কথা জন্মায়, ঘাসের মতো। বুকের ওপর একটু রোদ পড়লেই দেখা
যায় সবু্জ আভা। আবার কিছুদিন ঢেকে রাখলেই কেমন হলদেটে হয়ে যায়। সারাদিন মাঠে ঘাটে রাস্তায়
বাড়িতে, এমনকি স্বপ্নের মধ্যেও বিজবিজ করতে থাকে কথা। যানবাহনে চলতে চলতে, কানে হেডফোন
গোঁজা স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে কথার পাহাড় ডিঙিয়ে চলেছি। রাস্তা পার হই কথা বলতে বলতে,
রেললাইন টপকাই কথার সাথে। এ নিয়ে দুর্ঘটনাও কম হয়নি। বিশিষ্ট মেকাপ শিল্পী প্রবীর দে
চলে গেলেন দশ বছরের (২০০৫) ওপর হয়ে গেছে। তাঁর ছেড়ে যাওয়া কথাগুলো আগাছার মতো বেড়ে
গেছে আজ। ঘাসের যত্ন না করলে যা হয়। সেই ঘাসে জড়িয়ে গেছে আরো অনেক নাম।
জানকী প্রসাদের বয়স হয়েছে। দিনকালের মাপজোক ঠিক ঠাহর করতে
পারেন না। একদিন খুব খেদের সঙ্গে বড় ছেলেকে বললেন, “আজকালকার ছেলে মেয়েদের জন্য খুব
দুঃখ হয়। খুব কাজের চাপ”। ছেলে পরাশর একটু অবাক হয়ে তাকায়। জানকী বলে চলেন, “পথ ঘাটে
সব জায়গায় দেখি, সবার কানে যন্ত্র লাগানো, আর বিড়বিড় করে একা একা কথা বলে চলেছে”। পরাশর
প্রথমটায় বুঝতে পারেনি, বাবার হতাশার কারন কি? পরে বোঝে, বাবাদের আমলে এমনি তার সহযোগে
শ্রবন যন্ত্র ব্যবহৃত হত। ভেবে একটু হাসি পেলেও বাবার ভাবনাকে দূর করার চেষ্টা করে
না। যুগের নিয়মে মেলাতে পারবে না।
সবাই যে বিড়বিড় করেন তা নয়। কান না পাতলেও অজস্র শব্দবিন্যাস
জবরদস্তি কানের ভেতর দিয়ে মরম পোষন করে যাবে। পালাবার উপায় নেই। সকালবেলা আপিস
যাবার গাড়ি। প্রতিটি মুহুর্ত মূল্যবান। উপস্থিতির খাতায় লেটমার্ক পড়ে যাবার ভয়।
কোনরকমে সবাই এসে সিট দখল করে বসেছে। বসেই চালককে তাগাদা দিচ্ছে “চলো হে দেরি হয়ে
গেল”, “চল্ চল্ আর টাইম খাস না”, “একটু টেনে চালা”, “কালকের মত জ্যাম খেয়ে গেল...”।
এমনই নানা বাক্য ছুটে আসতে থাকে। গাড়ি চালু হয়ে গেলেই, যে যার যন্ত্রটি বার করে
ফেলেন। কেউ গেম খেলেন, কেউ ফেসবুক-হোয়াটসাপ, কেউ কানে হেডফোন গুঁজে সঙ্গীতরসে ডুবে
যান, কেউবা রেডিও। সিনেমাও দেখেন অনেকে। আবার কেউ
কেউ বাড়িতে ধারাভাষ্য দেন, “এই গাড়িতে উঠেছি, রাস্তায় জ্যাম আছে, সামনেই চড়াইপুর যাচ্ছে”
ইত্যাদি।
এক সুবেশা ভদ্রমহিলা। বোঝাই যাচ্ছে কোন বড় আপিসের কর্মী।
খুব আন্তরিক মুখ করে ফোন কানে দেন। গাঢ় স্বরে কথোপকথন শুরু হয়। “তুমি কিন্তু আজও দেরী করে ফেললে"। ভাবলেন, বাঃ এবার বোধহয়
প্রেমালাপ জমে যাবে। পরের বাক্যতেই বিষয়বস্তু জানতে অসুবিধা হয়না, অন্যপ্রান্তে জনৈক মালতী দি আছেন।
“আমার বেরোনোর আগে কিছুতে আসোনা, দাদাকে চাওমিনটা
করে দিও, পাঁচতলার প্রিয়াঙ্কা বৌদি আসতে পারে, ওর শাড়িটা নিয়ে নিও, বালতিতে জামাকাপড়
ভিজানো রয়েছে, কলারগুলোতে সাবান দিও প্লিজ, রোজ মনে করাতে হয়, বাবলু স্কুল থেকে এসে
ভাত খাবে, মাছে কালকের মতো নুন দিয়ে ফেল না…” ইত্যাদি প্রভৃতি। চলমান ইতিহাস ভুগোলসহ
সংসার সংবেদ।
যাতায়াতের পথে অনেকের অনেক তথ্য সামনে চলে আসে, কার কে
কোন হাসপাতালে ভর্তি? কার বৌয়ের সাথে কার গোপন সম্পর্ক তৈরি হল? কে কোথায় চাকরি পেল
বা পেল না? চোখের সামনে সম্পর্ক গজিয়ে ওঠে, বড় হয়, আবার ধুলিস্যাত। নিবিড় কথাও চোখে
আসে, তবে কানে পৌঁছায়না। নব্য তরুনীরা এক বিশেষ কন্ঠবিদ্যায় পারদর্শী হয়েছেন। গাড়ি্তে
বসে অনর্গল দয়িতের সঙ্গে কথা বলে যাবেন, পাশের সিট থেকে শুধু ঠোঁট আর ভ্রূভঙ্গী চোখে
পড়বে, একটি শব্দও কানে পৌঁছাবে না।
কানে ফোন বা তার গোঁজা থাকলে; তা দেখে বোঝা যায়, কথার
মধ্যে আছেন। অনেকের ব্লুটুথ যন্ত্র। পাশে থেকেও প্রথমে আঁচ পাওয়া যায় না, কার সাথে
কথা বলছে। হঠাৎ করে জোরালো আওয়াজ, “হ্যাঁ রে কেমন আছিস?” খুব স্বাভাবিক বন্ধু সুলভ
সম্ভাষণ। হাসি মুখ করে, বিশেষ পরিচিত কাউকে দেখবার প্রতিক্রিয়ায় চোখ ফেরালে হতাশ হতে
হবে। মানুষটির “হ্যাঁ রে”-টি হয়তো বিশ মাইল দুরে, কি তারও বেশি। নিশ্চিত সামনের মানুষটির
দিকে তাকিয়ে কথা বলছে কিন্তু সংযুক্ত আছেন অন্যকোন সত্যের মধ্যে। নিঃসন্দেহে এক যোগীপুরুষের
ভাব। এমনই আরেক যোগীপুরুষ বড় রাস্তার মুখে দাঁড়িয়ে কাউকে ওই ব্লুটুথের মাধ্যমে প্রচুর
ধমকাচ্ছিলেন। তার কথার মধ্যে অজস্র শ-কার ব-কার এবং পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ। অদূরেই এক
ট্রাফিক পুলিশ ডিউটি করছিলেন। যোগীপুরুষের মুখ সরাসরি পুলিশের দিকে ফেরানো। হঠাৎ করে
ধেয়ে আসা গালিগালাজ শুনে অবাক হয়ে তাকান, বোঝার চেষ্টা করেন, কেন তাকে গালি শুনতে হচ্ছে?
একটু তাকিয়ে বোঝেন, ব্লুটুথের মহিমা। কোনক্রমে তাৎক্ষণিক রাগ সংহত করে নিজের কাজে মন
দেবার চেষ্টা করেন। কিন্তু যোগীপুরুষ তো অন্য এক পরাবাস্তবে বিরাজ করছেন। অব্যবহিত
পরে আরো উত্তেজিত কন্ঠে ফোনের ওপারে থাকা মানুষটির উদ্দেশ্যে বাছা বাছা গাল পাড়তে থাকেন।
এদিকে ঘটমান বাস্তবে যোগীপুরুষের সমানে পুলিশ মাত্র, আর কেউ নেই। এবার আর পুলিশকে ধরে
রাখা দায়। উপর্যুপরি গালিগালাজ শুনে আর স্থির থাকতে পারেন না। হাতের লাঠিটি বাগিয়ে
তেড়ে আসেন। এবং গলা উঁচিয়ে বলেন “তুই যাবি এখান থেকে? না হলে পিঠে ভাঙবো”। অবশেষে যোগীপুরুষের
ধ্যান ভাঙে, তিনি ঘোর বাস্তবে নেমে দৌড়াতে শুরু করেন।
সে দৌড় আমাদের শব্দ সমুদ্রের জলোচ্ছাসের একটি ঢেউ মাত্র।
এমন রাশি রাশি ঢেউ উঠছে ভাঙছে আবার ঊঠছে। তার নাগাল পাবে কে? হাওয়াতে বড় হয়ে যাওয়া
ঘাস দোলে, জল পায় গাঢ় সবুজ হয়। বুকের ওপর একদিন আর কিছুই থাকবে না। শুধুই শব্দের প্রতিচ্ছবি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন