বৃহস্পতিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

ভয় আর ভয়

ক্লাস শেষ করে সিঁড়ি দিয়ে নামছেন উমাদি, দুচোখ দিয়ে জলের ধারা। দৃশ্যতঃ বড্ড বেসামাল। টিচার্স রুমে সবাই খুব উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করে, কি হয়েছে? উমাদি বলেন, আজ তিনি ক্লাসে একজন কে শাস্তি দিয়েছেন। সবাই আরও অবাক হয়। শিক্ষক শিক্ষিকারা তো প্রয়োজনে শাস্তি দিতেই পারেন। উমাদি খুব বিষণ্ণ হয়ে বলেন, কাল হয়তো এই ছাত্রটি অনেক বড় হবে, তখন তার আত্মজীবনীতে লিখবে আজকের কথা। সেদিনের কথা ভেবেই তাঁর এই কষ্ট। ঘটনাটি অবেগ তাড়িত সন্দেহ নেই, তবে আরও যে সত্যটা বেরিয়ে আসে, তা হল বিশ্বাস। ছাত্রদের প্রতি বিশ্বাস। এই বিশ্বাসই ছাত্রছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করে, সত্যি সত্যি বড় হয়ে উঠতে। কোনদিন স্কুল জানালার ঘেরাটোপ ছাড়িয়ে, ওই আকাশের রঙিন ঘুড়িরটার মতোই সে উড়াল দেয়, চাল ডালের দৈনন্দিন একঘেয়েমিতার বাইরে গিয়ে মানুষের মতো মানুষ হবার আকাঙ্খায়।

ঘটনাটি শুনেছিলাম শুভেন্দ্রর কাছে। কলকাতার পাঠভবনে পড়ত শুভেন্দ্র। উমাদি ছিলেন সেই পাঠভবনের শ্রদ্ধেয়া প্রতিষ্ঠাত্রী। শুনে বড় ঈর্ষা হয়েছিল, ওর সৌভাগ্য দেখে। এমন শিক্ষকের সান্নিধ্যে সব ছাত্ররা কেন আসেনা? ভালো ছাত্রদের প্রতি স্যারেরা বেশি স্নেহপরায়ণ হন। ব্যক্তিগতভাবে সেই পরিধিতে ঢোকার যোগ্যতা ছিলনা। আমাদের চারপাশটা ছিল অন্য রকম। স্যারেদের আমরা ভয় পেতেই শিখলাম। ক্লাসের বারান্দা থমথমে, টীচার্স রুম থেকে অন্য শিক্ষকরা ছুটে এসে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছেন, কিন্তু পারছেন না। ধুলিশায়ী একটি ছাত্র, আর তার উপর উপর্যুপরি বেত্রাঘাত করে চলেছেন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মশাই।  সাদা জামা রক্তাভ হয়ে উঠেছে। কখনও মারের চোটে বেত ভেঙে গেল। এমন দৃশ্য একবার নয়, মাঝে মাঝেই পীড়া দিত। কোন বিশেষ একজন শিক্ষক নন, এমন ছিলেন অনেকেই বা প্রত্যেকেই। আজ সময়ের সরণীতে পিছন ফিরে দুয়েকজনকেই মনে পড়ে, যিনি থার্ড ডিগ্রী ব্যবহার করেন নি।

ভয় গেঁথে গেছিল মনের ভেতর। এত ভয় যে স্কুলে আসার পথে, স্কুলের সাইনবোর্ড দেখলে অন্তরের অন্তঃস্থল পর্যন্ত কেঁপে উঠত। সেদিনের শিক্ষকরা হয়তো বলবেন, এমনভাবে নিয়মানুবর্তিতা শেখানো হয়েছে বলে আজ কর্মক্ষম হয়েছি। হতে পারে, আমরা শিখেছি কি করে এক ছাঁচের কর্মী হতে পারি। তবে শৈশবের দিনগুলো যদি আরেকটু খোলামেলা হত, তবে স্কুল থেকে বড় চাকুরে, বা ডাক্তার ইঞ্জিনীয়ার ছাড়া, কয়েকটি খেলোয়াড়, শিল্পী, কবি  বা অন্য কোন উদ্ভাবনী পথে হাঁটার মানুষও তৈরী হত। কলকাতা ময়দানের বড় ক্লাবে খেলেছেন এমন স্বনামধন্য খেলোয়াড় আছেন যিনি আমাদের স্কুলে পড়তেন, তবে দুঃখের বিষয়, তিনি এই স্কুল থেকে মাধ্যমিকের গন্ডী পেরতে পারেননি। হয়তো শিক্ষককুল বলবেন এটা ছাত্রটির দূর্বলতা। তা নয়, স্কুলের শিক্ষা পদ্ধতির দূর্বলতা, তাঁরা প্রতিটি ছাত্রকে তাদের মতো করে বেড়ে ওঠার ব্যবস্থা করতে পারেননি। পেরেছেন কেবল একটিমাত্র নির্দিষ্ট ছাঁচ তৈরি করতে। সেই সাবধানী ছাঁচ থেকে এক ধরনের ছাত্রই প্রস্তুত হয়।

তখন বোধহয় ক্লাস সিক্স, হঠাৎ একদিন শুনলাম আমাদের সহপাঠী সম্রাট, নিজেকে ট্রেনলাইনে সঁপে দিয়েছে। কারণ একজন স্যার তাকে বলেছিলেন, পরেরদিন তিনি ওকে দেখে নেবেন। আজ মনে নেই, ঠিক কি দেখে নেবার কথা হয়েছিল। একটি বারো তেরো বছরের কিশোরের কাছে কিইবা দেখবার থাকে, পড়া সংক্রান্ত বাড়ির-কাজ ছাড়া? সম্রাট সেই স্যারের সম্মুখীণ হবার চেয়ে, চলন্ত ট্রেন কে কম ভীতিপ্রদ মনে করেছিল। আজও সম্রাটের মুখটা চোখের সামনে ভাসে। ছুটিছাটার দিনগুলোতে সম্রাট আমাদের বাড়িতে আসত। অনেক খেলাধুলায় সময় কেটেছে।

বিপ্লব বলে একটি ছেলে ছিল আমাদের ক্লাসে।  কোন পড়াতেই তার কোন আগ্রহ থাকতনা। একজন স্যার প্রতিদিন এসে তাকে গালমন্দ করতেন আর বলতেন, তুই বড় হয়ে ট্রেনে বাদাম ফেরি করবি। কারণ স্যারের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তার চেয়ে বেশি যোগ্যতা সে অর্জন করতে পারবে না। অন্যদিকে সেই স্যার শুনেছি সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে গেছেন। এত ঋণাত্মক চিন্তা নিয়ে তিনি নিজেই নিজের শিক্ষকতার জীবনে স্থির থাকতে পারেননি। আজ সেই বিপ্লব কে খুঁজে বের করতে বড় ইচ্ছ হয়। সময়ের খেলাতে সে এখন কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে জানতে পেলে ভালো হত।

ক্লাসে পড়া না পারাতে, এক শিক্ষক একটি ছাত্রকে ডাস্টার দিয়ে মাথায় আঘাত করেন। ছাত্র ঠ্যাঙাতে অনেকই কাঠের ডাস্টার ব্যবহার করতেন।  ক্লাস শেষ হয়ে গেছে, টিফিনের সময় সেই স্যার হয়তো অন্য কোন ক্লাস থেকে বেরিয়ে আগের ক্লাসের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ সেই ছেলেটিকে দেখে, ঘরে ঢুকে আরও বার কয়েক ডাস্টার সহযোগে মেরে যান। এমনি করে ছেলেটি দিনের মধ্য প্রায় তিন-চার বার এক কারণের জন্য শাস্তি পায়। শেষে বাড়ির ফেরার পথে রেল স্টেশনে যখন দাঁড়িয়ে, ওকে দেখতে পেয়ে স্যারটি ওইখানেও অজস্র বাইরের মানুষের সামনে আবার প্রহার করেন।

স্যারেদের দাপটের সাথে সাথে, কঠোরতা ছিল নম্বর দেওয়াতেও। অনেক স্যারকে গর্বের সাথে বলতে শুনেছি, আমি ছেলে কে তিরিশ দেব, সেই ছেলে মাধ্যমিকে নব্বই পাবে। তখন সেই কথাগুলোকেই বেদবাক্য মনে হত। আজ মনে হয়, যে ছেলে নব্বই পাবার যোগ্য, তাকে তিরিশ দিয়ে হয়তো স্যার নিজের বিচার শক্তির অবমাননা করেছেন। তিনি অতি সাবধানী হয়ে ছেলেটিকে উপযুক্ত মান দিতে পারেননি। এই জন্য অনেক ছাত্র ক্লাস নাইন পর্যন্ত থেকে, শেষ ক্লাস অন্য স্কুলে পড়ে মাধ্যমিক দিয়েছে। তাতে আমাদের স্কুলের পরিসংখ্যান ঠিক থাকত, গড়ে প্রায় প্রত্যেকে ফার্স্ট ডিভিশন বা স্টারমার্ক। এখন খোঁজ নিলে দেখা যেতে পারে সেই ছেড়ে যাওয়া ছেলেরাও কোন অংশে কম নয়, তারাও জীবনের পরীক্ষাতে সসম্মানে উত্তীর্ণ।

স্কুলের শেষ পরীক্ষা ছিল ‘টেস্ট’ পরীক্ষা। এই পরীক্ষার ফলাফল ছিল একটি বিশেষ ছাঁকনি। ক্লাস ওয়ান থেকে ছাঁকতে ছাঁকতে, শেষের পরীক্ষাতে প্রায় তিনভাগ ছাত্রকে ছেঁটে ফেলা হত, যাতে মাধ্যমিকে স্কুলের অসাধারণ এক পরিসংখ্যান তৈরী হয়। এই ‘টেস্ট’ পরীক্ষাটি যেমন শক্ত হত, তেমনই কড়া, তার খাতা দেখা। ফল প্রকাশের দিন, খুব দুরুদুরু বুকে স্কুল প্রাঙ্গণে লাইন করে দাঁড়িয়ে। শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষক মহাশয় এসে বললেন, এত খারাপ রেজাল্ট হয়েছে, ছাত্রদের সুইসাইড করা উচিত। সামনে পনেরো ষোলো বছরের ছেলেরা, আর তাদের কে প্রধান শিক্ষক এই সম্ভাষণে প্ররোচিত করছেন। সহকারী প্রধান শিক্ষক পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। হয়তো ঘটনার গাম্ভীর্য উপলব্ধি করেছিলেন। তৎক্ষণাৎ অন্য কথা বলে অবস্থার নিয়ন্ত্রণ করেন, না হলে আরও কয়েকজনের নাম সম্রাটের পাশে লেখা হয়ে থাকত।

তুলনা করা হয়তো ঠিক নয়। আরেকটি স্কুলের এমন শেষদিনে তাদের মাস্টার মশাই বলছেনঃ

“প্রস্তুতিটা কেমন হল কমিয়ে দিয়ে নাওয়া খাওয়া?
এতদিনের স্কুল জীবনের এত রকম চাওয়া পাওয়া দেয়া নেয়া
একদিনের এই খাতার পাতায় সম্ভব তার বিচার হওয়া?
এপ্রিলস্য প্রথম দিনে এমনভাবে বোকা হওয়া যায় না সওয়া
গেলেই তবে সহজ হবে জীবন স্রোতে তরী বাওয়া।
পাঠ ভবন ছাড়বে বলে রঙ্গিন মনের ডানায় বুঝি লাগছে হাওয়া?
যতই বল বিদায়, তোমার যাওয়া তো নয় যাওয়া”।

একটা অবিচ্ছেদ্য বাঁধনে ছাত্র ছাত্রীদের বেঁধে রাখেলেন। আমরাও বেঁধে আছি, ভয়ে জড়সড় হয়ে।

বৃহস্পতিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

উইঙসের ওপারে

ঠিক কতটা পেলে পাওয়া হয়? প্রশ্নটা সহজ। উত্তর খোঁজাটা একলার হয়না। মানুষের ভেতর বাহির ঘিরে রাখে আরও অনেক কিছু। সম্পর্কের বীজ, মায়া মমতার ছাল বাকল। সময়ের ডালপালায় নিজেকে ঢেকে রাখে। এতগুলো ঝুরি নেমেছে চারিদিক দিয়ে, তার মধ্যে ঠিক কোনটা আমার কান্ড, সেই অবয়বটি হারিয়ে যায়। কতকটা, “পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি', মূর্তি ভাবে 'আমি দেব'” অবস্থা। নিজের নানারূপ দেখে আমরা নিজেরাই অস্থির। অথচ এই অস্তিত্বর সঙ্কট থেকে উদ্ধার করবে কে? গেরুয়া বসনের সন্ন্যাসী? যিনি এই ছাল বাকলের পর্দা এড়িয়ে একক সত্যের পথে চলেছেন। নাকি গর্ভগৃহে অধিষ্ঠান রত কোন দেবতার মন্ত্রপূতঃ ঔজ্জ্বল্য? অথবা অতিদূর কষ্ট সহ্যকারী কোন দূর্গম পথ, যা পার হবার পর যুধিষ্ঠিরের মত বলতে ইচ্ছা করে, আমি এসেছি। সাথে চিরসাথী পোষ্যটি। কিন্তু পোষ্যর সাথে নিজের জীবনের আয়ু এক নয়, তাই তাকে ‘চিরসখা ছেড়না’ বলে জড়ালেও প্রাকৃতিক নিয়মেই সে থাকবে না। অতয়েব সারবত্তা হল একলা এসেছি একলা যাবো, মাঝের এই ভেজাল যত বাড়বে, তত একলা মানুষটি হারিয়ে যাবে।

মেলার মাঝে যেমনটা হয়। একলা একলা হারিয়ে যাওয়া। আসেপাশে এদিক ওদিক, এমনকি উপর নিচেও মানুষ থাকতে পারে। উপর নিচে থাকে না? নাগরদোলা ছাড়া মেলা হয়? তবে উপর নিচও হল। আর সব অচেনা মানুষ। অচেনা অর্থ, আগে দেখিনি। কথা কইনি। তবু তারা গা ঘেঁষে চলে যায়, আলগোছে কথাও কয়। জীবনের মতো, ভীড় রেলগাড়িতে কতশত মানুষের সাথে অন্তরঙ্গ গা ঘষাঘষি হল, তার কি কিছু রইল? না রাখা যায়। এ জগৎ তেমনটাই। তোমার আমার সুতোর বাঁধন জুড়তেও সময় লাগনা, ছিঁড়তেও না। এটুকুর জন্য এত মারপিট আর দাঙ্গা হাঙ্গামা করার কোন প্রয়োজন নেই। তাহলে কি সকলে দূরে দূরে থাকবে? এমনটাও হবার নয়। দূরে আছি মনে রেখে, কাছে থাকতে হবে। কি আব্দার! মায়ার বাঁধন কি একেই বলে? মহাত্মারা বলতে পারেন। আমি খুব সাধারন মাপের মঞ্চশিল্পী। না আছে ওজন, না আছে ছটা। যবনিকা না পড়া পর্যন্ত সহশিল্পীর সাথে সম্পর্ক, নাট্যকার, নির্দেশক যেমন বলে দিয়েছেন, তেমন। সে বাপ ছেলে, চোর পুলিশ, রাজা উজির যা কিছু হতে পারে। আবার উইঙস দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে অন্য ভাষা অন্য রূপ অন্য সম্পর্ক। তা জগৎএর উইঙস থেকে বেরিয়ে গেলে ঠিক কি হয়, সেটা জানিনা বলেই এত গোল। তা, থাকল না হয়, একটু রহস্য। চেনা স্টেশন পার হয়ে কোন অচেনা স্টেশনে গিয়ে নামব, সেটা সেই সময়ের জন্য তোলা থাকল। আবার কেউ কেউ বলেন, এই জগতে ঢোকা বেরনোর সময়গুলোতে স্মৃতি লোপ পায়, যন্ত্রে না কি এমনই প্রোগ্রাম করা আছে। বেশ তবে তাই থাকল। এত বছরে এত লোক ঢুকছে বেরচ্ছে, কই কেউ তো একবারের জন্য ঘুরে এসে বলছে না মঞ্চের অন্যদিকটা কেমন? তার নিশ্চিত কোন কারণ আছে। আর কিছু না-জানা থাকলেই ভয় জমতে থাকে। সেখানে নানা ব্যবসায়ী তাঁদের মতো করে ভয় দেখায় যাতে তাদের দুটো রোজগার হয়।

শেষের দিনে প্রশ্নটা অধরাই থাকল, আমি কে? আমার শরীরটা কি আমি? নিশ্চই তা নয়। তা না হলে, কেন বলি “আমার শরীরটা ভালো নেই”? আমার জামা, আমার জুতোর মতোই আমার শরীর। তাই আমি আর আমার জামা বা জুতো যেমন একজন নই, আমি আর আমার শরীরও আলাদা। কেমন হল তো? সেই কাক্কেশ্বরের হিসেবের মতো হল কি? তার মানে আমার শরীরটা যদি আমি না হলাম, তবে আমি কে? হতে পারে আমি এই শরীরটার মধ্যে থাকি। কিন্তু আমি যে শরীরটা নই, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। তা পরজন্ম থাকলেও নেই, না থাকলেও নেই।

অন্যদিকে সম্পর্কের সূত্র ধরা যাক। আমার সন্তানের পিতা কি আমি? স্ত্রীর স্বামী, পিতা মাতার সন্তান? যাঁরা আত্মা-তত্বে বিশ্বাসী, তাঁরা বলবেন আত্মার একটা আধার দরকার, সেই কারণে একজন পিতা মাতাকে প্রয়োজন। প্রকৃতির নিয়মে একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন সত্ত্বাকে তাঁরা ধারন করেছেন। এই স্বাধীন স্বত্ত্বাটির স্বরূপ কি? তিনি কোথায় থাকেন? জন্ম নেবার আগে ও পরে তাঁর অস্তিত্ব কেমন? লাল, হলুদ না গোলাপী? পৃথিবীর বুকে প্রায় চুরাশি হাজার জীব প্রজাতি আছে। তাদের মধ্যে একমাত্র মানুষ উপার্জন করে খায়। অন্যরা তেমন কিছু করে না। অথচ তারা কেউ না খেয়ে নেই। খেতে গিয়ে কাজ করতে হয়, কাজ করতে গিয়ে অবয়ব তৈরি হয়। সেই অবয়ব তখন আমার পরিচয় হয়ে চেপে বসে। উনি ডাক্তার, তিনি পুলিশ, সে দোকানদার এমন নানা রকমের কাজ আর নানা রকমের পরিচয়। তবে সে যে মানুষ, সেই ঘটনাটা গেল হারিয়ে। অতঃপর তিনি বৃদ্ধ হলেন, তাঁর শরীর থেকে ঝরে পড়ল পেশাগত মুখোশ। ব্যাস আর যায় কোথায়, ডাক্তার পুলিশ দোকানদার সব মিশে গেল। কখনও কখনও তাঁরা বিশ্বাস করতে চান না, কি শো শেষ হয়ে গেছে, মনে মনে নকল দাড়ি গোঁফ লাগিয়ে সংলাপ বলে যান। মধ্যিখান থেকে হারিয়ে যায় আমার আসল আমি-টা।

বড্ড গোলমাল বাধালে দেখছি। আচ্ছা একটু ওপর থেকে ভাবা যাক। এক্কেবারে ফাঁকা একটা জায়গা। অতীব অন্ধকার, বাতাস নেই, ধুলো নেই, কিচ্ছু নেই। সে এক অভাবনীয় নেই-রাজ্য। সেখানে অতিকায় পাথুরে, ধাতব, গ্যাসীয় গোলা। একটা দুটো নয়, কোটি কোটি তে। চিন্তার পরিধির সবচেয়ে বড় সংখ্যাটার চেয়েও বড়। পেল্লায় তার আকার। কেউ কেউ আবার খুব গরম, সততঃ প্রজ্জ্বলিত আগুন। কেউ কেউ হিম হিম শীতল ঠান্ডা। আর অমন অতিপ্রাকৃত পরিবেশে এই রাক্ষুসে গোলারা বাঁই বাঁই করে ঘুরে চলেছে। কে ঘোরায়, কেনই বা ঘোরায়? তাই যদি হয় সেখানে, আমরা তার তুলনায় তো ধুলোর চেয়ে ক্ষুদ্র। আর আমদের রণ রক্ত সফলতা কোন পরিমাপেই আসেনা। তবে কি ধরে দিনগুলো কাটাবো? যেটাই করি, তাতে গোলমাল এসে যায়। ওই অত কোটি কোটি গোলকের মধ্যে এই পৃথিবী নামক গোলকটিতে এমন কেন হল বা কি করে হল? আর সেখানে হঠাৎ করে নিজের অস্তিত্ব আবিস্কার করে এমন আহ্লাদিত হবার কি হল?  অত দূর পর্যন্ত, যখন একান্ত পৌঁছানো যাচ্ছেনা, তখন এটুকুই সই। চোখ মেলে তাকাই, কান ভরে গান শুনি। আর ভাব করি ক্ষণস্থায়ী সহযাত্রীদের সাথে, তারা শুধু যে মানুষ তা নন, আরো যারা রয়েছে। এই পৃথিবী তাদেরও বাড়িঘর। প্রজাপতি, পাখি, পশু, পোকা মাকড় এদেরও সমান অধিকার। প্রত্যেকের নিজের নিজের মঞ্চসময় নির্দিষ্ট করা আছে। অভিনয় সাঙ্গ হলে বেরিয়ে যাওয়া দস্তুর। আবার ঢুকতে হবে কি না জানা নেই, তাই যতটুকু হাততালি এই সময়ের কাজের জন্য বরাদ্দ। উইঙস পার করে গেলে, ধরাচূড়া খসে গেলে আর কে চিনবে?


মঙ্গলবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

জলছাপ

বর্ষা নামে হৈচৈ করে। কারো কথা শুনতে দেয় না। রাস্তা জুড়ে কালো জল আর দু ধারের সবুজ গাছপালার বিরামহীন ভিজে যাওয়া। বেশ কিছু গবাদী প্রাণী গাছের নিচে গায়ে গায়ে ঘেঁষে থাকে। নির্বিকার চোখগুলো ঠিক করে পড়াও যাচ্ছেনা। শহর থেকে একটু দূরে, নতুন শিল্প নগরী বলে চিহ্নিত। যাওয়া কাজের সূত্রেই। এক টানা দেওয়া লম্বা মাঠের ওপর আকাশ কেমন ঝুঁকে পরে জল ঢালছে। কাজের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে জলের ছাট এসে যায়। নিরালম্ব মন ভিজে কাকের মত জড়সড় হয়ে বসে। মাঠে উঁচু উঁচু ঘাস। তার গায় বেয়ে জল ডিঙিয়ে যাচ্ছে ঢোঁড়া সাপ।

টাকা তুলতে একটি এটিএম-এ। লম্বা লাইন। বৃষ্টি একক ভাবে জানান দিয়ে চলেছে। একটা মাত্র যন্ত্র কাজ করছে। বেশ ভীড় জমেছে। আসে পাশে লোকজন বেশিরভাগ শ্রমজীবি হিন্দিভাষী মানুষ। এমন দুটি অল্প বয়সী ছেলে গল্প করছে। হিন্দী বাচনভঙ্গীতে বলে, "বাবুরাম সাপুরে, কোথা যাস বাপুরে। আয় বাবা দেখে যা, দুটো সাপ রেখে যা।" আমি চমকে তাকাই। একটু আগের ঢোঁড়া সাপটি নিজের অস্তিত্ব রেখে গেছে।  আমার চোখের আতিথ্য দেখে, ছেলেটি উৎসাহ পায়। বলে, আরও একটা কবিতা জানি। বুঝতে পারি, অন্য ছেলেটি একেবারে বাংলা জানেনা। অতটা আনন্দ পাচ্ছে না। জিজ্ঞেস করে, ফারসি কোন কবিতা জানে কি না। প্রথম ছেলেটি অদমনীয়। এবার, বাইরে বৃষ্টি দেখে ভাঙা বাংলায় কবিতা বলে, "বিষ্টি পোরে টাপুর টুপুর নোদে আলো বান"। আমি মন দিয়ে ফেলি, ভাবি পরের লাইনগুলো ধরিয়ে দি। ছেলে ভোলানো ছড়া। কেউ কোনদিন হয়তো কানে দিয়েছিল। আবার নিজে থেকে বলে, "দুসরা লাইন ভি থা, ঝাপসা গাছপালা"। এবার আমার গা ছমছম করে ওঠে। এতো রবিঠাকুর! আমি এবার সত্যি ভিজে যাই। আমার প্রাণের একটি তার ছেলেটি হঠাৎ করে ছুঁয়ে দিল, নিজের অজান্তে।

“দিনের আলো নিবে এল,
সুয্যি ডোবে - ডোবে।
আকাশ ঘিরে মেঘ জুটেছে
চাঁদের লোভে লোভে।
মেঘের উপর মেঘ করেছে-
রঙের উপর রঙ,
মন্দিরেতে কাঁসর ঘন্টা।
বাজল ঠঙ ঠঙ।
ও পারেতে বিষ্টি এল,
ঝাপসা গাছপালা।
এ পারেতে মেঘের মাথায়
একশো মানিক জ্বালা।
বাদলা হাওয়ায় মনে পড়ে
ছেলেবেলার গান-

'বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর,
নদেয় এল বান' ”

দিন কাটিয়ে সন্ধ্যে নামার আগে শহরে ফেরার পথে। বর্ষার এখনও কোন বিরতি নেই।  সমস্ত জমে থাকা ভালো লাগা, না শুকোনো জামার মত তিতকুটে। শহরের চারিদিকে জল জল আর জল। তার মধ্য দিয়ে গাড়ি চলছে। জলযানের দুলুনি অকারণ ভীতিপ্রদ হয়ে যায়। আরেক দফা আলাপচারি শেষ হয়, তখন সন্ধ্যে গড়িয়ে যায়। ছড়িয়ে পড়া সর্ষেদানার মত ভেজা মানুষ, ভেজা ছাতা, ছপ ছপ। ফুটপাথ  কোথায়, কোথায় নিকাশি নালা আর কোথায় বা রাস্তা, সব একাকার। তার মধ্যেই হা পিত্যেশ করে ভাড়া-গাড়ির খোঁজ। ফোন-গাড়িরা বেপাত্তা। সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে, অনুনয় করলেও দাঁড়ায় না। শেষে এক বৃদ্ধ ট্যাক্সিওয়ালা রাজি হলেন।  আমরা সবে উঠেছি, কোথা থেকে আর একটি লোক দৌড়ে এসে বলল, একটু বড় রাস্তা অবধি নামিয়ে দিন, সামনে অনেক জল। তারপর যানজট জল পার হয়ে আপিস এলাম, রাত তখন আটটা। গাড়িতে ফোন ফেলে নেমে পড়েছি। সেই ট্যাক্সি চালক আবার এসে ফেরত দিয়ে গেলেন। তারপর আপিস করে, এক শহর ভরা জল ডিঙিয়ে, গাড়ি চালিয়ে বাড়ি আসা। গাড়ি ধীরে চলছে। প্রায় দু ঘন্টা লাগল ঘরে ঢুকতে। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ঘুরতে হল অনেক। আটকে যেতে পারতাম, যেকোন জায়গায়। ইষ্টনাম জপতে জপতে ফেরা। রাতের শহরে. সে আরেক রোমহর্ষক অধ্যায়।

বৃহস্পতিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

মাঠের স্কুল-১

আমাকে প্রধান শিক্ষকের ঘরে ডেকে পাঠানো হল, কেন আজ মনে নেই। সাথে নিম্নবুনিয়াদী থেকে প্রাপ্ত শেষ ফলাফলের কাগজটা ছিল। ওটাই সম্ভবতঃ মাঠের স্কুলে আমার প্রথমদিন। প্রধান শিক্ষক অমরশঙ্কর, যাঁর গেরুয়া প্রবর্তিত নাম হয়েছে স্বামী বোধাতিতানন্দ। তবে একেবারে ছেলেবেলায় তাঁকে অমরশঙ্কর নামে চিনেছিলাম, সেই নামটিতে তিনি সারা জীবন পরিচিত হয়ে ছিলেন, অন্ততঃ আমাদের সময়ের কাছে। ঘরের ভিতর আরেকজন বর্ষীয়াণ শিক্ষক ছিলেন। পরে জেনেছি, ওঁনার নাম শশাঙ্ক শেখর তেওয়ারি, ছোট করে এস.এস.টি স্যার। আমার ফলাফলের কাগজ হাতে নিয়ে বলেছিলেন, ‘মিডিওকার’। সেই মুহুর্তে মানে বুঝতে পারিনি। পরে বাংলা প্রতিশব্দ জেনে এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। নিজেকে নিয়ে ভাবতে আর গৌরবান্বিত হতে অনেকেরই ইচ্ছা থাকে। অবচেতনে হয়তো আমারও তেমন কোন আকাঙ্খা ছিল। মুখের ওপর কেউ আমায় নেহাত মাঝারি বলায়, দশ বছরের বালক মনে চিরস্থায়ী দাগ কেটে যায়। আজও সেই দিনটার কথা মনের মধ্যে বয়ে নিয়ে চলেছি। আবার পুরো স্কুল জীবনে, এই এস.এস.টি স্যারের কাছেই আরেকটি মন্তব্য পেয়ছিলাম। একই সাথে সেই দিনটাও স্মৃতিতে গেঁথে রয়েছে। এস.এস.টি স্যার বাংলা পড়াতেন। সেই সময়, আমাদের স্কুলে পড়ানোর ধরনটা ছিল, খুব সাবধানী। স্যারেরা নিজেরাই প্রশ্ন এবং উত্তর লিখে দিতেন। ছাত্রর দায়িত্ব ছিল সেটা মুখস্থ করে খাতায় ওগড়ানো। চেনা লেখা পেলে তবেই ভালো নম্বর আসত, নচেৎ নয়। আমি ছিলাম ফাঁকিবাজ ছাত্র। গড়গড়িয়ে স্যারের লেখা মুখস্থ করাতে বড় আলস্য। যা বুঝতাম নিজে নিজেই লেখার চেষ্টা করতাম। এমনই একদিন আমার কোন একটি উত্তর পত্র দেখে স্যার বলেছিলেন, “ক্লাসের মধ্যে একমাত্র ছাত্র, যে মৌলিক রচনা লিখতে পারে”। অচিরেই বুঝতাম স্যার আমায় একটু স্নেহের চোখে দেখছেন।

স্কুলের মধ্যেই সিনেমা হল। আমাদের কাছে ছিল বিষ্ময়! বিবেকানন্দ হল, শুধুমাত্র সিনেমা হল নয়। নিয়মিত আবৃত্তি, গান, বিতর্ক, বক্তৃতা প্রতিযোগিতার অঙ্গন। আর প্রতিটি অনুষ্ঠানের মূল কান্ডারী ছিলেন এস.এস.টি স্যার। ছেলেদের মধ্যে মৌলিক বিদ্যাবৃত্তির চর্চার প্রতি তাঁর অপরিসীম উৎসাহ। সঙ্গে আরেকজন অল্প বয়সী উদ্যোমী শিক্ষক যোগ দিলেন, তাঁর নাম স্বরূপ নন্দ, সংক্ষেপে এস.এন। একবার এস.এন স্যার দুই কবিয়ালের লড়াই করার মতো কবিতায় গান বেঁধে দিলেন। ব্যাস সেই নিয়ে তৈরি হল কবির লড়াই। আশ্রমের দিপক বাজাত ঢোল আর আরেকজন কাঁসর। কবিয়ালের ভূমিকায় কারা অভিনয় করত, এখন আর মনে নেই। তবে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল সেই পালা। বাৎসরিক উৎসব প্রাঙ্গন সহ একাধিকবার অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই কবির লড়াইএর মহড়ার সময় আমিও অনেক সময় থেকেছি কবিতা, বক্তৃতা বা অন্য কোন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির জন্য। শুনে শুনে পুরোটা মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। আজও বেশ কয়েকটা পদ মনে আছে। বিবেকানন্দ হলের প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানে নানা অজুহাতে মঞ্চে থাকার সুযোগ মিলত, কখনও প্রতিযোগী বা কখনও সঞ্চালক রূপে। এই অভ্যাসটি পরবর্তী ক্ষেত্রে মঞ্চভীতি কাটিয়ে দিতে পেরেছিল। ‘পাব্লিক স্পিকিং’ বা কোন দলের সামনে কিছু বলতে অনেক বিদগ্ধ মানুষেরও অনেক সমস্যা হয়, বিবেকানন্দ হলের সেই দিনগুলো ভিত গড়ে দিয়েছিল।

মাঠের স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যে সবচেয়ে ভীতিপ্রদ ছিলেন পি.এম স্যার। পুরো নামা জানার সহস হয়নি কখনও। স্যার কে তেমন মারধর বা বকাবকি করতেও কখনও দেখিনি। তবু ধুতি পাঞ্জাবী পরা এই স্যার ছিলেন যেন সাক্ষাৎ বিভীষিকা। বারান্দা দিয়ে হেঁটে গেলেই ক্লাসের কোলাহল থেমে যেত। এমন নৈঃশব্দ সৃষ্টিকারী তিনজন ছিলেন। পি.এম স্যার ছাড়া হাইস্কুলের সন্তোষবাবু এবং স্বয়ং অমর শঙ্কর। অন্য দুজন বেত হাতেও সমান দক্ষ ছিলেন।

দত্ত স্যার ভূগোল পড়াতেন। একবার বোর্ডে ভারতবর্ষের ম্যাপ এঁকেছিলেন। কেউ একজন খুব বিষ্ময়সূচক মুখে জিজ্ঞেস করেছিল, ওটা কোন পাখির ছবি কি না? স্যার রেগে তাকে ক্লাসের বাইরে বার করে দেন। নিম্নবুনিয়াদী তে শাস্তি পাওয়া ভয়ের ব্যাপার ছিল, একটু উঁচু ক্লাসে উঠে শাস্তিটাও বেশ মজার হয়ে উঠল। গৌর ভুঁইয়া (জি.বি.) নামে একজন শিক্ষক ছিলেন। তার কাছে শাস্তি পাওয়ার জন্য রীতিমত হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। খুব নিরীহ প্রকৃতির ছোটখাটো চেহারার মানুষ ছিলেন জি.বি.। বেশিরভাগ ছাত্র তখন তার চেয়ে উচ্চতায় বেশি হয়ে গেছে। ক্লাসে বেত নিয়ে আসতেন। বেত কে উনি ‘ছড়ি’ বলতেন। ছেলেরা অন্যায় করলে সেই ছড়ি দিয়ে হাতে আঘাত করতেন। বড় বড় ছেলেদের হাতের নাগাল পেতে তাঁকে লাফিয়ে লাফিয়ে প্লাটফর্মের ওপর উঠতে হত, সেই দেখেই আমাদের আমোদের শেষ ছিলনা।

শুভ্রজিৎ বলে এক সহপাঠী আমার পাশেই বসত। তার খাতাপত্র বই একটু অগোছালো থাকত। হাতের লেখাটি যত-না খারাপ ছিল, খাতাটি তার চেয়ে বেশি কাটাকুটি করে, কালি ফেলে, মলাট ছিঁড়ে, কাগজ কুঁচকে একটা অদ্ভুত দর্শন করে রাখত। ওর নিজের চেহারা ছবিতেও এমন ঈশারা থাকত। জামায় কালির দাগ, প্যান্ট থেকে অর্দ্ধেক গোঁজা বেরিয়ে পড়েছে, জুতোয় কালি নেই, ফিতে খোলা। সব মিলিয়ে এলোমেলো এই ছেলেটিকে সুকুমার বর্ণিত দাশুর সাথে তুলনা করা যেত। একদিন ক্লাসে এন.এন.এস. স্যার পড়াচ্ছেন। কিছু একটা লিখতে দিয়েছিলেন। সবাই খাতা জমা দিয়েছি। স্যার একে একে দেখছেন আর মন্তব্য করছেন। শুভ্রজিৎ-এর খাতাটি, মরা-ইঁদুর ধরেছেন এমন মুখ করে তুলে বললেন, “এটা কি? এমন খাতা দিবি তো, ছুঁড়ে ফেলে দেব”। বলে সত্যিই মাটিতে ফেলে দিলেন। শুভ্রজিৎ অম্লান মুখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ছুঁড়ে ফেললে, আবার কুড়িয়ে নিয়ে আসব”। এই বলে একহাতে মাথা চুলকাতে চুলকাতে গিয়ে খাতাটি মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়ে এল। আমরা প্রত্যেকেই যখন মোটামুটি ধোপদুরস্ত হয়ে স্কুলে যেতাম, এমন কিছু নিশ্চই ছিল যা শুভ্রজিৎ কে অমন আলুথালু করে রাখত। সে বয়সে অতটা বোঝা বা জানার উপায় ছিল না।

বীশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য বলে একজন অঙ্কের শিক্ষক ছিলেন। দীর্ঘদেহী এই মানুষটা অন্যদের থেকে আলাদা ছিলেন। খানিক আপনভোলা বিজ্ঞানীর মতো ছিল তাঁর ব্যবহার। একটি কাল্পনিক ছাত্রের গল্প তিনি খুব শোনাতেন, মূলতঃ আমাদের সেই ছাত্রটির সাথে তুলনা করতেই ছিল সেই গল্পের আয়োজন। তিনটি বিষয়ে পরীক্ষাতে ছাত্রটি একশোর মধ্যে যথাক্রমে শূণ্য শূণ্য এবং ছয় পেয়েছে। অথচ খুব আনন্দের সাথে নাচতে নাচতে “আমি শূণ্য শূণ্য ছয় পেয়েছি” বলে বাড়ি ফেরে। ছাত্রটির নম্বর সম্পর্কে কোন বোধ তৈরি হয়নি। ওই সময় আনন্দবাজার পত্রিকাতে সাপ্তাহিক শব্দজব্দ বা ক্রসওয়ার্ড বেরত। আর সঠিক জবাব দিয়ে চিঠি দিলে, ওরা পরবর্তী সপ্তাহে প্রথম কয়েকটি প্ররকের নাম ছাপাতেন। ওই সময় ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখবার দূরন্ত বাসনা ছিল। সঠিক উত্তর দেবার জন্য, মাঝেমাঝেই আমার নাম ছাপা হত। পড়াশুনায় ভালো হলে স্যারেদের কাছে আসা যায়। আমার বেলায় তা খুব একটা খাটেনি। লক্ষ্য করলাম বি.বি. স্যারও শব্দজব্দ করেন। ওই সূত্রে আমাদের মধ্যে কিছুটা ভাব হয়েছিল। অনেকবার আটকে যাওয়া শব্দের সমাধান ওনার কাছ থেকে জেনে নিতাম।

এইসবই খুব অকিঞ্চিৎকর অভিজ্ঞতা। পাঠকের কোন উপকারে আসবে না। ফিরে দেখার মধ্যে একটা অনুরণন হয়, যা কোথাও যেন ফেলে আসা সময় কে আবার ছুঁইয়ে দেয়।

ব্লগ এবং বই পাওয়ার ঠিকানাঃ https://souravstory.com

 এখন থেকে ব্লগ সহ অন্যান্য সব খবর এবং বই পাওয়ার ঠিকানাঃ https://souravstory.com