মঙ্গলবার, ১২ জুলাই, ২০১৬

পথকথা-৭

মোর্তাজা সাহেব সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে স্থির হয়ে বসে। প্রত্যেকের শুভ্র পোশাক, গোছানো দাড়ি, মাথায় সুদৃশ তাজ। প্লেন নড়তে আরম্ভ করলে হাত জড়ো করে দুচার ছত্র আয়াৎ কবুল করিয়ে নেয়। হাজার মাইল আকাশ পথে পারি, কতরকম বিপদ আপদ হতে পারে। মুর্শেদ ছাড়া কার ওপরইবা এমন অখন্ড ভরসা রাখা যায়? কিন্তু একটু আধটু নড়ে উড়োজাহাজ আবার স্থির হয়ে গেল। কাপ্তেন সাহেব ঘোষনা করলেন, জমি-কর্মচারীর বিশেষ সাহায্য লাগবে। তাদের কাছে সাহায্য চাওয়া হয়েছে। আশা করা যায়, আগামী পনেরো মিনিটে সাহায্য এসে পৌঁছবে, তারপর ছাড়বে। সকলে বেশ আবার একটু ঢিলা হয়ে বসে। এমনি করে পনের মিনিট, তিরিশ মিনিট, এক ঘন্টা পার হয়ে গেল অবস্থার কোন পরিবর্তন হল না। সকলে উশখুশ করছে। আর কোন ঘোষনাও নেই। বিমান সেবিকাদেরও আর ধারে কাছে দেখা যাচ্ছে না। মোর্তাজা সাহেবের পাশের সিটগুলো ফাঁকা ছিল। তিনি সেইগুলো জুড়ে শুয়ে পড়লেন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে মৃদু মৃদু নাসিকাধ্বনি জানান দিল, তাঁর নিদ্রা অবতীর্ণ। তা হবে নাই বা কেন? রাত তো কম হল না। এই আন্তর্জাতিক উড়ানগুলো রাত করেই ছাড়ে। আজ তো আরো দেরী করছে, ওদিকে পরের বিমান ছুটে না যায়। বিসমিল্লা বলে হজের পথে পাড়ি দিয়েছেন। দলের অন্য সদস্যরা নতুন। শুধু তাই নয়, বাকিরা এই প্রথমবার বিমানে চড়ছেন। মোর্তাজা সাহেব আগে একবার ঘুরে এসেছেন। তাই প্রত্যাশিত ভাবে তিনিই এই দলের নায়ক। প্রায় আরো আধ ঘন্টা কাটল। হঠাৎ মোর্তাজা সাহেব ধরমড় করে উঠে বসলেন, হয়তো স্বপ্ন টপ্ন কিছু। জেগে উঠে দেখেন, গাড়ি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। এবারে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তার কারণ স্বাভাবিক, ওদিকে দুবাই থেকে সৌদি যাবার নির্দিষ্ট প্লেন ছেড়ে যাবে। শুনে বাকিরা অত্যন্ত দুশ্চিন্তায় পড়েন। তবে কি হবে? মোর্তাজা সাহেব আশ্বস্ত করেন, বিমান কোম্পানি পরের ফ্লাইটের ব্যবস্থা করে দেবে, চিন্তার কিছু নেই। নিজের সিটে উঠে বসে, সুন্দর মেহেদি করা দাড়ি আঁচড়িয়ে নিলেন। তারপর সাগরেদকে হুকুম করেন খানা লাগাতে। সাগরেদ এদিক ওদিক তাকায়, প্লেনে কি এমন ট্রেনের মতো নিয়ম আছে? যদি কোন গুনাহ হয়ে যায়। মোর্তাজা সাহেবের ক্ষুধা পেয়েছে, তাই তিনি খেতেই চান। আবশেষে টিফিন কৌটের ঢাকনা খোলা হল। উফ, অপরূপ বিরিয়ানির খোশবাই সারা উড়োজাহাজ ছড়িয়ে পড়ল। সাথে রেজালার হাল্কা আভিজত্য মাখা ঘ্রাণ। খাওয়ার মধ্যেই বাইরে ব্যস্ততা বোঝা যায়। প্লেনটিকে ঠেলে পিছনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। খুব বেশি নয়, হাত দশেক পিছোনোর পর, জমির গাড়িগুলো রানওয়ে ছেড়ে চলে গেল। এবার উড়োজাহাজ গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। নির্দিষ্ট সময়ের দু-ঘন্টা পর, প্রায় সাড়ে আটশো যাত্রীকে নিয়ে টুক করে আকাশে উঠে পড়ে। মোর্তাজা সাহেবের দল আরেকবার সমস্বরে বিসমিল্লাহ ই-রহমান ই-রহিম বলে দোয়া প্রার্থনা করে। নিচে পড়ে থাকে রাতের কলকাতা শহর, ঝপঝপ করে আলোগুলো ছোট হতে হতে মিলিয়ে যায়। মেঘেদের পেরিয়ে আরো ওপরে উঠে যায় ধাতব পাখি।   
 
একটা অপরিণত আলো ভাঙচুর হয়ে ছুঁয়ে যায়। কিছুতে বোঝা যায়না তার অস্তিত্বর অবয়ব কোথায়। চারিদিক কেমন সুসজ্জিত, বেশ লাগে! কেমন সুচারু পোশাক, পাটভাঙা স্যুট, মার্জিত নেকটাই! এসবের মধ্যেও একটা হেরে যাওয়া, ভয় পাওয়া অনুভব, যেখানে পা ফেলার অবলম্বন নেই। নেই মানে কখনওই যেন ছিলনা। এই যে এত আলো, এসব বানিয়ে তোলা আলেয়া। এত উচ্চকিত জগতে নিজের রঙের উদ্ভাস কতোটা এবং কোথায়? খুব সচেতন ভাবে ঠেলে দেওয়া মুহুর্ত, তারা সব কোথায় গেল? কখনও কাউকে জায়গা ছেড়ে দেওয়া হয়না। অধিকার করতে একটু লড়াই। যেমন সেকালের ক্রীতদাসেরা করেছে। মানুষে-মানুষে বা মানুষে-জানোয়ারে। কালের চলন বড় নির্মম। সেই ক্ষণগুলো অনায়াসে ঝুলি থেকে বার করে আনে। এই সময়ের গন্ডীতেও বকলেসের ঝুমঝুমি শোনা যায়। অলক্ষ্যে সেই বাজনা বাজে, দামী ডিজাইনার নেকটাইএর ভেতর, সোনার কাফলিংএর অন্দরে। এখানেও লড়াই চলতে থাকে। আর গ্যালারির অলিন্দ জুড়ে দর্শক বসে থাকে। প্রতিটা চাল মেপে নিচ্ছে। সরাসরি বাহবা না দিলেও, অতি সচতনতায় গুণে নিচ্ছে এগিয়ে বা পিছিয়ে যাওয়ার পরিমাপ। সেখানে আমি তুমির তুচ্ছতা ছাপিয়ে ওঠে, না-থাকা বা না-হয়ে ওঠার বোধ, যেখানে মাটির আলপনায় শুধু ঘাস নয়, থাকে রক্ত আর প্রতিহিংসার পান্ডুলিপি।



মার্থা ফিরছেন ছেলেমেয়েকে নিয়ে। দুবাইএ ওদের বাবা কাজ করেন। ভ্যাকেশান কাটাতে বাচ্চাদের সাথে কিছুদিন। ছুটির ছুটোছুটিতে ক্লান্তি আসে, বিশেষ করে ছুটি যখন ফুরিয়ে যায়। দুবাই থেকে ওয়াশিংটন ডিসি। লম্বা পথ। মধ্যে দুটি দুরন্ত শিশুকে নিয়ে মার্থা যে কি করে পৌঁছবে, সেই চিন্তাই সমানে ঘুরছে। ছেলেমেয়ে দুটির বয়স তিন থেকে পাঁচ। ছেলেটি বড়। দুজনের দৌরাত্মি এর মধ্যেই বিমানের এই অংশের যাত্রীরা টের পেয়ে গেছেন। খানিক পর পরই নানা বিষয় নিয়ে দুই ভাইবোনে খুনসুটি। দূর থেকে দেখে আনন্দ পেলেও, মার্থার যে কি যাচ্ছে, তা সেই-ই জানে। বিমান সেবিকারা ঘুরে ঘুরে নজরদারি করছেন, কার কি লাগবে। বাচ্চাদের খুশি করার জন্য নানা রকম পুতুলের সম্ভার এনে উপস্থিত। মার্থার ছেলে মেয়েরাও পেল। তবে সবাই যখন ঘুমোবার উদ্যোগ করছে, ওদের তখন চিল চিৎকার। লজ্জায় মাটিতে মিশে যাবা জোগাড়। মাথা ঠান্ডা রাখে। তিনটে পাশাপাশি সিটের, এপাশ ওপাশ কোন খালি সিটও নেই। বোঝাই যাচ্ছে পুরো গাড়ি ভরপুর। কোন রকমে বাচ্চাদের লম্বা করিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করে। এত অল্প পরিসরে কি আর শোয়া যায়! ওদের চেঁচামেচিতে এক বিমানসেবিকা চকোলেট নিয়ে আসে। মার্থা খুব নিরুপায় মুখ করে নেয় আর বলে, “আর দিও না। ওরা এতে আরো পেয়ে বসবে”। ক্লান্তি বড় বিষম দায়। হাজার চেঁচামেচিতেও এক সময় ঘুম ঠিক এসে যায়। দেখা গেল দুই বাচ্চাকে ধরে মার্থাও গভীর ঘুমে মগ্ন। এক সময় একজন বিমান সেবিকা এসে পরম যত্নে একটা চাদর দিয়ে ঢেকে দেয় তিনজন কে। ক্রমে আটলান্টিক পার হয়ে, উড়োজাহাজ ওয়াশিংটন পৌঁছয়। খুব বড় এয়ারপোর্ট তবে চেহারায় তেমন দম্ভ নেই। কেমন খালি খালি এক গ্রাম্য সরলতা নিয়ে দাঁড়িয়ে। মার্থা তখন মাল তোলার বেল্ট থেকে গুণে গুণে সাত সাতটা ঢাউস স্যুটকেস তুলছে। ছেলে মেয়েদুটি সারারাত কাটিয়ে আবার তরতাজা। আগের মতোই খুনসুটি চলে। একে সামলাতে গিয়ে অন্যজন ফস্কে যায়। কোনক্রমে সব কিছু গুছিয়ে যখন কাস্টমসের লাইনে দাঁড়ায়, দেখা গেল সারা পথ ছড়াতে ছড়াতে এসেছে, পুতুলের ছোট্ট ছোট্ট ঘর বাড়ি, কাপ ডিস, চামচ, ঘর গেরস্থালির নানা উপকরণ। সেই দেখে মায়ের মাথায় হাত। ট্রলির উপর সাতটা স্যুটকেস, তার ওপর দুটো বাচ্চাকে জড়ো করে, সে আবার চলল পিছন দিকে, একে একে সবকটি খেলনা কুড়িয়ে আনার জন্য। কষ্ট হলেও, এগুলে ফেলে যেতে একেবারেই মন চায়না। দুবাই থেকে ওদের বাবা শখ করে কিনে দিল। অন্ততঃ বাড়ি অবধি চলুক। এমনি করে সব কুড়িয়ে নিতে নিতেই দিন চলে যায়। কতক থাকে, কতক সঙ্গে চলে। সেও আবার কিছুদিন পর আপনা থেকেই পুরাণো হয়ে যায়। প্রয়োজনীয়তা হারায়। এমন একটা কিছু যে আদৌ ছিল, কারও আর মনেই পড়েনা। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

ব্লগ এবং বই পাওয়ার ঠিকানাঃ https://souravstory.com

 এখন থেকে ব্লগ সহ অন্যান্য সব খবর এবং বই পাওয়ার ঠিকানাঃ https://souravstory.com