স্বয়ং অবন ঠাকুর বলে গেছেন, শামুকদের কাছে রাস্তার খবর থাকে, মাছেদের থাকে জলের। আর পাখিদের আকাশে। আকাশের খবর উড়োজাহাজ কোম্পানিদেরও থাকে। আকাশের কোনদিকে কেমন হাওয়া? টার্বুলেন্স আছে কি নেই? একই উচ্চতায় আর রুটে আরও কতজন ডানা মেলেছে। জাহাজের ভেতর যিনি ক্যাপ্টেন আছেন, তিনি নিমিত্ত মাত্র। আসল টিঁকি বাঁধা নিচে। যেখানে তারা রাডারে চোখ রেখে প্রতিটি পল অনুপল মেপে যাচ্ছেন। সেই দুরূহ পদ্ধতিটির মধ্যে যাতায়াত যতই আরামদায়ক মনে হোক, সহজ নয় এতটুকু। সোমনাথের পেট গুড়গুড় করে। এরোপ্লেনে চড়ার নাম শুনলেই হাত পা যেন সেঁধিয়ে যেতে চায়। বিমান উড়বার আগে সুবেশা সেবিকারা হাত নেড়ে, বিপদে পড়লে কি করবেন শেখায়। তারা ভাবলেশহীন হয়ে যন্ত্রের মতো এইসব কথা বলেন, সোমনাথের ততই ভয় বাড়তে থাকে। বলে কি রে, সমুদ্রে নামলে কি করবে? অক্সিজেন কমে গেলে কি করবে? মাঝ আকাশে যদি গাড়ি খারাপই হয়, ওইসব বুকনি কোন কাজে আসবে? কক্ষোণো নয়। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ওঠা আর নামার সময়। সোমনাথ, প্রায় হাঁটুর মাঝখানে মাথা গুঁজে ফেলে। ঈশ্বরে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কোনটাই ওর নেই, তবু এই মুহুর্তগুলোতে ভাবতে ভালো লাগে, আহা কেউ যদি অমন সর্বশক্তিমান হত, তবে খানিক নিশ্চিন্তি হতেই পারত। আর যদি টার্বুলেন্সে পড়ে, তবে তো হয়ে গেল। মাঝে মাঝে সে একেকটা ফ্রী-ফল যা হয়, প্রাণপাখি পালাবার জন্য ডানা ঝাপটেই চলে।
সেবার এক পাহাড়ি পথে চলেছে। তা আবার বর্ষার মরশুম। সকাল থেকে বেশ কয়েকবার নির্ধারিত সময় পার হয়েছে। কি না, সেই দেশে বৃষ্টি হচ্ছে। সে, এতো বৃষ্টি এরোপ্লেন নামতেই নাকি পারবে না। এই ঘোষনাগুলো কেন যে করে? এসব শুনলে তো আরো পিলে চমকে যায়। এমন ভাবে সময় পিছোতে পিছোতে, যখন ভাবছে এবার বুঝি আজকের মত উড়ান বাতিল হল, নিশ্চিন্তে হোটেলে ফিরতে পারবে। ঠিক তখন প্লেন ছাড়ার ঘোষনাটি হল। কি আর করা, রামনাম জপতে জপতে প্লেনে উঠে আসন গ্রহন করে। সমতলের ওপর দিয়ে যখন চলল, তেমন কোন ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে না। বাধ সাধল, পাহাড়ি এলাকায় প্রবেশ করে। ওরে বাবারে এ কি বিশাল বিশাল চূড়া। দুইদিকে এমন সব দুরূহ কঠিন দেওয়াল। তার ভেতর দিয়ে অলি গলি খুঁজে বেরোনর মত ধাতব পাখিটা উড়ে চলে। ক্রমশঃ নিচে নামতে থাকে। মেঘের আস্তরণ পার হতেই বৃষ্টির মধ্যে পড়ল। সে কি তুমুল আলোড়ন। এর মধ্যে পাইলট সাহেবের ঘোষনা। সবাই কে শান্ত হয়ে থাকার অনুরোধ। সান্ত্বনা বাক্যে একটি আশ্বস্ত বানী "আপনাদের যদি মনে হয় দুই দিকের পাহাড়ের দেওয়ালগুলো, আপনাদের পূর্ব অভিজ্ঞতার চেয়ে কাছে, একদম ভয় পাবেন না। এই দেশে এটা স্বাভাবিক"। এই ঘোষনায় কারা স্বস্তি পেল জানা নেই, সোমনাথের কলজে শুকিয়ে, পিলে চমকিয়ে, তালু গরম হয়ে ফেটে যাবার জোগাড়। তার মধ্যে অনুভব করে দুই দিকের পাহাড় এতটাই কাছে যে, ডানা সোজা করে ধাতব পাখি বেরোতে পারবেনা। বোঁ করে প্রায় পঁচিশ ডিগ্রী হেলে গেল। বাস আর দেখতে হবেনা, এরোপ্লেন জুড়ে হাহাকার রব উঠল। এমন করে শেষমেষ এক ফালি রানওয়ের মত কিছু এল। তবে সে না দেখা যাবার মতো। বৃষ্টির তোড়ে সব সাদা। বিমান তিন বার চক্কর কাটে, তারপর আবার ক্যাপ্টেনে ঘোষনা, “ভয়ঙ্কর দুর্যোগের কারনে আপাততঃ আমারা নামার ঝুঁকি নিচ্ছিনা। আমরা প্রতিবেশী এক দেশে যাচ্ছি। আজ রাত কাটিয়ে কাল সকালে আবার চেষ্টা করব। এই অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির কারনে আমরা দুঃখিত”। যাত্রীদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ ভাবলেন নামলেই হত, কত কাজের লাইন ছিল। অনেকে ভাবলেন, পৈতৃক প্রাণটা অন্ততঃ রেহাই পেল। সোমনাথ বলা বাহুল্য দ্বিতীয় দলে।
পরদিন কিন্তু অসাধারন আকাশ। ঝকঝকে, কোথাও কোন মলিনতার মেঘ নেই। ভোরের আলোর সাথে ভাসতে ভাসতে ধাতব পাখি তার উড়ান সম্পুর্ণ করে। পথে পুরো হিমালয়। ক্যাপ্টেন উৎসাহ সহকারে চিনিয়ে দেন, কোনটা এভারেস্ট, কোনটা কাঞ্চনজঙ্ঘা আরো কত গগনভেদী নাম।
এমন একবার সোমনাথ দিল্লি চলছে আপিসের কাজে। বিজনেস ক্লাসে যাত্রা। আসন গ্রহন করেই বুঝতে পারে, ওর সহযাত্রীরা প্রত্যেকেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, এম-পি। পরেরদিন লোকসভার অধিবেশন শুরু হচ্ছে, সে উপলক্ষ্যে এই মানুষগুলো চলেছেন। যাইহোক, এঁদের সাথে, সোমনাথের কোন লেনা দেনা নেই। নিজের মনে, একটা বই বার করে পড়তে থাকে। চুপ করে থাকলেও আশেপাশের কথাবার্তা কানে এসেই যায়। এক পেশার বিভিন্ন মানুষ একত্রিত হলে খুব স্বাভাবিক ভাবে নিজেদের পেশা সংক্রান্ত আলোচনা বেশি হবে। অত্যন্ত নিরীহভাবে যে সব আলোচনা হচ্ছিল, শুনে সোমনাথের আক্কেল গুড়ুম। কেউ একজন জিজ্ঞেস করেন, অমুক এখন কোথায়? উত্তর আসে, তিনি এখন তিহারে সাজা কাটছেন। আগামী ইলেকশান জেল থেকেই লড়বেন। ইত্যাদি নানাবিধ সংবাদের আদান প্রদান হতে থাকে। প্রত্যেকটি মানুষ সাদা রঙের পোষাকে সজ্জিত। তাঁদের বেশভুষায় আভিজাত্যর ছাপ প্রকট। একই রকম ভাবে কথাবার্তায় অন্ধকারের হাতছানি। সোমনাথ অনুভব করে, কাদের হাতে দেশের শাসনভার, কারা আজ আমাদের ভারত ভাগ্যবিধাতা।
বেশ কয়েকদিন অন্য শহরে ছিল সোমনাথ। ফেরার সময় মনে চাপা খুশি। কতদিন পর আবার সবার সাথে দেখা হবে। বাড়ির ভাত খাওয়া হবে। রাতের ফ্লাইট। বিমান সেবিকারা ঘুরে ঘুরে রাতের খাবার দিচ্ছেন। সোমনাথের কাছে এসে জিজ্ঞেস করেন, আমিষ না নিরামিষ কি পছন্দ? সোমনাথ খুব বিনীত ভাবে বলে, “অনেকদিন পর বাড়ি ফিরছি। তাই এখানে খাবো না। বাড়ি গিয়ে সবার সাথে খাবো। আমার জন্য আমার ছেলে মেয়েরা অপেক্ষা করছে”। মেয়েটি ফিরে গেল। সবাইকে খাবার দেওয়া হয়ে যাবার পর, আবার ফিরে আসে হতে রঙিন কাগজে মোড়া একটা বড় ঝুড়ি। মিষ্টি হেসে বলে, “আপনি বাড়ি যাচ্ছেন, আমাদের তরফ থেকে এটা আপনার ছেলে মেয়েদের জন্য”। সোমনাথ বুঝতে পারে নানা রকম মহার্ঘ্য খাবার সামগ্রী দিয়ে প্যাকেটটি সাজানো। হয়তো সবটাই ভীষণ ভাবে ব্যবসায়িক স্বার্থে ব্যবহৃত, তবু এই ঘটনাটি মন ছুঁয়ে যায়। মাটি থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট ওপরে হঠ্ৎ যেন মাটির গন্ধ নাকে আসে। ঠিক এই জন্যই যেন আরো একবার বেঁচে থাকা যায়।
সেবার এক পাহাড়ি পথে চলেছে। তা আবার বর্ষার মরশুম। সকাল থেকে বেশ কয়েকবার নির্ধারিত সময় পার হয়েছে। কি না, সেই দেশে বৃষ্টি হচ্ছে। সে, এতো বৃষ্টি এরোপ্লেন নামতেই নাকি পারবে না। এই ঘোষনাগুলো কেন যে করে? এসব শুনলে তো আরো পিলে চমকে যায়। এমন ভাবে সময় পিছোতে পিছোতে, যখন ভাবছে এবার বুঝি আজকের মত উড়ান বাতিল হল, নিশ্চিন্তে হোটেলে ফিরতে পারবে। ঠিক তখন প্লেন ছাড়ার ঘোষনাটি হল। কি আর করা, রামনাম জপতে জপতে প্লেনে উঠে আসন গ্রহন করে। সমতলের ওপর দিয়ে যখন চলল, তেমন কোন ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে না। বাধ সাধল, পাহাড়ি এলাকায় প্রবেশ করে। ওরে বাবারে এ কি বিশাল বিশাল চূড়া। দুইদিকে এমন সব দুরূহ কঠিন দেওয়াল। তার ভেতর দিয়ে অলি গলি খুঁজে বেরোনর মত ধাতব পাখিটা উড়ে চলে। ক্রমশঃ নিচে নামতে থাকে। মেঘের আস্তরণ পার হতেই বৃষ্টির মধ্যে পড়ল। সে কি তুমুল আলোড়ন। এর মধ্যে পাইলট সাহেবের ঘোষনা। সবাই কে শান্ত হয়ে থাকার অনুরোধ। সান্ত্বনা বাক্যে একটি আশ্বস্ত বানী "আপনাদের যদি মনে হয় দুই দিকের পাহাড়ের দেওয়ালগুলো, আপনাদের পূর্ব অভিজ্ঞতার চেয়ে কাছে, একদম ভয় পাবেন না। এই দেশে এটা স্বাভাবিক"। এই ঘোষনায় কারা স্বস্তি পেল জানা নেই, সোমনাথের কলজে শুকিয়ে, পিলে চমকিয়ে, তালু গরম হয়ে ফেটে যাবার জোগাড়। তার মধ্যে অনুভব করে দুই দিকের পাহাড় এতটাই কাছে যে, ডানা সোজা করে ধাতব পাখি বেরোতে পারবেনা। বোঁ করে প্রায় পঁচিশ ডিগ্রী হেলে গেল। বাস আর দেখতে হবেনা, এরোপ্লেন জুড়ে হাহাকার রব উঠল। এমন করে শেষমেষ এক ফালি রানওয়ের মত কিছু এল। তবে সে না দেখা যাবার মতো। বৃষ্টির তোড়ে সব সাদা। বিমান তিন বার চক্কর কাটে, তারপর আবার ক্যাপ্টেনে ঘোষনা, “ভয়ঙ্কর দুর্যোগের কারনে আপাততঃ আমারা নামার ঝুঁকি নিচ্ছিনা। আমরা প্রতিবেশী এক দেশে যাচ্ছি। আজ রাত কাটিয়ে কাল সকালে আবার চেষ্টা করব। এই অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির কারনে আমরা দুঃখিত”। যাত্রীদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ ভাবলেন নামলেই হত, কত কাজের লাইন ছিল। অনেকে ভাবলেন, পৈতৃক প্রাণটা অন্ততঃ রেহাই পেল। সোমনাথ বলা বাহুল্য দ্বিতীয় দলে।
পরদিন কিন্তু অসাধারন আকাশ। ঝকঝকে, কোথাও কোন মলিনতার মেঘ নেই। ভোরের আলোর সাথে ভাসতে ভাসতে ধাতব পাখি তার উড়ান সম্পুর্ণ করে। পথে পুরো হিমালয়। ক্যাপ্টেন উৎসাহ সহকারে চিনিয়ে দেন, কোনটা এভারেস্ট, কোনটা কাঞ্চনজঙ্ঘা আরো কত গগনভেদী নাম।
এমন একবার সোমনাথ দিল্লি চলছে আপিসের কাজে। বিজনেস ক্লাসে যাত্রা। আসন গ্রহন করেই বুঝতে পারে, ওর সহযাত্রীরা প্রত্যেকেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, এম-পি। পরেরদিন লোকসভার অধিবেশন শুরু হচ্ছে, সে উপলক্ষ্যে এই মানুষগুলো চলেছেন। যাইহোক, এঁদের সাথে, সোমনাথের কোন লেনা দেনা নেই। নিজের মনে, একটা বই বার করে পড়তে থাকে। চুপ করে থাকলেও আশেপাশের কথাবার্তা কানে এসেই যায়। এক পেশার বিভিন্ন মানুষ একত্রিত হলে খুব স্বাভাবিক ভাবে নিজেদের পেশা সংক্রান্ত আলোচনা বেশি হবে। অত্যন্ত নিরীহভাবে যে সব আলোচনা হচ্ছিল, শুনে সোমনাথের আক্কেল গুড়ুম। কেউ একজন জিজ্ঞেস করেন, অমুক এখন কোথায়? উত্তর আসে, তিনি এখন তিহারে সাজা কাটছেন। আগামী ইলেকশান জেল থেকেই লড়বেন। ইত্যাদি নানাবিধ সংবাদের আদান প্রদান হতে থাকে। প্রত্যেকটি মানুষ সাদা রঙের পোষাকে সজ্জিত। তাঁদের বেশভুষায় আভিজাত্যর ছাপ প্রকট। একই রকম ভাবে কথাবার্তায় অন্ধকারের হাতছানি। সোমনাথ অনুভব করে, কাদের হাতে দেশের শাসনভার, কারা আজ আমাদের ভারত ভাগ্যবিধাতা।
বেশ কয়েকদিন অন্য শহরে ছিল সোমনাথ। ফেরার সময় মনে চাপা খুশি। কতদিন পর আবার সবার সাথে দেখা হবে। বাড়ির ভাত খাওয়া হবে। রাতের ফ্লাইট। বিমান সেবিকারা ঘুরে ঘুরে রাতের খাবার দিচ্ছেন। সোমনাথের কাছে এসে জিজ্ঞেস করেন, আমিষ না নিরামিষ কি পছন্দ? সোমনাথ খুব বিনীত ভাবে বলে, “অনেকদিন পর বাড়ি ফিরছি। তাই এখানে খাবো না। বাড়ি গিয়ে সবার সাথে খাবো। আমার জন্য আমার ছেলে মেয়েরা অপেক্ষা করছে”। মেয়েটি ফিরে গেল। সবাইকে খাবার দেওয়া হয়ে যাবার পর, আবার ফিরে আসে হতে রঙিন কাগজে মোড়া একটা বড় ঝুড়ি। মিষ্টি হেসে বলে, “আপনি বাড়ি যাচ্ছেন, আমাদের তরফ থেকে এটা আপনার ছেলে মেয়েদের জন্য”। সোমনাথ বুঝতে পারে নানা রকম মহার্ঘ্য খাবার সামগ্রী দিয়ে প্যাকেটটি সাজানো। হয়তো সবটাই ভীষণ ভাবে ব্যবসায়িক স্বার্থে ব্যবহৃত, তবু এই ঘটনাটি মন ছুঁয়ে যায়। মাটি থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট ওপরে হঠ্ৎ যেন মাটির গন্ধ নাকে আসে। ঠিক এই জন্যই যেন আরো একবার বেঁচে থাকা যায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন