বৃহস্পতিবার, ২ জুন, ২০১৬

শব্দ-গন্ধ

ডিমপুকুরে ভোর হতো কারাখানার ভোঁ-র সাথে। মানুষ ঘড়ি মিলিয়ে নিত। ওদিকে ফাঁড়িতেও একটা পেতলের পেটা ঘন্টা ঝোলানো। প্রতি ঘন্টায় একজন সেপাই গুণে গুণে হাতুড়ি মারত। অনেক দূর থেকে সেই ঘন্টা ধ্বনি ভেসে আসে। সকালের অপিসের ভাতের ঘ্রাণের সাথে জুড়ে থাকে ভোঁ-এর শব্দ। আর শীতের রাতে, আপাতঃ নিঝুম হওয়া পল্লীর বাতাসে রাত এগারোটা বা বারোটার লম্বা ঘন্টা ধ্বনি নীরবতাকেই যেন প্রলম্বিত করত। জুটমিলের ছিল বাড়বাড়ন্ত। তার শ্রমিক আর অফিসারদের ভিন্ন ভিন্ন আবাসন আর পল্লী। তাদের চরিত্র একেক রকম। ক্রমশঃ ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ল চট শিল্প। একের পর এক মিলগুলো তে তালা লাগল। দিশেহারা মানুষ কেউ কেউ ছোটখাটো দোকান দিল। মুদি বা সাইকেল সারানো। কেউ দেশে ফিরে গেল, যাদের ফেরার উপায় নেই তারা গলায় দড়িও দিল। অপরাধ বাড়তে থাকে। রাজনৈতিক নেতারা ডামাডোলের সুযোগ নিয়ে নেমে পড়ল ঘোলা জলে মাছ ধরতে।

গোবিনের এসব ছোটবেলার কথা। এখনও বেশ মনে পড়ে, দূর্গাপূজার চেয়ে বিশ্বকর্মায় জাঁক ছিল বেশি। প্রতিটি কারখানার গেট খুলে দেওয়া হতো। বড়দের হাত ধরে অপার বিষ্ময়ে সেই বিশাল বিশাল গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করত। কত রকম চোখ-স্থির হওয়া যন্ত্র। কনভেয়ার বেল্ট। স্পিনিং মিল। এক আধটা লোহা আর রাসায়নিক কারখানাও ছিল। তাদের বড় বড় হপার, সেখান থেকে লম্বা বেল্টের লাইন চলে গেছে এক শেড থেকে অন্য শেডে। এর মধ্যে কোথাও প্যান্ডেল খাটিয়ে বিশ্বকর্মার অধিষ্ঠান। দুই দিক দিয়ে হয়তো বড় বড় বুলডোজারের ধাতব হাত দিয়ে মালা ঝোলানো আছে। পাশাপাশি কোম্পানিতে রেষারেষি চলত, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিয়ে। কেউ টালিগঞ্জ থেকে শিল্পী নিয়ে এলেন তো অন্যজন ছুটলেন বম্বে। আর ছিল আকাশ ভরা ঘুড়ি। মন্ডপ সজ্জাতেও অনেক ঘুড়ি। সবকিছু ছাপিয়ে থাকত শ্রমজীবি মানুষের ঢল। যে যার সাধ্য মতো সাজায় নিজেকে, তারপর উৎসবের হাত ধরতে বাইরে আসে। সেখানে না আছে বিত্তের দম্ভ, না আছে প্রচুর্য্যের প্রতিযোগিতা। তাই, খুশি-ই এই উৎসব উদযাপনের প্রাথমিক শর্ত ।

সময় দাঁড়িয়ে থাকে না। সে চলতে থাকে তার নিজের তাগিদে। এক সময়কার এলাকা কাঁপানো মস্তান হঠাৎ করে বিয়ে করে আনল, এক শিক্ষিত সুন্দরী কে। তারপরে বদল ঘটল ধীরে ধীরে। এখন সে অটো চালায়, আর স্ত্রী স্কুলে পড়ান। পুরোণ কারখানার কঙ্কাল দাঁড়িয়ে থাকে পাশে তৈরি হয় নতুন উদ্যোগ। বিস্কুটের কারখানা, পাইপের কারখানা। সেখানে আবার নতুন করে শুরু হল কর্মযজ্ঞ। সকাল থেকে ঠিকা শ্রমিকদের লাইন পড়ে এই নতুন কারখানাগুলোর গেটে। একজন দুজন করে ফেরিওয়ালারা বসতে আরম্ভ করে। কেউ ছাতুর সরবত, কেউ চা, কেউ কচুরি, ডিম সেদ্ধ।

রাসায়নিক কারখানা থেকে মাঝে মাঝে ক্লোরিন গ্যাস বেরিয়ে আসত। তার উত্তেজক ঘ্রাণে নিঃশ্বাস নেওয়া ছিল ভারি মুশ্কিল। গাছের পাতাদের রাতারাতি হলুদ হয়ে মাটিতে ঝরে থাকতে দেখা গেছে। আসেপাশের জঙ্গল থেকে দিনের বেলাতেই শিয়ালরা বেরিয়ে এসে ডোবার জলে ডুবে রেহাই পেতে চাইছে। চিরশত্রু কুকুরদেরও এক দশা। তখন আর কেউ কাউকে তেড়ে যাচ্ছেনা। প্রাণের দায়ে একই সাথে ডোবার জলে। পরিবেশ বাঁচাতে মানুষ একত্রিত হয়েছে। আন্দোলন হয়, হৈচৈ, লেখালেখি। কয়েকদিন একটু ঠিক থাকে, তারপর আবার কোন একদিন টের পাওয়া যায় প্রবল গ্যাস ছেড়েছে। একদিন সেই কারখানা বন্ধ হয়ে গেল। বন্ধ কারখানার গেটে একটা ত্রিপল খাটিয়ে কিছু শ্রমিকরা অবস্থান ধর্মঘট করতেন। শুরু শুরুতে তাঁদের মাইক বাজত, দুয়েকজন ছোট বা মাঝারি নেতা এসে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। যাতায়াতের পথে রোজ দেখা হত। ওরা বসে আছেন, কখনও সময় কাটাতে তাস খেলছেন। ক্রমে সেই মঞ্চে বাতি দেবার লোক কমতে থাকে। ত্রিপল আর খুঁটিগুলোও কেউ কখন যেন খুলে নিয়ে গেছে, জানাও গেল না। আর সেই চাকরি হারানো মানুষগুলো কি করল? তাদের অন্নের কি ব্যবস্থা হল, তা কেউ জানল না। এখন আর সেই ক্লান্ত স্বপ্নহীন মুখগুলো মনেও পড়েনা। এক সময়ের সেই ত্রাস জাগানো কারখানাটিও হাড় পাঁজর বার করে জরাজীর্ণ অবস্থায়, এখন নেহাত ইতিহাস পাহারা দিচ্ছে। সেই গন্ধের স্মৃতি নিয়ে আর বসে নেই কেউ।

হাল আমলে, বিস্কুটের কারখানা থেকে নানা রকম সুখাদ্যের গন্ধ ভেসে আসে। পাশ দিয়ে যাবার সময় প্রত্যেকেই টের পায়। নতুন যারা এ পথে যায়, একটু অবাক হয়ে তাকায়। সেই গন্ধে কোথাও নিরন্ন মানুষের কথা লেখা থেকে যায়। গন্ধের পরিমাপে কারো গা গুলোয়, কেউবা আনন্দ পায়, কারো মন খারাপ হয়ে যায়। সময় এসে মানুষের হাত ধরে, কিছুটা পথ নিয়ে যায়। তারপর আবার অন্যকারো দিন শুরু হয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

ব্লগ এবং বই পাওয়ার ঠিকানাঃ https://souravstory.com

 এখন থেকে ব্লগ সহ অন্যান্য সব খবর এবং বই পাওয়ার ঠিকানাঃ https://souravstory.com