ডিমপুকুরের মতো এ তল্লাটে অমন একটা পুকুর আর নেই। দীঘি বলাই ঠিক। এই গরমে ওই গভীর কালো জলের দিকে তাকালেই যেন মন শীতল হয়। বিশাল বট গাছের একটা ডাল ঝুঁকে পড়েছে। যেন জলের সাথে তার গোপন শলা। আর নুইয়ে পড়া ডালে রোজ একটা মাছরাঙা এসে বসে। গোবিন্দর সকালে কোন তাড়া থাকে না। অবশ্য সকাল বললে ভুল হবে, সকাল দুপুর রাত, তাড়া শব্দটা ওর জীবনে নেই। দাঁত মাজতে মাজতে পুকুর পাড় অবধি হেঁটে চলে আসে। মাছরাঙাটাকে গভীর ভাবে দেখে। কেমন অবলীলায় শিকার ধরে। এই গাছের ডালে বসেই খায়, জিরোয়। তারপর কোথায় যেন চলে যায়।
ডিমপুকুরের একদিকের চৌহুদ্দিতে ডিমপুকুর ফাঁড়ি। রায়মশাইদের সম্পত্তি। রায়মশাইয়ের বাবা, সাহেব আমলের দারোগা। তখন থেকেই তাঁদের প্রতিপত্তি। এই বাড়ি সরকার কে দান করে গেছেন। শোনা যায় রবীন্দ্রনাথের এক দুঃসম্পর্কের পিসমশাইয়ের সাথে রায়মশাইয়ের বাবা নাকি দাবা খেলতেন। সে সব সত্যি, না নিজের ক্ষমতা জাহির করতে গল্প ফেঁদেছিলেন, তা আজ আর কেউ জানে না। ওই লোকের মুখে মুখে গল্পটা লতিয়ে বেড়ায়।
ডিমপুকুর মোটামুটি শান্তিপ্রিয় জায়গা। দুয়েকটা চোর বদমাইশ যারা অছেন, তাঁরাও পরিচিত। ফাঁড়িতেও তেমন কোন উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায় না। তবে এখন হল ভোটের কাল। তাই কিছু না হোক কয়েক গাড়ি মিলিটারি এসে উপস্থিত। তারা অবশ্য মানদা সুন্দরী উচ্চ বিদ্যালয়ে ঘাঁটি গেড়েছে। তবে সকালে এই পুকুরের ধারটা ওদেরও পছন্দ। অনেকে বেশ সাঁতার কেটে চান করে, পাশে দামোদরের মিষ্টির দোকানে বসে জিলিপি খায়। দোকানে সকালের আড্ডাধারী বয়স্ক মানুষরা এই মুশকো জোয়ানদের কাছে পেয়ে কিঞ্চিৎ আমড়াগাছি করে। তবে ভাষার ব্যবধানে তেমন হয়ে ওঠে না।
ডিমপুকুর ফাঁড়িতে একটা ছোট হাজত আছে। বেশির ভাগ খালি থাকে। এখন ভোট উপলক্ষে এলাকার দাগীদের তুলে, ভরাট করে রাখা। গোবিন্দর সকালের দাঁতমাজা ও পুকুর পাড় নিরীক্ষণ সম্পুর্ণ। এবার বাড়ি ফেরার জন্য এগোয়, হঠাৎ শোরগোল শুনে থমকায়। ডিমপুকুরে এ হেন নিস্তরঙ্গ জীবনে এত হাঁকডাক সহ্য হয় না। বড়বাবু চুনীলালের বাজখাঁই গলা ভেসে আসছে। “কয়দী কোথায় গেল?” সর্বনাশ, এই মারাত্মক ভোট মুহুর্তে শেষে কি না, এই ছিল কপালে! দামোদরের দোকানের গল্পবাজ বুড়োরা, ডিমপুকুরের ধারে স্নানরত জোয়ানরা, প্রত্যেকেই শরীর সোজা করে ফেলে। অনেকে গুটি গুটি ফাঁড়ির দিকে এগোতে থাকে। চুনীলালের চিৎকার পঞ্চম ছাড়িয়ে এখন সপ্তমে ছুঁয়েছে। “কে? কে? ডিউটি তে কে ছিল?” একটা খুব রোগা মত লোক, পুলিশের পোষাক পরা। প্রায় কাঁপতে কাঁপতে সামনে আসে। চোখে ঘোলাটে চশমা, পিঠে কাঠের বাঁটের একটা দোনলা বন্দুক। তাকে দেখে বড় বাবু ফেটে পড়লেন।
- আপনাকে আজ কে বাঁচায় আমি দেখব? শিগ্গির রাইফেল জমা দিন। আমি এখুনি সাসপেন্ড করছি।
একটু দূরে অন্য একটা টেবিলে মেজো বাবু এক মহিলার বাড়িতে দুই জায়ের মারপিটের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করছিলেন। এদিকে যে সব ঘটনা ঘটে চলেছে, তার প্রতি যে খুব একটা খেয়াল আছে, বলে মনে হচ্ছেনা। মহিলার সমস্যা খুব জটিল। সকাল বেলা গোয়ালা এক ঘটি দুধ দুইয়ে রেখে গেছে। আজ দুধ একটু কম। গরুটা বড়ভাই কিনেছিল, আপাততঃ ছোটভাই খোল ভুষি খাইয়ে চেকনাই করেছে। তাই আজকের দুধের দাবীদার কে হবে? এই নিয়ে, এ কথা সে কথার পর, ওই ঘটি ছুঁড়ে মারে। মুহুর্তে কপাল ফেটে দুধে আলতায় স্নান।
কিন্তু চুনীলালের এইসব পেটি কেস নিয়ে পরে থাকলে তো হবে না। সক্কাল বেলায় ডিমপুকুরের গারদ থেকে এলাকার সবচেয়ে বদমাইশ গুন্ডা লোচন ওরফে পেট্টোলোচন গায়েব। একটু পরেই সাংবাদিক, নির্বাচক পরিদর্শক সবাই কাঁঠাল ভাঙা গন্ধ পেয়ে মাছির মতো ভনভন করতে করতে চলে আসবে। উফ্। আজ চুনীলালের শ্বশুড়বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান আছে। গামছাষষ্ঠী না তিনপলাজোড় কিছু একটা পুজো। চুনীলালকে সেখানে একবার না গেলে গৃহশান্তি থাকবে না। আরে পুলিশ বলে কি তারা মানুষ নয়। দিনভর এই ঘটনার চর্বিত চর্বন করে চলবে। সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল মেজোবাবুর ওপর। “আপনি এই অবস্থায় মেয়েদের সাথে গল্প মাড়াচ্ছেন? চোখের সামনে থেকে প্রিজনার চলে যাচ্ছে, কারো কোন হুঁশ নেই। সব দায়িত্ব কি আমার একার?” একজন দুজন করে ভীড় আস্তে বেড়ে গেছে। চুনীলাল তাই দেখে আরও খাপ্পা। তবে এবার মেজোবাবু রনভূমে অবতীর্ণ হন। একটা খেটো লাঠি নিয়ে জমে থাকা জনতার দিকে তেড়ে এলেন। “কি চাই আপনাদের? মজা দেখতে এসেছেন? সবাই কে ধরে চালান করে দেব”। ভীড়টা একটু পাতলা হয়ে গেল। তবু সবাই যে চলে গেল তা নয়, পুকুরের পাড় ঘেঁষে ছড়িয়ে গেল। এইসব হট্টগোলের মধ্যে হঠাৎ কে যেন বলে, “ওই তো পেট্টোলোচন”। সত্যি ষন্ডা মার্কা চেহারার লোচন গুন্ডা, খুব নিরুদ্বিগ্ন মুখে হেঁটে ফাঁড়িতে ঢোকে। আর গারদের দোর খুলে সুর সুর করে ভেতরেও চলে যায়। ঘটনার তাৎক্ষনিকতায় বড়বাবু, মেজবাবু সহ কেউই ব্যাপারটা বুঝতে উঠতে পারেননি। এট্টুখানি পর হুঁশ এলে, চুনীলাল হুঙ্কার দেন, “কোথায় গেছিলি? ইতরের বাচ্চা?” পাশাপাশি মেজোবাবুও বলে ওঠেন, “ওকে বাটাম লাগাও”। চুনীলাল মেজোবাবুর দিকে কটাক্ষ করে বলেন, “থাক এখন আর বীরত্ব ফলাতে হবে না”। আবার লোচনের দিকে ফিরে বলেন, “কি হল জবাব দিচ্ছিস না যে?”
গারদের ভেতরে দৃশ্যতঃ লোচন কে খুব করুন লাগছিল। হাজতে আরও দু-চারটে খুচরো অপরাধী আছে, তবে বড় মাছ লোচন। বড়বাবুর ধমকে, খুব কাতর হয়ে, বিনয়ী মুখ করে বলে, “স্যার সকালে একটু চা খেতে বেরিয়েছিলাম। এই দামোদরটা চা বানাতেই জানেনা, তাই বড়রাস্তার ধারে গেছিলাম”।
কথা শুনে সবাই শুধু চুপ নয়, একেবারে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। গোবিন্দ লক্ষ্য করে, মাছরাঙাটাও যেন বুঝতে পারে না কি করবে। সদ্য ধরে আনা মাছটা ঠোঁটের মাঝে নড়ছিল। একদুবার শক্ত করে ধরতে গিয়ে, ফস্কে গেল। টপাস করে জলের মধ্যে। কিন্তু এ মাছ তো পেট্টোলোচন নয়, যে খানিক পর আবার নিজে নিজেই ফিরে আসবে।
ডিমপুকুরের একদিকের চৌহুদ্দিতে ডিমপুকুর ফাঁড়ি। রায়মশাইদের সম্পত্তি। রায়মশাইয়ের বাবা, সাহেব আমলের দারোগা। তখন থেকেই তাঁদের প্রতিপত্তি। এই বাড়ি সরকার কে দান করে গেছেন। শোনা যায় রবীন্দ্রনাথের এক দুঃসম্পর্কের পিসমশাইয়ের সাথে রায়মশাইয়ের বাবা নাকি দাবা খেলতেন। সে সব সত্যি, না নিজের ক্ষমতা জাহির করতে গল্প ফেঁদেছিলেন, তা আজ আর কেউ জানে না। ওই লোকের মুখে মুখে গল্পটা লতিয়ে বেড়ায়।
ডিমপুকুর মোটামুটি শান্তিপ্রিয় জায়গা। দুয়েকটা চোর বদমাইশ যারা অছেন, তাঁরাও পরিচিত। ফাঁড়িতেও তেমন কোন উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায় না। তবে এখন হল ভোটের কাল। তাই কিছু না হোক কয়েক গাড়ি মিলিটারি এসে উপস্থিত। তারা অবশ্য মানদা সুন্দরী উচ্চ বিদ্যালয়ে ঘাঁটি গেড়েছে। তবে সকালে এই পুকুরের ধারটা ওদেরও পছন্দ। অনেকে বেশ সাঁতার কেটে চান করে, পাশে দামোদরের মিষ্টির দোকানে বসে জিলিপি খায়। দোকানে সকালের আড্ডাধারী বয়স্ক মানুষরা এই মুশকো জোয়ানদের কাছে পেয়ে কিঞ্চিৎ আমড়াগাছি করে। তবে ভাষার ব্যবধানে তেমন হয়ে ওঠে না।
ডিমপুকুর ফাঁড়িতে একটা ছোট হাজত আছে। বেশির ভাগ খালি থাকে। এখন ভোট উপলক্ষে এলাকার দাগীদের তুলে, ভরাট করে রাখা। গোবিন্দর সকালের দাঁতমাজা ও পুকুর পাড় নিরীক্ষণ সম্পুর্ণ। এবার বাড়ি ফেরার জন্য এগোয়, হঠাৎ শোরগোল শুনে থমকায়। ডিমপুকুরে এ হেন নিস্তরঙ্গ জীবনে এত হাঁকডাক সহ্য হয় না। বড়বাবু চুনীলালের বাজখাঁই গলা ভেসে আসছে। “কয়দী কোথায় গেল?” সর্বনাশ, এই মারাত্মক ভোট মুহুর্তে শেষে কি না, এই ছিল কপালে! দামোদরের দোকানের গল্পবাজ বুড়োরা, ডিমপুকুরের ধারে স্নানরত জোয়ানরা, প্রত্যেকেই শরীর সোজা করে ফেলে। অনেকে গুটি গুটি ফাঁড়ির দিকে এগোতে থাকে। চুনীলালের চিৎকার পঞ্চম ছাড়িয়ে এখন সপ্তমে ছুঁয়েছে। “কে? কে? ডিউটি তে কে ছিল?” একটা খুব রোগা মত লোক, পুলিশের পোষাক পরা। প্রায় কাঁপতে কাঁপতে সামনে আসে। চোখে ঘোলাটে চশমা, পিঠে কাঠের বাঁটের একটা দোনলা বন্দুক। তাকে দেখে বড় বাবু ফেটে পড়লেন।
- আপনাকে আজ কে বাঁচায় আমি দেখব? শিগ্গির রাইফেল জমা দিন। আমি এখুনি সাসপেন্ড করছি।
একটু দূরে অন্য একটা টেবিলে মেজো বাবু এক মহিলার বাড়িতে দুই জায়ের মারপিটের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করছিলেন। এদিকে যে সব ঘটনা ঘটে চলেছে, তার প্রতি যে খুব একটা খেয়াল আছে, বলে মনে হচ্ছেনা। মহিলার সমস্যা খুব জটিল। সকাল বেলা গোয়ালা এক ঘটি দুধ দুইয়ে রেখে গেছে। আজ দুধ একটু কম। গরুটা বড়ভাই কিনেছিল, আপাততঃ ছোটভাই খোল ভুষি খাইয়ে চেকনাই করেছে। তাই আজকের দুধের দাবীদার কে হবে? এই নিয়ে, এ কথা সে কথার পর, ওই ঘটি ছুঁড়ে মারে। মুহুর্তে কপাল ফেটে দুধে আলতায় স্নান।
কিন্তু চুনীলালের এইসব পেটি কেস নিয়ে পরে থাকলে তো হবে না। সক্কাল বেলায় ডিমপুকুরের গারদ থেকে এলাকার সবচেয়ে বদমাইশ গুন্ডা লোচন ওরফে পেট্টোলোচন গায়েব। একটু পরেই সাংবাদিক, নির্বাচক পরিদর্শক সবাই কাঁঠাল ভাঙা গন্ধ পেয়ে মাছির মতো ভনভন করতে করতে চলে আসবে। উফ্। আজ চুনীলালের শ্বশুড়বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান আছে। গামছাষষ্ঠী না তিনপলাজোড় কিছু একটা পুজো। চুনীলালকে সেখানে একবার না গেলে গৃহশান্তি থাকবে না। আরে পুলিশ বলে কি তারা মানুষ নয়। দিনভর এই ঘটনার চর্বিত চর্বন করে চলবে। সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল মেজোবাবুর ওপর। “আপনি এই অবস্থায় মেয়েদের সাথে গল্প মাড়াচ্ছেন? চোখের সামনে থেকে প্রিজনার চলে যাচ্ছে, কারো কোন হুঁশ নেই। সব দায়িত্ব কি আমার একার?” একজন দুজন করে ভীড় আস্তে বেড়ে গেছে। চুনীলাল তাই দেখে আরও খাপ্পা। তবে এবার মেজোবাবু রনভূমে অবতীর্ণ হন। একটা খেটো লাঠি নিয়ে জমে থাকা জনতার দিকে তেড়ে এলেন। “কি চাই আপনাদের? মজা দেখতে এসেছেন? সবাই কে ধরে চালান করে দেব”। ভীড়টা একটু পাতলা হয়ে গেল। তবু সবাই যে চলে গেল তা নয়, পুকুরের পাড় ঘেঁষে ছড়িয়ে গেল। এইসব হট্টগোলের মধ্যে হঠাৎ কে যেন বলে, “ওই তো পেট্টোলোচন”। সত্যি ষন্ডা মার্কা চেহারার লোচন গুন্ডা, খুব নিরুদ্বিগ্ন মুখে হেঁটে ফাঁড়িতে ঢোকে। আর গারদের দোর খুলে সুর সুর করে ভেতরেও চলে যায়। ঘটনার তাৎক্ষনিকতায় বড়বাবু, মেজবাবু সহ কেউই ব্যাপারটা বুঝতে উঠতে পারেননি। এট্টুখানি পর হুঁশ এলে, চুনীলাল হুঙ্কার দেন, “কোথায় গেছিলি? ইতরের বাচ্চা?” পাশাপাশি মেজোবাবুও বলে ওঠেন, “ওকে বাটাম লাগাও”। চুনীলাল মেজোবাবুর দিকে কটাক্ষ করে বলেন, “থাক এখন আর বীরত্ব ফলাতে হবে না”। আবার লোচনের দিকে ফিরে বলেন, “কি হল জবাব দিচ্ছিস না যে?”
গারদের ভেতরে দৃশ্যতঃ লোচন কে খুব করুন লাগছিল। হাজতে আরও দু-চারটে খুচরো অপরাধী আছে, তবে বড় মাছ লোচন। বড়বাবুর ধমকে, খুব কাতর হয়ে, বিনয়ী মুখ করে বলে, “স্যার সকালে একটু চা খেতে বেরিয়েছিলাম। এই দামোদরটা চা বানাতেই জানেনা, তাই বড়রাস্তার ধারে গেছিলাম”।
কথা শুনে সবাই শুধু চুপ নয়, একেবারে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। গোবিন্দ লক্ষ্য করে, মাছরাঙাটাও যেন বুঝতে পারে না কি করবে। সদ্য ধরে আনা মাছটা ঠোঁটের মাঝে নড়ছিল। একদুবার শক্ত করে ধরতে গিয়ে, ফস্কে গেল। টপাস করে জলের মধ্যে। কিন্তু এ মাছ তো পেট্টোলোচন নয়, যে খানিক পর আবার নিজে নিজেই ফিরে আসবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন