক্ষকের সান্নিধ্যে সব ছাত্ররা কেন আসেনা? ভালো ছাত্রদের প্রতি স্যারেরা বেশি স্নেহপরায়ণ হন। ব্যক্তিগতভাবে সেই পরিধিতে ঢোকার যোগ্যতা ছিলনা। আমাদের চারপাশটা ছিল অন্য রকম। স্যারেদের আমরা ভয় পেতেই শিখলাম। ক্লাসের বারান্দা থমথমে, টীচার্স রুম থেকে অন্য শিক্ষকরা ছুটে এসে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছেন, কিন্তু পারছেন না। ধুলিশায়ী একটি ছাত্র, আর তার উপর উপর্যুপরি বেত্রাঘাত করে চলেছেন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মশাই। সাদা জামা রক্তাভ হয়ে উঠেছে। কখনও মারের চোটে বেত ভেঙে গেল। এমন দৃশ্য একবার নয়, মাঝে মাঝেই পীড়া দিত। কোন বিশেষ একজন শিক্ষক নন, এমন ছিলেন অনেকেই বা প্রত্যেকেই। আজ সময়ের সরণীতে পিছন ফিরে দুয়েকজনকেই মনে পড়ে, যিনি থার্ড ডিগ্রী ব্যবহার করেন নি।
ভয় গেঁথে গেছিল মনের ভেতর। এত ভয় যে স্কুলে আসার পথে, স্কুলের সাইনবোর্ড দেখলে অন্তরের অন্তঃস্থল পর্যন্ত কেঁপে উঠত। সেদিনের শিক্ষকরা হয়তো বলবেন, এমনভাবে নিয়মানুবর্তিতা শেখানো হয়েছে বলে আজ কর্মক্ষম হয়েছি। হতে পারে, আমরা শিখেছি কি করে এক ছাঁচের কর্মী হতে পারি। তবে শৈশবের দিনগুলো যদি আরেকটু খোলামেলা হত, তবে স্কুল থেকে বড় চাকুরে, বা ডাক্তার ইঞ্জিনীয়ার ছাড়া, কয়েকটি খেলোয়াড়, শিল্পী, কবি বা অন্য কোন উদ্ভাবনী পথে হাঁটার মানুষও তৈরী হত। কলকাতা ময়দানের বড় ক্লাবে খেলেছেন এমন স্বনামধন্য খেলোয়াড় আছেন যিনি আমাদের স্কুলে পড়তেন, তবে দুঃখের বিষয়, তিনি এই স্কুল থেকে মাধ্যমিকের গন্ডী পেরতে পারেননি। হয়তো শিক্ষককুল বলবেন এটা ছাত্রটির দূর্বলতা। তা নয়, স্কুলের শিক্ষা পদ্ধতির দূর্বলতা, তাঁরা প্রতিটি ছাত্রকে তাদের মতো করে বেড়ে ওঠার ব্যবস্থা করতে পারেননি। পেরেছেন কেবল একটিমাত্র নির্দিষ্ট ছাঁচ তৈরি করতে। সেই সাবধানী ছাঁচ থেকে এক ধরনের ছাত্রই প্রস্তুত হয়।
তখন বোধহয় ক্লাস সিক্স, হঠাৎ একদিন শুনলাম আমাদের সহপাঠী সম্রাট, নিজেকে ট্রেনলাইনে সঁপে দিয়েছে। কারণ একজন স্যার তাকে বলেছিলেন, পরেরদিন তিনি ওকে দেখে নেবেন। আজ মনে নেই, ঠিক কি দেখে নেবার কথা হয়েছিল। একটি বারো তেরো বছরের কিশোরের কাছে কিইবা দেখবার থাকে, পড়া সংক্রান্ত বাড়ির-কাজ ছাড়া? সম্রাট সেই স্যারের সম্মুখীণ হবার চেয়ে, চলন্ত ট্রেন কে কম ভীতিপ্রদ মনে করেছিল। আজও সম্রাটের মুখটা চোখের সামনে ভাসে। ছুটিছাটার দিনগুলোতে সম্রাট আমাদের বাড়িতে আসত। অনেক খেলাধুলায় সময় কেটেছে।
বিপ্লব বলে একটি ছেলে ছিল আমাদের ক্লাসে। কোন পড়াতেই তার কোন আগ্রহ থাকতনা। একজন স্যার প্রতিদিন এসে তাকে গালমন্দ করতেন আর বলতেন, তুই বড় হয়ে ট্রেনে বাদাম ফেরি করবি। কারণ স্যারের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তার চেয়ে বেশি যোগ্যতা সে অর্জন করতে পারবে না। অন্যদিকে সেই স্যার শুনেছি সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে গেছেন। এত ঋণাত্মক চিন্তা নিয়ে তিনি নিজেই নিজের শিক্ষকতার জীবনে স্থির থাকতে পারেননি। আজ সেই বিপ্লব কে খুঁজে বের করতে বড় ইচ্ছ হয়। সময়ের খেলাতে সে এখন কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে জানতে পেলে ভালো হত।
ক্লাসে পড়া না পারাতে, এক শিক্ষক একটি ছাত্রকে ডাস্টার দিয়ে মাথায় আঘাত করেন। ছাত্র ঠ্যাঙাতে অনেকই কাঠের ডাস্টার ব্যবহার করতেন। ক্লাস শেষ হয়ে গেছে, টিফিনের সময় সেই স্যার হয়তো অন্য কোন ক্লাস থেকে বেরিয়ে আগের ক্লাসের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ সেই ছেলেটিকে দেখে, ঘরে ঢুকে আরও বার কয়েক ডাস্টার সহযোগে মেরে যান। এমনি করে ছেলেটি দিনের মধ্য প্রায় তিন-চার বার এক কারণের জন্য শাস্তি পায়। শেষে বাড়ির ফেরার পথে রেল স্টেশনে যখন দাঁড়িয়ে, ওকে দেখতে পেয়ে স্যারটি ওইখানেও অজস্র বাইরের মানুষের সামনে আবার প্রহার করেন।
স্যারেদের দাপটের সাথে সাথে, কঠোরতা ছিল নম্বর দেওয়াতেও। অনেক স্যারকে গর্বের সাথে বলতে শুনেছি, আমি ছেলে কে তিরিশ দেব, সেই ছেলে মাধ্যমিকে নব্বই পাবে। তখন সেই কথাগুলোকেই বেদবাক্য মনে হত। আজ মনে হয়, যে ছেলে নব্বই পাবার যোগ্য, তাকে তিরিশ দিয়ে হয়তো স্যার নিজের বিচার শক্তির অবমাননা করেছেন। তিনি অতি সাবধানী হয়ে ছেলেটিকে উপযুক্ত মান দিতে পারেননি। এই জন্য অনেক ছাত্র ক্লাস নাইন পর্যন্ত থেকে, শেষ ক্লাস অন্য স্কুলে পড়ে মাধ্যমিক দিয়েছে। তাতে আমাদের স্কুলের পরিসংখ্যান ঠিক থাকত, গড়ে প্রায় প্রত্যেকে ফার্স্ট ডিভিশন বা স্টারমার্ক। এখন খোঁজ নিলে দেখা যেতে পারে সেই ছেড়ে যাওয়া ছেলেরাও কোন অংশে কম নয়, তারাও জীবনের পরীক্ষাতে সসম্মানে উত্তীর্ণ।
স্কুলের শেষ পরীক্ষা ছিল ‘টেস্ট’ পরীক্ষা। এই পরীক্ষার ফলাফল ছিল একটি বিশেষ ছাঁকনি। ক্লাস ওয়ান থেকে ছাঁকতে ছাঁকতে, শেষের পরীক্ষাতে প্রায় তিনভাগ ছাত্রকে ছেঁটে ফেলা হত, যাতে মাধ্যমিকে স্কুলের অসাধারণ এক পরিসংখ্যান তৈরী হয়। এই ‘টেস্ট’ পরীক্ষাটি যেমন শক্ত হত, তেমনই কড়া, তার খাতা দেখা। ফল প্রকাশের দিন, খুব দুরুদুরু বুকে স্কুল প্রাঙ্গণে লাইন করে দাঁড়িয়ে। শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষক মহাশয় এসে বললেন, এত খারাপ রেজাল্ট হয়েছে, ছাত্রদের সুইসাইড করা উচিত। সামনে পনেরো ষোলো বছরের ছেলেরা, আর তাদের কে প্রধান শিক্ষক এই সম্ভাষণে প্ররোচিত করছেন। সহকারী প্রধান শিক্ষক পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। হয়তো ঘটনার গাম্ভীর্য উপলব্ধি করেছিলেন। তৎক্ষণাৎ অন্য কথা বলে অবস্থার নিয়ন্ত্রণ করেন, না হলে আরও কয়েকজনের নাম সম্রাটের পাশে লেখা হয়ে থাকত।
তুলনা করা হয়তো ঠিক নয়। আরেকটি স্কুলের এমন শেষদিনে তাদের মাস্টার মশাই বলছেনঃ
“প্রস্তুতিটা কেমন হল কমিয়ে দিয়ে নাওয়া খাওয়া?
এতদিনের স্কুল জীবনের এত রকম চাওয়া পাওয়া দেয়া নেয়া
একদিনের এই খাতার পাতায় সম্ভব তার বিচার হওয়া?
এপ্রিলস্য প্রথম দিনে এমনভাবে বোকা হওয়া যায় না সওয়া
গেলেই তবে সহজ হবে জীবন স্রোতে তরী বাওয়া।
পাঠ ভবন ছাড়বে বলে রঙ্গিন মনের ডানায় বুঝি লাগছে হাওয়া?
যতই বল বিদায়, তোমার যাওয়া তো নয় যাওয়া”।
একটা অবিচ্ছেদ্য বাঁধনে ছাত্র ছাত্রীদের বেঁধে রাখেলেন। আমরাও বেঁধে আছি, ভয়ে জড়সড় হয়ে।
ঘটনাটি শুনেছিলাম শুভেন্দ্রর কাছে। কলকাতার পাঠভবনে পড়ত শুভেন্দ্র। উমাদি ছিলেন সেই পাঠভবনের শ্রদ্ধেয়া প্রতিষ্ঠাত্রী। শুনে বড় ঈর্ষা হয়েছিল, ওর সৌভাগ্য দেখে। এমন শিক্ষকের সান্নিধ্যে সব ছাত্ররা কেন আসেনা? ভালো ছাত্রদের প্রতি স্যারেরা বেশি স্নেহপরায়ণ হন। ব্যক্তিগতভাবে সেই পরিধিতে ঢোকার যোগ্যতা ছিলনা। আমাদের চারপাশটা ছিল অন্য রকম। স্যারেদের আমরা ভয় পেতেই শিখলাম। ক্লাসের বারান্দা থমথমে, টীচার্স রুম থেকে অন্য শিক্ষকরা ছুটে এসে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছেন, কিন্তু পারছেন না। ধুলিশায়ী একটি ছাত্র, আর তার উপর উপর্যুপরি বেত্রাঘাত করে চলেছেন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মশাই। সাদা জামা রক্তাভ হয়ে উঠেছে। কখনও মারের চোটে বেত ভেঙে গেল। এমন দৃশ্য একবার নয়, মাঝে মাঝেই পীড়া দিত। কোন বিশেষ একজন শিক্ষক নন, এমন ছিলেন অনেকেই বা প্রত্যেকেই। আজ সময়ের সরণীতে পিছন ফিরে দুয়েকজনকেই মনে পড়ে, যিনি থার্ড ডিগ্রী ব্যবহার করেন নি।
ভয় গেঁথে গেছিল মনের ভেতর। এত ভয় যে স্কুলে আসার পথে, স্কুলের সাইনবোর্ড দেখলে অন্তরের অন্তঃস্থল পর্যন্ত কেঁপে উঠত। সেদিনের শিক্ষকরা হয়তো বলবেন, এমনভাবে নিয়মানুবর্তিতা শেখানো হয়েছে বলে আজ কর্মক্ষম হয়েছি। হতে পারে, আমরা শিখেছি কি করে এক ছাঁচের কর্মী হতে পারি। তবে শৈশবের দিনগুলো যদি আরেকটু খোলামেলা হত, তবে স্কুল থেকে বড় চাকুরে, বা ডাক্তার ইঞ্জিনীয়ার ছাড়া, কয়েকটি খেলোয়াড়, শিল্পী, কবি বা অন্য কোন উদ্ভাবনী পথে হাঁটার মানুষও তৈরী হত। কলকাতা ময়দানের বড় ক্লাবে খেলেছেন এমন স্বনামধন্য খেলোয়াড় আছেন যিনি আমাদের স্কুলে পড়তেন, তবে দুঃখের বিষয়, তিনি এই স্কুল থেকে মাধ্যমিকের গন্ডী পেরতে পারেননি। হয়তো শিক্ষককুল বলবেন এটা ছাত্রটির দূর্বলতা। তা নয়, স্কুলের শিক্ষা পদ্ধতির দূর্বলতা, তাঁরা প্রতিটি ছাত্রকে তাদের মতো করে বেড়ে ওঠার ব্যবস্থা করতে পারেননি। পেরেছেন কেবল একটিমাত্র নির্দিষ্ট ছাঁচ তৈরি করতে। সেই সাবধানী ছাঁচ থেকে এক ধরনের ছাত্রই প্রস্তুত হয়।
তখন বোধহয় ক্লাস সিক্স, হঠাৎ একদিন শুনলাম আমাদের সহপাঠী সম্রাট, নিজেকে ট্রেনলাইনে সঁপে দিয়েছে। কারণ একজন স্যার তাকে বলেছিলেন, পরেরদিন তিনি ওকে দেখে নেবেন। আজ মনে নেই, ঠিক কি দেখে নেবার কথা হয়েছিল। একটি বারো তেরো বছরের কিশোরের কাছে কিইবা দেখবার থাকে, পড়া সংক্রান্ত বাড়ির-কাজ ছাড়া? সম্রাট সেই স্যারের সম্মুখীণ হবার চেয়ে, চলন্ত ট্রেন কে কম ভীতিপ্রদ মনে করেছিল। আজও সম্রাটের মুখটা চোখের সামনে ভাসে। ছুটিছাটার দিনগুলোতে সম্রাট আমাদের বাড়িতে আসত। অনেক খেলাধুলায় সময় কেটেছে।
বিপ্লব বলে একটি ছেলে ছিল আমাদের ক্লাসে। কোন পড়াতেই তার কোন আগ্রহ থাকতনা। একজন স্যার প্রতিদিন এসে তাকে গালমন্দ করতেন আর বলতেন, তুই বড় হয়ে ট্রেনে বাদাম ফেরি করবি। কারণ স্যারের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তার চেয়ে বেশি যোগ্যতা সে অর্জন করতে পারবে না। অন্যদিকে সেই স্যার শুনেছি সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে গেছেন। এত ঋণাত্মক চিন্তা নিয়ে তিনি নিজেই নিজের শিক্ষকতার জীবনে স্থির থাকতে পারেননি। আজ সেই বিপ্লব কে খুঁজে বের করতে বড় ইচ্ছ হয়। সময়ের খেলাতে সে এখন কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে জানতে পেলে ভালো হত।
ক্লাসে পড়া না পারাতে, এক শিক্ষক একটি ছাত্রকে ডাস্টার দিয়ে মাথায় আঘাত করেন। ছাত্র ঠ্যাঙাতে অনেকই কাঠের ডাস্টার ব্যবহার করতেন। ক্লাস শেষ হয়ে গেছে, টিফিনের সময় সেই স্যার হয়তো অন্য কোন ক্লাস থেকে বেরিয়ে আগের ক্লাসের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ সেই ছেলেটিকে দেখে, ঘরে ঢুকে আরও বার কয়েক ডাস্টার সহযোগে মেরে যান। এমনি করে ছেলেটি দিনের মধ্য প্রায় তিন-চার বার এক কারণের জন্য শাস্তি পায়। শেষে বাড়ির ফেরার পথে রেল স্টেশনে যখন দাঁড়িয়ে, ওকে দেখতে পেয়ে স্যারটি ওইখানেও অজস্র বাইরের মানুষের সামনে আবার প্রহার করেন।
স্যারেদের দাপটের সাথে সাথে, কঠোরতা ছিল নম্বর দেওয়াতেও। অনেক স্যারকে গর্বের সাথে বলতে শুনেছি, আমি ছেলে কে তিরিশ দেব, সেই ছেলে মাধ্যমিকে নব্বই পাবে। তখন সেই কথাগুলোকেই বেদবাক্য মনে হত। আজ মনে হয়, যে ছেলে নব্বই পাবার যোগ্য, তাকে তিরিশ দিয়ে হয়তো স্যার নিজের বিচার শক্তির অবমাননা করেছেন। তিনি অতি সাবধানী হয়ে ছেলেটিকে উপযুক্ত মান দিতে পারেননি। এই জন্য অনেক ছাত্র ক্লাস নাইন পর্যন্ত থেকে, শেষ ক্লাস অন্য স্কুলে পড়ে মাধ্যমিক দিয়েছে। তাতে আমাদের স্কুলের পরিসংখ্যান ঠিক থাকত, গড়ে প্রায় প্রত্যেকে ফার্স্ট ডিভিশন বা স্টারমার্ক। এখন খোঁজ নিলে দেখা যেতে পারে সেই ছেড়ে যাওয়া ছেলেরাও কোন অংশে কম নয়, তারাও জীবনের পরীক্ষাতে সসম্মানে উত্তীর্ণ।
স্কুলের শেষ পরীক্ষা ছিল ‘টেস্ট’ পরীক্ষা। এই পরীক্ষার ফলাফল ছিল একটি বিশেষ ছাঁকনি। ক্লাস ওয়ান থেকে ছাঁকতে ছাঁকতে, শেষের পরীক্ষাতে প্রায় তিনভাগ ছাত্রকে ছেঁটে ফেলা হত, যাতে মাধ্যমিকে স্কুলের অসাধারণ এক পরিসংখ্যান তৈরী হয়। এই ‘টেস্ট’ পরীক্ষাটি যেমন শক্ত হত, তেমনই কড়া, তার খাতা দেখা। ফল প্রকাশের দিন, খুব দুরুদুরু বুকে স্কুল প্রাঙ্গণে লাইন করে দাঁড়িয়ে। শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষক মহাশয় এসে বললেন, এত খারাপ রেজাল্ট হয়েছে, ছাত্রদের সুইসাইড করা উচিত। সামনে পনেরো ষোলো বছরের ছেলেরা, আর তাদের কে প্রধান শিক্ষক এই সম্ভাষণে প্ররোচিত করছেন। সহকারী প্রধান শিক্ষক পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। হয়তো ঘটনার গাম্ভীর্য উপলব্ধি করেছিলেন। তৎক্ষণাৎ অন্য কথা বলে অবস্থার নিয়ন্ত্রণ করেন, না হলে আরও কয়েকজনের নাম সম্রাটের পাশে লেখা হয়ে থাকত।
তুলনা করা হয়তো ঠিক নয়। আরেকটি স্কুলের এমন শেষদিনে তাদের মাস্টার মশাই বলছেনঃ
“প্রস্তুতিটা কেমন হল কমিয়ে দিয়ে নাওয়া খাওয়া?
এতদিনের স্কুল জীবনের এত রকম চাওয়া পাওয়া দেয়া নেয়া
একদিনের এই খাতার পাতায় সম্ভব তার বিচার হওয়া?
এপ্রিলস্য প্রথম দিনে এমনভাবে বোকা হওয়া যায় না সওয়া
গেলেই তবে সহজ হবে জীবন স্রোতে তরী বাওয়া।
পাঠ ভবন ছাড়বে বলে রঙ্গিন মনের ডানায় বুঝি লাগছে হাওয়া?
যতই বল বিদায়, তোমার যাওয়া তো নয় যাওয়া”।
একটা অবিচ্ছেদ্য বাঁধনে ছাত্র ছাত্রীদের বেঁধে রাখেলেন। আমরাও বেঁধে আছি, ভয়ে জড়সড় হয়ে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন