চেয়ার বা কেদারা আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তা সে ময়ুর সিংহাসন হোক বা রতনবাবুর চেয়ার। রতনবাবু আজ থেকে চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছর আগে কনিষ্ঠ কেরানী হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। সঠিক তারিখটা তাঁর নিজের তো মনে নেই, রেকর্ডেও নেই। প্রথমে ঠিকা কর্মী হিসেবে তাঁর নিয়োগ। যোগদানের প্রায় অব্যবহিত পরেই তার একটি কেদারা বা চেয়ার প্রাপ্তি হয়। সে কাঁঠাল কাঠের তৈরি, ভয়ানক মজবুত একটি নিদর্শন। সেবার যখন বেশকিছু ঠিকা কর্মীকে স্থায়ীপদে নেওয়া হচ্ছে, সাহেব রতনবাবু কে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন, “স্থায়ী তালিকায় নাম তুলতে হলে তো, বয়সের হিসেবটা দিতে হবে”। ততদিনে রতনবাবু হুঁশিয়ার হয়ে দিয়েছেন। সাত ঘাটের জল খেয়ে, যাকে বলে পোক্ত মানুষ। অত্যন্ত লাজুক মুখে, নিজের পায়ের বুড়ো আঙুল নিরীক্ষণ করতে করতে জবাব দেন, “কত আর হবে? ওই আঠাশই লিখে দিন। সত্যি বলতে, আজ তো আমার পুনর্জন্ম হল”। সাহেব মুচকি হেসে রতনবাবুর দিকে তাকান। কারণ রতনবাবুর ছেলেই আঠারোর গন্ডী পেরিয়ে গেছে। রতনবাবুর দৃষ্টি তখনো নিজের পায়ের আঙুলে নিবদ্ধ। সাহেব কি বুঝলেন কে জানে, যা হোক ওই আঠাশের কাছাকাছি একটা বয়স দাগিয়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকে রতনবাবু আর তাঁর চেয়ার প্রায় সমার্থক।
এর মধ্যে বহুবার আপিসের খোলনলচে পাল্টছে। এসেছেন নতুন কর্মচারীর দল, এসেছে নতুন আসবাব। শুধু রয়ে গেছেন রতনবাবু আর তাঁর চেয়ার। এখনকার আপিস ঘর, বড় হলের মত। তার মধ্যে সার সার ঘনক। প্রতিটি ঘনকের সাথে যুক্ত মানানসই একেকটি চেয়ার। শুধু রতনবাবুর চেয়ারটি একই ভাবে আলোকিত করে রেখেছ। মহামতি ভরত যেমন চোদ্দ বছর সিংহাসনের পাশে বসেই কাটিয়ে দিলেন, রতনবাবুরও তেমনই তাঁর চেয়ারের প্রতি আনুগত্য। নতুন আসবাব আসার সাথে পুরোন আসবাব সরানোর ধুম পড়ে যায়। একবার তো নীলামের আয়োজন করা হয়। বেশ কিছু কর্মচারী রীতিমত মুটে ডেকে আপিস থেকে চেয়ার, টেবিল, আলমারি বাড়ি নিয়ে গেছেন। শোনা যায় আনেকে আবার নিজের মেয়ের বিয়েতে যৌতুক হিসেবে আপিসের নীলাম থেকে কেনা আসবাব দিয়ে পাত্রকুলে সুনাম অর্জন করেন। আপিসের আসবাব পুরোন হলেও কেতাদার। একমাত্র রতনবাবুর চেয়ার ধ্রবতারার মতো স্থির হয়ে থাকে। অন্যদের চেয়ার পাল্টেছে, রতনবাবু আপিস কে অনুরোধ করে চেয়ারটি নতুন করে পালিশ করিয়ে নিয়েছেন। তাই দেখতে হাল ফ্যাশানের না হলেও জেল্লা কিছু কম নয়।
চেয়ারের সাথে যে শুধুমাত্র রতনবাবুর সখ্যতা, এটা বলা ঠিক হবে না। ট্রেনের নিত্যযাত্রীদের মধ্যে নির্দিষ্ট কামরার নির্দিষ্ট চেয়ার না পেলে সারাদিন কেমন যেন লাগে। নির্দিষ্ট শৌচাগার না পেলে, অনেকেরই প্রাতকৃত্য পরিস্কার হয়না। খেতে বসার নির্দিষ্ট স্থান, সেলুনে বসবার নির্দিষ্ট চেয়ার বা গাছতলা, সব কিছুর অনুষঙ্গে এই নিরীহ আসবাবটি জড়িয়ে যায়। নতুন কর্মচারীদের মধ্যে কোন বিশেষ চেয়ার বা স্থানের প্রতি মোহ বজায় রাখার উপায় নেই। আধুনিক আপিস ব্যবস্থায়, ল্যাপটপ যন্ত্রটি থাকলেই নিজের আপিস তৈরী। কোনো বিশেষ ঘনকের ওপর নির্ভরশীল হবার দরকার নেই। একবার এক অল্পবয়সী মহিলা কর্মচারীর কাজের ক্ষেত্র বদল হয়। নতুন ক্ষেত্রটি একই আপিসের অন্য তলায়। নির্দিষ্ট দিন থেকে, তাঁর অন্য সহকর্মীদের সাথে গিয়ে বসতে হয়। কিন্তু দেখা গেল প্রতিদিন সকালে, সেই মহিলা কর্মচারীটি তাঁর পূর্বতন চেয়ারে এসে কিছুক্ষণ বসেন, চুল আঁচড়ান, তারপর ধীরে ধীরে নিজের নতুন আসনে চলে যান।
রতনবাবুর কথা আলাদা। ওনার দপ্তর আলাদা হয়েছে, বসার স্থানের বদল হয়েছে। কিন্তু যেখানেই গেছেন, নিজের চেয়ারটি সঙ্গে নিয়ে গেছেন। এই আপিসে থেকেই তাঁর ছেলে মেয়েদের বিবাহ হল। নাতি নাতনি হল। অবশেষে সেই দিনটি এসে উপস্থিত। রতনবাবুর অবসর। আজ বাড়ি থেকে তাঁর স্ত্রী, এক পুত্র, পুত্রবধু ও নাতনি এসেছে। আপিসের পর এক মিটিংরুমে সবাই জমায়েত হয়। রতনবাবু দৃশ্যতঃ আবেগপ্রবণ। বয়সের জল মেশানোর পরও, আজ সত্যি তাঁর সময় ফুরিয়ে এল। নানা বয়সোচিত উপহার পাওয়া, হাসি হাসি মুখে সবার সাথে ছবি তোলার পর্ব শেষ হবার পর রতনবাবু জনতার উদ্দেশ্যে দরবার করেন। প্রবীনত্বের কারণে কনিষ্ঠ কেরানী থেকে যতটা ওপরে ওঠা, তার বেশি তো নয়। নতুন যোগ দেওয়া ছেলে মেয়েগুলোও তাঁর চেয়ে বেশি মাইনে পায়। সেদিক দিয়ে খুব কুন্ঠিত থাকেন। আমতা আমতা করে বলেন, যদি চেয়ারটি কে তাঁকে উপহার হিসেবে দেওয়া হয়, উনি চিরকৃতজ্ঞ থাকবেন। বলাই বাহুল্য এহেন অনুরোধ আজকের এই বিশেষদিনে অনুমোদন পেতে বেশিক্ষণ লাগবে না।
সবকিছু মিটে যাবার পর পরিবার ও চেয়ার সমেত ছলছল চোখে, একটি মালবাহী গাড়িতে গিয়ে বসেন। ড্রাইভারের কেবিনে স্ত্রী ও নাতনি। বাকিরা সবাই পিছনের ডালাতে। মাঝখানে আলো করে আছে সেই কাঁঠাল কাঠের চেয়ার, যার ওপরে রাজার মতো বসে রতনবাবু। পুত্র ও পুত্র বধূ পায়ের কাছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন