চলতে গিয়ে চলা আর বলতে গিয়ে বলা। গোটা জীবনটা কেটে যায়। পথ চলতে দেখা হয় কত মানুষের সাথে। এক গাড়িতে কিছুক্ষণ, তারপর যে যার পথে। সকালের সেই চেনা মুখটা বিকেলে হয়তো মনেও পড়েনা। গোবিন্দ প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময় বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ায়। ভজাইবাবার মন্দির। এখান থেকে এক কিলোমিটার মতো গেলে জমজমাট মোড় ডিমপুকুর। বেশিরভাগ অটো চেষ্টা করে ডিমপুকুরে গিয়ে বড় মাছ ধরতে। গোবিন্দ তখন মন কাচমাচু করে দাঁড়ায়, অধিকাংশ গাড়ি তাকে না নিয়ে চলে যায়। এর মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ কেউ একবারে ওকে নিয়ে ফেলে। তখন আহ্লাদে আনুগত্যে প্রায় জল এসে যাবার জোগাড়। পাশে বসে কত রকম মানুষ আর তাদের কত রকম চলন বলন। তার মধ্যে কেউ কেউ মনের ভিতর সেঁধিয়ে যায়।
গোবিন্দর আপিসপাড়া, চড়াইপুর। আপিস ফেরতা গাড়িতে বসে আছে। যাত্রী বোঝাই না হলে ছাড়বে না। আজ বেশ রাত হয়ে গেছে। যাত্রী ভরতে সময় বেশি লাগছে। যে কয়েকজন বসে গেছেন, তাঁরা অস্থির হয়ে আসে পাশে দেখছেন, কেউ আসছেন কিনা। দোকানপাটও বন্ধ । একটি সাতাশ আঠাশ বছরের ছেলে অনর্গল ফোনে কথা বলে যাচ্ছে। কথার ধরন দেখে বোঝা যায়, অন্যদিকে বিশেষ কেউ। যে হয়তো অনেক উৎকন্ঠা নিয়ে অপেক্ষায়। গোবিন্দ এই ফেরার সময় কিছুমিছু খায়। বাদাম, ঝালমুড়ি। আজ চিঁড়েভাজা পেয়েছিল। অপেক্ষার সময়টা চিঁড়ে দিয়ে ভরাট করছে, নির্লিপ্তভাবে। শুনতে পায় উল্টোদিকের ছেলেটি ফোনে বলছে, বড্ড খিদে পেয়ে গেছে। অথচ কাছাকাছি যে কটি খাবার দোকান ছিল, সবই ঝাঁপ ফেলেছে। প্রিয়জনের কষ্টের কথা শুনে, ওদিকের মানুষটি নিশ্চই উতলা হয়ে উঠছেন। ছেলেটিও খানিক যেন আনন্দ পাচ্ছে, কষ্ট দিয়ে। বারে বারে খিদের কথা তুলছে। কেউ আমার জন্য উতলা, এটা ভাবলেও তো নিজেকে দামী লাগে। হয়তো তাই। গোবিন্দর মুশ্কিল হল। সামনে ক্ষুধার্ত মানুষকে রেখে নিজে একা একা কি করে খায়? অথচ প্যাকেট মাত্র একটি, তাও ভেঙে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। নিজের এঁটোটা কাউকে দিতে যাওয়া কি সভ্যতা বোধ? এই ভাবতে ভাবতে গোবিন্দ আরও বার দুয়েক মুখে চিঁড়ে চালান করে। আর ছেলেটি যেন সেটি দেখে বেশি বেশি করে খিদে পাওয়ার কথা বলছে। শেষমেষ আর থাকতে পারে না। ছেলেটি গোবিন্দ কে বলেই ফেলে, “কি খাচ্ছেন, একটু দেবেন”। ওফ! গোবিন্দ হাঁফ ছাড়ে। নিজে থেকে কিছুতেই ডিঙোতে পারছিল না। অথচ বাধাটা যে কিসের কে জানে। ছেলেটি কেমন অবলীলায় চেয়ে ফেলল। গাড়ি ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে। গোবিন্দ নিজে এক আঁজলা নিয়ে পুরো প্যাকেটটা ছেলেটিকে দিয়ে দেয়। একটু না না করে, নিয়ে নেয়। খিদের চেয়ে বেশি সত্যি আর কি আছে? আর এসময়, চোখের সামনে কাউকে খেতে দেখলে, খিদে আরো বেড়ে যায়। তারপর থেকে অনেকদিন গোবিন্দ ছেলেটিকে খুঁজেছে, দেখেনি। আজকাল মুখটাও মনে পড়েনা। তবে ঘটনাটা গেঁথে রইল অনেক গভীরে।
কোনদিন সহযাত্রীটি যদি সুবেশা তরুনী হয়, তবে তো কথাই নেই। সেই কবেকার ট্রাম যাত্রার 'কমলা'কে মনে পড়ে যায় অনায়াসে। গোবিন্দর আজ সুখের দিন। “...আর কোন সম্বন্ধ না থাক্, ও তো আমার সহযাত্রিণী”। সেই ছোট তৃপ্তিটুকু নিয়ে চড়াইপুর পর্যন্ত এসে পড়ে। মেয়েটি একটু আগে নেমে পড়ে। গাড়ি ফাঁকা হতেই দেখে, সিটের ওপর একটা মোবাইল রাখা। বাকিরা বলল, নির্ঘাত ওই মেয়েটির। একজন বললে, “ড্রাইভারের কাছে রেখে দিন”, আরেকজন গোবিন্দকে দেখিয়ে বলে “আপনি রেখে দিন। যার ফোন সে তো ফোন করবেই। আপনার কাছাকাছি আপিস, ওনাকে ডেকে দিয়ে দেবেন। ড্রাইভার কে দিলে, কালকের আগে পাবে না”। গোবিন্দ একটু হকচকিয়ে যায়, সবার মুখের দিকে চেয়ে আমতা আমতা করে ফোনটা নিল। বুঝলনা ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে কিনা। আপিসে এসে অবধি অস্বস্তি। কখন ফোন আসবে? কিভাবে কথা বলবে? কোথায় আসতে বলবে? আসলে, কি চা খাওয়ার কথা বলবে? আরও অনেক পারমপর্য ভেবে ফেলে। কাজের ফাঁকে একদুবার ড্রয়ার খুলে ফোনটা স্পর্শ করে। স্মার্টফোন। লক করা। গোবিন্দ অন করার কথা ভাবেনি। এমন সময় ফোন বেজে ওঠে। ফোন ধরতে অন্যপাশ থেকে পুরুষ কন্ঠ ভেসে আসে। তিনি বলেন, এটি তাঁর ফোন, গাড়িতে ফেলে এসেছেন। গোবিন্দর তালগোল পাকিয়ে যায়, তবে কি ফোনটা মেয়েটির নয়? মেয়েটির অন্যপাশে কে বসেছিলেন? তাকে কি গোবিন্দ চিনতে পারবে? সব গুলিয়ে যেতে থাকে। না কি এ আদপে ফোনের মালিক নয়?
ভদ্রলোক রিসেপশানে বসে। কাচের পাল্লার ওপাশ থেকে গোবিন্দ ওঁকে দেখে আর মেলাবার চেষ্টা করতে থাকে। কতশত মুখ রোজ দেখা হয়, কিন্তু একটাও যে মনে পড়ছে না। শুধু কিছু পারিবারিক পরিধির চেনা মুখ ভেসে আসছে। কিন্তু কোন ভাবেই মনে আসছে না আজকের গাড়িতে কারা ছিলেন।
গোবিন্দর আপিসপাড়া, চড়াইপুর। আপিস ফেরতা গাড়িতে বসে আছে। যাত্রী বোঝাই না হলে ছাড়বে না। আজ বেশ রাত হয়ে গেছে। যাত্রী ভরতে সময় বেশি লাগছে। যে কয়েকজন বসে গেছেন, তাঁরা অস্থির হয়ে আসে পাশে দেখছেন, কেউ আসছেন কিনা। দোকানপাটও বন্ধ । একটি সাতাশ আঠাশ বছরের ছেলে অনর্গল ফোনে কথা বলে যাচ্ছে। কথার ধরন দেখে বোঝা যায়, অন্যদিকে বিশেষ কেউ। যে হয়তো অনেক উৎকন্ঠা নিয়ে অপেক্ষায়। গোবিন্দ এই ফেরার সময় কিছুমিছু খায়। বাদাম, ঝালমুড়ি। আজ চিঁড়েভাজা পেয়েছিল। অপেক্ষার সময়টা চিঁড়ে দিয়ে ভরাট করছে, নির্লিপ্তভাবে। শুনতে পায় উল্টোদিকের ছেলেটি ফোনে বলছে, বড্ড খিদে পেয়ে গেছে। অথচ কাছাকাছি যে কটি খাবার দোকান ছিল, সবই ঝাঁপ ফেলেছে। প্রিয়জনের কষ্টের কথা শুনে, ওদিকের মানুষটি নিশ্চই উতলা হয়ে উঠছেন। ছেলেটিও খানিক যেন আনন্দ পাচ্ছে, কষ্ট দিয়ে। বারে বারে খিদের কথা তুলছে। কেউ আমার জন্য উতলা, এটা ভাবলেও তো নিজেকে দামী লাগে। হয়তো তাই। গোবিন্দর মুশ্কিল হল। সামনে ক্ষুধার্ত মানুষকে রেখে নিজে একা একা কি করে খায়? অথচ প্যাকেট মাত্র একটি, তাও ভেঙে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। নিজের এঁটোটা কাউকে দিতে যাওয়া কি সভ্যতা বোধ? এই ভাবতে ভাবতে গোবিন্দ আরও বার দুয়েক মুখে চিঁড়ে চালান করে। আর ছেলেটি যেন সেটি দেখে বেশি বেশি করে খিদে পাওয়ার কথা বলছে। শেষমেষ আর থাকতে পারে না। ছেলেটি গোবিন্দ কে বলেই ফেলে, “কি খাচ্ছেন, একটু দেবেন”। ওফ! গোবিন্দ হাঁফ ছাড়ে। নিজে থেকে কিছুতেই ডিঙোতে পারছিল না। অথচ বাধাটা যে কিসের কে জানে। ছেলেটি কেমন অবলীলায় চেয়ে ফেলল। গাড়ি ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে। গোবিন্দ নিজে এক আঁজলা নিয়ে পুরো প্যাকেটটা ছেলেটিকে দিয়ে দেয়। একটু না না করে, নিয়ে নেয়। খিদের চেয়ে বেশি সত্যি আর কি আছে? আর এসময়, চোখের সামনে কাউকে খেতে দেখলে, খিদে আরো বেড়ে যায়। তারপর থেকে অনেকদিন গোবিন্দ ছেলেটিকে খুঁজেছে, দেখেনি। আজকাল মুখটাও মনে পড়েনা। তবে ঘটনাটা গেঁথে রইল অনেক গভীরে।
কোনদিন সহযাত্রীটি যদি সুবেশা তরুনী হয়, তবে তো কথাই নেই। সেই কবেকার ট্রাম যাত্রার 'কমলা'কে মনে পড়ে যায় অনায়াসে। গোবিন্দর আজ সুখের দিন। “...আর কোন সম্বন্ধ না থাক্, ও তো আমার সহযাত্রিণী”। সেই ছোট তৃপ্তিটুকু নিয়ে চড়াইপুর পর্যন্ত এসে পড়ে। মেয়েটি একটু আগে নেমে পড়ে। গাড়ি ফাঁকা হতেই দেখে, সিটের ওপর একটা মোবাইল রাখা। বাকিরা বলল, নির্ঘাত ওই মেয়েটির। একজন বললে, “ড্রাইভারের কাছে রেখে দিন”, আরেকজন গোবিন্দকে দেখিয়ে বলে “আপনি রেখে দিন। যার ফোন সে তো ফোন করবেই। আপনার কাছাকাছি আপিস, ওনাকে ডেকে দিয়ে দেবেন। ড্রাইভার কে দিলে, কালকের আগে পাবে না”। গোবিন্দ একটু হকচকিয়ে যায়, সবার মুখের দিকে চেয়ে আমতা আমতা করে ফোনটা নিল। বুঝলনা ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে কিনা। আপিসে এসে অবধি অস্বস্তি। কখন ফোন আসবে? কিভাবে কথা বলবে? কোথায় আসতে বলবে? আসলে, কি চা খাওয়ার কথা বলবে? আরও অনেক পারমপর্য ভেবে ফেলে। কাজের ফাঁকে একদুবার ড্রয়ার খুলে ফোনটা স্পর্শ করে। স্মার্টফোন। লক করা। গোবিন্দ অন করার কথা ভাবেনি। এমন সময় ফোন বেজে ওঠে। ফোন ধরতে অন্যপাশ থেকে পুরুষ কন্ঠ ভেসে আসে। তিনি বলেন, এটি তাঁর ফোন, গাড়িতে ফেলে এসেছেন। গোবিন্দর তালগোল পাকিয়ে যায়, তবে কি ফোনটা মেয়েটির নয়? মেয়েটির অন্যপাশে কে বসেছিলেন? তাকে কি গোবিন্দ চিনতে পারবে? সব গুলিয়ে যেতে থাকে। না কি এ আদপে ফোনের মালিক নয়?
ভদ্রলোক রিসেপশানে বসে। কাচের পাল্লার ওপাশ থেকে গোবিন্দ ওঁকে দেখে আর মেলাবার চেষ্টা করতে থাকে। কতশত মুখ রোজ দেখা হয়, কিন্তু একটাও যে মনে পড়ছে না। শুধু কিছু পারিবারিক পরিধির চেনা মুখ ভেসে আসছে। কিন্তু কোন ভাবেই মনে আসছে না আজকের গাড়িতে কারা ছিলেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন