অভিযোজন
দোয়েলপাড়ার মাঠে পুজোর বাঁশ পড়েছে।
এই অঞ্চলে এটাই সবচেয়ে বড় পুজো। আর প্রতি বছর ঠিক পনেরোই অগাষ্ট মাঠে প্যান্ডেলের
বাঁশ পড়ে। দিগিন এ পাড়ার আশ্রিত। রোগা দড়ি পাকানো চেহারা। তা দেখে বয়স আন্দাজ করা
খুব মুশকিল। পঞ্চাশ থেকে সত্তর যা খুশি হতে পারে। মাঠের পাশেই বিশাল দিঘি। তার
ভাঙাচোরা ঘাটে সন্ধ্যেবেলার বাবার প্রসাদ চড়িয়ে বসে আছে। মনের মধ্যে বেশ রঙ ধরেছে।
স্বাধীনতা দিবসের সকালে কয়েক পশলা বৃষ্টির পর বিকেলটা বেশ মনোরম। দিগিনের বড় সুখ
হচ্ছে। এ পাড়ায় সে ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো। কখনও ইস্ত্রিওয়ালা, কখনও কারো বাজার
সরকার, কখনওবা শ্মশান যাত্রী বা হাসপাতালে রাত জাগার লোক। সন্ধ্যের মুখে, এই ঘাটে
কেউ বড় একটা আসেনা। হঠাৎ দিগিনের খেয়াল হয়, কে একটা যেন জলের কাছে বসে। কি রে
বাবা! সুইসাইড কেস না কি? দিগিন এমন অনেক দেখেছে। ভোম্বলদার ছোট মেয়ে, বিয়ের আগের
দিন রাতে এই ঘাটেই ডুব দিয়েছিল। দিগিন তখনও এমন বোম ভোলা হয়ে ছিল। ভেবেছিল, মেয়েটি
বোধহয় নাইতে এসেছে। তা পরদিন দারোগা যখন ওকে জিজ্ঞেস করে, ওর খুব কষ্ট হয়েছিল। আহা
রে! আগে জানলে নিশ্চই বাঁচাতে পারত। আজ আর দেরী করেনা পায় পায়, সিঁড়ি ভেঙে নামে।
বিশাল পালোয়ানি চেহারা। জলের দিকে মুখ করে বসা। পরনে টাইট গেঞ্জী আর প্যান্ট।
বাবা, এত স্বাস্থ্যবান লোক, নিশ্চই সুইসাইড করতে আসেনি। নিজেকে আস্বস্ত করে দিগিন।
- দাদা কি পাড়ায় নতুন?
মিহি সুরে দিগিন জিজ্ঞেস করে।
কিন্তু ওপাশ থেকে কোন উত্তর আসেনা। শুধু লোকটা পাশ ফিরে চায়। যেমন রাক্ষসের মতো
চেহারা, তেমনি জাঁদরেল মুখ। পাকানো গালপাট্টা আর কোঁকরা চুল। কোথায় যেন দেখেছে।
কিন্তু এই মুহুর্তে মনে করতে পারেনা। গঞ্জিকায় রঙ ধরলে তখন আলু আর আলুবোখরায় তফাত
করা একটু মুশকিল হয়। চেনা পরিচিতি না হাতড়ানোই ভালো। আবার জিজ্ঞেস করে,
- স্যার কি পাড়ায় নতুন?
- কেন তোমারা কি নতুন লোকের কাছে
ট্যাক্স নাও?
- না স্যার কি বলছেন? আপনারা হলেন
গণ্যমান্য ব্যক্তি।
- কি করে বুঝলে? তুমি তো আমায় আগে
কোনদিন দেখনি।
- সে কি কথা স্যার? আপনাদের মতো
লোককে কি চিনতে হয়? আপানাদের শরীর থেকে একটা জ্যোতি বার হয়।
- ভ্যাট। বাজে কথা যত। ও সব জ্যোতি
ফোতি ফালতু।
-
তা আপনি যাই বলুন, আপনার চেহারার মধ্যে কিন্তু একটা ব্যাপার আছে।
- সে যাই হোক, তুমি বল তোমাদের এই
পাড়ায়, এটা কি দূর্গা পূজার প্যান্ডেল?
- হ্যাঁ স্যার, এটা দূর্গা পূজার
প্যান্ডেল।
- তুমি স্যার স্যার করছো কেন বল
তো?
- না মানে ওই বললাম না, আপনার
চেহারার মধ্যে একটা ব্যাপার আছে। সে বার এই দোয়েল পাড়ায় একটা হাতি এসেছিল। তা ছেলে
বুড়ো, সবাই সেই হাতির ছবি তুলতে লেগেছিল পটাপট করে।
- তা তে কি প্রমান হয়?
- না তেমন কিছু নয়। মানে হাতি টা
কিন্তু কারো ছবি তোলেনি।
- হাতি আবার ছবি তুলবে কেন?
- না মানে সবার হাতিকে বিশেষ
লেগেছিল কিন্তু হাতির কাউকে মনে লাগেনি।
- এমন বলছো, যেন মনে লাগলেই সে ক্যামেরা
বাগিয়ে ছবি তুলতে লেগে যেত?
- ও সেটা হতো না বুঝি?
- তোমার কি তার কাটা আছে?
- স্যার কি পুলিশ?
- কেন বলতো?
- না কেমন ঠিক ঠিক আন্দাজ করে
ফেল্লেন?
- মানে?
- না এমনি তে ঠিক থাকে, ওই
সন্ধ্যের পর আমার একটু আলুথালু হয়ে যায়।
- তার মানে তোমার আলুর এখন পটল তোলার
অবস্থা?
- যা বলেন। আপনারা সব গণ্যমান্য
ব্যক্তি।
- আবার সেই এক কথা?
- তার মানে আপনি এখানে নতুন।
- নতুন আবার পুরোণও বটে।
- নতুন কিন্তু পুরোণ? কি করে হয়?
- তা তুমি এখন বুঝবে না। দিনের
বেলা বুঝে নিও।
- বেশ না হয় দিনের বেলায় জিজ্ঞেস
করবেন। কিন্তু আপনাকে কখনও দেখেছি বলে তো মনে পড়েনা। অথচ আপনার মুখটা খুবই পরিচিত।
- বছ্ছরের চারটা দিন তো আমাকেও
দেখ। না চেনার তো কিছু নেই।
- ও আপনি বুঝি ক্লাবের
প্যান্ডেলওয়ালা? তা তখনই ঠাহর হয়ছে, আপনি যেমন তেমন লোক নন।
-
কি বল্লে? প্যান্ডেলওয়ালা? হো: হো: হো:
এই বলে সেই পালোয়ান ভয়ানক জোরে
হেসে ওঠে। দিগিনের পিলে পর্যন্ত নড়ে যায়। কুঁই কুঁই করে বলে, "ওমন করে হাসবেন
না স্যার। আমার নেশাটা ফেটে যাবে।"
- বাবা তোমার তো দেখছি তুরীয়
অবস্থা।
- ওই যা একটু আধটু প্রসাদ পাই। তা
আপনি কোথা থেকে আসছেন?
- পাতাল থেকে।
- পাতাল রেল? তা ভালো। ওখানে বেশ
ঠান্ডা ঠান্ডা থাকে। তবে বিড়ি সিগারেট খেতে দেয় না।
- আচ্ছা নিরেট তো? বল্লাম পাতাল
থেকে, বলে কিনা পাতাল রেল?
- ওই হল পাতাল আর রেল। উনিশ আর
বিশ। তা কি করতে এখানে এলেন স্যার?
- জেরা করছ না কি?
- বালাই ষাট। আপনি স্যার
গণ্যমান্য, আপনাকে জেরা করার আমার কি ক্ষমতা?
- তা করলেও কিছু যায় আসে না। আমি
এসেছি ময়না করতে।
- ময়না? ভোম্বলদার ছোট মেয়ে? সে তো
গত বছর এই ঘাট থেকেই।
- ধুস। ময়না মানে তদন্ত।
- ও বাবা। তবে তো পুলিশ। তখন ঠিক
বলেছিলাম।
- না না পুলিশ টুলিশ নয়। প্রতিটা
প্যান্ডেলে ঘুরে দেখতে হয় সব সেফ কিনা?
- তবে তো তাই হল স্যার।
- না তাই হল না। পুলিশ কে
গভর্মেন্ট পাঠায়। আমায় পাঠায় স্বয়ং ভোলানাথ।
- ভোলাদা? আপনি ভোলাদার লোক? তাই
বলুন। পেটো ভোলার নামে এখানে সবাই বান্ডিল হয়ে যায়।
- আচ্ছা গেরো তো? বলছি ভোলা মহেশ্বর,
তোমাদের দূর্গা মায়ের হাজব্যান্ড। গেঁজেলটা বলে পেটো ভোলা।
দিগিনের এবার সত্যি মনে হয় নেশা টা
ফেটে যাবে। বলে কি লোকটা? ও দেবলোক থেকে আসছে? কি জানি, এও হয়তো ছিলিমে টান দিয়ে
এসেছে। তাই আর তর্ক করে না।
- তা সব দেখে শুনে কি বুঝলেন? সব
ঠিক ঠাক তো?
- সব ঠিক কি আর কোন কালে হয়? আমরা
আছি না?
- আপনারা মানে?
- আরে টিউব লাইট, আমরা মানে
মহিষাসুর।
- আরিব্বাস আপনি মহিষাসুর?
- ন্যাকা তবে কি ভেবেছো, তোমার মতো
সিরিঙ্গাসুর?
- স্যার শরীর তুলে কথা বলবেন না।
বড্ড ইয়ে লাগে।
- অত সেন্টি যদি, মুগুর ভাঁজো না
কেন?
- ওসব কথা থাক, তবে তো স্যার, কি
বলে, সেলিব্রিটি।
- সেসব ভালো লোকেরা হয়। আমরা
খারাপের দলে।
- বেশ। খারাপ না হলে, ভালো টা
বুঝবো কি করে?
- ঠিক, আমারও সম্ভবানি যুগে যুগে।
- তা স্যার এই যুগে কি বুঝলেন?
- ঠিক-ই আছে। অপরাধ আর অপরাধী
মার্কেটে না থাকলে, তাদের ঠেঙিয়ে গ্লোরিফাই হবে কি করে? তবে কিনা তোমাদের এখনকার
অপরাধের একটা বেসিক পাল্টে গেছে।
- সেটা কি রকম?
- এই দেখ আমি তোমাদের দুগ্গা মা-র
কাছে কেমন ধোলাই টা খাই, কিন্তু এখনকার অসুররা মেয়েদের কে পাল্টা দিচ্ছে। চার পাঁচ
জন মিলে একসাথে। তারপর আবার পুড়িয়ে টুড়িয়ে দিচ্ছে।
শুনে, দিগিন কেমন ব্যোম খেয়ে গেল।
লোকটা বলে কি?
- তা স্যার সেটা ভালো না খারাপ?
- জানিনা। তবে অভিযোজন বোঝ?
- অত বিদ্যে থাকলে, কি এই দশা হয়?
তবে স্যার আপনার দেখা পেয়ে রোমাঞ্চ লাগছে।
- থাক, অত আদিখ্যেতায় কাজ নেই। যাও
একটা ছিলিম সেজে আনো।
এটা দিগিনের সবচেয়ে পছন্দের কাজ।
লাফ দিয়ে উঠে যায়। একটু পর যত্ন করে ছিলিম সাজিয়ে লাফাতে লাফাতে ফিরে আসে। দেখে
কেউ কোথাও নেই। শুধু ঘাটের নিচটাতে একটা বড়সড় মোষ, বসে বসে জাবর কাটছে। অনেকটাই
রাত নেমেছে। দোয়েলপাড়ায় সকালে কারা পতাকা তুলেছিল, সেটা নামাতে ভুলে গেছে। অন্ধকার
আকাশের গায়ে একা একা পতকাটা অভাগার মতো ঝুলে আছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন