তিন চাকার কি মহিমা। দেখতে কচ্ছপের মত হলেও চালচলন খরগোশ বা অন্য প্রাণী পতঙ্গের সাথে তুলনীয়। কাঁঠালের গন্ধে যেমন নীল মাছির দল ছুটে আসে, অবিকল সেই ক্ষিপ্রতা। সবেমাত্র সিগনালের হলুদ বা লাল দপদপিয়ে উঠল কি উঠল না, সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকে কোথায় কে ছিল, হুড়মুড়িয়ে অন্য সব যানকে ডিঙিয়ে সামনে চলে এল। অটোরিক্সা। কোথাও শুধু রিক্সা বা কোথাও আবার বেবি ট্যাক্সি। গলি থেকে রাজপথ প্রবল পরাক্রান্ত অস্তিত্ব। সবাই সমঝে চলে। এক সময় কাটাতেল। এখন পরিবেশ বান্ধব গ্যাস। যদিও শহরের শাসনের পরিধির বাইরে এখনও কাটাতেলে রাজত্ব অব্যাহত।
ভাবতে অবাক লাগে, যানের সাথে চালকের কি রাজযোটক? না হলে প্রায় প্রতিটি গাড়ি একই দ্রুততায় একই রকমভাবে নিয়ম ভাঙে, কি করে? নগর কলকাতার নবদিগন্তে কর্পোরেট গেট। উর্দিধারী দ্বাররক্ষী। সেখানে আপিসের তাড়ার সময় চালক অনায়াসে গাড়ি রাখে, যাত্রীর টাকা গোনে, খুচরো নিয়ে বচসা করে, খুব নির্লিপ্ত মুখে। পিছনে তখন সার দিয়ে অন্য গাড়ি দাঁড়িয়ে। দ্বারপাল গেট ছেড়ে দাঁড়াতে অনুরোধ করায়, মুহুর্তে তার বাক্যবিন্যাস চালু। বাছা বাছা কটু শব্দে বুঝিয়ে দেয়, গত দশ বছর এভাবেই চলেছে এবং আগামীতেও একই থাকবে।
অটোযানের একটি বিশেষ আসন, চালকের কোল। সামনের সারিতে বসে বিবিধ মানুষের মধ্যে যাকে সবচেয়ে অকিঞ্চিতকর বলে প্রতীয়মান হন, তিনিই চালক। প্রায় আসনের বাইরে বসে, ঝুলন্ত হয়ে এক অসামান্য প্রতিভায় গাড়ির নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করেন। বিজ্ঞানীরা বলতে পারবেন ওইটুকু পরিসরে, এতগুলো মানুষের স্থান সঙ্কুলান কি করে হয়? সব চালক একই রকম চেহারার নন। কেউ কৃশ কেউ স্থূল কেউ দীর্ঘ কেউবা খাটো। সে কারণে কিন্তু সামনের আসনের পরিবর্তন হয় না। কোথাও তিনজন, কোথাও চারজনের বিধান আছে। পিছনে মোটামুটি তিনজন বসতে পারেন। একবার এক শহরতলির বিশেষ রুটে যাত্রা করতে গিয়ে পিছনের সারিতে কোলে বসার অভিজ্ঞতাও হল। ওদেশে নাকি এমনটাই দস্তুর। আগু পিছু হয়ে বসুন। এ এক অদ্ভুত সমীকরণ। আর অনায়াসে ধরে যায় আট কিম্বা নয়জন। নামার পরও বিষ্ময় কাটে না, এতজন কোথায় ছিলাম? অনেকটা তেঁতুলপাতায় নয়জনের মতো। সবাই যে সুজন, বলাই বাহুল্য।
খুচরো নিয়ে অটো চালকদের নিত্য অভিযোগ। তার উপর এক বিন্দু থেকে আরেক বিন্দু ভাড়া কত হওয়া উচিত এই নিয়ে বিস্তর বাদ বিসম্বাদ। সকালবেলা মেজাজ অপেক্ষাকৃত মসৃণ থাকার কথা। তবু ঝামেলা লেগে গেল এক যাত্রীর সাথে। যাত্রীর মতে বিনিময় মুল্যে একটি টাকা বেশি চেয়েছে চালক। আর চালকের মতে তিনি সঠিক। এই বাদানুবাদে আমাদের দেরী হলেও মুখে প্রকাশ করতে সাহস হয়না। বেশ কিছু সময় ক্ষয় করার পর যাত্রীটি হার মানতে বাধ্য হয়। চালক, নিজের অধিকার ছিনিয়ে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসের সাথে চলতে থাকেন। এর মধ্যে আরেকটি যাত্রী ওঠেন। তাঁর গন্তব্য যে নাম করেন এই অটোটি সেদিকে যাবেনা। তা সত্বেও যাত্রীটিকে নিয়ে চলতে থাকে। বেশ কিছু সময় পর একটি স্থানে গাড়ি থামে। অটোচালক বলেন, এখান থেকে আপনি যে জায়গার কথা বললেন তার গাড়ি পাবেন। যাত্রীটি এ পথে নতুন বোঝাই যাচ্ছে। পার্স বার করে কত দিতে হবে জিজ্ঞেস করেন। চলকের সপাট উত্তর, ওটা আমার রুট নয়, ভাড়া লাগবে না। ঠিক মেলাতে পারছিলাম না, একটু আগে যে একটা টাকার জন্য তুমুল যুদ্ধ করল, সে অনায়াসে আরেক প্রাপ্তির সম্ভাবনা ছেড়ে দিচ্ছে।
চালকের কোলে বসার অতিরিক্ত সুবিধা। প্রথমতঃ সর্পিল পথে গতিময় যাত্রার অ্যাডভেঞ্চারের পূর্ণ স্বাদ। দ্বিতীয়তঃ জগৎ সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গী। রাস্তার ধারে অপেক্ষয়মান যাত্রীর মুখ দেখে বুঝে ফেলেন, উনি বাস না অটো? খুচরো আছে না নেই। কিম্বা আদৌ ভাড়া দেবেন কি না? অবাক লাগে তার দূরদৃষ্টি আর মানুষ চেনার চোখ দেখে। এরকম এক রাতে চালকের কোলের ছেলে হয়ে ফিরছি। সময়টা দুর্গাপুজোর পরের সপ্তাহ। রাত নটা টটা হবে। বাতাসে উৎসবের রেশ মেলায়নি। রাস্তাঘাট অপেক্ষাকৃত ফাঁকা। আমাদের অটোটিকে ঝড়ের বেগে অতিক্রম করে তিনটি বাইক। প্রতিটিতে তিনটি করে অল্পবয়সী বালক। কারো মাথায় শিরোস্ত্রাণ নেই। সাপের মতো এঁকে বেঁকে তাদের গতিপথ। একেক বাইকের ভাঁজে হাঁটু ছুঁয়ে যায় রাস্তা। চালক বন্ধু উদাস গলায় বলে, এদের পুজো এখনও শেষ হয়নি। এরপর হয়তো আর দুই তিন কিলোমিটার এগিয়েছি। রাস্তার ধারে জটলা। ইতস্ততঃ ভাঙা বাইক আর রক্তের দাগ। দুতিন জন মিলে নিথর বাইক আরোহীদের শরীরগুলো রাস্তা থেকে পাশে নিয়ে যাচ্ছে। মুহুর্তে হাত পা অবশ হয়ে আসে। বুঝতে অসুবিধা হয়না, এই সেই তিনটে বাইক, যারা একটু আগে যৌবনের তুমুল উত্তেজনার ধ্বজা তুলে আমাদের অতিক্রম করেছিল। অটোচালক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, এবার বোধহয় পুজো শেষ হল।
ভাবতে অবাক লাগে, যানের সাথে চালকের কি রাজযোটক? না হলে প্রায় প্রতিটি গাড়ি একই দ্রুততায় একই রকমভাবে নিয়ম ভাঙে, কি করে? নগর কলকাতার নবদিগন্তে কর্পোরেট গেট। উর্দিধারী দ্বাররক্ষী। সেখানে আপিসের তাড়ার সময় চালক অনায়াসে গাড়ি রাখে, যাত্রীর টাকা গোনে, খুচরো নিয়ে বচসা করে, খুব নির্লিপ্ত মুখে। পিছনে তখন সার দিয়ে অন্য গাড়ি দাঁড়িয়ে। দ্বারপাল গেট ছেড়ে দাঁড়াতে অনুরোধ করায়, মুহুর্তে তার বাক্যবিন্যাস চালু। বাছা বাছা কটু শব্দে বুঝিয়ে দেয়, গত দশ বছর এভাবেই চলেছে এবং আগামীতেও একই থাকবে।
অটোযানের একটি বিশেষ আসন, চালকের কোল। সামনের সারিতে বসে বিবিধ মানুষের মধ্যে যাকে সবচেয়ে অকিঞ্চিতকর বলে প্রতীয়মান হন, তিনিই চালক। প্রায় আসনের বাইরে বসে, ঝুলন্ত হয়ে এক অসামান্য প্রতিভায় গাড়ির নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করেন। বিজ্ঞানীরা বলতে পারবেন ওইটুকু পরিসরে, এতগুলো মানুষের স্থান সঙ্কুলান কি করে হয়? সব চালক একই রকম চেহারার নন। কেউ কৃশ কেউ স্থূল কেউ দীর্ঘ কেউবা খাটো। সে কারণে কিন্তু সামনের আসনের পরিবর্তন হয় না। কোথাও তিনজন, কোথাও চারজনের বিধান আছে। পিছনে মোটামুটি তিনজন বসতে পারেন। একবার এক শহরতলির বিশেষ রুটে যাত্রা করতে গিয়ে পিছনের সারিতে কোলে বসার অভিজ্ঞতাও হল। ওদেশে নাকি এমনটাই দস্তুর। আগু পিছু হয়ে বসুন। এ এক অদ্ভুত সমীকরণ। আর অনায়াসে ধরে যায় আট কিম্বা নয়জন। নামার পরও বিষ্ময় কাটে না, এতজন কোথায় ছিলাম? অনেকটা তেঁতুলপাতায় নয়জনের মতো। সবাই যে সুজন, বলাই বাহুল্য।
খুচরো নিয়ে অটো চালকদের নিত্য অভিযোগ। তার উপর এক বিন্দু থেকে আরেক বিন্দু ভাড়া কত হওয়া উচিত এই নিয়ে বিস্তর বাদ বিসম্বাদ। সকালবেলা মেজাজ অপেক্ষাকৃত মসৃণ থাকার কথা। তবু ঝামেলা লেগে গেল এক যাত্রীর সাথে। যাত্রীর মতে বিনিময় মুল্যে একটি টাকা বেশি চেয়েছে চালক। আর চালকের মতে তিনি সঠিক। এই বাদানুবাদে আমাদের দেরী হলেও মুখে প্রকাশ করতে সাহস হয়না। বেশ কিছু সময় ক্ষয় করার পর যাত্রীটি হার মানতে বাধ্য হয়। চালক, নিজের অধিকার ছিনিয়ে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসের সাথে চলতে থাকেন। এর মধ্যে আরেকটি যাত্রী ওঠেন। তাঁর গন্তব্য যে নাম করেন এই অটোটি সেদিকে যাবেনা। তা সত্বেও যাত্রীটিকে নিয়ে চলতে থাকে। বেশ কিছু সময় পর একটি স্থানে গাড়ি থামে। অটোচালক বলেন, এখান থেকে আপনি যে জায়গার কথা বললেন তার গাড়ি পাবেন। যাত্রীটি এ পথে নতুন বোঝাই যাচ্ছে। পার্স বার করে কত দিতে হবে জিজ্ঞেস করেন। চলকের সপাট উত্তর, ওটা আমার রুট নয়, ভাড়া লাগবে না। ঠিক মেলাতে পারছিলাম না, একটু আগে যে একটা টাকার জন্য তুমুল যুদ্ধ করল, সে অনায়াসে আরেক প্রাপ্তির সম্ভাবনা ছেড়ে দিচ্ছে।
চালকের কোলে বসার অতিরিক্ত সুবিধা। প্রথমতঃ সর্পিল পথে গতিময় যাত্রার অ্যাডভেঞ্চারের পূর্ণ স্বাদ। দ্বিতীয়তঃ জগৎ সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গী। রাস্তার ধারে অপেক্ষয়মান যাত্রীর মুখ দেখে বুঝে ফেলেন, উনি বাস না অটো? খুচরো আছে না নেই। কিম্বা আদৌ ভাড়া দেবেন কি না? অবাক লাগে তার দূরদৃষ্টি আর মানুষ চেনার চোখ দেখে। এরকম এক রাতে চালকের কোলের ছেলে হয়ে ফিরছি। সময়টা দুর্গাপুজোর পরের সপ্তাহ। রাত নটা টটা হবে। বাতাসে উৎসবের রেশ মেলায়নি। রাস্তাঘাট অপেক্ষাকৃত ফাঁকা। আমাদের অটোটিকে ঝড়ের বেগে অতিক্রম করে তিনটি বাইক। প্রতিটিতে তিনটি করে অল্পবয়সী বালক। কারো মাথায় শিরোস্ত্রাণ নেই। সাপের মতো এঁকে বেঁকে তাদের গতিপথ। একেক বাইকের ভাঁজে হাঁটু ছুঁয়ে যায় রাস্তা। চালক বন্ধু উদাস গলায় বলে, এদের পুজো এখনও শেষ হয়নি। এরপর হয়তো আর দুই তিন কিলোমিটার এগিয়েছি। রাস্তার ধারে জটলা। ইতস্ততঃ ভাঙা বাইক আর রক্তের দাগ। দুতিন জন মিলে নিথর বাইক আরোহীদের শরীরগুলো রাস্তা থেকে পাশে নিয়ে যাচ্ছে। মুহুর্তে হাত পা অবশ হয়ে আসে। বুঝতে অসুবিধা হয়না, এই সেই তিনটে বাইক, যারা একটু আগে যৌবনের তুমুল উত্তেজনার ধ্বজা তুলে আমাদের অতিক্রম করেছিল। অটোচালক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, এবার বোধহয় পুজো শেষ হল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন