শুক্রবার, ১৭ জুন, ২০১৬

রাজকুমার

রাজকুমার বাজারে কুলির কাজ করে। চেহারা বেশ ধারালো। বোঝা যায় গায়ের রঙ কোন কালে ফর্সা ছিল, রোদজলে পুড়ে এখন তামাটে। নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রমের জন্য হাত পা পেশল এবং সুগঠিত। গোবিন রাজকুমার কে দেখে আর অবাক হয়। ভোর বেলা বাজারের ধার ঘেঁষে আলু বোঝাই লরি এসে দাঁড়ায়। বড় বড় আলুর বস্তা লরির ওপর থেকে নামিয়ে দেয়। রাজকুমার সেই আলু বোঝাই বস্তাগুলো অবলীলায় পিঠে নিয়ে নেয়। একটা ফাঁকা বস্তা চাদরের মতন মাথা থেকে পিঠের ওপর পাতা থাকে। তার ওপর অমন ভারি ভারি বস্তাগুলো চাপিয়ে, কেমন হেঁটে চলে যায়। একটু কুঁজো হয়ে, দুই হাত মাথার ওপর দিয়ে বস্তার দুই কোণা আঁকড়িয়ে ধরা। এটুকুই অবলম্বন। তারপর বাজারের ভেতরে বিভিন্ন দোকানদারদের কাছে গিয়ে নামিয়ে রাখে। রাজকুমারকে ভোরবেলা মাল টানা ছাড়া অন্য সময়ে বড় একটা দেখতে পায়না গোবিন। মনে মনে ভাবে, এ নিশ্চই কোন শাপগ্রস্ত সত্যিকারের রাজকুমার। খুব গোপনে ছদ্মবেশে এখানে রয়েছে। না হলে এমন চেহারা আর আভিজাত্য নিয়ে, সে কি করে এমন সামান্য কাজ করে! রাজকুমার কে সে বড় একটা কারো সাথে গল্পগাছা করতে দেখে না। একমনে নিজের কাজ করে যায়। এক বস্তার পর দুই বস্তা, দুই থেকে তিন, এমন চলতেই থাকে।

গোবিনের বেয়াড়া ইচ্ছা, এই রাজকুমারের বাড়ি যাবে। বা ওর রাজপ্রাসাদ দেখবে। একবার পুষ্পহাটিতে গিয়ে এমন একটা বড় প্রাসাদের মতো বাড়ি দেখেছিল। বাড়ির পাঁচিল জায়গায় জায়গায় ধসে গেছে। রঙ উঠে গিয়ে দাঁত বেরোন চেহারা। বেশ কয়েকটা বট অশথ্থের চারা এদিক ওদিক দিয়ে মাথা উঁচিয়ে রয়েছে। বাড়ির হাওদার মধ্যে এক বিশাল পুকুর। সেখানে একটা অল্প বয়সী মেয়ে বাসন মাজছিল। কে যেন বলেছিল, এদের পূর্বপুরুষ এই অঞ্চলের জমিদার ছিল। এখন অবস্থার বিপাকে পরে খাবি খাচ্ছে। শরিকি ভাগাভাগিতে বাড়ি মেরামত আর হয়না। যার কোথাও যাবার নেই, তারাই কোন মতে এই পোড়ো বাড়িতে ভুতের মতো টিঁকে আছে। গোবিন ভাবে, সে হিসেবে মেয়েটি রাজকুমারী। শাপগ্রস্ত হয়ে বাসন মেজে দিন গুজরান করছে। তেমনই দৃঢ় বিশ্বাস, বাজারের রাজকুমারেরও এমন কোন ইতিহাস আছে। কিন্তু রাজকুমারের সাথে আলাপ করার সুযোগ হয় না। সে কাজের বাইরে কারো সাথেই কথা বলেনা। হাসি ঠাট্টাও করেনা। কি করে যে কাছে ঘেঁষবে, বুঝে উঠতে পারে না।

সেদিন তেমন কাজ ছিল না, তাল ঠুকে রাজকুমারের পিছু নিল। একটু ভয় ভয় করছিল, যদি জানতে পেরে যায়! তবে রাজকুমারের একমনে রাস্তা চলা, তার কাজের মতোই। কোনদিকে তাকায় না। সোজা গড়গড়িয়ে হেঁটে যায়। এ রাস্তা সে রাস্তা পাড় হল। পথে জল ছিল, বাঁ ধারে পুকুর এল, ডান ধারে পুরোণ পোস্টাপিস, বাজার, স্কুল। এমন কতশত পথ ঘুরে শেষমেষ একটা পেল্লায় বাড়ির সামনে এসে থামল। সে বাড়ি যেমন মস্ত তার সদরও তেমন দশাসই। লোহার গেট পার হয়ে, ভেতরে বড় বড় গাছে ছাওয়া মোরাম বিছোনো রাস্তা। সেই নুড়ি পাড়িয়ে রাজকুমার গড়গড় করে ভেতর পানে হেঁটে চলে যায়। এই অবধি এসে, গোবিন থমকায়। এবার কি করবে? গেট দিয়ে, কি বলে ঢুকবে? একটু দূরে দাঁড়িয়ে সাতপাঁচ ভাবছিল, এমন সময় মাথায় পাগড়ি বাঁধা একটা লোক এল, হাতে তার তেল দিয়ে পাকানো একটা বাঁশের লাঠি। বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। “আপনাকে ভেতরে তলব করেছে”। গোবিন এবারে সত্যি ভয় পেয়ে গেল। তবে কি ধরা পরে গেল? আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে, “কে?” লোকটা জবাব দেয় না। ইঙ্গিতে সামনের দিকে দেখায়। গোবিন এবার মহা ফাঁপরে পড়ল। কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। একবার ভাবে, টেনে দৌড় লাগাবে কি না? তারপর মনে হয়, কোন দোষ তো করেনি, শুধুশুধু পালাতে যাবে কেন? একটু আড়ষ্ট হয়েই ভেতরে ঢুকলো। বাইরে থেকে যতটা মনে হয়েছিল, বাড়িটা তার চেয়েও বড়। বিশাল বাগান। বাঁ দিকে একটা টানা বারান্দা সহ দুচালার লম্বা বাড়ি। অনেকটা কাছারি বাড়ির আদল। বাগানের ডান দিকে বিরাট প্রাসাদ। বোধহয় দোতলা। তবে উচ্চতায় অনায়াসে এখনকার চারতলার সমান। বড় বড় থাম আর নক্সাকাটা জাফরি। বাড়ি পুরোণ তবে ভাঙাচোরা নয়। বোঝা যাচ্ছে নিয়মিত পরিচর্যা হয়। আর সোজা তাকালে চোখে পড়ে সতত প্রবহবান গঙ্গা। সুন্দর বাঁধানো ঘাট। বড় বড় গাছেরা ছায়া নিয়ে ঘিরে রেখেছে। গোবিনের মন ভরে গেল। ইচ্ছে করছিল ওই ঘাটে গিয়ে দু দন্ড বসে। এদিকে পাগড়ি পড়া লোকটা, ওকে নিয়ে ওই ঘাটের কাছেই নিয়ে এল। সেখানে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পড়ে এক বৃদ্ধ বসে আছেন। গোবিন কে রেখে সে আবার ফিরে গেল।

বৃদ্ধ গৌরবর্ণ। সাদা পোশাকে সৌম্যসুন্দর লাগছে। ইশারায় বসতে বলে। গোবিন মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে পরে।  বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করেন,
- বাড়ি কোথায়?
- ডিমপুকুর।
- তা এখানে কি মনে করে?
- মানে, এই বেড়াতে বেড়াতে চলে এসেছি।
- ও বাবা এটা বেড়ানোর জায়গা জানতুম না তো?
- বেড়ানোর কি জায়গা লাগে না কি? আমার যে রাস্তায় যেতে ভালো লাগে, সেখানেই বেড়ানো হয়।
- বাঃ বেড়ে বললে তো।

দুচার কথায়, গোবিনের আড় ভাঙতে থাকে। এবার নিজে থেকে জিজ্ঞেস করে,

- এটা কি আপনার বাড়ি?
- না না, এখানে আমি চাকরি করি।
- এটা কি অফিস নাকি?
- না অফিস নয়, তবে মহিলাদের পুনর্বাসন কেন্দ্র। আমি এর সম্পাদক।
- এটা রাজবাড়ি নয়?
- রাজবাড়ি? তুমি তাই ভেবেছো নাকি? তবে এটা এক ধনীব্যক্তির সম্পত্তি ছিল ঠিক। এখন হাত বদল হয়ে ট্রাস্টের হাতে। হোমটা ট্রাস্ট-ই চালায়।
- খুব সুন্দর জায়গাটা। একটু ঘুরে দেখতে পারি?
- যা ঘোরার তো ঘুরেই ফেলেছো। এদিকটাতেই আসাযাওয়া করা যায়, ওই বাড়ির দিকে নিষেধ আছে।
- কেন?
- কেন আবার বললাম না, মেয়েদের হোম। পুরুষ মানুষদের ঢুকতে দেওয়া হয়না। তাই তোমায় গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভেতরে নিয়ে এলাম। এতোগুলো মেয়ে এখানে থাকে, বুঝতেই পারছো। আমারও যাতায়াত ওই আপিস ঘর পর্যন্ত
- ও, আসলে আমি জানতাম না। তবে আমি একজন পুরুষ কে একটু আগে ঢুকতে দেখলাম।
কথাবর্তায় একটু সহজ হয় গোবিন। এবার মূল উদ্দেশ্যটা সিদ্ধ করতে চায়। যদি রাজকুমারের ব্যাপারটা জানতে পারে।
- তুমি রাজকুমারের কথা বলছ? ও তো হোমে রান্না করে।
- রান্না করে?
- হ্যাঁ, সকালের রান্নাটা মাসি করে দিয়ে চলে যায়। বিকেলেরটা ও করবে। আবার কখনও মাসি ছুটিছাটা নিলে, তখন দুবেলাই করে।
- ও এটা ওর বাড়ি নয়?
- তুমি রাজকুমারকে চেন?
- না তেমন ভাবে নয়, তবে বাজারে দেখেছি।
- বাড়ি যে ওর কোথায়, ও নিজেই জানে না। খুব ছোটবেলায় এক বন্যায় ভেসে যাওয়া দলে ওকে পাওয়া যায়। মা বাপের খোঁজ মেলেনি। ওই দলের দুয়েকটা মেয়ের সাথে এই হোমে আসে। সেই থেকে রয়ে গেছে। তবে মেয়েদের হোমে তো জায়গা হবে না। আমার সাথে থাকে। ট্রাস্টের খাতায় নাম তুলে দিয়েছি। মাইনে পায়, কাজ করে। কখনও মালি, কখনও রাধুনী, কখনও দারোয়ান, ইস্ত্রিওয়ালা, এই সব।

গোবিনের হিসেব গুলিয়ে গেল। রাজপ্রাসাদ যে কোথাও একটা রয়েছে, তার সম্ভাবনা রয়েই গেল। রাজকুমার কোন একদিন নিশ্চই তার হদিশ পেয়ে যাবে। তখন গোবিনেরও শান্তি হবে। ঘাটের সিঁড়িতে বসে অস্তগামী সূর্য্যের রংবাহার দেখতে থাকে। নদীর জল, সোনালী হয়ে ওঠে। স্রোত ক্রমান্বয়ে দৌড়ে চলেছে। সেই দৌড়ে সামিল সবাই। বাড়ি ঘর, এই হোমের সমস্ত মেয়েরা, এই বৃদ্ধ সম্পাদক সবাই। শুধু রাজকুমার একা। তার বাড়ি, ঘুম, রাজ্যপাট কোনটাই নেই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

ব্লগ এবং বই পাওয়ার ঠিকানাঃ https://souravstory.com

 এখন থেকে ব্লগ সহ অন্যান্য সব খবর এবং বই পাওয়ার ঠিকানাঃ https://souravstory.com