ট্রেনে চেপে বেশ গুছিয়ে বসে গোবিন্দ। অনেক পথ যেতে হবে। এই ট্রেনটা মাঝারি পাল্লার। শহর পেরিয়ে প্রায় প্রতিটি স্টেশনেই থামে। গড়ন এক্সপ্রেস ট্রেনের মতোই। উপরে বাঙ্ক। সেখানেও মালপত্রের সাথে বহু মানুষ নিজেদের যত্ন করে গুঁজে নিয়েছে। শুধু শহরের মধ্যেকার স্টেশনগুলোতে থামে না। তাই যাত্রীরা মূলতঃ গ্রামীন মানুষ। তাদের বেশভুষা আচারন সবই স্বতন্ত্র এবং আন্তরিক। চোখের দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে কথা বলে, যেন কতদিনের পরিচিত। আজ বোধহয় ট্রেনটি একটু লেট চলছে। এইসব মানুষরা নিত্য এই গাড়িতেই যাতায়াত করেন। গাড়ির গতিবেগ দেখে বলে দিতে পারেন ড্রাইভারে বয়স বা অভিজ্ঞতার পরিমাপ। কিম্বা আজ ড্রাইভার সাহেবের তাড়া আছে কিনা। গোবিন্দ কোন আপিস করতে যাচ্ছেনা, তাই ট্রেনের দেরী হলেও কিছু যায় আসে না।
জানালার বাইরে চোখ চালিয়ে নিশ্চিন্তে থাকে। বাইরেটা যে এত মনোরম লাগে! কেমন মায়াবী সবুজে মোড়া। ছোট ছোট জনপদগুলো দ্রুত পার হয়ে যায়। দেখলেই কেন যেন মনে হয়, দু দিন এখানে থেকে গেলে হয়। তবে ট্রেনের ভিতরটিও অতীব রঙীন। একের পর এক নানান ফেরিওয়ালার মিছিল। পুরো পথটাকে কেমন ঘটমান করে রাখে। একজন গজাওয়ালা এলেন। এসেই বলেন, “আজ আপনাদের ধরতেই দেব না। কারণ ধরলেই ছ্যাঁকা লাগবে, এ এমন টাটকা। সদ্য কড়াই থেকে নামিয়ে আনা”। তার বাচন ভঙ্গী আর বলার ভাষাতে যাত্রীরা আমোদ পায়, বিক্রিও হয়। এক প্রৌঢ় হাত পাতে একটা নমুনা সংগ্রহের জন্য। বোঝা যায়, গজাওয়ালা খুব খুশি হয়নি। অনেক ফেরিওয়ালা নিজে থেকেই নমুনা বিতরণ করে। তারা আবার অপমানিত হয়, যদি কেউ নমুনা নিতে অস্বীকার করেন। গজাওয়ালা তেমন নয়। সে নেমে গেলে পরে, আরেক সহযাত্রী একটি গল্প বলতে শুরু করে। যেন গোবিন্দকেই শোনাচ্ছেন।
দুই বন্ধু ছিল। তাদের একজন পাশ-টাশ দিয়ে একটা চাকরি জুটিয়ে ফেলে। অন্য বন্ধুটি স্টেশনে একটি পানের দোকান দেয়। ছোট গুমটি আর কি! চাকুরে বন্ধু প্রতিদিন সকালে ট্রেন ধরতে স্টেশনে আসে, পানওয়ালা বন্ধুর সাথে একটু খোশগল্প করে, তারপর ট্রেন এলে চলে যায়। প্রতিদিনের আড্ডার মাঝে, সে একটি এলাচ চেয়ে নিয়ে খায়। এমন করে অনেকদিন যায়। সকালে আসে, গল্প করে, এলাচ মুখে নেয়, ট্রেন ধরে, চলে যায়। প্রায় বছর পাঁচেক পর কোন এক ঘটনা নিয়ে দুজনের মনোমালিণ্য ঘটে। তখন পানওয়ালা বন্ধুটি অন্যজনের কাছে কিছু টাকা ফেরত চায়। চাকুরে বন্ধুটি তো অবাক। সে চাকরি করে বলে প্রচ্ছন্ন গর্ব আছে। পানওয়ালা বন্ধুটির চেয়ে, তার আয় যায় বেশি। তারপরও পানওয়ালা উত্তমর্ণ্য, ভাবতেই পারে না। পানওয়ালা বন্ধু তখন হিসেবের খাতা নিয়ে বসে, গত পাঁচ বছরে চাকুরে বন্ধুটি প্রায় ১৩২৮টি এলাচ নিয়ে খেয়েছে। সব মিলিয়ে এলাচের গড়দাম অনুসারে ৫৩৭টাকা মতো পাওনা।
গল্পের শেষে সহযাত্রীটি সেই গজা-র নমুনা প্রার্থী প্রৌঢ়র দিকে ফিরে বলেন, “চেয়ে খাবেন না। কারণ যে দিচ্ছে, সে খুব যে খুশি মনে দিচ্ছে, তা নয়”। গোবিন্দর বেশ লাগে, কেমন সুন্দর ভাবে ভদ্রলোককে শিক্ষা দিলেন। এরমধ্যে আরো অনেক ফেরিওয়ালা ওঠেন, একজন বৃদ্ধদের আবার করে কবাডি খেলার ওষুধ বিক্রি করছেন। কত রকম চোরাগোপ্তা কথা, ঠাঁই পেতে হলে নিয়মিত রেলযাত্রা করতে হবে। একজন তার পসরা বিক্রি করতে গিয়ে বলে ফেলেন, “আজ টাকাপয়সা কম থাকলে নেবেন না। কোন অসুবিধা নেই। পরে সময়মতো নিলেই হবে”। সম্ভবতঃ বদহজমের ওষুধ। এইসব ফেরিওয়ালারাও প্রতিনিয়তঃ তাদের মতো করে সৃষ্টিসুখে আছেন। নিতান্ত পেটের তাগিদ বলেই উপাচারের বাহুল্য নেই, উপস্থাপনা দৃঢ় এবং সরাসরি।
অবশেষে গন্তব্য, লোনামাটি পৌঁছায় গোবিন্দ। শহর ছাড়িয়ে তিন ঘন্টার দূরত্বে যে এমন জায়গা আছে, না এলে বোঝাই যায়না। একটা মোবাইলেও সিগনাল নেই। কি যে ভালো। একরত্তি নদীটা বয়ে চলে, কেউ এল, দু দন্ড পাশে বসল ওর বুঝি গায়েই লাগে না। বিকেলের আলো নৌকাকে টেনে নিয়ে যায়, অস্তমিত সূর্যের দিকে। বড় বড় উলুর ঝোপে হাঁসগুলো কি যেন খোঁজে আবার ছুটে এসে জলে ডুব দেয়। গোবিন্দ কাউকে না জানিয়ে মাঝে মাঝে এখানে চলে আসে। প্রথম প্রথম নতুন মানুষ দেখে, গ্রামের লোক জিজ্ঞেস করত, “কোন বাড়ি এসেছেন? কতদিন থাকবেন? কোথা থেকে আসছেন? কেন আসছেন? কি করেন?” ইত্যাদি নানা কথা। তা তো ঠিক। কে কোথা দিয়ে চলে আসে, কত রকম ফন্দি ফিকির নিয়ে। গোবিন্দ তেমন বলার মতো কিছু করেও না, যে গুছিয়ে বলবে। যদিও খুব ব্যস্ত থাকে, তবু কাউকে কি বলা যায়, যে সে বাজার করতে, ইলেক্ট্রিক বিল জমা দিতে বা ফেলে আসা জিনিস পৌঁছানোর কাজ করে। শহরে যেমন মানুষ আলগা আলগা, পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকছে, কে আসছে জানা থাকে না। গ্রামে ঠিক তেমনটা নয়। কার বাড়িতে কে এল, অন্যরাও খবর রাখে। শুরুতে গোবিন্দ এক খুড়তোতো দাদার পিসতুতো কাকা মাস্টারবাবুর নাম করে চলে এসেছিল। ওই ওদের পাড়াতে কোন এক সময় ভদ্রলোক নিমন্ত্রণ খেতে গিয়েছিলেন। তা ভুল করে সেই কাকার মেয়ে বাথরুমে কানের দুল ফেলে চলে আসে। পরে যখন খোঁজ মিলল, কে পৌঁছে দেবে? ব্যাস পাড়ায় এক অধটা কাঠ বেকার থাকার এই সুবিধে। সেই সুযোগে গোবিন্দও এই জায়গার খোঁজ পেয়ে গেল। এখন অবশ্য শুধু মাস্টারবাবুর কথা বলতে হয়না, এই গ্রামের সে অনেককেই চেনে।
এখানে আসতে ট্রেনে চাপতে হয়। তারপর বেশ কিছু বড় বড় জংশনে গাড়ি পাল্টে পাল্টে লোনামাটি স্টেশনে নামতে হয়। এই স্টেশনে এখনও প্ল্যাটফর্ম হয়নি। সিঁড়িওয়ালা ট্রেনই থামে। আজকাল অন্য গাড়িও থামে, তাতে ওঠা নামা বড্ড মুশ্কিল। গোবিন্দর এই স্টেশনের কাছাকাছি এলে মন ভালো হয়ে যায়। তড়াক করে লফিয়ে নামে। নিচে পাথরে খচমচ করে ওঠে। পুরো স্টেশন চত্বর কৃষ্ণচূড়ায় ঢাকা। এখন যদিও জৈষ্ঠ্য শুরু হয়ে গেছে, গাছেদের ফুলের বিরাম নেই। লাল ফুলের ফরাস পাতা যেন। ভজন পাল পিছন থেকে বলে, “ভাইপো, আমরা হাত একটু ধর। নিজে তো হুড়ুম দিয়ে নামলে, আমাদের বুড়ো হাড়। পারি নাকি?” ভজন পালের সাথে ট্রেনেই আলাপ রুমাল ফিরি করে। সকালের ট্রেনে শহরে গিয়ে এই বেলার গাড়িতে ফেরে। দিনের এক দুটো ট্রেনই আছে এই স্টেশনে দাঁড়ায়। মাস্টারবাবু কে কাকা বলাতে, গ্রামের মোটামুটি সব মাঝবয়সীদের কাছে গোবিন্দ গণ-ভাইপো হয়ে গেছে। লোনামাটি স্টেশন থেকে পায়ে হেঁটে একটা ছোট জঙ্গল পেরোতে হয়। আগে এই জঙ্গল ছিল ডাকাতদের আস্তানা। এখন অবশ্য ডাকাতরা গোয়ালা হয়ে গেছে। তারা মোষ পোষে। সাইকেলের দুপাশে দুধের ক্যান ঝুলিয়ে গ্রামে গ্রামে বিক্রি করে। জঙ্গলের মাঝে সেই ডাকাতে গোয়ালাদের ছোট বসত। সেইখানে পথে ওপর সার দিয়ে বড় বড় মোষরা বসে জাবর কাটে। তা ডিঙিয়ে আসে ছোট্ট নদী, নাম তার পাখনা। পাখনা পেরোতে নৌকা নেয় একটাকা। তারপর আসবে মাস্টারবাবুর গ্রাম। জঙ্গল লাগোয়া বলে পাখিদের ডাকে চতুর্দিক মেতে থাকে। যতবার গোবিন্দ আসে ওরা যেন ঠিক চিনে ফেলে। তাই তো এত ডাকাডাকি করে। কিন্তু গোবিন্দর আর পাখিদের চেনা হয়ে উঠল না। প্রতিবার এখান থেকে ফিরে ভাবে লাইব্রেরিতে খোঁজ নেবে পাখি নিয়ে কোন বই আছে কিনা। কিন্তু সে আর হয় না। অবশ্য না জানার মধ্যেও একটা আনন্দ আছে। সব কিছু তো চিনে ফেলতে নেই।
জানালার বাইরে চোখ চালিয়ে নিশ্চিন্তে থাকে। বাইরেটা যে এত মনোরম লাগে! কেমন মায়াবী সবুজে মোড়া। ছোট ছোট জনপদগুলো দ্রুত পার হয়ে যায়। দেখলেই কেন যেন মনে হয়, দু দিন এখানে থেকে গেলে হয়। তবে ট্রেনের ভিতরটিও অতীব রঙীন। একের পর এক নানান ফেরিওয়ালার মিছিল। পুরো পথটাকে কেমন ঘটমান করে রাখে। একজন গজাওয়ালা এলেন। এসেই বলেন, “আজ আপনাদের ধরতেই দেব না। কারণ ধরলেই ছ্যাঁকা লাগবে, এ এমন টাটকা। সদ্য কড়াই থেকে নামিয়ে আনা”। তার বাচন ভঙ্গী আর বলার ভাষাতে যাত্রীরা আমোদ পায়, বিক্রিও হয়। এক প্রৌঢ় হাত পাতে একটা নমুনা সংগ্রহের জন্য। বোঝা যায়, গজাওয়ালা খুব খুশি হয়নি। অনেক ফেরিওয়ালা নিজে থেকেই নমুনা বিতরণ করে। তারা আবার অপমানিত হয়, যদি কেউ নমুনা নিতে অস্বীকার করেন। গজাওয়ালা তেমন নয়। সে নেমে গেলে পরে, আরেক সহযাত্রী একটি গল্প বলতে শুরু করে। যেন গোবিন্দকেই শোনাচ্ছেন।
দুই বন্ধু ছিল। তাদের একজন পাশ-টাশ দিয়ে একটা চাকরি জুটিয়ে ফেলে। অন্য বন্ধুটি স্টেশনে একটি পানের দোকান দেয়। ছোট গুমটি আর কি! চাকুরে বন্ধু প্রতিদিন সকালে ট্রেন ধরতে স্টেশনে আসে, পানওয়ালা বন্ধুর সাথে একটু খোশগল্প করে, তারপর ট্রেন এলে চলে যায়। প্রতিদিনের আড্ডার মাঝে, সে একটি এলাচ চেয়ে নিয়ে খায়। এমন করে অনেকদিন যায়। সকালে আসে, গল্প করে, এলাচ মুখে নেয়, ট্রেন ধরে, চলে যায়। প্রায় বছর পাঁচেক পর কোন এক ঘটনা নিয়ে দুজনের মনোমালিণ্য ঘটে। তখন পানওয়ালা বন্ধুটি অন্যজনের কাছে কিছু টাকা ফেরত চায়। চাকুরে বন্ধুটি তো অবাক। সে চাকরি করে বলে প্রচ্ছন্ন গর্ব আছে। পানওয়ালা বন্ধুটির চেয়ে, তার আয় যায় বেশি। তারপরও পানওয়ালা উত্তমর্ণ্য, ভাবতেই পারে না। পানওয়ালা বন্ধু তখন হিসেবের খাতা নিয়ে বসে, গত পাঁচ বছরে চাকুরে বন্ধুটি প্রায় ১৩২৮টি এলাচ নিয়ে খেয়েছে। সব মিলিয়ে এলাচের গড়দাম অনুসারে ৫৩৭টাকা মতো পাওনা।
গল্পের শেষে সহযাত্রীটি সেই গজা-র নমুনা প্রার্থী প্রৌঢ়র দিকে ফিরে বলেন, “চেয়ে খাবেন না। কারণ যে দিচ্ছে, সে খুব যে খুশি মনে দিচ্ছে, তা নয়”। গোবিন্দর বেশ লাগে, কেমন সুন্দর ভাবে ভদ্রলোককে শিক্ষা দিলেন। এরমধ্যে আরো অনেক ফেরিওয়ালা ওঠেন, একজন বৃদ্ধদের আবার করে কবাডি খেলার ওষুধ বিক্রি করছেন। কত রকম চোরাগোপ্তা কথা, ঠাঁই পেতে হলে নিয়মিত রেলযাত্রা করতে হবে। একজন তার পসরা বিক্রি করতে গিয়ে বলে ফেলেন, “আজ টাকাপয়সা কম থাকলে নেবেন না। কোন অসুবিধা নেই। পরে সময়মতো নিলেই হবে”। সম্ভবতঃ বদহজমের ওষুধ। এইসব ফেরিওয়ালারাও প্রতিনিয়তঃ তাদের মতো করে সৃষ্টিসুখে আছেন। নিতান্ত পেটের তাগিদ বলেই উপাচারের বাহুল্য নেই, উপস্থাপনা দৃঢ় এবং সরাসরি।
অবশেষে গন্তব্য, লোনামাটি পৌঁছায় গোবিন্দ। শহর ছাড়িয়ে তিন ঘন্টার দূরত্বে যে এমন জায়গা আছে, না এলে বোঝাই যায়না। একটা মোবাইলেও সিগনাল নেই। কি যে ভালো। একরত্তি নদীটা বয়ে চলে, কেউ এল, দু দন্ড পাশে বসল ওর বুঝি গায়েই লাগে না। বিকেলের আলো নৌকাকে টেনে নিয়ে যায়, অস্তমিত সূর্যের দিকে। বড় বড় উলুর ঝোপে হাঁসগুলো কি যেন খোঁজে আবার ছুটে এসে জলে ডুব দেয়। গোবিন্দ কাউকে না জানিয়ে মাঝে মাঝে এখানে চলে আসে। প্রথম প্রথম নতুন মানুষ দেখে, গ্রামের লোক জিজ্ঞেস করত, “কোন বাড়ি এসেছেন? কতদিন থাকবেন? কোথা থেকে আসছেন? কেন আসছেন? কি করেন?” ইত্যাদি নানা কথা। তা তো ঠিক। কে কোথা দিয়ে চলে আসে, কত রকম ফন্দি ফিকির নিয়ে। গোবিন্দ তেমন বলার মতো কিছু করেও না, যে গুছিয়ে বলবে। যদিও খুব ব্যস্ত থাকে, তবু কাউকে কি বলা যায়, যে সে বাজার করতে, ইলেক্ট্রিক বিল জমা দিতে বা ফেলে আসা জিনিস পৌঁছানোর কাজ করে। শহরে যেমন মানুষ আলগা আলগা, পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকছে, কে আসছে জানা থাকে না। গ্রামে ঠিক তেমনটা নয়। কার বাড়িতে কে এল, অন্যরাও খবর রাখে। শুরুতে গোবিন্দ এক খুড়তোতো দাদার পিসতুতো কাকা মাস্টারবাবুর নাম করে চলে এসেছিল। ওই ওদের পাড়াতে কোন এক সময় ভদ্রলোক নিমন্ত্রণ খেতে গিয়েছিলেন। তা ভুল করে সেই কাকার মেয়ে বাথরুমে কানের দুল ফেলে চলে আসে। পরে যখন খোঁজ মিলল, কে পৌঁছে দেবে? ব্যাস পাড়ায় এক অধটা কাঠ বেকার থাকার এই সুবিধে। সেই সুযোগে গোবিন্দও এই জায়গার খোঁজ পেয়ে গেল। এখন অবশ্য শুধু মাস্টারবাবুর কথা বলতে হয়না, এই গ্রামের সে অনেককেই চেনে।
এখানে আসতে ট্রেনে চাপতে হয়। তারপর বেশ কিছু বড় বড় জংশনে গাড়ি পাল্টে পাল্টে লোনামাটি স্টেশনে নামতে হয়। এই স্টেশনে এখনও প্ল্যাটফর্ম হয়নি। সিঁড়িওয়ালা ট্রেনই থামে। আজকাল অন্য গাড়িও থামে, তাতে ওঠা নামা বড্ড মুশ্কিল। গোবিন্দর এই স্টেশনের কাছাকাছি এলে মন ভালো হয়ে যায়। তড়াক করে লফিয়ে নামে। নিচে পাথরে খচমচ করে ওঠে। পুরো স্টেশন চত্বর কৃষ্ণচূড়ায় ঢাকা। এখন যদিও জৈষ্ঠ্য শুরু হয়ে গেছে, গাছেদের ফুলের বিরাম নেই। লাল ফুলের ফরাস পাতা যেন। ভজন পাল পিছন থেকে বলে, “ভাইপো, আমরা হাত একটু ধর। নিজে তো হুড়ুম দিয়ে নামলে, আমাদের বুড়ো হাড়। পারি নাকি?” ভজন পালের সাথে ট্রেনেই আলাপ রুমাল ফিরি করে। সকালের ট্রেনে শহরে গিয়ে এই বেলার গাড়িতে ফেরে। দিনের এক দুটো ট্রেনই আছে এই স্টেশনে দাঁড়ায়। মাস্টারবাবু কে কাকা বলাতে, গ্রামের মোটামুটি সব মাঝবয়সীদের কাছে গোবিন্দ গণ-ভাইপো হয়ে গেছে। লোনামাটি স্টেশন থেকে পায়ে হেঁটে একটা ছোট জঙ্গল পেরোতে হয়। আগে এই জঙ্গল ছিল ডাকাতদের আস্তানা। এখন অবশ্য ডাকাতরা গোয়ালা হয়ে গেছে। তারা মোষ পোষে। সাইকেলের দুপাশে দুধের ক্যান ঝুলিয়ে গ্রামে গ্রামে বিক্রি করে। জঙ্গলের মাঝে সেই ডাকাতে গোয়ালাদের ছোট বসত। সেইখানে পথে ওপর সার দিয়ে বড় বড় মোষরা বসে জাবর কাটে। তা ডিঙিয়ে আসে ছোট্ট নদী, নাম তার পাখনা। পাখনা পেরোতে নৌকা নেয় একটাকা। তারপর আসবে মাস্টারবাবুর গ্রাম। জঙ্গল লাগোয়া বলে পাখিদের ডাকে চতুর্দিক মেতে থাকে। যতবার গোবিন্দ আসে ওরা যেন ঠিক চিনে ফেলে। তাই তো এত ডাকাডাকি করে। কিন্তু গোবিন্দর আর পাখিদের চেনা হয়ে উঠল না। প্রতিবার এখান থেকে ফিরে ভাবে লাইব্রেরিতে খোঁজ নেবে পাখি নিয়ে কোন বই আছে কিনা। কিন্তু সে আর হয় না। অবশ্য না জানার মধ্যেও একটা আনন্দ আছে। সব কিছু তো চিনে ফেলতে নেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন