গাঢ় সবুজের মাঝখানে একটা হলুদ প্রজাপতি উড়ছিল। তার ডানায় ডানায় লেগেছিল সময়।
পাইনের ডাল থেকে গোপন আঁধারে একটা মাকড়শা সুতো ছাড়তে ছাড়তে নামছে। হাল্কা
দোল খেয়ে পরের পাতায় পা দেবে। এডাল থেকে পরের ডালে সময় ছুঁয়ে চলে যায়। তার
সময়কে কি ভাবে ধরা যায়? একটা ভালো ঘড়ি হাতে দিয়ে বল, এই ধরলাম। একটা কাচের
বালি-ঘড়িতে একমুঠো বালি ভরে বললাম, এই ধরেছি। সব কেমন আঙুলের ফাঁক দিয়ে মসৃণ
ভাবে গলে যায়, টের পাওয়াও যায় না। আগের মুহুর্তের প্রজাপতি এই সময়ে অন্য কোন
ব্যপ্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল, তাকে ধরা যাবে না আর কোন দিন। ছোট্ট গুবরে পোকার জন্য যেমন
সত্যি, অতিকায় নীল তিমির জন্যেও তাই। আবার পৃথিবীর বাইরে থেকে দেখতে পেলে গোটা
গ্রহ উপগ্রহ সহ সৌরজগতের জন্য সত্যি। এখনকার ক্ষণের সঙ্গে পরের ক্ষণের কোন মিল
নেই। সে চলে গেছে ধরা ছোঁযার বাইরে। আর কোনদিন আসবে না।
রোজ রোজ চেনা মুখটাকে অয়নায় দেখতে দেখতে, হঠাৎ করেই একদিন মনে হয়, এই
মানুষটা তো আগে ছিল না। বা সেদিনের সেই মানুষটি কোথায় হারিয়ে গেল? এই তো এখানেই
ছিল! এমন করে কোথায় চলে গেল যে আর তাকে খুঁজেই পেল না কেউ। প্রজাপতি উড়ে
গেলে বাতাসে একটা দাগ থেকে যায়। শামুক হেঁটে গেলেও তার চিহ্ন রেখে যায়। মানুষের
হেঁটে চলা পথে পথে দাগ থাকে। সে দাগে কাটাকুটি হয়, আবার অন্য দাগে হারিয়ে যায়।
কোথাও কোথাও সে দাগ হয়তো স্থায়ী হয়ে যায়। হয়তো তার কাছের মানুষটির মনে ভেতর।
সেই ভালোবাসায় দাগ ধরে রাখে। যাত্রাকাল ছোট হোক বা লম্বা, সেই গতিপথের আসেপাশে
যাঁরা এলেন, তাঁরা ছুঁয়ে গেলেন। প্রত্যেকে প্রত্যেকের মতো। সবই যে ভালো তা নয়, কারো
মনে গভীর ভাবে গেঁথে গেল কোন ব্যথার দাগ। সেই নিয়েই চলল তার রথ।
বহুদিনের চেনা পথে হেঁটেও তাই মনে হয় এ রাস্তায় তো আগে আসিনি। কি করে হবে? আগে
এলেও সময়টা তো অন্য। এখনকার সময় দিয়ে সেইদিনের সময় কে ধরতে গেলে বিড়ম্বনা
তো হবেই। এই রহস্যটাই বেঁচে থাকার উৎসমুখ, যার ঝর্ণায় অঞ্জলি পেতে রসদ সংগ্রহ করি।
হঠাৎ করেই মনে হয়ে সামনের বাঁক ঘুরলেই হয়তো দেখব, সেই পরিচিত মানুষটা, মুখে
একরাশ হাসির নিমন্ত্রণ সাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। যদিও জানি একটা অনেক বড় ‘নেই’ শব্দে
ঢেকে গেছে চতুর্দিক। তবু ভুল করে বিশ্বাস করতে ভালো লাগে, কষ্টও হয়।
প্রথম শৈশবে, যে শিশুর হাত ধরে নতুন সময়ের সরনী তৈরী হয়, তার প্রতিটি অনন্দময় ক্ষণে
মনে কি অবিশ্রাম দাগ কাটে। যেন কোন নিপুণ শিল্পীর সঙ্গীতের স্বরলিপি, ভালো লাগার
সঙ্কেত। রেণু রেণু হয়ে জুড়ে থাকে প্রতিটি প্রাণ। যে সময়টা প্রত্যেকের একসাথে, সেই
সময়ের মূল্যে এই অভিজ্ঞতা শাশ্বত। তারপর ধীরে ধীরে কারো কারো সময় ফুরিয়ে আসে,
তাকে মঞ্চ থেকে বিদায় নিতে হয়। পরের দৃশ্য অন্য কুশীলব আসবেন। গত দৃশ্যের
হাততালির রেশ মিলাতে বেশিক্ষণ লাগে না। এভাবেই দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে আমাদের চলন।
কাউকেই বলে দিতে হয় না। কেমন যেন আগে থেকে তৈরি করা সংলাপ ক্রম। কাকে কি
বলতে হবে, যেন শেখানোই আছে। সেই পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক।
এর মধ্যে সময়ের মাইলফলক চিহ্নিত করে রাখি, তারিখের মাধ্যমে। পুরোন সময়ের
স্পর্শসুখে শুধু সেই সংখ্যা ছুঁয়ে থাকি। জন্মদিন, মৃত্যুদিন, বিয়ের দিন, এমন কত কি?
ব্যক্তিসত্তার পরিধির বাইরেও এমন অজস্র তারিখ। স্বধীনতা দিবস, শ্রম দিবস, মায়ের দিন,
বাবার দিন, ভালোবাসার দিন এমন আরো। বছরের প্রতিটা দিন-ই হয়তো বিশেষ কোন কারনে
দাগিয়ে দেওয়া যায়। কারন মানুষ বড় ভয় পায়, প্রতি নিয়ত হাত থেকে খসে পড়া সময়ের
বালি। ধরতে না পারার এক চরম অপ্রাপ্তি। তাই মাইলফলক রাখি, কোন মতে তাকে ঘরের
শো-কেসে সাজাবার জন্য। ভুল করেও যেন ভুলে না যাই, ওই সময়ে আমরা এই পথে চলেছি,
হাত হাত রেখেছি। আবার হরিয়ে গেছি সময়ের নিয়মেই।
পাইনের ডাল থেকে গোপন আঁধারে একটা মাকড়শা সুতো ছাড়তে ছাড়তে নামছে। হাল্কা
দোল খেয়ে পরের পাতায় পা দেবে। এডাল থেকে পরের ডালে সময় ছুঁয়ে চলে যায়। তার
সময়কে কি ভাবে ধরা যায়? একটা ভালো ঘড়ি হাতে দিয়ে বল, এই ধরলাম। একটা কাচের
বালি-ঘড়িতে একমুঠো বালি ভরে বললাম, এই ধরেছি। সব কেমন আঙুলের ফাঁক দিয়ে মসৃণ
ভাবে গলে যায়, টের পাওয়াও যায় না। আগের মুহুর্তের প্রজাপতি এই সময়ে অন্য কোন
ব্যপ্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল, তাকে ধরা যাবে না আর কোন দিন। ছোট্ট গুবরে পোকার জন্য যেমন
সত্যি, অতিকায় নীল তিমির জন্যেও তাই। আবার পৃথিবীর বাইরে থেকে দেখতে পেলে গোটা
গ্রহ উপগ্রহ সহ সৌরজগতের জন্য সত্যি। এখনকার ক্ষণের সঙ্গে পরের ক্ষণের কোন মিল
নেই। সে চলে গেছে ধরা ছোঁযার বাইরে। আর কোনদিন আসবে না।
রোজ রোজ চেনা মুখটাকে অয়নায় দেখতে দেখতে, হঠাৎ করেই একদিন মনে হয়, এই
মানুষটা তো আগে ছিল না। বা সেদিনের সেই মানুষটি কোথায় হারিয়ে গেল? এই তো এখানেই
ছিল! এমন করে কোথায় চলে গেল যে আর তাকে খুঁজেই পেল না কেউ। প্রজাপতি উড়ে
গেলে বাতাসে একটা দাগ থেকে যায়। শামুক হেঁটে গেলেও তার চিহ্ন রেখে যায়। মানুষের
হেঁটে চলা পথে পথে দাগ থাকে। সে দাগে কাটাকুটি হয়, আবার অন্য দাগে হারিয়ে যায়।
কোথাও কোথাও সে দাগ হয়তো স্থায়ী হয়ে যায়। হয়তো তার কাছের মানুষটির মনে ভেতর।
সেই ভালোবাসায় দাগ ধরে রাখে। যাত্রাকাল ছোট হোক বা লম্বা, সেই গতিপথের আসেপাশে
যাঁরা এলেন, তাঁরা ছুঁয়ে গেলেন। প্রত্যেকে প্রত্যেকের মতো। সবই যে ভালো তা নয়, কারো
মনে গভীর ভাবে গেঁথে গেল কোন ব্যথার দাগ। সেই নিয়েই চলল তার রথ।
বহুদিনের চেনা পথে হেঁটেও তাই মনে হয় এ রাস্তায় তো আগে আসিনি। কি করে হবে? আগে
এলেও সময়টা তো অন্য। এখনকার সময় দিয়ে সেইদিনের সময় কে ধরতে গেলে বিড়ম্বনা
তো হবেই। এই রহস্যটাই বেঁচে থাকার উৎসমুখ, যার ঝর্ণায় অঞ্জলি পেতে রসদ সংগ্রহ করি।
হঠাৎ করেই মনে হয়ে সামনের বাঁক ঘুরলেই হয়তো দেখব, সেই পরিচিত মানুষটা, মুখে
একরাশ হাসির নিমন্ত্রণ সাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। যদিও জানি একটা অনেক বড় ‘নেই’ শব্দে
ঢেকে গেছে চতুর্দিক। তবু ভুল করে বিশ্বাস করতে ভালো লাগে, কষ্টও হয়।
প্রথম শৈশবে, যে শিশুর হাত ধরে নতুন সময়ের সরনী তৈরী হয়, তার প্রতিটি অনন্দময় ক্ষণে
মনে কি অবিশ্রাম দাগ কাটে। যেন কোন নিপুণ শিল্পীর সঙ্গীতের স্বরলিপি, ভালো লাগার
সঙ্কেত। রেণু রেণু হয়ে জুড়ে থাকে প্রতিটি প্রাণ। যে সময়টা প্রত্যেকের একসাথে, সেই
সময়ের মূল্যে এই অভিজ্ঞতা শাশ্বত। তারপর ধীরে ধীরে কারো কারো সময় ফুরিয়ে আসে,
তাকে মঞ্চ থেকে বিদায় নিতে হয়। পরের দৃশ্য অন্য কুশীলব আসবেন। গত দৃশ্যের
হাততালির রেশ মিলাতে বেশিক্ষণ লাগে না। এভাবেই দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে আমাদের চলন।
কাউকেই বলে দিতে হয় না। কেমন যেন আগে থেকে তৈরি করা সংলাপ ক্রম। কাকে কি
বলতে হবে, যেন শেখানোই আছে। সেই পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক।
এর মধ্যে সময়ের মাইলফলক চিহ্নিত করে রাখি, তারিখের মাধ্যমে। পুরোন সময়ের
স্পর্শসুখে শুধু সেই সংখ্যা ছুঁয়ে থাকি। জন্মদিন, মৃত্যুদিন, বিয়ের দিন, এমন কত কি?
ব্যক্তিসত্তার পরিধির বাইরেও এমন অজস্র তারিখ। স্বধীনতা দিবস, শ্রম দিবস, মায়ের দিন,
বাবার দিন, ভালোবাসার দিন এমন আরো। বছরের প্রতিটা দিন-ই হয়তো বিশেষ কোন কারনে
দাগিয়ে দেওয়া যায়। কারন মানুষ বড় ভয় পায়, প্রতি নিয়ত হাত থেকে খসে পড়া সময়ের
বালি। ধরতে না পারার এক চরম অপ্রাপ্তি। তাই মাইলফলক রাখি, কোন মতে তাকে ঘরের
শো-কেসে সাজাবার জন্য। ভুল করেও যেন ভুলে না যাই, ওই সময়ে আমরা এই পথে চলেছি,
হাত হাত রেখেছি। আবার হরিয়ে গেছি সময়ের নিয়মেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন