লাল কালো রঙে জড়ানো স্বপ্নের সুলুক সন্ধান। বাক্স ভরা খবর। আর তার জন্য প্রতীক্ষা। কতশত রোমান্টিস্ম। সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের কালজয়ী রানার কবিতার হাত ছুঁয়ে, সলিল চৌধুরির সুর আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠমাধুর্য্য। ডাকবাক্স আর ডাকপিওন। কেমন মন কেমন করা কুয়াশার গহিন ডুবে যাওয়া। প্রত্যেকের বাড়িতেও ছিল। হয়তো এখনও আছে। কাঠের তৈরী, এক দিকে ছোট একটা তালা। আজকাল চিঠি আসেনা, আসলেও তা ভীষণই পোশাকি লেখা। কোন কোম্পানির বিজ্ঞাপনের কাগজ, ফোন বা ইলেক্ট্রিকের বিল। তাও ই-মেল কিম্বা এস-এম-এস মারফত এসে যায়, তাই ডাকবাক্স খোলার আগ্রহ থাকে না। অবহেলায় পড়েই থাকে, টিকটিকি বা আরশোলা সংসার পাতে।
কৈশোর পেরোন ভোরে, যখন বিশেষ চিঠির প্রতীক্ষায় দিন যাপন। কখন সেই প্রার্থিত খামটি আসবে? বাইরের অবয়ব দেখেই অনেকটা মন ভরে যায়। তার রঙ, ওজন, গড়ন আর গন্ধ। মিলেমিশে আবহ তৈরী হয়। কেজো চিঠি ইনল্যান্ড, পোস্টকার্ড বা সরকারি খাম। এয়ার মেলের ওপর বিদেশি ডাকটিকিট। শুধু তার আগ্রহে এপাড়া থেকে অন্য পাড়া ছুটে চলে যেত সাইকেল। ডাকপিওন কে আগেভাগে হাত করে নেবার ছল। তার হতের দিস্তা বাঁধা বান্ডিল দূর থেকে দেখেই বোঝা যেত, নিজের বিশেষ চিঠিটি আছে কিনা। বাড়ির ডাকবাক্সে পড়লে অন্য হতেও পড়তে পারে। সেই অতীব গোপনীয় সব শব্দজাল। কিম্বা দুয়েকটা বিদেশি ডাকটিকিট হাতিয়ে নেওয়া। খামের ওপর থেকে মসৃণ ভাবে ছুড়ি দিয়ে চেঁছে নেওয়া। ডাকটিকিট নিয়ে বিশ্বজোড়া চর্চা। তার জন্য সুরম্য অ্যালবাম, প্রথম প্রকাশের খাম, এ সমস্ত অতি মহার্ঘ্য দখল। এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মতে হাত বদল হয় তার উত্তরাধিকার।
ডিমপুকুরের ফাঁড়ির গায়ে একটা লাল বাক্স ঝোলানো থাকত। পাড়ার লোককে পোস্টঅফিস অবধি উজিয়ে যেতে হতো না চিঠি ডাকে দেবার জন্য। ভারতবর্ষ জুড়ে দেড়লক্ষের বেশি পোস্ট অফিস আছে। ডাকবাক্স আছে আরো বহুগুণ। গাঢ় কালচে-লাল তাদের রঙ। পরবর্তিকালে সবুজ নীল অন্য রঙও হয়। কিন্তু স্বপ্নের রঙ অবশ হয়ে পড়ে। এ পাড়ার সেই লাল বাক্সটি ক্রমশঃ মরচে ধরতে শুরু করে। একসময় দেখা গেল নিচের পাতটি ভেঙে গেছে। কেউ কেউ হয়তো তখনও চিঠি পোস্ট করতেন, কিন্তু সে নিচ দিয়ে গলে যেত। কখন হয়তো দুষ্ট বালকের দল ইচ্ছাকৃত ভাবে চিঠি লোপাটও করে দিত। অন্যের চিঠি পড়ার মধ্যে একটা গোপন শিহরণ জাগানো রোমাঞ্চ থাকত। ক্রমে সেই ডাকবাক্সটাও সরিয়ে ফেলা হয়। তার বদলে আর নতুন কোন বাক্স ঝোলানো হয় না। শুধু একটা লোহার আংটা গাছের গুঁড়ির গায়ে পুরোন ক্ষতর মতো জেগে থাকল।
এখনকার প্রেম চিঠির অপেক্ষা করে না। তাৎক্ষনিক খাবারের মত, তাৎক্ষনিক খবরের আদান প্রদান। হয়তো অনেক সময় সঙ্কুলান হয়, মনের কাছে আসতে ডাকপিওনের হাত ধরতে হয় না। তবে ঢিমে আঁচে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা স্বাদের সাথে তাৎক্ষনিক খাবারের যেমন তফাত, চিঠি আর এস-এম-এস হয়তো কতকটা তেমনই। ক্রিয়া আর প্রতিক্রিয়ার দ্রুততায় সম্পর্ক বেড়ে ওঠে তরতর করে। বড় বড় ইমারতের ভিত নির্মাণে, সবচেয়ে বেশি সময় দেওয়া হয়। সিমেন্ট, বালি, পাথর, লোহার মত সময়ও এই নির্মাণের এক মস্ত জরুরী উপাদান। তাই সময় খাইয়ে খাইয়ে শক্ত ভিত্তি তৈরী করেন স্থপতিরা। সম্পর্কের তৈরিতে হয়তো সেই ভিত্তিটা চিঠি গড়ে দিত। এখন তাৎক্ষণিক সম্পর্ক যেমন দ্রুত তৈরি হয়, তেমনই দ্রুত ভেঙেও পড়ে।
টেলিগ্রাফের সরকারি মৃত্যু পরোয়ানায় শিলমোহর পড়ে গেছে অনেকদিন। আর বেশিদিন হয়তো নেই, যখন অবলুপ্ত হবে চিঠি আর ডাকবাক্সের এই ক্ষয়িষ্ণু সম্পর্ক। অনেক পত্র সাহিত্য কেবল ঐতিহাসিক উপাদান হয়ে জেগে থাকবে। পরিবেশ বান্ধবরা হয়তো খুশি হবেন। কতশত গাছ বেঁচে গেল, এই ভেবে। কি জানি কারা মরলো আর সে জন্য কারা বাঁচল? জগতের নিয়মে সে চলতেই থাকবে। যাদুঘরে যেমন পুরাতত্বের নিদর্শন সযত্নে সংরক্ষণ হয়, তেমনি ডাকটিকিট, খাম, চিঠিও থাকে। পরবর্তি প্রজন্ম সেই হলদে হয়ে যাওয়া কাগজের টুকরো তে সময়কে ছুঁয়ে দেখবে। বিদগ্ধ গবেষক মোটা চশমার ফাঁকে পর্যালোচনা করবেন সময়ের সরনীতে ফেলে যাওয়া মাইলফলক। ডাকটিকিট প্রকাশের কারন ও তার পারিপার্শিক সময়ের দলিল হিসেবে তার আদর জুটবে, বক্তৃতায় আর গবেষণপত্রে।
প্রতিটি ডাকটিকিটের পিছনে একটা করে গল্প থাকে। সে শুধু প্রকাশের ইতিহাস নয়, কবে কখন কে পাঠিয়েছিল? সব সময় যে খুব শুভ সংবাদ বয়ে নিয়ে এসেছে তা নয়, বহুবার চোখের জলে ভিজে খবর এসেছে। কাছের কোন মানুষের বিচ্ছেদের খবর। এতটা সময়ের পার থেকে আর ছুঁয়ে দেখার সাধ্য থাকে না। শুধু তার স্পর্শ মাখা খামটি থেকে যায় স্মৃতিচিহ্ন হয়ে। চোখের জলে বিধুর হয়, ফিকে হয়ে আসা হস্তাক্ষর। কবে যেন কে খুব যত্নে লিখেছিল। বুকের তলায় বালিশ দিয়ে উপুড় হয়ে। লিখতে গিয়ে হয়তো ভাঙলো কাচের চুড়ি, কব্জি চুঁয়ে চুনীর ফোঁটা এসে পড়ে লেখার পাতায়। সেই শোনিত চিহ্ন আর এক টুকরো ভাঙা চুড়ির টুকরো বুকে নিয়ে চিঠি ঊড়ে চলে। এ পোস্টাফিস থেকে অন্য পোস্টাফিস। হাত বদল হয় কত ডাক কর্মীর। অবশেষে তা যখন গ্রহকের হাতে পৌঁছয়, সে চিঠি আর চিঠি থাকে না। হয়ে ওঠে এক স্মারক, যা শাজাহনের হাত ধরে মুমতাজ কে অমরত্ব দিয়েছে।
কৈশোর পেরোন ভোরে, যখন বিশেষ চিঠির প্রতীক্ষায় দিন যাপন। কখন সেই প্রার্থিত খামটি আসবে? বাইরের অবয়ব দেখেই অনেকটা মন ভরে যায়। তার রঙ, ওজন, গড়ন আর গন্ধ। মিলেমিশে আবহ তৈরী হয়। কেজো চিঠি ইনল্যান্ড, পোস্টকার্ড বা সরকারি খাম। এয়ার মেলের ওপর বিদেশি ডাকটিকিট। শুধু তার আগ্রহে এপাড়া থেকে অন্য পাড়া ছুটে চলে যেত সাইকেল। ডাকপিওন কে আগেভাগে হাত করে নেবার ছল। তার হতের দিস্তা বাঁধা বান্ডিল দূর থেকে দেখেই বোঝা যেত, নিজের বিশেষ চিঠিটি আছে কিনা। বাড়ির ডাকবাক্সে পড়লে অন্য হতেও পড়তে পারে। সেই অতীব গোপনীয় সব শব্দজাল। কিম্বা দুয়েকটা বিদেশি ডাকটিকিট হাতিয়ে নেওয়া। খামের ওপর থেকে মসৃণ ভাবে ছুড়ি দিয়ে চেঁছে নেওয়া। ডাকটিকিট নিয়ে বিশ্বজোড়া চর্চা। তার জন্য সুরম্য অ্যালবাম, প্রথম প্রকাশের খাম, এ সমস্ত অতি মহার্ঘ্য দখল। এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মতে হাত বদল হয় তার উত্তরাধিকার।
ডিমপুকুরের ফাঁড়ির গায়ে একটা লাল বাক্স ঝোলানো থাকত। পাড়ার লোককে পোস্টঅফিস অবধি উজিয়ে যেতে হতো না চিঠি ডাকে দেবার জন্য। ভারতবর্ষ জুড়ে দেড়লক্ষের বেশি পোস্ট অফিস আছে। ডাকবাক্স আছে আরো বহুগুণ। গাঢ় কালচে-লাল তাদের রঙ। পরবর্তিকালে সবুজ নীল অন্য রঙও হয়। কিন্তু স্বপ্নের রঙ অবশ হয়ে পড়ে। এ পাড়ার সেই লাল বাক্সটি ক্রমশঃ মরচে ধরতে শুরু করে। একসময় দেখা গেল নিচের পাতটি ভেঙে গেছে। কেউ কেউ হয়তো তখনও চিঠি পোস্ট করতেন, কিন্তু সে নিচ দিয়ে গলে যেত। কখন হয়তো দুষ্ট বালকের দল ইচ্ছাকৃত ভাবে চিঠি লোপাটও করে দিত। অন্যের চিঠি পড়ার মধ্যে একটা গোপন শিহরণ জাগানো রোমাঞ্চ থাকত। ক্রমে সেই ডাকবাক্সটাও সরিয়ে ফেলা হয়। তার বদলে আর নতুন কোন বাক্স ঝোলানো হয় না। শুধু একটা লোহার আংটা গাছের গুঁড়ির গায়ে পুরোন ক্ষতর মতো জেগে থাকল।
এখনকার প্রেম চিঠির অপেক্ষা করে না। তাৎক্ষনিক খাবারের মত, তাৎক্ষনিক খবরের আদান প্রদান। হয়তো অনেক সময় সঙ্কুলান হয়, মনের কাছে আসতে ডাকপিওনের হাত ধরতে হয় না। তবে ঢিমে আঁচে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা স্বাদের সাথে তাৎক্ষনিক খাবারের যেমন তফাত, চিঠি আর এস-এম-এস হয়তো কতকটা তেমনই। ক্রিয়া আর প্রতিক্রিয়ার দ্রুততায় সম্পর্ক বেড়ে ওঠে তরতর করে। বড় বড় ইমারতের ভিত নির্মাণে, সবচেয়ে বেশি সময় দেওয়া হয়। সিমেন্ট, বালি, পাথর, লোহার মত সময়ও এই নির্মাণের এক মস্ত জরুরী উপাদান। তাই সময় খাইয়ে খাইয়ে শক্ত ভিত্তি তৈরী করেন স্থপতিরা। সম্পর্কের তৈরিতে হয়তো সেই ভিত্তিটা চিঠি গড়ে দিত। এখন তাৎক্ষণিক সম্পর্ক যেমন দ্রুত তৈরি হয়, তেমনই দ্রুত ভেঙেও পড়ে।
টেলিগ্রাফের সরকারি মৃত্যু পরোয়ানায় শিলমোহর পড়ে গেছে অনেকদিন। আর বেশিদিন হয়তো নেই, যখন অবলুপ্ত হবে চিঠি আর ডাকবাক্সের এই ক্ষয়িষ্ণু সম্পর্ক। অনেক পত্র সাহিত্য কেবল ঐতিহাসিক উপাদান হয়ে জেগে থাকবে। পরিবেশ বান্ধবরা হয়তো খুশি হবেন। কতশত গাছ বেঁচে গেল, এই ভেবে। কি জানি কারা মরলো আর সে জন্য কারা বাঁচল? জগতের নিয়মে সে চলতেই থাকবে। যাদুঘরে যেমন পুরাতত্বের নিদর্শন সযত্নে সংরক্ষণ হয়, তেমনি ডাকটিকিট, খাম, চিঠিও থাকে। পরবর্তি প্রজন্ম সেই হলদে হয়ে যাওয়া কাগজের টুকরো তে সময়কে ছুঁয়ে দেখবে। বিদগ্ধ গবেষক মোটা চশমার ফাঁকে পর্যালোচনা করবেন সময়ের সরনীতে ফেলে যাওয়া মাইলফলক। ডাকটিকিট প্রকাশের কারন ও তার পারিপার্শিক সময়ের দলিল হিসেবে তার আদর জুটবে, বক্তৃতায় আর গবেষণপত্রে।
প্রতিটি ডাকটিকিটের পিছনে একটা করে গল্প থাকে। সে শুধু প্রকাশের ইতিহাস নয়, কবে কখন কে পাঠিয়েছিল? সব সময় যে খুব শুভ সংবাদ বয়ে নিয়ে এসেছে তা নয়, বহুবার চোখের জলে ভিজে খবর এসেছে। কাছের কোন মানুষের বিচ্ছেদের খবর। এতটা সময়ের পার থেকে আর ছুঁয়ে দেখার সাধ্য থাকে না। শুধু তার স্পর্শ মাখা খামটি থেকে যায় স্মৃতিচিহ্ন হয়ে। চোখের জলে বিধুর হয়, ফিকে হয়ে আসা হস্তাক্ষর। কবে যেন কে খুব যত্নে লিখেছিল। বুকের তলায় বালিশ দিয়ে উপুড় হয়ে। লিখতে গিয়ে হয়তো ভাঙলো কাচের চুড়ি, কব্জি চুঁয়ে চুনীর ফোঁটা এসে পড়ে লেখার পাতায়। সেই শোনিত চিহ্ন আর এক টুকরো ভাঙা চুড়ির টুকরো বুকে নিয়ে চিঠি ঊড়ে চলে। এ পোস্টাফিস থেকে অন্য পোস্টাফিস। হাত বদল হয় কত ডাক কর্মীর। অবশেষে তা যখন গ্রহকের হাতে পৌঁছয়, সে চিঠি আর চিঠি থাকে না। হয়ে ওঠে এক স্মারক, যা শাজাহনের হাত ধরে মুমতাজ কে অমরত্ব দিয়েছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন