বিকেলের মোড়কে জলঙ্গীর জলে পাখিদের ডাক মেশে। পানকৌরিরা আজকের মতো ডানা শুকিয়ে নিচ্ছে, পাড় থেকে হেলে পরা বাবলাগাছের একটা ডালে। তিরের ফলার আকারে বকেদের সারি ঘরপানে চলল। চন্দ্রমাধব দাস তাঁর একতারা গুছোয় উঠবে বলে। গোবিন্দর সাথে তাঁর আজকেই আলাপ। নদীর পাড়ে বসে গল্প হচ্ছিল। খুব অমায়িক গলায় বলে, “আগামী মঙ্গলবার পূর্ণিমা, নতুন ঘর বেঁধেছি। ওইদিন একটু নামগান হবে। সেবা হবে। এসো কিন্তু”। সেই মঙ্গলবার পর্যন্ত থাকা সম্ভব নয়, তাই আগেই গেছে দেখা করতে। ছোট্ট বাড়ি। সুন্দর করে নিকোনো উঠোন। দরমার বেড়া আর করোগোটেড টিন দিয়ে ছাউনি। মাটির উনোন, দুয়েকটা হাঁড়ি কড়াই। ঘরে রাধামাধব। “এর চেয়ে আর বেশি কি লাগে?” বলতে গিয়ে চন্দ্রমাধবের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়। অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে এক মুঠো মুড়ি বাতাসা আর জল। “আমাদের সঞ্চয় করতে নেই। যা জুটেছে তাই দিলাম”। এইসব দিন বা মানুষ খুব দূরবর্তী নন। তবে ক্রমশঃ অপসৃয়মান। একান্ত নিজস্ব দেশজ সম্পদকে ঠেলে দিচ্ছে আরও দূরে।
গোবিন্দর এমনই এলোমেলো ভ্রমন। যেখানে যত বেগার, সেখানে তার ডাক পরে। কোন ছেলেবেলায় অমৃতাদিকে ভালো লাগত। পাড়ায় ডাকসাইটে সুন্দরী থকলে যা হয়, সাইকেল যুবকদের আনাগোনা লেগেই থাকে। অমৃতা গোবিন্দকে প্রশ্রয় দিত। এলেবেলে বা দুধভাত। তাই সই, গোবিন্দর তা পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা। এর তার চিঠি এনে দিত। কখন কখন অমৃতাদিও তাকে দিয়ে কিছুমিছু পাঠাত। তারপর অনেকদিন কেটে গেল। ছেলেবেলার রূপোলি ঝালর কেটে এখন অমৃতাদি শহরে থাকে। স্বামী পুত্র কন্যা নিয়ে ভরপুর সংসার। সেদিন হঠাৎ ডাক আসে। অমৃতাদির বাবার সাথে বাজারে দেখা, “তোকে অমৃতা যেতে বলেছে”।
ঠিকানা জুটিয়ে গোবিন্দ ঠিক হাজির। ওরেবাব্বা! বত্রিশ তলায় অমৃতা থাকে। ওদের দুহাজার স্কোয়ারফুটের ফ্ল্যাট। বারান্দায় দাঁড়ালে মনে হয়, ঝড় হচ্ছে এমন হাওয়া। নিচের দিকে হারিয়ে যাওয়া শহর। কত ছোট! খেলনার বাড়িঘর, গাড়ি, ঘোড়া। তাকালে পা শিরশির করে। কি জানি যদি উড়ে যায়। মেঘগুলো কি জানালার কাছে চলে এল? অমৃতার নতুন বাড়ির সবকিছুই নতুন। আসবাবপত্র, আধুনিক ঝাড়লন্ঠন, নিচে দামি কার্পেট। শোকেসে সাজানো সারি সারি কাচের গ্লাস আর রকমারি পানীয়র বোতল। “তোমার তো মেঘের দেশে বাড়ি গো। খুব স্বপ্ন দেখ নিশ্চই”। কিন্তু অমৃতাকে দেখে আগের মতো লাগল না, কেমন চোখের তলায় কালি পড়েছে। চেহারার জৌলুশও যেন কম। অমৃতা দামি কাচের বাসনে খেতে দেয়, থালায় ভরা কত কি? গোবিন্দও না না করেও, করে না। পরিপাটি খেয়ে নেয়। শেষে একটা বড় প্যাকেট নিয়ে আসে। সেখানে সাজানো অনেক ফল মিষ্টি। “এগুলো কি হবে?” অমৃতাদি বলে, “বাবাকে দিবি। ওঁরা কেউ তো এ বাড়িতে আসেনা। আমারও আর যাওয়া হয়না”। গোবিন্দ কিছু জিগেস করেনা। না বলতেও অনেক কথা বুঝে যায়। সেই ছোটবেলার মতই। যখন চিরকুটগুলো বয়ে এনে দিত। কোনদিন খুলে দেখেনি। কিন্তু বুঝে যেত ভিতরে কি আছে। মানুষের মন খুলে দেখার দরকার হয়না। গোবিন্দ বুঝে যায়। হাসি মুখে বিদায় নেয়। “আবার আসবি কিন্তু। এবার একটা মোবাইল ফোন সাথে রাখবি। দরকারে ডাকা যায়”। গোবিন্দ নেমে আসে, বত্রিশতলা থেকে জমিতে। গোবিন্দ এখন জানে দরকারেই তার ডাক পরে, সেই ছেলেবেলার মত, এখনও এলেবেলে। ঘাড় উঁচু করে দেখার চেষ্টা করে। ব্যালকনিতে অমৃতা দাঁড়িয়ে যতক্ষণ চোখের আড়ালে না চলে যায়।
আসার পথে একটা বস্তি চোখে পড়ে, খালের ওপর দিয়ে একটা ব্রিজ রয়েছে। তার নিচে প্লাস্টিকের আড়াল দিয়ে প্রায় ত্রিশ চল্লিশ ঘর থাকে। খাল দিয়ে বয়ে চলেছে শহরের ক্লেদ আবর্জনা। তার ঢালু জমিতে কালো নোংরা জলের খুব কাছাকাছি উদোম বাচ্চারা খেলছে। আর রাস্তার ধারে বেশকিছু ভ্যান, রিক্সা সার দিয়ে সাজানো। এইখানকার পুরুষদের জীবিকা, মেয়েরা হয়তো অমৃতাদিদের ফ্ল্যাটগুলোতে যায়।
এর বেশকিছুদিন পর আবার এক মেলাতে দেখা হয় চন্দ্রমাধবের সাথে। ইদানিং নাকি এখানেই তাঁর ডেরা। “জলঙ্গীর পাড়ে যাওনা?” উত্তরে হাসিতে ভরিয়ে দেয় চন্দ্রমাধব, “তা রাধামাধব নিয়ে গেলেই যাব। সারা দুনিয়াটাই তো ওনার। যখন যখানে বসি, সেখানেই বসত তৈরি হয়”। গোবিন্দ সবটা বোঝেনা। তবে ভালো লাগে। এই ডেরাটা আগেরটার চেয়েও ছোট। তবে ভিতরে রাধামাধব আর নিরাভরন তৈজস। এই মেলাতে শুধু হাঁড়িকুরি আর চন্দ্রদের গান হচ্ছে না। অনেক আধুনিক জিনিসের পসরা নিয়ে বসেছে দামি দোকান। সেখানে বড় বড় যন্ত্রে বাজছে একালের গান।
অমৃতাদির বাক্সটা ওর বাবাকে দিয়ে, গোবিন্দ খানিক বোকার মতোই জিজ্ঞেস করে, “তুমি ওর ওখানে গেলেই তো পারো। দুঃখ করছিল”। বৃদ্ধ চোখ দিয়ে হেসে বলে, “নিজের মাটি ছুঁয়ে না থাকলে কেমন অপমান লাগে, ও তুই বুঝবি না”। গোবিন্দ বোঝেনা। সত্যিই বোঝেনা। মানুষের তল কোথায়, তালুকইবা কোথায়, কে বলতে পারে?
গোবিন্দর এমনই এলোমেলো ভ্রমন। যেখানে যত বেগার, সেখানে তার ডাক পরে। কোন ছেলেবেলায় অমৃতাদিকে ভালো লাগত। পাড়ায় ডাকসাইটে সুন্দরী থকলে যা হয়, সাইকেল যুবকদের আনাগোনা লেগেই থাকে। অমৃতা গোবিন্দকে প্রশ্রয় দিত। এলেবেলে বা দুধভাত। তাই সই, গোবিন্দর তা পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা। এর তার চিঠি এনে দিত। কখন কখন অমৃতাদিও তাকে দিয়ে কিছুমিছু পাঠাত। তারপর অনেকদিন কেটে গেল। ছেলেবেলার রূপোলি ঝালর কেটে এখন অমৃতাদি শহরে থাকে। স্বামী পুত্র কন্যা নিয়ে ভরপুর সংসার। সেদিন হঠাৎ ডাক আসে। অমৃতাদির বাবার সাথে বাজারে দেখা, “তোকে অমৃতা যেতে বলেছে”।
ঠিকানা জুটিয়ে গোবিন্দ ঠিক হাজির। ওরেবাব্বা! বত্রিশ তলায় অমৃতা থাকে। ওদের দুহাজার স্কোয়ারফুটের ফ্ল্যাট। বারান্দায় দাঁড়ালে মনে হয়, ঝড় হচ্ছে এমন হাওয়া। নিচের দিকে হারিয়ে যাওয়া শহর। কত ছোট! খেলনার বাড়িঘর, গাড়ি, ঘোড়া। তাকালে পা শিরশির করে। কি জানি যদি উড়ে যায়। মেঘগুলো কি জানালার কাছে চলে এল? অমৃতার নতুন বাড়ির সবকিছুই নতুন। আসবাবপত্র, আধুনিক ঝাড়লন্ঠন, নিচে দামি কার্পেট। শোকেসে সাজানো সারি সারি কাচের গ্লাস আর রকমারি পানীয়র বোতল। “তোমার তো মেঘের দেশে বাড়ি গো। খুব স্বপ্ন দেখ নিশ্চই”। কিন্তু অমৃতাকে দেখে আগের মতো লাগল না, কেমন চোখের তলায় কালি পড়েছে। চেহারার জৌলুশও যেন কম। অমৃতা দামি কাচের বাসনে খেতে দেয়, থালায় ভরা কত কি? গোবিন্দও না না করেও, করে না। পরিপাটি খেয়ে নেয়। শেষে একটা বড় প্যাকেট নিয়ে আসে। সেখানে সাজানো অনেক ফল মিষ্টি। “এগুলো কি হবে?” অমৃতাদি বলে, “বাবাকে দিবি। ওঁরা কেউ তো এ বাড়িতে আসেনা। আমারও আর যাওয়া হয়না”। গোবিন্দ কিছু জিগেস করেনা। না বলতেও অনেক কথা বুঝে যায়। সেই ছোটবেলার মতই। যখন চিরকুটগুলো বয়ে এনে দিত। কোনদিন খুলে দেখেনি। কিন্তু বুঝে যেত ভিতরে কি আছে। মানুষের মন খুলে দেখার দরকার হয়না। গোবিন্দ বুঝে যায়। হাসি মুখে বিদায় নেয়। “আবার আসবি কিন্তু। এবার একটা মোবাইল ফোন সাথে রাখবি। দরকারে ডাকা যায়”। গোবিন্দ নেমে আসে, বত্রিশতলা থেকে জমিতে। গোবিন্দ এখন জানে দরকারেই তার ডাক পরে, সেই ছেলেবেলার মত, এখনও এলেবেলে। ঘাড় উঁচু করে দেখার চেষ্টা করে। ব্যালকনিতে অমৃতা দাঁড়িয়ে যতক্ষণ চোখের আড়ালে না চলে যায়।
আসার পথে একটা বস্তি চোখে পড়ে, খালের ওপর দিয়ে একটা ব্রিজ রয়েছে। তার নিচে প্লাস্টিকের আড়াল দিয়ে প্রায় ত্রিশ চল্লিশ ঘর থাকে। খাল দিয়ে বয়ে চলেছে শহরের ক্লেদ আবর্জনা। তার ঢালু জমিতে কালো নোংরা জলের খুব কাছাকাছি উদোম বাচ্চারা খেলছে। আর রাস্তার ধারে বেশকিছু ভ্যান, রিক্সা সার দিয়ে সাজানো। এইখানকার পুরুষদের জীবিকা, মেয়েরা হয়তো অমৃতাদিদের ফ্ল্যাটগুলোতে যায়।
এর বেশকিছুদিন পর আবার এক মেলাতে দেখা হয় চন্দ্রমাধবের সাথে। ইদানিং নাকি এখানেই তাঁর ডেরা। “জলঙ্গীর পাড়ে যাওনা?” উত্তরে হাসিতে ভরিয়ে দেয় চন্দ্রমাধব, “তা রাধামাধব নিয়ে গেলেই যাব। সারা দুনিয়াটাই তো ওনার। যখন যখানে বসি, সেখানেই বসত তৈরি হয়”। গোবিন্দ সবটা বোঝেনা। তবে ভালো লাগে। এই ডেরাটা আগেরটার চেয়েও ছোট। তবে ভিতরে রাধামাধব আর নিরাভরন তৈজস। এই মেলাতে শুধু হাঁড়িকুরি আর চন্দ্রদের গান হচ্ছে না। অনেক আধুনিক জিনিসের পসরা নিয়ে বসেছে দামি দোকান। সেখানে বড় বড় যন্ত্রে বাজছে একালের গান।
অমৃতাদির বাক্সটা ওর বাবাকে দিয়ে, গোবিন্দ খানিক বোকার মতোই জিজ্ঞেস করে, “তুমি ওর ওখানে গেলেই তো পারো। দুঃখ করছিল”। বৃদ্ধ চোখ দিয়ে হেসে বলে, “নিজের মাটি ছুঁয়ে না থাকলে কেমন অপমান লাগে, ও তুই বুঝবি না”। গোবিন্দ বোঝেনা। সত্যিই বোঝেনা। মানুষের তল কোথায়, তালুকইবা কোথায়, কে বলতে পারে?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন