বিয়েবাড়ি অনেক ভীড়। আত্মীয় অনাত্মীয় মিলে একশোর ওপর পাত পড়ছে দুবেলা। মামাবাড়ি বড় হলেও শীতের কালে একশো মানুষকে ধরানো সম্ভব নয়। সকলে প্রতিবেশীদের বাড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। গ্রামে এটাই রেওয়াজ। পুরো গ্রামই যেন এক পরিবার। আস্তানা গাড়লাম মামাবাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে। মামাবাড়ির প্রতিবেশীরা, সম্পর্কে সকলেই 'মামা' 'মাসি'। আশেপাশের বাড়িগুলো ইতস্ততঃ আম কাঁঠাল সুপুরি ছায়ায় ঘেরা। একজনের উঠোন অন্যের রান্নাঘর ঘেঁষে। নেই কোন পাঁচিলের সীমানা, মনেরও। বাড়ির উঠোন দিয়ে বয়ে চলে জলঙ্গী। সময় অসময়ে ডুব দিয়ে আসে। নিজস্ব নদী বয়ে চলে তার স্বচ্ছ অবয়ব নিয়ে। নিচ অবধি দেখা যায়। মনেরও যেন তল পাওয়া যায়।
কন্যা বিদায়ের পর উৎসবের তাল কেটে যায়। সূর্যের তেজও যেন কমে আসে। এলোমেলো ছড়িয়ে থাকে শালপাতা, কাগজের কাপ। প্যান্ডেলওয়ালা বাঁশ খুলতে চলে এসেছে। দূর দূর দেশ থেকে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা যে যার ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত। অতিথিদের মধ্যে কয়েকজন বিদেশীও ছিলেন। তাঁদের চোখে মুখে বিস্ময়, এত লম্বা অনুষ্ঠান আর সেখানে এত রকম সম্পর্কের লতাপাতা! উন্নত দেশে এমন উষ্ণতা কই? আজ সন্ধ্যে নামে মন্থরগতিতে। গতরাতের রোশনাই আর নেই, আকাশ ঢেলে সাজে তারায়। মাথার ওপর মাঘ মাসের কালপুরুষ ঝুলে থাকে। তার খোলা তলোয়ার যেন সম্পর্কের রক্ষক রূপে আশ্বাস দেয়। আগামী প্রজন্ম আসুক, দুধে ভাতে থাকুক সন্তান। রাত বেশি হলে হিম পড়ে। গাছের পাতা বেয়ে সেই হিম টপটপ করে ঝরে। বাপ মায়ের গোপন কান্নার মতো সে বৃষ্টি।
ঘরের মানুষের মতো যদি একটা ঘরের নদী থাকে, তখন এমনই হয়। আলো ফোটার আগে নদীকে নিমন্ত্রণ জানানো, তুমি এসো কিন্তু, মা। তারপর এয়োস্ত্রীদের জলসইতে যাওয়া, জল আনা, স্নান করা। কিম্বা মন খারাপের, শুধু বসে থাকা। দস্যি দামালদের ক্লান্ত হয়ে নদীর ঘাটে ঘুমিয়ে পড়া। প্রতিটি কাজের মাঝে নদীটি জড়িয়ে থাকে। যেসব পাখিরা এপাড়ে এসেছিল, গোধূলীতে উড়ে যায় ওপাড়ে। সেখানে তার ঘাসে বোনা ছোটো বাসা অপেক্ষায় আছে। আমরাও কোমর বাঁধি। ফিরতে হবে। সাথে লেগে থাকে স্নানের ঘ্রাণ। মাছ এসে সারা গায়ে ঠুকরে দিয়েছে, সেই স্পর্শটুকু জমিয়ে রাখি। ফেরার দিন রাস্তাটা অনেক লম্বা হয়ে যায়। শেষ হতেই চায়না।