মঙ্গলবার, ২৪ মে, ২০১৬

রূপকথার পোষাক বদল

পাড়ায় আজকাল অনেকেই শপিং মলে যায় বাজার করতে। এলাকার বাজার তো আছেই, তবে মলের বাজারে মুদিখানার অনেক কিছু এক ছাদের তলায় পাওয়া যায়, যা পাড়ার দোকানে হয়তো দেখাই যায় না। যেমন নুডলের বিরাট প্যাক বা কর্নফ্লেক্সের এক বিশেষ মিশ্রন কিম্বা হিং-এর একটি পছন্দের ব্রান্ড। এমন কত কি! গোবির মলে আসতে খারাপ লাগে না। বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা। চারিদিকে সুবেশ মানুষজন। যদিও পাড়ার দোকান বাজারে বেশি স্বচ্ছন্দ। এখানে, বাজারের মত বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনা। তাও মাঝে মাঝে পাড়ার দাদা বৌদি বা মাসিমাদের ফরমাইসি কেনাকাটা করতে মলে চলে আসে। শপিংমলে দোকানদার বা সহ-ক্রেতাদের চালচলন আলাদা। এর মধ্যে একজন পাহারাদার কে দেখে গোবির মনে হল, কোথায় যেন দেখেছে। সবাই এক পোষাক পরে ঘুরে বেরায়, তাই আলাদা করে চিহ্নিত করা কঠিন। তবু খানিক চেনা লাগার ছুতোয় কাছাকাছি আসে। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে, “দাদা কি এখানকার?” মাথা থেকে টুপি খুলতেই লোকটির স্বরূপ বেরিয়ে পরে। এ বাবা! এ তো লোনামাটির লোক, তপন। গোবি একে ঢের চেনে, “আরে তুমি এখানে?” তপন বিড়ি খাওয়া কালো দাঁতগুলো বের করে হাসে। “এই এখন এখানে ডিউটি। তা তোমার বাড়ি এদিকে নাকি?” ব্যাস গোবি কে আর পায় কে? দোকান বাজারে একটা নিজস্ব লোক না থাকলে কি সুখ হয়? পাখনা নদীর ধার দিয়ে টানা ক্ষেত রয়েছে। সেই ক্ষেতের আল ধরে আর কিছুটা উত্তরে গেলে তপনদের বাড়ি। সেখানে তপনের বৌ, ছেলে, বুড়ো মা থাকে। গোবির মনে অনেক প্রশ্ন,

- তা তুমি এখানে রোজ আসো?
- এখন এখানে ডিউটি দিচ্ছে, আবার যখন বদলে দেবে চলে যাব। আমাদের এজেন্সির সাথে কন্টাক্ট।
- কতক্ষণ থাকতে হয়?
- তা বারো ঘন্টা তো হয়ই। নাইটও থাকে।
- ও বাবা তাহলে তো কষ্ট আছে। রাত জেগে থাকতে হয়?
- এখানে ঘুমোন যায় না। ছবি উঠে যায়। তখন কৈফেয়ত দিতে হয়। এই যে তোমার সাথে গল্প করছি তারও ছবি উঠছে।
- এ বাবা,মাটি করেছে। আমার জন্যে তুমি বকা খাবে নাকি?
- হওয়া উচিত নয়। তবে কাজ করি আমরা, আর ভুল ধরার অন্য লোক। তাই কি থেকে কিসের ভুল, সে তারাই বলতে পারে।
- তবে আমি যাই। পরে কথা হবে।
- বেশ যাও। আবার এসো।

তপনকে গোবি প্রথম আবিস্কার করেছিল মটরশুঁটির ক্ষেতে। মাথায় তালপাতার টোকা, খেটো করে লুঙ্গি পড়া, গায়ে একটা পুরাণ রঙচটা ফুলহাতা সোয়েটার। খুরপি হাতে একমনে জমি নিড়িয়ে যাচ্ছিল। আর খোলা গলায় গান গাইছিল। ওই দিকচক্রবাল পর্যন্ত ক্ষেত আর ক্ষেত। নানান রঙের সবুজে হলুদে মিশে আছে। দূরে দূরে আরও কেউ কেউ নিজের নিজের জমিতে কাজ করছে। দুয়েকটা দোয়েল ফিঙে উড়ে উড়ে ফড়িং ধরে খাচ্ছিল। আবার ছোট ছোট ঝোপের ভেতর কয়েকটা টুনটুনিতে নেচে বেড়াচ্ছে। সেই নির্লিপ্ত প্রশান্তির মাঝখানে তপনের গান কেমন মন কেমন করে দিচ্ছিল। “লোকে বলে বলেরে, ঘরবাড়ি ভালা নায় আমার...” এক আকাশ শূণ্যতায় ইতস্ততঃ পাখিদের ডাক আর “...কি ঘর বানাইমু আমি শূণ্যের মাঝার...”। গোবি তখন লোনামাটির পথে পাখনার পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে কখন জমিতে এসে পড়েছে। অবাক হয়ে শুনছিল গান। আলের ওপর বসে পড়ে। গান শেষ হয়, তপন আবার অন্য গানে যায়। যতক্ষণ ক্ষেতে রইল, প্রায় ততক্ষণই গান ঘিরে রইল। তপনকেই জিজ্ঞেস করে “তুমি গান শিখেছো কোথায়?” তপন হাসে, মাথা নাড়ায় “এই গান কে শেখায়? ওই আকাশের উপরে যে আছে, সে”। গোবি কতক বোঝে কতক বোঝেনা। এ তো শহুরে গানের ক্লাস না, যে সপ্তায় একদিন মাস্টামশাই বা দিদিমনি আসবেন। আর গান নিয়ে কিছু প্রশ্ন করেনা।

- এগুলো কি ফসল?
তপন হাসে, “আসো, খেয়ে দেখ”। এই বলে নিচু হয়ে কিছু শুঁটি ছিড়ে দেয়। গোবি তো অবাক! এইগুলো বাজারের তরকারিওয়ালার ঝুড়িতে দেখেছে। এমন আলাদা করে ক্ষেতে, এই প্রথম। যাকে যেখানে দেখে অভ্যস্থ, সেখানে না পেলে কেমন মন গুলিয়ে যায়। সেই থেকে তপনের সাথে গোবির সঙ্গত। এই শপিংমলের ঝাঁ চকচকে আবহাওয়াতে সেই মাথায় টোকা পড়া চাষীটিকে কোথায় পাবে? আর গান? কাজ করতে করতে যে সুরে ভরিয়ে রাখত, সেই বা কোথায় গেল। তাই চলে যাবার আগে, তপনের কাছে আবার যায়, জিজ্ঞেস করে,

- তুমি এখানে কি করে গান গাও?

তপন চোখ দিয়ে হাসে। বোধহয় কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না। ওদিকে চ্যানেল মিউজিক বেজে চলেছে। সেখানে মুম্বাই কাঁপানো সুরের দাপট। গান পুরো বোঝা না গেলেও দ্রিম দ্রিম তালের শব্দ পৌঁছে যাচ্ছে। তপন চট করে টুপিটা পড়ে নেয়। চোখের নিমেষে সেই তালপাতার টোকা মাথার অবয়ব হারিয়ে যায়। এই ইউনিফর্ম পড়া মানুষটি অন্য আর পাঁচটা পাহারাদারের মতোই। এক নির্দিষ্ট গেটে নির্দিষ্ট সময় ধরে ডিউটি। সেখানে খোলা মাঠের সুরের দুলুনি, যেন কোন তেপান্তরের ওপাশ থেকে ভেসে আসে। সেখানে স্বপ্নগাছ আছে আর তাকে ঘিরে রঙিন পালকদের ওড়াউড়ি। রূপকথারা ঘর বাঁধে ঝোপেঝাড়ের আবডালে।

সোমবার, ২৩ মে, ২০১৬

পথকথা-৬ (লোনামাটি)

ট্রেনে চেপে বেশ গুছিয়ে বসে গোবিন্দ। অনেক পথ যেতে হবে। এই ট্রেনটা মাঝারি পাল্লার। শহর পেরিয়ে প্রায় প্রতিটি স্টেশনেই থামে। গড়ন এক্সপ্রেস ট্রেনের মতোই। উপরে বাঙ্ক। সেখানেও মালপত্রের সাথে বহু মানুষ নিজেদের যত্ন করে গুঁজে নিয়েছে। শুধু শহরের মধ্যেকার স্টেশনগুলোতে থামে না। তাই যাত্রীরা মূলতঃ গ্রামীন মানুষ। তাদের বেশভুষা আচারন সবই স্বতন্ত্র এবং আন্তরিক। চোখের দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে কথা বলে, যেন কতদিনের পরিচিত। আজ বোধহয় ট্রেনটি একটু লেট চলছে। এইসব মানুষরা নিত্য এই গাড়িতেই যাতায়াত করেন। গাড়ির গতিবেগ দেখে বলে দিতে পারেন ড্রাইভারে বয়স বা অভিজ্ঞতার পরিমাপ। কিম্বা আজ ড্রাইভার সাহেবের তাড়া আছে কিনা। গোবিন্দ কোন আপিস করতে যাচ্ছেনা, তাই ট্রেনের দেরী হলেও কিছু যায় আসে না।

জানালার বাইরে চোখ চালিয়ে নিশ্চিন্তে থাকে। বাইরেটা যে এত মনোরম লাগে! কেমন মায়াবী সবুজে মোড়া। ছোট ছোট জনপদগুলো দ্রুত পার হয়ে যায়। দেখলেই কেন যেন মনে হয়, দু দিন এখানে থেকে গেলে হয়। তবে ট্রেনের ভিতরটিও অতীব রঙীন। একের পর এক নানান ফেরিওয়ালার মিছিল। পুরো পথটাকে কেমন ঘটমান করে রাখে। একজন গজাওয়ালা এলেন। এসেই বলেন, “আজ আপনাদের ধরতেই দেব না। কারণ ধরলেই ছ্যাঁকা লাগবে, এ এমন টাটকা। সদ্য কড়াই থেকে নামিয়ে আনা”। তার বাচন ভঙ্গী আর বলার ভাষাতে যাত্রীরা আমোদ পায়, বিক্রিও হয়। এক প্রৌঢ় হাত পাতে একটা নমুনা সংগ্রহের জন্য। বোঝা যায়, গজাওয়ালা খুব খুশি হয়নি। অনেক ফেরিওয়ালা নিজে থেকেই নমুনা বিতরণ করে। তারা আবার অপমানিত হয়, যদি কেউ নমুনা নিতে অস্বীকার করেন। গজাওয়ালা তেমন নয়। সে নেমে গেলে পরে, আরেক সহযাত্রী একটি গল্প বলতে শুরু করে। যেন গোবিন্দকেই শোনাচ্ছেন।

দুই বন্ধু ছিল। তাদের একজন পাশ-টাশ দিয়ে একটা চাকরি জুটিয়ে ফেলে। অন্য বন্ধুটি স্টেশনে একটি পানের দোকান দেয়। ছোট গুমটি আর কি! চাকুরে বন্ধু প্রতিদিন সকালে ট্রেন ধরতে স্টেশনে আসে, পানওয়ালা বন্ধুর সাথে একটু খোশগল্প করে, তারপর ট্রেন এলে চলে যায়। প্রতিদিনের আড্ডার মাঝে, সে একটি এলাচ চেয়ে নিয়ে খায়। এমন করে অনেকদিন যায়। সকালে আসে, গল্প করে, এলাচ মুখে নেয়, ট্রেন ধরে, চলে যায়। প্রায় বছর পাঁচেক পর কোন এক ঘটনা নিয়ে দুজনের মনোমালিণ্য ঘটে। তখন পানওয়ালা বন্ধুটি অন্যজনের কাছে কিছু টাকা ফেরত চায়। চাকুরে বন্ধুটি তো অবাক। সে চাকরি করে বলে প্রচ্ছন্ন গর্ব আছে। পানওয়ালা বন্ধুটির চেয়ে, তার আয় যায় বেশি। তারপরও পানওয়ালা উত্তমর্ণ্য, ভাবতেই পারে না। পানওয়ালা বন্ধু তখন হিসেবের খাতা নিয়ে বসে, গত পাঁচ বছরে চাকুরে বন্ধুটি প্রায় ১৩২৮টি এলাচ নিয়ে খেয়েছে। সব মিলিয়ে এলাচের গড়দাম অনুসারে ৫৩৭টাকা মতো পাওনা।

গল্পের শেষে সহযাত্রীটি সেই গজা-র নমুনা প্রার্থী প্রৌঢ়র দিকে ফিরে বলেন, “চেয়ে খাবেন না। কারণ যে দিচ্ছে, সে খুব যে খুশি মনে দিচ্ছে, তা নয়”। গোবিন্দর বেশ লাগে, কেমন সুন্দর ভাবে ভদ্রলোককে শিক্ষা দিলেন। এরমধ্যে আরো অনেক ফেরিওয়ালা ওঠেন, একজন বৃদ্ধদের আবার করে কবাডি খেলার ওষুধ বিক্রি করছেন। কত রকম চোরাগোপ্তা কথা, ঠাঁই পেতে হলে নিয়মিত রেলযাত্রা করতে হবে।  একজন তার পসরা বিক্রি করতে গিয়ে বলে ফেলেন, “আজ টাকাপয়সা কম থাকলে নেবেন না। কোন অসুবিধা নেই। পরে সময়মতো নিলেই হবে”। সম্ভবতঃ বদহজমের ওষুধ। এইসব ফেরিওয়ালারাও প্রতিনিয়তঃ তাদের মতো করে সৃষ্টিসুখে আছেন। নিতান্ত পেটের তাগিদ বলেই উপাচারের বাহুল্য নেই, উপস্থাপনা দৃঢ় এবং সরাসরি।

অবশেষে গন্তব্য, লোনামাটি পৌঁছায় গোবিন্দ। শহর ছাড়িয়ে তিন ঘন্টার দূরত্বে যে এমন জায়গা আছে, না এলে বোঝাই যায়না। একটা মোবাইলেও সিগনাল নেই। কি যে ভালো। একরত্তি নদীটা বয়ে চলে, কেউ এল, দু দন্ড পাশে বসল ওর বুঝি গায়েই লাগে না। বিকেলের আলো নৌকাকে টেনে নিয়ে যায়, অস্তমিত সূর্যের দিকে। বড় বড় উলুর ঝোপে হাঁসগুলো কি যেন খোঁজে আবার ছুটে এসে জলে ডুব দেয়। গোবিন্দ কাউকে না জানিয়ে মাঝে মাঝে এখানে চলে আসে। প্রথম প্রথম নতুন মানুষ দেখে, গ্রামের লোক জিজ্ঞেস করত, “কোন বাড়ি এসেছেন? কতদিন থাকবেন? কোথা থেকে আসছেন? কেন আসছেন? কি করেন?” ইত্যাদি নানা কথা। তা তো ঠিক। কে কোথা দিয়ে চলে আসে, কত রকম ফন্দি ফিকির নিয়ে। গোবিন্দ তেমন বলার মতো কিছু করেও না, যে গুছিয়ে বলবে। যদিও খুব ব্যস্ত থাকে, তবু কাউকে কি বলা যায়, যে সে বাজার করতে, ইলেক্ট্রিক বিল জমা দিতে বা ফেলে আসা জিনিস পৌঁছানোর কাজ করে। শহরে যেমন মানুষ আলগা আলগা, পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকছে, কে আসছে জানা থাকে না। গ্রামে ঠিক তেমনটা নয়। কার বাড়িতে কে এল, অন্যরাও খবর রাখে। শুরুতে গোবিন্দ এক খুড়তোতো দাদার পিসতুতো কাকা মাস্টারবাবুর নাম করে চলে এসেছিল। ওই ওদের পাড়াতে কোন এক সময় ভদ্রলোক নিমন্ত্রণ খেতে গিয়েছিলেন। তা ভুল করে সেই কাকার মেয়ে বাথরুমে কানের দুল ফেলে চলে আসে। পরে যখন খোঁজ মিলল, কে পৌঁছে দেবে? ব্যাস পাড়ায় এক অধটা কাঠ বেকার থাকার এই সুবিধে। সেই সুযোগে গোবিন্দও এই জায়গার খোঁজ পেয়ে গেল। এখন অবশ্য শুধু মাস্টারবাবুর কথা বলতে হয়না, এই গ্রামের সে অনেককেই চেনে।

এখানে আসতে ট্রেনে চাপতে হয়। তারপর বেশ কিছু বড় বড় জংশনে গাড়ি পাল্টে পাল্টে লোনামাটি স্টেশনে নামতে হয়। এই স্টেশনে এখনও প্ল্যাটফর্ম হয়নি। সিঁড়িওয়ালা ট্রেনই থামে। আজকাল অন্য গাড়িও থামে, তাতে ওঠা নামা বড্ড মুশ্কিল। গোবিন্দর এই স্টেশনের কাছাকাছি এলে মন ভালো হয়ে যায়। তড়াক করে লফিয়ে নামে। নিচে পাথরে খচমচ করে ওঠে। পুরো স্টেশন চত্বর কৃষ্ণচূড়ায় ঢাকা। এখন যদিও জৈষ্ঠ্য শুরু হয়ে গেছে, গাছেদের ফুলের বিরাম নেই। লাল ফুলের ফরাস পাতা যেন। ভজন পাল পিছন থেকে বলে, “ভাইপো, আমরা হাত একটু ধর। নিজে তো হুড়ুম দিয়ে নামলে, আমাদের বুড়ো হাড়। পারি নাকি?” ভজন পালের সাথে ট্রেনেই আলাপ রুমাল ফিরি করে। সকালের ট্রেনে শহরে গিয়ে এই বেলার গাড়িতে ফেরে। দিনের এক দুটো ট্রেনই আছে এই স্টেশনে দাঁড়ায়। মাস্টারবাবু কে কাকা বলাতে, গ্রামের মোটামুটি সব মাঝবয়সীদের কাছে গোবিন্দ গণ-ভাইপো হয়ে গেছে। লোনামাটি স্টেশন থেকে পায়ে হেঁটে একটা ছোট জঙ্গল পেরোতে হয়। আগে এই জঙ্গল ছিল ডাকাতদের আস্তানা। এখন অবশ্য ডাকাতরা গোয়ালা হয়ে গেছে। তারা মোষ পোষে। সাইকেলের দুপাশে দুধের ক্যান ঝুলিয়ে গ্রামে গ্রামে বিক্রি করে। জঙ্গলের মাঝে সেই ডাকাতে গোয়ালাদের ছোট বসত। সেইখানে পথে ওপর সার দিয়ে বড় বড় মোষরা বসে জাবর কাটে। তা ডিঙিয়ে আসে ছোট্ট নদী, নাম তার পাখনা। পাখনা পেরোতে নৌকা নেয় একটাকা। তারপর আসবে মাস্টারবাবুর গ্রাম। জঙ্গল লাগোয়া বলে পাখিদের ডাকে চতুর্দিক মেতে থাকে। যতবার গোবিন্দ আসে ওরা যেন ঠিক চিনে ফেলে। তাই তো এত ডাকাডাকি করে। কিন্তু গোবিন্দর আর পাখিদের চেনা হয়ে উঠল না। প্রতিবার এখান থেকে ফিরে ভাবে লাইব্রেরিতে খোঁজ নেবে পাখি নিয়ে কোন বই আছে কিনা। কিন্তু সে আর হয় না। অবশ্য না জানার মধ্যেও একটা আনন্দ আছে। সব কিছু তো চিনে ফেলতে নেই।

বৃহস্পতিবার, ১৯ মে, ২০১৬

রাস্তার দিক

রাস্তা যখন সোজা পড়ে থাকে, সামনে থেকে কালো গভীর পথ। এলোমেলো বৃষ্টি এসে সেই কালিমা আরও গাঢ় করে দেয়। আতান্তরে পড়ে খোলা মন। সেখানে বাতাস ঘুলঘুলির ঘুর পথে নিয়ে আসে চড়াইয়ের ঠোঁটে করে খড়কুটোর সন্দেশ। একটা খবরেই মনের আঙিনায় আলপনা দেয়, সে খবর খুব বিরাট কিছু, যে তা নয়। গোবিন্দ এই সব দেখে আর ভাবে, ঠাঁই পায় না। বাজারে দেখা হয় মান্তু দার সাথে। ভদ্রলোক এই কাছাকাছি কোথাও থাকেন, বাজারে সহ-ক্রেতা হিসেবেই তাকে দেখেছে, অন্য কোথাও যে মান্তুদার অস্তিত্ব আছে মনেও হয় না। যেন মান্তু মানেই একটা পুরানো লুঙ্গি, হয়তো লাল ছিল কোনকালে, এখন রঙচটে একটা অন্যরকম কিছু হয়েছে। স্বভাবে একটু সখী ভাব। গলায় গান ও খিস্তি। সব দোকানদারের সাথে তার ঠাট্টার সম্পর্ক। কখনও মাত্রাতিরিক্ত কটু কথায় তিক্ততার সৃষ্টি হয়। গান শুনে মন ভরে। বিরক্ত দোকানদার কুকুরের ডাক ডাকে। মান্তুদা গায়ে মাখেনা অনায়াসে রাগী প্রতিপক্ষকে আলিঙ্গন করে।

আজ মান্তুদা খুব খুশি। তাদের বাড়ির কাজের মাসির মেয়ে সরকার থেকে থেকে সাইকেল পেয়েছে। সেই আনন্দে মিষ্টি কিনছে আর গান গাইছে। লোকে আড়াল নয়, সামনেই বলে, পাগল। মান্তুদা বাছা বাছা খিস্তি উচ্চারণ করে সেই পাগল উপাধি ফিরিয়ে দেয় বক্তার ঊর্দ্ধতন চোদ্দ পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে। সরকার বাইরে থেকে ব্যবসা আনলো কি আনলো না, তাতে মান্তুদা বা তার বাড়ির কাজের মাসির কিছু এসে যায় না। তবে এই সাইকেলটি হওয়াতে মেয়েটি প্রায় দুকিলোমিটার দূরের স্কুলে যেতে পারছে। এটা ওই পরিবারটি এবং ব্যাচেলার মান্তুদার বড় আনন্দের কথা। একই সাথে কন্যাশ্রীর টাকা পেয়েছে, পাচ্ছে দুটাকা কেজি চাল। এই জনমোহিনী কাজের গুঁতোয় হয়তো কোষাগার ফাঁকা হয়ে গেল। কাগজ পড়া মিষ্টির দোকানদার তিলক একবার বলার চেষ্টা করে। মান্তুদাকে সে কথা বলে, খাল কেটে কুমির আনা। খিস্তির এমন সম্ভার খুব কম মানুষের কাছে আছে। থাকলেও অনেকের তা প্রকাশ করার ক্ষমতা থাকে না। মান্তুদা অমায়িক অর্থাৎ বিনা মাইকে সারা বাজারের সকলকে শুনিয়ে তিলকের ভুত ভাগায়। শেষে অন্যরা মিলে তিলককেই থামায়, যাতে মান্তুদাকে আর উত্যক্ত না করে।

গোবিন্দ লক্ষ্য রাখে সব। বাজার ছাড়া আরেক জায়গায় মান্তুদাকে দেখে সেদিন চিনতে পারেনি। আসলে যে মানুষটাকে যেখানে দেখে অভ্যস্থ, তার বাইরে তার যে কোন পরিচয়, থাকতে পারে সেটাই আমাদের অজানা। লাল শালুর পতাকা কাঁধে মিছিলে চলা মানুষটাকে প্রথমে চেনা চেনা লাগলেও বুঝতে পারেনি কে? সেই লুঙ্গি নেই, হাতে বাজারের থলেও নেই। মান্তুদা ঠিক নজর করে গোবিন্দকে। দুরন্তবেগে গালি সহকারে জিজ্ঞেস করেন, “...মরণ, অমন হাঁ করে দেখছিস কি? আমায় তোর পছন্দ হল না কি?” গালি শব্দটি কানে যেতেই টনক ঠং করে বেজে, নড়ে ওঠে। তখন চিনতে আর ভুল হয়না, ইনি কিনি? লম্বা একটা মিছিল। সামনে হুডখোলা গাড়িতে, নেতা। পিছনে সার সার পদাতিক বাহিনীর একজন হয়ে মান্তুদা চলেছে। পরে এক অন্য সময়, দোকানদার তিলক জিজ্ঞেস করে, “কি গো দল বদল করে ফেললে?” গালি শব্দের স্রোত বাঁচিয়ে গোবিন্দ কান পাতে মান্তুদা কি বলে, শোনার জন্য। “...রাস্তা কি পাল্টায়? একসাথে চলার লোক হয়তো পাল্টে যায়”। শুনে তিলক বলে, “বাঃ সুযোগ বুঝে পাল্টি মারলে। এতদিন লাল শালু বয়ে বেড়ালে, আজ হঠাৎ জামা পাল্টে অন্যদলে!”

-“ ... তোরা বুঝিস না। আমাদের মতো মানুষের এক্তিয়ার কতটুকু? খাওয়ার জোগাড় করা, আর সেটুকু খেয়ে দিনটা পার করা। সেটা করতেই সময় চলে যায়। ভাবনা করার মত সময় বা ক্ষমতা কোনোটাই নেই। এতদিন যে দাদা এসে রুটি আলুরদম খাওয়াতে নিয়ে যেত, সেই আসছে ওই একই রকম বা তার চেয়ে ভালো টিফিনের ব্যবস্থা করতে। আমি কি তোদের মতো পাগল, যে যাবো না?” মান্তুদাকেই সবাই পাগল বলে, সে তিলককে পাগল বলায় আসেপাশে সবাই হেসে ফেলে।

মানুষ চলতে চায়, যেকোন ভাবে হোক। খুব বেশি ভাবতে হবে না কোথায় যাচ্ছি। তাদের চলার একমাত্র শর্ত দলবদ্ধ যাত্রা। গন্তব্য ঠিক করার দায়িত্ব তাদের নয়। একমনে হঁটে যাওয়া একমাত্র কাজ। অন্য কেউ হাল ধরে থাকবে। আমি ভার সঁপে দিয়ে হাল্কা হয়ে থাকব পালকের মতো। হাওয়া বয়ে নিয়ে যাবে, হাওয়ার মতো। সে যদি ঝড়ের হাওয়া হয়, তাই সই। ঘরের ঘুলঘুলিতে এক অধটা চড়াই এল বাইরের খবর নিয়ে। তাদের ঠোঁটে ধরা খড়কুটো। সেখানেই লেগে আছে অন্য খবর। রাস্তার খবর। সে রাস্তা বৃষ্টিজলে ভিজে আরো কালো হয়ে ওঠে। সেখানে মান্তুদার মতো অনেকেই। কাজের মাসির মেয়ে সাইকেল চালায়। রাস্তা থাকে রাস্তার মতোই, শুধু চলার সাথী বদল হয়। মান্তুদাদের কথা কোন স্বতন্ত্র কথা নয়। গোবিন্দ রাস্তার পাশে দাঁড়াবার চেষ্টা করে, যাতে দেখা যায় কে কোনদিকে যাচ্ছে। তবে রাস্তার পাশও একটা দিক। এই দিক না অন্যদিক?

সোমবার, ১৬ মে, ২০১৬

বসত

বিকেলের মোড়কে জলঙ্গীর জলে পাখিদের ডাক মেশে। পানকৌরিরা আজকের মতো ডানা শুকিয়ে নিচ্ছে, পাড় থেকে হেলে পরা বাবলাগাছের একটা ডালে। তিরের ফলার আকারে বকেদের সারি ঘরপানে চলল। চন্দ্রমাধব দাস তাঁর একতারা গুছোয় উঠবে বলে। গোবিন্দর সাথে তাঁর আজকেই আলাপ। নদীর পাড়ে বসে গল্প হচ্ছিল। খুব অমায়িক গলায় বলে, “আগামী মঙ্গলবার পূর্ণিমা, নতুন ঘর বেঁধেছি। ওইদিন একটু নামগান হবে। সেবা হবে। এসো কিন্তু”। সেই মঙ্গলবার পর্যন্ত থাকা সম্ভব নয়, তাই আগেই গেছে দেখা করতে। ছোট্ট বাড়ি। সুন্দর করে নিকোনো উঠোন। দরমার বেড়া আর করোগোটেড টিন দিয়ে ছাউনি। মাটির উনোন, দুয়েকটা হাঁড়ি কড়াই। ঘরে রাধামাধব। “এর চেয়ে আর বেশি কি লাগে?” বলতে গিয়ে চন্দ্রমাধবের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়। অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে এক মুঠো মুড়ি বাতাসা আর জল। “আমাদের সঞ্চয় করতে নেই। যা জুটেছে তাই দিলাম”।  এইসব দিন বা মানুষ খুব দূরবর্তী নন। তবে ক্রমশঃ অপসৃয়মান। একান্ত নিজস্ব দেশজ সম্পদকে ঠেলে দিচ্ছে আরও দূরে।

গোবিন্দর এমনই এলোমেলো ভ্রমন। যেখানে যত বেগার, সেখানে তার ডাক পরে। কোন ছেলেবেলায় অমৃতাদিকে ভালো লাগত। পাড়ায় ডাকসাইটে সুন্দরী থকলে যা হয়, সাইকেল যুবকদের আনাগোনা লেগেই থাকে। অমৃতা গোবিন্দকে প্রশ্রয় দিত। এলেবেলে বা দুধভাত। তাই সই, গোবিন্দর তা পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা। এর তার চিঠি এনে দিত। কখন কখন অমৃতাদিও তাকে দিয়ে কিছুমিছু পাঠাত। তারপর অনেকদিন কেটে গেল। ছেলেবেলার রূপোলি ঝালর কেটে এখন অমৃতাদি শহরে থাকে। স্বামী পুত্র কন্যা নিয়ে ভরপুর সংসার। সেদিন হঠাৎ ডাক আসে। অমৃতাদির বাবার সাথে বাজারে দেখা, “তোকে অমৃতা যেতে বলেছে”।

ঠিকানা জুটিয়ে গোবিন্দ ঠিক হাজির। ওরেবাব্বা! বত্রিশ তলায় অমৃতা থাকে। ওদের দুহাজার স্কোয়ারফুটের ফ্ল্যাট। বারান্দায় দাঁড়ালে মনে হয়, ঝড় হচ্ছে এমন হাওয়া। নিচের দিকে হারিয়ে যাওয়া শহর। কত ছোট! খেলনার বাড়িঘর, গাড়ি, ঘোড়া। তাকালে পা শিরশির করে। কি জানি যদি উড়ে যায়। মেঘগুলো কি জানালার কাছে চলে এল? অমৃতার নতুন বাড়ির সবকিছুই নতুন। আসবাবপত্র, আধুনিক ঝাড়লন্ঠন, নিচে দামি কার্পেট। শোকেসে সাজানো সারি সারি কাচের গ্লাস আর রকমারি পানীয়র বোতল। “তোমার তো মেঘের দেশে বাড়ি গো। খুব স্বপ্ন দেখ নিশ্চই”। কিন্তু অমৃতাকে দেখে আগের মতো লাগল না, কেমন চোখের তলায় কালি পড়েছে। চেহারার জৌলুশও যেন কম। অমৃতা দামি কাচের বাসনে খেতে দেয়, থালায় ভরা কত কি? গোবিন্দও না না করেও, করে না। পরিপাটি খেয়ে নেয়। শেষে একটা বড় প্যাকেট নিয়ে আসে। সেখানে সাজানো অনেক ফল মিষ্টি। “এগুলো কি হবে?” অমৃতাদি বলে, “বাবাকে দিবি। ওঁরা কেউ তো এ বাড়িতে আসেনা। আমারও আর যাওয়া হয়না”। গোবিন্দ কিছু জিগেস করেনা। না বলতেও অনেক কথা বুঝে যায়। সেই ছোটবেলার মতই। যখন চিরকুটগুলো বয়ে এনে দিত। কোনদিন খুলে দেখেনি। কিন্তু বুঝে যেত ভিতরে কি আছে। মানুষের মন খুলে দেখার দরকার হয়না। গোবিন্দ বুঝে যায়। হাসি মুখে বিদায় নেয়। “আবার আসবি কিন্তু। এবার একটা মোবাইল ফোন সাথে রাখবি। দরকারে ডাকা যায়”। গোবিন্দ নেমে আসে, বত্রিশতলা থেকে জমিতে। গোবিন্দ এখন জানে দরকারেই তার ডাক পরে, সেই ছেলেবেলার মত, এখনও এলেবেলে। ঘাড় উঁচু করে দেখার চেষ্টা করে। ব্যালকনিতে অমৃতা দাঁড়িয়ে যতক্ষণ চোখের আড়ালে না চলে যায়। 

আসার পথে একটা বস্তি চোখে পড়ে, খালের ওপর দিয়ে একটা ব্রিজ রয়েছে। তার নিচে প্লাস্টিকের আড়াল দিয়ে প্রায় ত্রিশ চল্লিশ ঘর থাকে। খাল দিয়ে বয়ে চলেছে শহরের ক্লেদ আবর্জনা। তার ঢালু জমিতে কালো নোংরা জলের খুব কাছাকাছি উদোম বাচ্চারা খেলছে। আর রাস্তার ধারে বেশকিছু ভ্যান, রিক্সা সার দিয়ে সাজানো। এইখানকার পুরুষদের জীবিকা, মেয়েরা হয়তো অমৃতাদিদের ফ্ল্যাটগুলোতে যায়।

এর বেশকিছুদিন পর আবার এক মেলাতে দেখা হয় চন্দ্রমাধবের সাথে। ইদানিং নাকি এখানেই তাঁর ডেরা। “জলঙ্গীর পাড়ে যাওনা?” উত্তরে হাসিতে ভরিয়ে দেয় চন্দ্রমাধব, “তা রাধামাধব নিয়ে গেলেই যাব। সারা দুনিয়াটাই তো ওনার। যখন যখানে বসি, সেখানেই বসত তৈরি হয়”। গোবিন্দ সবটা বোঝেনা। তবে ভালো লাগে। এই ডেরাটা আগেরটার চেয়েও ছোট। তবে ভিতরে রাধামাধব আর নিরাভরন তৈজস। এই মেলাতে শুধু হাঁড়িকুরি আর চন্দ্রদের গান হচ্ছে না। অনেক আধুনিক জিনিসের পসরা নিয়ে বসেছে দামি দোকান। সেখানে বড় বড় যন্ত্রে বাজছে একালের গান।

অমৃতাদির বাক্সটা ওর বাবাকে দিয়ে, গোবিন্দ খানিক বোকার মতোই জিজ্ঞেস করে, “তুমি ওর ওখানে গেলেই তো পারো। দুঃখ করছিল”। বৃদ্ধ চোখ দিয়ে হেসে বলে, “নিজের মাটি ছুঁয়ে না থাকলে কেমন অপমান লাগে, ও তুই বুঝবি না”। গোবিন্দ বোঝেনা। সত্যিই বোঝেনা। মানুষের তল কোথায়, তালুকইবা কোথায়, কে বলতে পারে?

বৃহস্পতিবার, ১২ মে, ২০১৬

বিকিকিনির সম্পর্ক

বিপণনের দুনিয়া আমাদের জীবনে নতুন মাত্রা আনে। নতুন ফ্যাশন নতুন বাহার নতুন শব্দ। আমদানীকৃত অলঙ্কার আসে সাগর পাড়ের লোনা হাওয়ার সাথে। বনিকের মানদন্ডে যুক্ত রাজদন্ড এখনও পা ফেলে, তবে খুব চুপিসারে আসে। এ রাজত্ব ফেলে আসা সময়ের মতো উচ্চকিত নয়। রাজত্ব বিস্তৃত হয় সমাজের অভ্যন্তরে মননে মেধায় জীবনে। অনায়াসে পরাধীন হয়ে পড়ি, নিজের অজান্তে।

ইংরাজির ‘শপ’ শব্দের অর্থ দোকান। এ শব্দের সাথে মুখ্য যোগ দোকানদারের, তারপর ক্রেতা। বিপণন বিজ্ঞান সংজ্ঞা পাল্টে দিচ্ছে। দৃষ্টিকোণ অনুসারিত হচ্ছে বিক্রেতা থেকে ক্রতার দিকে। ‘শপ’-এর ক্রিয়াকরনে ‘শপিং’, বিক্রি না বুঝিয়ে ক্রয়কে বোঝানো হল। আর ‘শপার’ বিক্রেতা না হয়ে হলেন ক্রেতা। কারন পরিবর্তিত পরিবেশে ক্রেতা ভগবান। তার ভজনা করাই তাবড় বিশ্ব বিপণন দুনিয়ার লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও মোক্ষ। আর এই শপিংএর পীঠস্থান হল ‘শপিংমল’। দরজা খুলে ঢুকতে না ঢুকতে গলে গলে পড়ে সুখ। রিনরিনে কোলাহল আর রঙিন আবহাওয়া মুহুর্তে ভুলিয়ে দেবে সমস্ত দুঃখ কষ্ট। পরিসংখ্যান বলে ২০১৩ পর্যন্ত ৫৭০টি এমন শপিংমল আমাদের দেশে তৈরি হয়েছে এবং বলাই বাহুল্য আরও হচ্ছে। আজকের প্রজন্মের কাছে এই দোকানপুজ্ঞগুলো শুধু কেনাকাটার জায়গা নয়, বেড়ানোর, প্রেম করার, সময় কাটানোর জায়গা। অন্যান্য দোকান বাজার ছাড়া সিনেমা, রেস্তোঁরা, হেল্থ ক্লাব, বাচ্চাদের কিডস জোন কি নেই। এক্কেবারে যাদুতে মোড়া সব পেয়েছির আসর বলতে যা বোঝায়, এ যেন তাই।

ইংরাজিতে আরেকটি শব্দবন্ধ আছে ‘মম এন্ড পপ শপ’। অর্থাৎ কিনা মা বাবার দোকান বা পরিবার পরিচালিত ছোট দোকান। ডিমপুকুরে গোবিন্দর বাড়ির পাশের দোকান। যাদের বিশ্বজোড়া শৃঙ্খলবদ্ধ দোকানমালা নেই। একটি ছোট দোকান ঘিরে তাদের বেঁচে থাকা। যে দোকানদার কে গোবিন্দরা সবাই চেনে দামোদর, সুভাষ, অনুপ, আশিস এবং তার বৃদ্ধা মা, শঙ্কর, মিলন, তুলসী, যোগেশ এমন সব কত নাম। অমল কাকুর মনিহারি দোকান তাকে বিজয়ায় প্রণাম করে। বাড়িতে গোবিন্দর বাবা অসুস্থ হলে ফলওয়ালা অনুপ তাকে দেখতে আসে। তিনদিন পরে বাজারে গেলে অনায়াসে ফেরত পায় আগের দিনে ভুল করে ফেলে আসা বিস্কুটের প্যাকেট। কখনো সাইকেল করে শঙ্কর বাড়ি বয়ে দিয়ে আসে ফেলে আসা মাছের থলি, কিম্বা ফেরত দেয় গত সপ্তাহে মাছের জন্য ভুল করে বেশি নিয়ে নেওয়া দুশো টাকা। গোবিন্দ বাজার করতে গেলে খোঁজ নেয়, জয়দেব দুদিন ধরে কেন আসছে না? নদীয়া জেলার সব্জী খুব সুস্বাদু। অনেক মানুষ অনেক দুর থেকে এই বাজারে সব্জি কিনতে আসেন, তার কারন জয়দেব সুদূর সমুদ্রগড় থেকে প্রতিদিন নানান পদ বয়ে নিয়ে আসে এই বাজারে। আবার নিতাইএর মতো ব্যবসায়ী আছে, যারা সুযোগ বুঝে পচা আলু দিয়ে দেয়। পড়শী দোকানদাররা আড়ালে সাবধানও করে দেয়। বাড়িতে বিয়ে বা পরবে এই অনাত্মীয় বাজারওয়ালাও নিমন্ত্রণ পায়। সব মিলিয়ে বাজার শুধু কেনাকাটার নয় একটা সম্পর্কের বুনোট।

পাশাপাশি মহার্ঘ্য শপিংমলের দোকানে যে সব বিক্রেতারা থাকেন, তাঁরা মূলত কর্মচারী। এক ইউনিফর্ম পরা প্রত্যেকে। আলাদা করে চেনার উপায় নেই। তাই বিকিকিনি বাইরে কোন সম্পর্ক গড়ে ওঠেনা। একটু খুঁটিয়ে দেখলে বোঝাই যায় দামি বা কেতা দুরস্ত পোষাকের অন্তরালে হয়তো একটি গ্রাম্য গৃহবধূ, যার সাধ্য নেই যে সব পণ্য ব্যবহার করার, সেই সমস্ত পণ্যের গুণকীর্তন করে বিক্রির চেষ্টা করছে। এখানে বিক্রেতাটি থাকেন আড়ালে। তিনি সর্বশক্তিমানের মতো, বিশ্বজোড়া তার বিস্তার, বহুজাতিক তার মালিকানা। তার অসংখ্য চোখ কান, যা প্রতি নিয়তঃ তার বিশ্বস্ত ক্রেতা আর সম্ভাব্য ক্রেতাদের পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। টেলিভিশন, রেডিও, খবরের কাগজ, সাইনবোর্ড ইত্যাদির মাধ্যমে। তাই শপিংমলে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ-বিক্রতাটি বুকে লেবেল লাগানো শুধুমাত্র সেই মহামহিমের প্রতিনিধিমাত্র। তার আলাদা পরিচিতি হতেই পারে না। ব্যক্তিগত সুখ দুঃখ অনেক অতীত স্বাক্ষর। খুব জটিল মনোবিজ্ঞান আর ব্যবহারিক তথ্য সংগ্রহ করে অনায়াসে বুঝে ফেলে, ক্রেতা কখন ঠিক কি চাইতে পারে বা কেন চাইতে পারে। তার যোগান অব্যর্থ উপায়ে ঠিক সময়ের আগেই তার চোখের সামনে সুদৃশ্য মোড়কে ঝুলিয়ে দেওয়াই এই বিপণন দুনিয়ার মূলমন্ত্র।

সময় তার নিজের নিয়মে গড়িয়ে চলে, যা আগে ঘটেনি তা যে এখন ঘটবে না, কেউ বলতে পারে না। হয়তো সময়ের নিজেরও সেটা বলার স্বাধীনতা নেই। তাই আমরা যা পাই, তাই নিয়ে হেসেখেলে দিন গলিয়ে এগিয়ে যাই। ফেলে আসা দশকের ফেরিওয়ালারা যেমন আজ আর নেই। বেলফুল, আতর, শোনপাপড়ি-সন্দেশ, কেক-লো, কুলফি বরফ এমন কত নানা প্রয়োজনীয় পসরা সাজিয়ে তারা আসতো। তারাও তো আজ বিস্মৃতির গহিনে। পাড়ার বাজারের আব্বাসের মা হরিয়ে গেলে কোন ক্ষতিবৃদ্ধি হবে-কি হবে-না, কেউ জানে না। তবে ঈদের পর শাকপাতার স্বল্প সম্ভারের মধ্যে থেকে টিফিন কৌটো বার করে কে দেবে? বাড়িতে গড়া পরবের মিষ্টি। সাথে ফোকলা দাঁতে একরাশ আশীর্বাণী। মানুষে মানুষে যোগাযোগ-ই একমাত্র উপায় পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তোলে। যদি সেই যোগাযোগ হয় কেবল মাত্র কৃত্রিম আর কোন অন্য উদ্দেশ্য প্রণোদিত তবে আশঙ্কা বেড়েই চলে।

মঙ্গলবার, ১০ মে, ২০১৬

সময় সরণী

গাঢ় সবুজের মাঝখানে একটা হলুদ প্রজাপতি উড়ছিল। তার ডানায় ডানায় লেগেছিল সময়।
পাইনের ডাল থেকে গোপন আঁধারে একটা মাকড়শা সুতো ছাড়তে ছাড়তে নামছে। হাল্কা
দোল খেয়ে পরের পাতায় পা দেবে। এডাল থেকে পরের ডালে সময় ছুঁয়ে চলে যায়। তার
সময়কে কি ভাবে ধরা যায়? একটা ভালো ঘড়ি হাতে দিয়ে বল, এই ধরলাম। একটা কাচের
বালি-ঘড়িতে একমুঠো বালি ভরে বললাম, এই ধরেছি। সব কেমন আঙুলের ফাঁক দিয়ে মসৃণ
ভাবে গলে যায়, টের পাওয়াও যায় না। আগের মুহুর্তের প্রজাপতি এই সময়ে অন্য কোন
ব্যপ্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল, তাকে ধরা যাবে না আর কোন দিন। ছোট্ট গুবরে পোকার জন্য যেমন
সত্যি, অতিকায় নীল তিমির জন্যেও তাই। আবার পৃথিবীর বাইরে থেকে দেখতে পেলে গোটা
গ্রহ উপগ্রহ সহ সৌরজগতের জন্য সত্যি। এখনকার ক্ষণের সঙ্গে পরের ক্ষণের কোন মিল
নেই। সে চলে গেছে ধরা ছোঁযার বাইরে। আর কোনদিন আসবে না।

রোজ রোজ চেনা মুখটাকে অয়নায় দেখতে দেখতে, হঠাৎ করেই একদিন মনে হয়, এই
মানুষটা তো আগে ছিল না। বা সেদিনের সেই মানুষটি কোথায় হারিয়ে গেল? এই তো এখানেই
ছিল! এমন করে কোথায় চলে গেল যে আর তাকে খুঁজেই পেল না কেউ। প্রজাপতি উড়ে
গেলে বাতাসে একটা দাগ থেকে যায়। শামুক হেঁটে গেলেও তার চিহ্ন রেখে যায়। মানুষের
হেঁটে চলা পথে পথে দাগ থাকে। সে দাগে কাটাকুটি হয়, আবার অন্য দাগে হারিয়ে যায়।
কোথাও কোথাও সে দাগ হয়তো স্থায়ী হয়ে যায়। হয়তো তার কাছের মানুষটির মনে ভেতর।
সেই ভালোবাসায় দাগ ধরে রাখে। যাত্রাকাল ছোট হোক বা লম্বা, সেই গতিপথের আসেপাশে
যাঁরা এলেন, তাঁরা ছুঁয়ে গেলেন। প্রত্যেকে প্রত্যেকের মতো। সবই যে ভালো তা নয়, কারো
মনে গভীর ভাবে গেঁথে গেল কোন ব্যথার দাগ। সেই নিয়েই চলল তার রথ।

বহুদিনের চেনা পথে হেঁটেও তাই মনে হয় এ রাস্তায় তো আগে আসিনি। কি করে হবে? আগে
এলেও সময়টা তো অন্য। এখনকার সময় দিয়ে সেইদিনের সময় কে ধরতে গেলে বিড়ম্বনা
তো হবেই। এই রহস্যটাই বেঁচে থাকার উৎসমুখ, যার ঝর্ণায় অঞ্জলি পেতে রসদ সংগ্রহ করি।
হঠাৎ করেই মনে হয়ে সামনের বাঁক ঘুরলেই হয়তো দেখব, সেই পরিচিত মানুষটা, মুখে
একরাশ হাসির নিমন্ত্রণ সাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। যদিও জানি একটা অনেক বড় ‘নেই’ শব্দে
ঢেকে গেছে চতুর্দিক। তবু ভুল করে বিশ্বাস করতে ভালো লাগে, কষ্টও হয়।

প্রথম শৈশবে, যে শিশুর হাত ধরে নতুন সময়ের সরনী তৈরী হয়, তার প্রতিটি অনন্দময় ক্ষণে
মনে কি অবিশ্রাম দাগ কাটে। যেন কোন নিপুণ শিল্পীর সঙ্গীতের স্বরলিপি, ভালো লাগার
সঙ্কেত। রেণু রেণু হয়ে জুড়ে থাকে প্রতিটি প্রাণ। যে সময়টা প্রত্যেকের একসাথে, সেই
সময়ের মূল্যে এই অভিজ্ঞতা শাশ্বত। তারপর ধীরে ধীরে কারো কারো সময় ফুরিয়ে আসে,
তাকে মঞ্চ থেকে বিদায় নিতে হয়। পরের দৃশ্য অন্য কুশীলব আসবেন। গত দৃশ্যের
হাততালির রেশ মিলাতে বেশিক্ষণ লাগে না।  এভাবেই দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে আমাদের চলন।
কাউকেই বলে দিতে হয় না। কেমন যেন আগে থেকে তৈরি করা সংলাপ ক্রম। কাকে কি
বলতে হবে, যেন শেখানোই আছে। সেই পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক। 

এর মধ্যে সময়ের মাইলফলক চিহ্নিত করে রাখি, তারিখের মাধ্যমে। পুরোন সময়ের
স্পর্শসুখে শুধু সেই সংখ্যা ছুঁয়ে থাকি। জন্মদিন, মৃত্যুদিন, বিয়ের দিন, এমন কত কি?
ব্যক্তিসত্তার পরিধির বাইরেও এমন অজস্র তারিখ। স্বধীনতা দিবস, শ্রম দিবস, মায়ের দিন,
বাবার দিন, ভালোবাসার দিন এমন আরো। বছরের প্রতিটা দিন-ই হয়তো বিশেষ কোন কারনে
দাগিয়ে দেওয়া যায়। কারন মানুষ বড় ভয় পায়, প্রতি নিয়ত হাত থেকে খসে পড়া সময়ের
বালি। ধরতে না পারার এক চরম অপ্রাপ্তি। তাই মাইলফলক রাখি, কোন মতে তাকে ঘরের
শো-কেসে সাজাবার জন্য। ভুল করেও যেন ভুলে না যাই, ওই সময়ে আমরা এই পথে চলেছি,
হাত হাত রেখেছি। আবার হরিয়ে গেছি সময়ের নিয়মেই।  

রবিবার, ৮ মে, ২০১৬

ডাকবাক্স

লাল কালো রঙে জড়ানো স্বপ্নের সুলুক সন্ধান। বাক্স ভরা খবর। আর তার জন্য প্রতীক্ষা। কতশত রোমান্টিস্ম। সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের কালজয়ী রানার কবিতার হাত ছুঁয়ে, সলিল চৌধুরির সুর আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠমাধুর্য্য। ডাকবাক্স আর ডাকপিওন। কেমন মন কেমন করা কুয়াশার গহিন ডুবে যাওয়া। প্রত্যেকের বাড়িতেও ছিল। হয়তো এখনও আছে। কাঠের তৈরী, এক দিকে ছোট একটা তালা। আজকাল চিঠি আসেনা, আসলেও তা ভীষণই পোশাকি লেখা। কোন কোম্পানির বিজ্ঞাপনের কাগজ, ফোন বা ইলেক্ট্রিকের বিল। তাও ই-মেল কিম্বা এস-এম-এস মারফত এসে যায়, তাই ডাকবাক্স খোলার আগ্রহ থাকে না। অবহেলায় পড়েই থাকে, টিকটিকি বা আরশোলা সংসার পাতে।

কৈশোর পেরোন ভোরে, যখন বিশেষ চিঠির প্রতীক্ষায় দিন যাপন। কখন সেই প্রার্থিত খামটি আসবে? বাইরের অবয়ব দেখেই অনেকটা মন ভরে যায়। তার রঙ, ওজন, গড়ন আর গন্ধ। মিলেমিশে আবহ তৈরী হয়। কেজো চিঠি ইনল্যান্ড, পোস্টকার্ড বা সরকারি খাম। এয়ার মেলের ওপর বিদেশি ডাকটিকিট। শুধু তার আগ্রহে এপাড়া থেকে অন্য পাড়া ছুটে চলে যেত সাইকেল। ডাকপিওন কে আগেভাগে হাত করে নেবার ছল। তার হতের দিস্তা বাঁধা বান্ডিল দূর থেকে দেখেই বোঝা যেত, নিজের বিশেষ চিঠিটি আছে কিনা। বাড়ির ডাকবাক্সে পড়লে অন্য হতেও পড়তে পারে। সেই অতীব গোপনীয় সব শব্দজাল। কিম্বা দুয়েকটা বিদেশি ডাকটিকিট হাতিয়ে নেওয়া। খামের ওপর থেকে মসৃণ ভাবে ছুড়ি দিয়ে চেঁছে নেওয়া। ডাকটিকিট নিয়ে বিশ্বজোড়া চর্চা। তার জন্য সুরম্য অ্যালবাম, প্রথম প্রকাশের খাম, এ সমস্ত অতি মহার্ঘ্য দখল। এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মতে হাত বদল হয় তার উত্তরাধিকার।

ডিমপুকুরের ফাঁড়ির গায়ে একটা লাল বাক্স ঝোলানো থাকত। পাড়ার লোককে পোস্টঅফিস অবধি উজিয়ে যেতে হতো না চিঠি ডাকে দেবার জন্য। ভারতবর্ষ জুড়ে দেড়লক্ষের বেশি পোস্ট অফিস আছে। ডাকবাক্স আছে আরো বহুগুণ। গাঢ় কালচে-লাল তাদের রঙ। পরবর্তিকালে সবুজ নীল অন্য রঙও হয়। কিন্তু স্বপ্নের রঙ অবশ হয়ে পড়ে। এ পাড়ার সেই লাল বাক্সটি ক্রমশঃ মরচে ধরতে শুরু করে। একসময় দেখা গেল নিচের পাতটি ভেঙে গেছে। কেউ কেউ হয়তো তখনও চিঠি পোস্ট করতেন, কিন্তু সে নিচ দিয়ে গলে যেত। কখন হয়তো দুষ্ট বালকের দল ইচ্ছাকৃত ভাবে চিঠি লোপাটও করে দিত। অন্যের চিঠি পড়ার মধ্যে একটা গোপন শিহরণ জাগানো রোমাঞ্চ থাকত। ক্রমে সেই ডাকবাক্সটাও সরিয়ে ফেলা হয়। তার বদলে আর নতুন কোন বাক্স ঝোলানো হয় না। শুধু একটা লোহার আংটা গাছের গুঁড়ির গায়ে পুরোন ক্ষতর মতো জেগে থাকল।

এখনকার প্রেম চিঠির অপেক্ষা করে না। তাৎক্ষনিক খাবারের মত, তাৎক্ষনিক খবরের আদান প্রদান। হয়তো অনেক সময় সঙ্কুলান হয়, মনের কাছে আসতে ডাকপিওনের হাত ধরতে হয় না। তবে ঢিমে আঁচে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা স্বাদের সাথে তাৎক্ষনিক খাবারের যেমন তফাত, চিঠি আর এস-এম-এস হয়তো কতকটা তেমনই। ক্রিয়া আর প্রতিক্রিয়ার দ্রুততায় সম্পর্ক বেড়ে ওঠে তরতর করে। বড় বড় ইমারতের ভিত নির্মাণে, সবচেয়ে বেশি সময় দেওয়া হয়। সিমেন্ট, বালি, পাথর, লোহার মত সময়ও এই নির্মাণের এক মস্ত জরুরী উপাদান। তাই সময় খাইয়ে খাইয়ে শক্ত ভিত্তি তৈরী করেন স্থপতিরা। সম্পর্কের তৈরিতে হয়তো সেই ভিত্তিটা চিঠি গড়ে দিত। এখন তাৎক্ষণিক সম্পর্ক যেমন দ্রুত তৈরি হয়, তেমনই দ্রুত ভেঙেও পড়ে।

টেলিগ্রাফের সরকারি মৃত্যু পরোয়ানায় শিলমোহর পড়ে গেছে অনেকদিন। আর বেশিদিন হয়তো নেই, যখন অবলুপ্ত হবে চিঠি আর ডাকবাক্সের এই ক্ষয়িষ্ণু সম্পর্ক। অনেক পত্র সাহিত্য কেবল ঐতিহাসিক উপাদান হয়ে জেগে থাকবে। পরিবেশ বান্ধবরা হয়তো খুশি হবেন। কতশত গাছ বেঁচে গেল, এই ভেবে। কি জানি কারা মরলো আর সে জন্য কারা বাঁচল? জগতের নিয়মে সে চলতেই থাকবে। যাদুঘরে যেমন পুরাতত্বের নিদর্শন সযত্নে সংরক্ষণ হয়, তেমনি ডাকটিকিট, খাম, চিঠিও থাকে। পরবর্তি প্রজন্ম সেই হলদে হয়ে যাওয়া কাগজের টুকরো তে সময়কে ছুঁয়ে দেখবে। বিদগ্ধ গবেষক মোটা চশমার ফাঁকে পর্যালোচনা করবেন সময়ের সরনীতে ফেলে যাওয়া মাইলফলক। ডাকটিকিট প্রকাশের কারন ও তার পারিপার্শিক সময়ের দলিল হিসেবে তার আদর জুটবে, বক্তৃতায় আর গবেষণপত্রে।

প্রতিটি ডাকটিকিটের পিছনে একটা করে গল্প থাকে। সে শুধু প্রকাশের ইতিহাস নয়, কবে কখন কে পাঠিয়েছিল? সব সময় যে খুব শুভ সংবাদ বয়ে নিয়ে এসেছে তা নয়, বহুবার চোখের জলে ভিজে খবর এসেছে। কাছের কোন মানুষের বিচ্ছেদের খবর। এতটা সময়ের পার থেকে আর ছুঁয়ে দেখার সাধ্য থাকে না। শুধু তার স্পর্শ মাখা খামটি থেকে যায় স্মৃতিচিহ্ন হয়ে। চোখের জলে বিধুর হয়, ফিকে হয়ে আসা হস্তাক্ষর। কবে যেন কে খুব যত্নে লিখেছিল। বুকের তলায় বালিশ দিয়ে উপুড় হয়ে। লিখতে গিয়ে হয়তো ভাঙলো কাচের চুড়ি, কব্জি চুঁয়ে চুনীর ফোঁটা এসে পড়ে লেখার পাতায়। সেই শোনিত চিহ্ন আর এক টুকরো ভাঙা চুড়ির টুকরো বুকে নিয়ে চিঠি ঊড়ে চলে। এ পোস্টাফিস থেকে অন্য পোস্টাফিস। হাত বদল হয় কত ডাক কর্মীর। অবশেষে তা যখন গ্রহকের হাতে পৌঁছয়, সে চিঠি আর চিঠি থাকে না। হয়ে ওঠে এক স্মারক, যা শাজাহনের হাত ধরে মুমতাজ কে অমরত্ব দিয়েছে। 

শনিবার, ৭ মে, ২০১৬

পথকথা-৫ (আকাশ পথ)

স্বয়ং অবন ঠাকুর বলে গেছেন, শামুকদের কাছে রাস্তার খবর থাকে, মাছেদের থাকে জলের। আর পাখিদের আকাশে। আকাশের খবর উড়োজাহাজ কোম্পানিদেরও থাকে। আকাশের কোনদিকে কেমন হাওয়া? টার্বুলেন্স আছে কি নেই? একই উচ্চতায় আর রুটে আরও কতজন ডানা মেলেছে। জাহাজের ভেতর যিনি ক্যাপ্টেন আছেন, তিনি নিমিত্ত মাত্র। আসল টিঁকি বাঁধা নিচে। যেখানে তারা রাডারে চোখ রেখে প্রতিটি পল অনুপল মেপে যাচ্ছেন। সেই দুরূহ পদ্ধতিটির মধ্যে যাতায়াত যতই আরামদায়ক মনে হোক, সহজ নয় এতটুকু। সোমনাথের পেট গুড়গুড় করে। এরোপ্লেনে চড়ার নাম শুনলেই হাত পা যেন সেঁধিয়ে যেতে চায়। বিমান উড়বার আগে সুবেশা সেবিকারা হাত নেড়ে, বিপদে পড়লে কি করবেন শেখায়। তারা ভাবলেশহীন হয়ে যন্ত্রের মতো এইসব কথা বলেন, সোমনাথের ততই ভয় বাড়তে থাকে। বলে কি রে, সমুদ্রে নামলে কি করবে? অক্সিজেন কমে গেলে কি করবে? মাঝ আকাশে যদি গাড়ি খারাপই হয়, ওইসব বুকনি কোন কাজে আসবে? কক্ষোণো নয়। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ওঠা আর নামার সময়। সোমনাথ, প্রায় হাঁটুর মাঝখানে মাথা গুঁজে ফেলে। ঈশ্বরে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কোনটাই ওর নেই, তবু এই মুহুর্তগুলোতে ভাবতে ভালো লাগে, আহা কেউ যদি অমন সর্বশক্তিমান হত, তবে খানিক নিশ্চিন্তি হতেই পারত। আর যদি টার্বুলেন্সে পড়ে, তবে তো হয়ে গেল। মাঝে মাঝে সে একেকটা ফ্রী-ফল যা হয়, প্রাণপাখি পালাবার জন্য ডানা ঝাপটেই চলে।

সেবার এক পাহাড়ি পথে চলেছে। তা আবার বর্ষার মরশুম। সকাল থেকে বেশ কয়েকবার নির্ধারিত সময় পার হয়েছে। কি না, সেই দেশে বৃষ্টি হচ্ছে। সে, এতো বৃষ্টি এরোপ্লেন নামতেই নাকি পারবে না। এই ঘোষনাগুলো কেন যে করে? এসব শুনলে তো আরো পিলে চমকে যায়। এমন ভাবে সময় পিছোতে পিছোতে, যখন ভাবছে এবার বুঝি আজকের মত উড়ান বাতিল হল, নিশ্চিন্তে হোটেলে ফিরতে পারবে। ঠিক তখন প্লেন ছাড়ার ঘোষনাটি হল। কি আর করা, রামনাম জপতে জপতে প্লেনে উঠে আসন গ্রহন করে। সমতলের ওপর দিয়ে যখন চলল, তেমন কোন ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে না। বাধ সাধল, পাহাড়ি এলাকায় প্রবেশ করে। ওরে বাবারে এ কি বিশাল বিশাল চূড়া। দুইদিকে এমন সব দুরূহ কঠিন দেওয়াল। তার ভেতর দিয়ে অলি গলি খুঁজে বেরোনর মত ধাতব পাখিটা উড়ে চলে। ক্রমশঃ নিচে নামতে থাকে। মেঘের আস্তরণ পার হতেই বৃষ্টির মধ্যে পড়ল। সে কি তুমুল আলোড়ন। এর মধ্যে পাইলট সাহেবের ঘোষনা। সবাই কে শান্ত হয়ে থাকার অনুরোধ। সান্ত্বনা বাক্যে একটি আশ্বস্ত বানী "আপনাদের যদি মনে হয় দুই দিকের পাহাড়ের দেওয়ালগুলো, আপনাদের পূর্ব অভিজ্ঞতার চেয়ে কাছে, একদম ভয় পাবেন না। এই দেশে এটা স্বাভাবিক"। এই ঘোষনায় কারা স্বস্তি পেল জানা নেই, সোমনাথের কলজে শুকিয়ে, পিলে চমকিয়ে, তালু গরম হয়ে ফেটে যাবার জোগাড়। তার মধ্যে অনুভব করে দুই দিকের পাহাড় এতটাই কাছে যে, ডানা সোজা করে ধাতব পাখি বেরোতে পারবেনা। বোঁ করে প্রায় পঁচিশ ডিগ্রী হেলে  গেল। বাস আর দেখতে হবেনা, এরোপ্লেন জুড়ে হাহাকার রব উঠল। এমন করে শেষমেষ এক ফালি রানওয়ের মত কিছু এল। তবে সে না দেখা যাবার মতো। বৃষ্টির তোড়ে সব সাদা। বিমান তিন বার চক্কর কাটে, তারপর আবার ক্যাপ্টেনে ঘোষনা, “ভয়ঙ্কর দুর্যোগের কারনে আপাততঃ আমারা নামার ঝুঁকি নিচ্ছিনা। আমরা প্রতিবেশী এক দেশে যাচ্ছি। আজ রাত কাটিয়ে কাল সকালে আবার চেষ্টা করব। এই অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির কারনে আমরা দুঃখিত”। যাত্রীদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ ভাবলেন নামলেই হত, কত কাজের লাইন ছিল। অনেকে ভাবলেন, পৈতৃক প্রাণটা অন্ততঃ রেহাই পেল। সোমনাথ বলা বাহুল্য দ্বিতীয় দলে।

পরদিন কিন্তু অসাধারন আকাশ। ঝকঝকে, কোথাও কোন মলিনতার মেঘ নেই। ভোরের আলোর সাথে ভাসতে ভাসতে ধাতব পাখি তার উড়ান সম্পুর্ণ করে। পথে পুরো হিমালয়। ক্যাপ্টেন উৎসাহ সহকারে চিনিয়ে দেন, কোনটা এভারেস্ট, কোনটা কাঞ্চনজঙ্ঘা আরো কত গগনভেদী নাম।
এমন একবার সোমনাথ দিল্লি চলছে আপিসের কাজে। বিজনেস ক্লাসে যাত্রা। আসন গ্রহন করেই বুঝতে পারে, ওর সহযাত্রীরা প্রত্যেকেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, এম-পি। পরেরদিন লোকসভার অধিবেশন শুরু হচ্ছে, সে উপলক্ষ্যে এই মানুষগুলো চলেছেন। যাইহোক, এঁদের সাথে, সোমনাথের কোন লেনা দেনা নেই। নিজের মনে, একটা বই বার করে পড়তে থাকে। চুপ করে থাকলেও আশেপাশের কথাবার্তা কানে এসেই যায়। এক পেশার বিভিন্ন মানুষ একত্রিত হলে খুব স্বাভাবিক ভাবে নিজেদের পেশা সংক্রান্ত আলোচনা বেশি হবে। অত্যন্ত নিরীহভাবে যে সব আলোচনা হচ্ছিল, শুনে সোমনাথের আক্কেল গুড়ুম। কেউ একজন জিজ্ঞেস করেন, অমুক এখন কোথায়? উত্তর আসে, তিনি এখন তিহারে সাজা কাটছেন। আগামী ইলেকশান জেল থেকেই লড়বেন। ইত্যাদি নানাবিধ সংবাদের আদান প্রদান হতে থাকে। প্রত্যেকটি মানুষ সাদা রঙের পোষাকে সজ্জিত। তাঁদের বেশভুষায় আভিজাত্যর ছাপ প্রকট। একই রকম ভাবে কথাবার্তায় অন্ধকারের হাতছানি। সোমনাথ অনুভব করে, কাদের হাতে দেশের শাসনভার, কারা আজ আমাদের ভারত ভাগ্যবিধাতা। 

বেশ কয়েকদিন অন্য শহরে ছিল সোমনাথ। ফেরার সময় মনে চাপা খুশি। কতদিন পর আবার সবার সাথে দেখা হবে। বাড়ির ভাত খাওয়া হবে। রাতের ফ্লাইট। বিমান সেবিকারা ঘুরে ঘুরে রাতের খাবার দিচ্ছেন। সোমনাথের কাছে এসে জিজ্ঞেস করেন, আমিষ না নিরামিষ কি পছন্দ? সোমনাথ খুব বিনীত ভাবে বলে, “অনেকদিন পর বাড়ি ফিরছি। তাই এখানে খাবো না। বাড়ি গিয়ে সবার সাথে খাবো। আমার জন্য আমার ছেলে মেয়েরা অপেক্ষা করছে”। মেয়েটি ফিরে গেল। সবাইকে খাবার দেওয়া হয়ে যাবার পর, আবার ফিরে আসে হতে রঙিন কাগজে মোড়া একটা বড় ঝুড়ি। মিষ্টি হেসে বলে, “আপনি বাড়ি যাচ্ছেন, আমাদের তরফ থেকে এটা আপনার ছেলে মেয়েদের জন্য”। সোমনাথ বুঝতে পারে নানা রকম মহার্ঘ্য খাবার সামগ্রী দিয়ে প্যাকেটটি সাজানো। হয়তো সবটাই ভীষণ ভাবে ব্যবসায়িক স্বার্থে ব্যবহৃত, তবু এই ঘটনাটি মন ছুঁয়ে যায়। মাটি থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট ওপরে হঠ্ৎ যেন মাটির গন্ধ নাকে আসে। ঠিক এই জন্যই যেন আরো একবার বেঁচে থাকা যায়।

বুধবার, ৪ মে, ২০১৬

গোলমেলে আলো

চেনা রাস্তা অনেক সময় অচেনা লাগে। কতবার হেঁটে গেছ, কত শত সাইকেল ভ্রমন এমন কি মোটর সাইকেল বা গাড়িতেও। হঠাৎ একদিন সেই রোজকার নেহাত আটপৌরে রাস্তা, যার কিনা আলাদা কোন বিশেষত্ব নেই, তাকেও অচেনা ঠেকে। আর পাঁচটা রাস্তার মতোই, সে সাতে পাঁচে থাকে না। বিপ্লব বা দুর্ভিক্ষ কোনোটাতেই নেই, কোনো কালে কোন রাজপুরুষ এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেছেন বলেও শোনা যায় না। সেই রাস্তা কিনা একদিন কাউকে কিছু না বলে রঙ বদল করে ফেলল। তার গা হয়ে উঠল মসৃণ, তার দুধারে জমে থাকা নোংরার ঢিবিগুলো কে যেন রাতারাতি পরিস্কার করে দিল। এতদিন একটা নেহাত এলেবেলে গাছ রাস্তাটার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, হঠৎ বেমক্কা একগাদা হলুদ ফুল ফুটিয়ে জায়গাটা কেমন আলো করে দিল। সেই আলো কতক গাছে, কতক গাছের তলায়, আর কিছু পথচলতি মানুষের মনের মধ্যেও ঢুকে গেল।

আলোটা ভেতরে নিয়ে গোবিন্দ একটু দিশেহারা হয় পরে। এই অভিজ্ঞতা তার আগে ঘটেনি। চাল ডালের জীবনে, এই আলোর বিড়ম্বনা ঘাড়ে নেওয়াও তো ঝামেলা। হঠাৎ করে যেন নিবিড় করে দেখার চোখ ফুটে যায়। কেন বাবা বেশ তো ইঁট কে ইঁট বা পাটকেল কে ধুসর, এই নিয়ে চলছিল। তারমধ্যে এই গাঢ় চোখে দেখাটা, কোথায় সে ব্যবহার করবে বুঝে উঠতে পারেনা। পাঁচিলের ওপর একটা লাল রঙের বিড়াল ঘুমোচ্ছিল, তা সে রোজই যেমন ঘুমায় আর কি? গোবিন্দ তার দিকে একটু তাকাবার চেষ্টা করে। সে বেচারাও অর্ধনিমীলিত চোখে দৃষ্টি ফেরত দেয়, তা বেড়াল যেমন করে তাকায়। ব্যাস গোবিন্দ ভাবে এ যেন তার ভেতরের আলোর ছটা। বেড়ালও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেল। বেশ সে না হয় মন্ত্রমুগ্ধ হল, তাতে কার কি কাজে লাগবে?

গোবিন্দ কিন্তু বেশ খুশি খুশি হয়। আজ তার মনের ভিতর এক অন্য উপলব্ধি, যা কিনা তাকে আর পাঁচজন থেকে আলাদা করে দিয়েছে। সারা গায়ে রোদ মেখে ঘোরে। মনের ভিতর, মাথার ভিতর একটা আলো দপদপ করে। গালে ঘাড়ে, দুই বাহুতে লেগে থাকে অন্তহীন স্বেদ বিন্দু। তাপিত শরীরের নিঁভাজ ক্লান্তি কোথাও থামার কথা বলে না। বাজার যায়, আনাজওয়ালার কাছে লঙ্কার দর করে। দোকানি শুধু গ্রীবা হেলিয়ে, “দশ টাকা শ”। গোবিন্দ পরের কথা বলার আগে হাঁ করে, কিছুটা বিষ্ময়ে, কিছুটা অভ্যেসে। “ওরে বাবা! এত কেন?”  আনাজওয়ালার কম্পহীন নির্লিপ্ত উত্তর। “সমস্ত বোধবুদ্ধি, টাকা পয়সা, সব ওই লঙ্কা গাছের গোড়ায়, এবছর দাম আর কমবে না”। আকাশের আলো চাষীর জমিতে আর বাজারেও তার আঁচ। বাড়ির বাজারটা করে গোবিন্দ দু-চার পয়সা সরায়, আজ দেখছি উল্টে বেরিয়ে না যায়। মুরগি কিনতে যায়, দুশো টাকা। মাছ, ছশো টাকায় ট্যাংরা। ভারি মুশ্কিল হল। সেই হলুদ আলোটা তো কাজ করছে না। দোকানদার তো এই দৃষ্টির আওতায় মোটেই আসছে না। দিব্যি যে যার ইচ্ছে খুশি দাম হাঁকিয়ে চলেছে।

বাজারে আসার সময় যতটা আনন্দ পেয়েছিল ফেরার সময় আর তেমন লাগছে না। নাঃ এটা মোটেই ভালো হল না, যেখানে সেখানে আলো জ্বেলে কোন কাজের কিছু হয়না। দুই হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে বাড়ির পথে। আজ আর রিক্সা করবে না। আর যখন কোন কিছুতেই হাত ছোঁয়ানো গোল না, অন্ততঃ রিক্সা ভাড়াটা সঙ্গে থাকুক। পথে যেতে সেই বাড়িটা পরে। সেও তো রোজ পরে। গোপাদের বাড়ি। তাও ওরা এ পাড়া ছেড়ে চলে গেছে আজ কত বছর হয়ে গেল। তারপর থেকে বাড়িটাই যেন নিভে গিয়েছিল। আজ হঠাৎ কেন চোখে পড়ল? তবে কি এটা আলোর গুণ? গোবিন্দ একটু দাঁড়িয়ে যায়। খুব ছোটবেলায় গোপার সাথে তার খেলাধুলা দিন। সেখানে হাঁড়িকুরি নিয়ে মেয়েলি খেলা। সেই পুতুলের সংসারে গোবিন্দই বাজার করে আনত। ঘাস, লুচিপাতা নামক এক ছোটছোট চকচকে আগাছা, পুরোন পাঁচিল খুঁচিয়ে মোটা মোটা মসের আস্তরন, ইঁটের টুকরো গুড়ো করে লাল লাল মশলা, এমন আরো কত কি! গোবিন্দ বাজার করে আনলে, গোপা রান্না করত। সেই রান্না আরও অনেক কাল্পনিক আত্মীয় স্বজনের সাথে ভাগ করে খেত।

আজ বুকের ভেতর এই আলোটা নিয়ে গোবিন্দ খাবি খায়, আর ভাবে এই বুঝি সামনের গেট খুলে গোপা বেরিয়ে আসবে। ওর হাত থেকে বাজারের ব্যাগ কেড়ে নিয়ে বলবে, “এত দেরি করলে, আমি কখন থেকে বসে আছি। রান্না করব কখন বা খেতে দেব কখন?” সেই ছেলেবেলার খুনসুটি। বড় হয়ে বুঝে উঠবার আগেই গোপারা চলে গেল, বাড়িটাও কেমন অস্পষ্ট হয়ে গেল। পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও আর চোখে পড়ে না।  ভীষণ রোদে চতুর্দিক খুব বাস্তব। সেখানে এতটুকু ভুল হবার সংশয় নেই। হলুদ ফুলগুলোই গোলমাল পাকিয়ে দিল। গোবিন্দ জানে ওই বাড়িতে কেউ নেই। গোপারা চলে গিয়েছে সে অনেক বছর আগে। তার আলো মাখা মুখটা খুব কাছে চলে আসে, যে হাত দিয়ে ছোঁয়া যায়। এমন কি ওর চুলের থেকে একটা ঘ্রাণও ভেসে আসে। তা কে অস্বীকার করা তো অসম্ভব। গোবিন্দ আবার বাজারের ব্যাগ হাতে তোলে, মাটির দিকে মুখ করে গোপাদের বাড়ির চৌহদ্দি পার হয়ে যায়। গন্ধটা পিছনে থেকে যায়। একবার মনে হয় পিছনে তাকায়, একবার তাকালে কি হবে? তবু মনে জোর আনে। সোজা এগিয়ে নিজের বাড়ির গেট খোলে। পাঁচিলের ওপর বসে থাকা বিড়ালটা ঠিক একই ভঙ্গীতে তাকিয়ে থাকে। গোবিন্দ অবাক হয়, তবে কি এখনও মুগ্ধতা কাটেনি!  

স্বপ্নের বীজ

সব মফঃস্বল শহরের মত ডিমপুকুরও তার চরিত্র পাল্টাচ্ছে। একটা দুটো করে পুরোন বসতবাড়ি ভেঙে তৈরী হয়েছে ফ্ল্যাট বাড়ি। প্রথম প্রথম একটু অন্য রকম লাগত। কোথাও যেন ছন্দ পতন হল। আস্তে আস্তে চোখ সয়ে যাচ্ছে। সবুজে ঢাকা পাড়ায় কিছু বনেদী বাড়ি ছিল। না হলে, এক তলা বা দোতলা বাড়ি, সামনে এক চিলতে বাগান। অস্তিত্বে কোন ঔদ্ধত্য নেই। সেই বাড়ি ধুলিস্যাত হয় প্রাসাদের গর্বে। এই সাধারনের মধ্যে হঠাৎ আকাশ চেরা অতিগর্বী তিরিশ চল্লিশ তলার অট্টালিকাগুলো কে অহঙ্কারী দৈত্যর মতো মনে হয়।

খুব বেশিদিন নয়, যখন জমির এমন আকাল হয়নি। ইতস্ততঃ খালি বা পতিত জমি আর ডোবা চোখে পড়ত। সেখানে অযত্নে গড়ে ওঠে আগাছার জঙ্গল। সদ্য কৈশোর ছোঁয়া ছেলে মেয়েদের কাছে, এই রহস্যের অন্তরালটি যেন শঙ্করের চাঁদের পাহাড়। মাথা নিচু করে সেই সব অগভীর আগাছার ছায়াতে লুকোচুরি খেলা। কখন দেখা হয়ে যায় সাপের খোলস বা শিয়ালের গর্ত। ডোবার কচুরিপানার ওপর আলগোছে হেঁটে যাওয়া ডাহুক।  কুবো পাখির একটানা ডাক। সব গাছপালা আর তাদের নাম না জানা অকুলিন ফুলের মিশেলে এক অদ্ভুত বন্য গন্ধ তৈরি হয়। স্বপ্নের মধ্যে যেন গাংচিলের ডাক আর ওই গন্ধ দাঁড়িয়ে যায়। কিছু না থাকার মধ্যেই প্রকৃতির অপার ঐশ্বর্য্যের ডালি। প্রাচুর্য্য না থাকলেও কোথাও এতটুকু কৃপণতা নেই। শীতের কালে দু-চারটে বেলেহাঁস সেই কোন বরফ পাহাড় পার করে এই অকিঞ্চিতকর আঙিনাকেও তার অস্তিত্বর ছোঁয়াতে করে তুলত বিশেষ। সন্ধ্যের মুখে শিয়ালরা একজন দুজন করে ডোবার ধার ঘেঁষে দাঁড়াতো। অন্ধকারে তাদের সবুজ চোখগুলো জ্বলছে দেখে ছেলেমেয়েদের সেকি ভয়! নিশ্চই বাঘ ভালুক বা অন্য কোন দৈত্য হবে।

এখনকার পাঁচিল ঘেরা আকাশ ছোঁয়া বাড়িগুলো অতি আলোকিত। রাত হলেও আঁধার নামে না। রহস্যময় বন্য গন্ধ স্মৃতির আড়ালে মুখ ঢেকে ফেলে। ঘোর বাস্তবতায় পিছু হটে জলজ শ্যাওলার ঘ্রাণ, সাপের খোলস, ডাহুকের ক্লান্তিকর ডাক। কি জানি মুখের রক্ত দিয়ে ডিম ফোটাতে পারল কিনা? তবে তাদের যে বাসা বদল হল, সে তো ঠিক। পিছু হটতে লাগল বন বাদার। চেষ্টা করলেও তাদের নিমন্ত্রণ করে আনা যাবে না। মানুষের ওপর অভিমান। সাপেদের, শিয়ালের, বেলে হাঁস বা শামুকেরও। এখানে রাস্তা অনেক চওড়া, শান বাঁধনো সুখ দুঃখ, এমনকি ভালোবাসাও। তবে তার মধ্যে অস্থির মুখ তোলে আবর্জনা। মানুষ পৃথিবী জুড়ে প্রায় দেড়শো কোটি টন বর্জ্য পদার্থ্য প্রসব করছে প্রতি বছর। এই ভার কে নেবে? ডিমপুকুরও তার ব্যতিক্রম নয়। সুন্দর চওড়া রাস্তার দুধারে পাহাড় জমছে আবর্জনার। সেখানে তৈরী হয়েছে এক নতুন প্রানী বৈচিত্র্য। কালো কুৎসিত ময়লার টিলা গুলোতে সাদা ফুলের মত ঘুরে বেড়ায় বক। পুকুরের মাছ ছেড়ে তারা বোধহয়, এখানেই খুঁজে পেয়েছে তাদের বেঁচে থাকার রসদ। আছে দঙ্গল বাঁধা কুকুর, মেঠো ইঁদুর, বিড়াল, কাক, চিল। আর অমৃতের পুত্র কন্যারাও। এক বিরাট সংখ্যার মানুষ এই বর্জ্য পদার্থ্যকে তাদের জীবিকা করেছে। পুরুষ নারী নির্বিশেষে, এই তীব্র গন্ধ মাখা নারকীয় কুন্ডটিই তাদের লীলাক্ষেত্র। রাত্রিদিন এখানেই কাজ করে। খালি হাতে সম্ভবতঃ তারা আলাদা করে জৈব আর অজৈব বর্জ্যকে। এই আবর্জনার পাহাড়ের পাশেই সেই অজৈব জিনিসপত্রের কেনাবেচার দোকান। সেখানেও ব্যাপারি আসে।  সওদা করে। রুজির ব্যবস্থা হয়। আর তার পাশটিতেই তাদের বাসস্থান। বাসস্থান না বলে মাথা গোঁজার ছাউনি বলা ভালো। পুরো ঘরটাই ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়ে বানানো। ছেঁড়া প্লাস্টিক দিয়ে ছাদ। ভাঙা আসবাবের টুকরো দিয়ে খাট, উনোন, বাসন। এই মানুষদের ছেলেমেয়েরাও নিজেদের আনন্দের উপকরন খুঁজে নেয় এই আবর্জনার মধ্যেই। ফেলে দেওয়া পুতুল। পেটে ফেঁসে তুলো বেরনো টেডি, সিট ভাঙা সাইকেল। তবে সেই সবকিছু পরম মমতায় তারা আগলে রাখে। হয়তো মানুষ বলেই। শৈশবের স্বপ্নে বোধহয় কোন ধরতাই লাগে না। যে কোন পরিবেশে ভালো লাগার ইচ্ছে লতিয়ে ওঠে। না হলে পুতিগন্ধময় বর্জ্য পদার্থ্য, অনতিদূরে পচনশীল মৃত প্রাণীর শবদেহ, তার মধ্যে টায়ার কেটে দোলনা টানানো হয়। সেখানে অতি অনায়াসে দোল খায় শৈশবের কুঁড়িরা। তাদের পরনে ধুসর মলিন পোষাক। কারো আদুর গা, শুধুই ইজের পড়া। কারওবা সেটুকুও জোটেনি। কোন পায়েই জুতো নেই। এইসব ছেলেমেয়েদের বাড়িতে কিন্তু টিভি আছে আর তাদের ঘরের ছাউনি ওপর ডিস অ্যান্টেনা শোভা পায়। সব মিলিয়ে হঠাৎ মনে হতে পারে এরা বেঁচে আছে কি করে? সত্যি এই প্রশ্ন বড় কঠিন। মানুষ কি করে টিঁকে থাকে? সমস্ত প্রতিকূলতা এড়িয়ে জীবনের নিয়মে জীবন তার রাস্তা খুঁজে নেয়।

বিকেলের দিকে একটা গাড়ি আসে। সেখান থেকে নেমে আসেন এক সন্ন্যাসী। সেই গাড়িতে করে তিনি বেশিরভাগ বাচ্চদের তুলে নেন। বাচ্চাদের পিঠে এখন বইয়ের ব্যাগ। স্থানীয় এক আশ্রম থেকে ওনারা আসেন। সারাদিন কাজের পর বাচ্চাদের অক্ষরজ্ঞান করানোর এক অসম লড়াইয়ের ব্রত নিয়েছেন এই মানুষগুলো। তিন চার ঘন্টার ক্লাস শেষে রাতের খাবার খাইয়ে আবার বাসে করে ফেরত দিয়ে যায়।

সব কিছু ক্ষয়ে যাওয়া, ফেলে দেওয়া, বাতিল জিনিসপত্রের মধ্যে যেন একটু হলেও ভবিষ্যত বলে একটা শব্দ থাকে। সেটা হাল্কা হয়ে লেগে থাকে, যেমন টায়ার কাটা দোলনা টা একা একা দুলে চলে। চারপাশে ভীষণ খারাপ আর নোংরা পরিবেশ থাকা সত্যেও একটা স্বপ্নের বীজ কোথাও যেন উড়ে এসে পরে। তাতে জল হাওয়া লাগে, আবার কোন এক নতুন ভোরের আলো লতিয়ে উঠবে।

সোমবার, ২ মে, ২০১৬

মাছরাঙা আর পেট্টোলোচন

ডিমপুকুরের মতো এ তল্লাটে অমন একটা পুকুর আর নেই। দীঘি বলাই ঠিক। এই গরমে ওই গভীর কালো জলের দিকে তাকালেই যেন মন শীতল হয়। বিশাল বট গাছের একটা ডাল ঝুঁকে পড়েছে। যেন জলের সাথে তার গোপন শলা। আর নুইয়ে পড়া ডালে রোজ একটা মাছরাঙা এসে বসে। গোবিন্দর সকালে কোন তাড়া থাকে না। অবশ্য সকাল বললে ভুল হবে, সকাল দুপুর রাত, তাড়া শব্দটা ওর জীবনে নেই। দাঁত মাজতে মাজতে পুকুর পাড় অবধি হেঁটে চলে আসে। মাছরাঙাটাকে গভীর ভাবে দেখে। কেমন অবলীলায় শিকার ধরে। এই গাছের ডালে বসেই খায়, জিরোয়। তারপর কোথায় যেন চলে যায়।

ডিমপুকুরের একদিকের চৌহুদ্দিতে ডিমপুকুর ফাঁড়ি। রায়মশাইদের সম্পত্তি। রায়মশাইয়ের বাবা, সাহেব আমলের দারোগা। তখন থেকেই তাঁদের প্রতিপত্তি। এই বাড়ি সরকার কে দান করে গেছেন। শোনা যায় রবীন্দ্রনাথের এক দুঃসম্পর্কের পিসমশাইয়ের সাথে রায়মশাইয়ের বাবা নাকি দাবা খেলতেন। সে সব সত্যি, না নিজের ক্ষমতা জাহির করতে গল্প ফেঁদেছিলেন, তা আজ আর কেউ জানে না। ওই লোকের মুখে মুখে গল্পটা লতিয়ে বেড়ায়।

ডিমপুকুর মোটামুটি শান্তিপ্রিয় জায়গা। দুয়েকটা চোর বদমাইশ যারা অছেন, তাঁরাও পরিচিত। ফাঁড়িতেও তেমন কোন উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায় না। তবে এখন হল ভোটের কাল। তাই কিছু না হোক কয়েক গাড়ি মিলিটারি এসে উপস্থিত। তারা অবশ্য মানদা সুন্দরী উচ্চ বিদ্যালয়ে ঘাঁটি গেড়েছে। তবে সকালে এই পুকুরের ধারটা ওদেরও পছন্দ। অনেকে বেশ সাঁতার কেটে চান করে, পাশে দামোদরের মিষ্টির দোকানে বসে জিলিপি খায়। দোকানে সকালের আড্ডাধারী বয়স্ক মানুষরা এই মুশকো জোয়ানদের কাছে পেয়ে কিঞ্চিৎ আমড়াগাছি করে। তবে ভাষার ব্যবধানে তেমন হয়ে ওঠে না।

ডিমপুকুর ফাঁড়িতে একটা ছোট হাজত আছে। বেশির ভাগ খালি থাকে। এখন ভোট উপলক্ষে এলাকার দাগীদের তুলে, ভরাট করে রাখা। গোবিন্দর সকালের দাঁতমাজা ও পুকুর পাড় নিরীক্ষণ সম্পুর্ণ। এবার বাড়ি ফেরার জন্য এগোয়, হঠাৎ শোরগোল শুনে থমকায়। ডিমপুকুরে এ হেন নিস্তরঙ্গ জীবনে এত হাঁকডাক সহ্য হয় না। বড়বাবু চুনীলালের বাজখাঁই গলা ভেসে আসছে। “কয়দী কোথায় গেল?” সর্বনাশ, এই মারাত্মক ভোট মুহুর্তে শেষে কি না, এই ছিল কপালে! দামোদরের দোকানের গল্পবাজ বুড়োরা, ডিমপুকুরের ধারে স্নানরত জোয়ানরা, প্রত্যেকেই শরীর সোজা করে ফেলে। অনেকে গুটি গুটি ফাঁড়ির দিকে এগোতে থাকে। চুনীলালের চিৎকার পঞ্চম ছাড়িয়ে এখন সপ্তমে ছুঁয়েছে। “কে? কে? ডিউটি তে কে ছিল?” একটা খুব রোগা মত লোক, পুলিশের পোষাক পরা। প্রায় কাঁপতে কাঁপতে সামনে আসে। চোখে ঘোলাটে চশমা, পিঠে কাঠের বাঁটের একটা দোনলা বন্দুক। তাকে দেখে বড় বাবু ফেটে পড়লেন।

- আপনাকে আজ কে বাঁচায় আমি দেখব? শিগ্গির রাইফেল জমা দিন। আমি এখুনি সাসপেন্ড করছি।

একটু দূরে অন্য একটা টেবিলে মেজো বাবু এক মহিলার বাড়িতে দুই জায়ের মারপিটের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করছিলেন। এদিকে যে সব ঘটনা ঘটে চলেছে, তার প্রতি যে খুব একটা খেয়াল আছে, বলে মনে হচ্ছেনা। মহিলার সমস্যা খুব জটিল। সকাল বেলা গোয়ালা এক ঘটি দুধ দুইয়ে রেখে গেছে। আজ দুধ একটু কম। গরুটা বড়ভাই কিনেছিল, আপাততঃ ছোটভাই খোল ভুষি খাইয়ে চেকনাই করেছে। তাই আজকের দুধের দাবীদার কে হবে? এই নিয়ে, এ কথা সে কথার পর, ওই ঘটি ছুঁড়ে মারে। মুহুর্তে কপাল ফেটে দুধে আলতায় স্নান।

কিন্তু চুনীলালের এইসব পেটি কেস নিয়ে পরে থাকলে তো হবে না। সক্কাল বেলায় ডিমপুকুরের গারদ থেকে এলাকার সবচেয়ে বদমাইশ গুন্ডা লোচন ওরফে পেট্টোলোচন গায়েব। একটু পরেই সাংবাদিক, নির্বাচক পরিদর্শক সবাই কাঁঠাল ভাঙা গন্ধ পেয়ে মাছির মতো ভনভন করতে করতে চলে আসবে। উফ্। আজ চুনীলালের শ্বশুড়বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান আছে। গামছাষষ্ঠী না তিনপলাজোড় কিছু একটা পুজো। চুনীলালকে সেখানে একবার না গেলে গৃহশান্তি থাকবে না। আরে পুলিশ বলে কি তারা মানুষ নয়। দিনভর এই ঘটনার চর্বিত চর্বন করে চলবে। সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল মেজোবাবুর ওপর। “আপনি এই অবস্থায় মেয়েদের সাথে গল্প মাড়াচ্ছেন? চোখের সামনে থেকে প্রিজনার চলে যাচ্ছে, কারো কোন হুঁশ নেই। সব দায়িত্ব কি আমার একার?” একজন দুজন করে ভীড় আস্তে বেড়ে গেছে। চুনীলাল তাই দেখে আরও খাপ্পা। তবে এবার মেজোবাবু রনভূমে অবতীর্ণ হন। একটা খেটো লাঠি নিয়ে জমে থাকা জনতার দিকে তেড়ে এলেন। “কি চাই আপনাদের? মজা দেখতে এসেছেন? সবাই কে ধরে চালান করে দেব”। ভীড়টা একটু পাতলা হয়ে গেল। তবু সবাই যে চলে গেল তা নয়, পুকুরের পাড় ঘেঁষে ছড়িয়ে গেল। এইসব হট্টগোলের মধ্যে হঠাৎ কে যেন বলে, “ওই তো পেট্টোলোচন”। সত্যি ষন্ডা মার্কা চেহারার লোচন গুন্ডা, খুব নিরুদ্বিগ্ন মুখে হেঁটে ফাঁড়িতে ঢোকে। আর গারদের দোর খুলে সুর সুর করে ভেতরেও চলে যায়। ঘটনার তাৎক্ষনিকতায় বড়বাবু, মেজবাবু সহ কেউই ব্যাপারটা বুঝতে উঠতে পারেননি। এট্টুখানি পর হুঁশ এলে, চুনীলাল হুঙ্কার দেন, “কোথায় গেছিলি? ইতরের বাচ্চা?”  পাশাপাশি মেজোবাবুও বলে ওঠেন, “ওকে বাটাম লাগাও”। চুনীলাল মেজোবাবুর দিকে কটাক্ষ করে বলেন, “থাক এখন আর বীরত্ব ফলাতে হবে না”। আবার লোচনের দিকে ফিরে বলেন, “কি হল জবাব দিচ্ছিস না যে?”

গারদের ভেতরে দৃশ্যতঃ লোচন কে খুব করুন লাগছিল। হাজতে আরও দু-চারটে খুচরো অপরাধী আছে, তবে বড় মাছ লোচন। বড়বাবুর ধমকে, খুব কাতর হয়ে, বিনয়ী মুখ করে বলে, “স্যার সকালে একটু চা খেতে বেরিয়েছিলাম। এই দামোদরটা চা বানাতেই জানেনা, তাই বড়রাস্তার ধারে গেছিলাম”।

কথা শুনে সবাই শুধু চুপ নয়, একেবারে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। গোবিন্দ লক্ষ্য করে, মাছরাঙাটাও যেন বুঝতে পারে না কি করবে। সদ্য ধরে আনা মাছটা ঠোঁটের মাঝে নড়ছিল। একদুবার শক্ত করে ধরতে গিয়ে, ফস্কে গেল। টপাস করে জলের মধ্যে। কিন্তু এ মাছ তো পেট্টোলোচন নয়, যে খানিক পর আবার নিজে নিজেই ফিরে আসবে।

ব্লগ এবং বই পাওয়ার ঠিকানাঃ https://souravstory.com

 এখন থেকে ব্লগ সহ অন্যান্য সব খবর এবং বই পাওয়ার ঠিকানাঃ https://souravstory.com