বুধবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৬

ভজাইবাবা

সেই কোন কালে স্বয়ং শিব্রাম বলে গিয়েছেন দেবতার জন্মের কথা। তারপরেও বহু দেবতাকে আমরা রাস্তায়, ঘাটে, রিক্সাস্ট্যান্ডে, বটগাছ তলায় জন্মাতে দেখেছি। গাছ ক্রমশঃ বিরল হয়ে যাওয়ায়, আজকালকার দেবতার বটপ্রাপ্তি খুব একটা ঘটে না। তাঁদের নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা গল্প, গাথা, গান। এ কথা সত্যি, মানুষ বড় দুর্বল। তার সেই অসহায়তার সুযোগ নিয়ে ঢুকে পড়ে দেবতা ভুত ও তাদের জয়গাথা। তবে দেশ এগিয়েছে। এখনকার দেবতার উথ্থান, সে কালের মত নয়। রীতিমত কর্পোরেট আকার নিয়ে আবির্ভূত হন। গোবিন্দের বাড়ি বড় রাস্তার ওপর। সেখানে সার সার মাঝারি মাপের কারখানা। এক সময় নতুন কারখানার সাথে একটি মন্দিরও তৈরি হত। ছোট বড় কর্তা ব্যক্তিরা আপিস আসার পথে সেখানে মাথা ঠুকে আসেন।

বেশ কিছু পুরোন কারখানার গনেশ উল্টানোর পর, বড় বড় শেডগুলো কিছুদিন ভুতের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। শিল্প মরে গেলে, চুরি শিল্প গড়ে ওঠে। বছরখানেকের মধ্যে মেশিনপত্র, দরজা, জানালা সব রাতের অন্ধকারে পাচার হয়ে যায়। শেষমেষ শুধু ইঁটের কঙ্কালটা কিছুদিন নিজের প্রাচীন অস্তিত্বের জানান দেয়। তারপর একদিন সেই ইঁটগুলোও কারা যেন সব খুলে নিয়ে যায়। এখন আর কারো বোঝার উপায় নেই, কোনো কালে এখানে শয়ে শয়ে মানুষ চার শিফ্টে কাজ করেছে, বিশ্বকর্মা পুজোতে আনন্দ করেছে।

সে যাই হোক, কালের নিয়মে আসে নতুন মালিক। সেই পড়ে থাকা জমিতে তৈরী হল নতুন কারখানা। সে যেমন তার বিস্তার, তেমনি তার জাঁক। তবে সেই নতুন কারখানার সাথে কোন ছোট মন্দির তৈরী হল না। শুরু হল এক বিরাটাকায় ইমারত। গঠন শৈলীতে আন্দাজ হয় কোন দেবতার স্থান নিশ্চিত। কিন্তু অধিষ্ঠান কার হবে, তা নিয়ে সংশয় হয়। কেউ কিছু জানে না। কেউ বলে ভোলেনাথ, তো কেউ বলেন বজরংবলী, কেউ বলেন মায়ের স্থান তো কেউ বলেন বিশ্বকর্মা। এতবড় নতুন আই-এস-ও প্রাপ্ত কোম্পানির পক্ষে একটা মানানসই দেবতা না হলে চলবে কি করে। জল্পনা শুরু হয়, মালিকের গৃহদেবতা কে? তাঁর দেশ কোথায়? তাঁর পুরোহিত কোথাকার, গোত্র কি? এমন নানা রকম মতবাদ ও মতভেদ। কেউই কিন্তু সঠিক যুক্তিগ্রাহ্য কথা বলতে পারে না।

ওদিকে নতুন মালিক আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। ঝুলিতে এক আধটা বিদেশি ডিগ্রীও আছে। তিনি আর পাঁচ জনের মতো শুধু আবেগের বশে মন্দির তৈরি করবেন না, বলাই বাহুল্য। একটা বোর্ড তৈরি হয়েছে। সেখানে নাম করা পরামর্শদাতা কোম্পানির তাবড় মানুষরা আসলেন। তাঁদের কাজ হল, মার্কেট স্টাডি করে রিপোর্ট তৈরি করে দেওয়া, এখানে কোন দেবতার অধিষ্ঠান হতে পারে।

কাজের বরাত পেয়ে সবাই মাঠে নেমে পড়েন। প্রথমে দেখতে হবে ত্রিশ কিলোমিটার ব্যাসে কোন কোন দেবতা ইতিমধ্যে আছেন। তারপর, তাঁদের প্রত্যেকের সম্মান সূচক কত? প্রাণামী, প্রতিদিনের গড় ভক্ত সংখ্যা, কোন অলৌকিক গল্প আছে কিনা, পুরোহিতের সামাজিক প্রতিষ্ঠা ইত্যাকার নানা বিষয়ের সাথে অত্যন্ত জটিল অঙ্কের সমীকরণে গঠিত এই সূচক। এরপর আসবে, ভক্তকুল কারা? তাঁরা সমজের কোন স্তরের নাগরিক? বাস্তবিক, এর ওপর নির্ভর করবে, প্রসাদ কেমন হবে? নাট মন্দিরে এসি হবে না পাখা? চরণামৃতে মিনারাল ওয়াটার না কর্পোরেশনের জল? এমন আরো সব সিদ্ধান্ত। তিন মাসের অসাধ্য সাধন করে রিপোর্ট তৈরি হল। সে রিপোর্ট কোম্পানির বড়কর্তাদের সমীপে পেশ করা হল। গলাবন্ধ টাই আর স্যুট পরিহিত পরামর্শদাতারা তথ্যের কারিকুরি আর নানাবিধ অনুষঙ্গে নিদান দিলেন, ভজাইবাবা। সবার চোখ কপালে! এ বলে কিরে? মহাকাল মহাকালি থেকে নিত্যানন্দ শ্রীচৈতন্য ছেড়ে ভজাইবাবা? তিনি কে? পরামর্শদাতারা একটুও দমেননি। তাঁরা পুরাণ খুলে বার করেন এই বাবার অস্তিত্ব। দীর্ঘ ভজনা করে তাঁর সিদ্ধি। তাই তাঁর নাম ভজাইবাবা। কাছাকাছি এখনও দ্বিতীয় কোন মন্দির নেই। আর বাবার নামের একটা পেটেন্ট বা রেজিস্ট্রি করে নিলে, ভবিষ্যতে অন্য কারো পক্ষে এই বাবার মন্দির করা আইনতঃ অসম্ভব হবে না।

শুধু তাই নয়, পরামর্শদাতাদের রিপোর্টে থাকল আরো অনেককিছু। আগামী বছরগুলোর সম্পূর্ণ রোডম্যাপ। প্রথমে একটি বিশ্বাসযোগ্য, ভক্তি উদৃককারী মূর্তি। নিত্যপুজোর সমস্ত নিয়ম কানুন। বছরের কোন কোন যোগে কি কি উৎসব হবে। সে উৎসবে মানুষ মিছিল করে আসবেন। প্রথম তিন বছর সেই মিছিলে লোক সাপ্লাই করবেন কোম্পানির ম্যান-পাওয়ার ডিপার্টমেন্ট। কোম্পানির পক্ষ থেকে দেওয়া হবে বাবার ছবি সহ ইউনিফর্ম, খাবার, মিষ্টি এবং সম্মান দক্ষিণা।  প্রতি দুই কিলোমিটার অন্তর মাইক সহযোগে থাকবে ছোট ছোট প্রসাদ বিতরন ক্যাম্প। যারা খিচুড়ি, পায়েস, জল দিয়ে এই ভক্তকুল কে বরন করবে। পরমর্শদাতার ব্যক্তব্য তিন বছর এই মিছিলে টাকা ঢাললে, অচিরে উৎসবগুলো সমাজের অঙ্গ হয়ে যাবে। মানুষ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মিছিলে যোগদান করবেন। জেলায় প্রায় দুশো চায়ের দোকান কে নিয়মিত খরচ দেওয়া হবে, বাবার থানে পুজো দিয়ে কি লাভ হয়েছে তার ছোট ছোট গল্প হুইসপারিং ক্যাম্পেনের মাধ্যমে প্রচার করতে হবে।

পরামর্শের মধ্যে সংযোজিত হল এক জীবনীকারের নাম। তিনি বাবাজীর জীবনী নিয়ে স্ক্রীপ্ট তৈরি করবেন। আর তা নিয়ে হবে সিরিয়াল। সেই সিরিয়ালে বিজ্ঞাপনদাতা রূপে থাকবে একমাত্র এই কোম্পানির অধিকার। এতে বাবাজীর জীবন কথা প্রচারও হবে সাথে টি-আর-পি বৃদ্ধি, ও ব্যাবসা বৃদ্ধি। এবং সবচেয়ে মূল্যবান যে ভবিষ্যতবানী; তা আগামী বছরগুলোতে কি হারে প্রণামী আসবে তার একটা সুচিন্তিত মতামত। সেটা সম্পূর্ণ ট্যাক্স মুক্ত। 

ব্যাস আর পায় কে? হই হই করে ভজাইবাবার যাত্রা শুরু হয়ে গেল। মেগা ইভেন্টের পরিকল্পনা রোডম্যাপেই ছিল, সাথে যুক্ত হল শহরের সবচেয়ে নামি ইভেন্ট ম্যানেজার। তারা এলেন, ধামাকা দিলেন এবং জিতে নিলেন। বাসস্ট্যান্ডের একটা আটপৌরে নাম ছিল কোন পুর বা বাগান। এখন তা ‘ভজাইবাবার মন্দির’ নামেই অধিক প্রসিদ্ধ। আগের নামটা কারো হয়তো আর মনে নেই। সিরিয়ালের জনপ্রিয়তাও উর্দ্ধমুখী। নামী তারকারা সব অভিনয় করছেন। তাঁরাও খুব খুশি।

গোবিন্দ সহ আরো হাজার স্থানীয় লোক রোজ এই মন্দিরের সামনে দিয়েই যাতায়াত করে, ভিতরের গদগদ ভক্তি সংগীত শুনতে পায়। প্রথম প্রথম দূর থেকে, ক্রমে অনেকে ভিতরে গিয়েও প্রনাম করে আসে। জনান্তিকে খবর কোম্পানির নিজস্ব ব্যবসার চেয়ে বাবাজীর মন্দিরের আয় নাকি বহুগুণ বেশি। পরামর্শদাতা কোম্পানিটিও নাকি এই আয়ের একটি লভ্যাংশ পায়। তার অনেকটাই অবশ্য বাবাজীর নামে ভান্ডারা দিতে খরচও করেন। আর কোম্পানির মালিক স্বয়ং “সব বাবাজীর কৃপা” বলে সকাল সন্ধ্যে নাট মন্দিরে অন্য সাধারন ভক্তদের সাথে প্রায় আধ ঘন্টা করে সময় কাটান।  সব মিলিয়ে ভজাইবাবার মন্দির এখন এক জনপ্রিয় তীর্থ স্থানে পরিণত।

মঙ্গলবার, ২৬ এপ্রিল, ২০১৬

পথকথা-৪ (সহযাত্রী)

চলতে গিয়ে চলা আর বলতে গিয়ে বলা। গোটা জীবনটা কেটে যায়। পথ চলতে দেখা হয় কত মানুষের সাথে। এক গাড়িতে কিছুক্ষণ, তারপর যে যার পথে। সকালের সেই চেনা মুখটা বিকেলে হয়তো মনেও পড়েনা। গোবিন্দ প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময় বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ায়।  ভজাইবাবার মন্দির। এখান থেকে এক কিলোমিটার মতো গেলে জমজমাট মোড় ডিমপুকুর। বেশিরভাগ অটো চেষ্টা করে ডিমপুকুরে গিয়ে বড় মাছ ধরতে। গোবিন্দ তখন মন কাচমাচু করে দাঁড়ায়, অধিকাংশ গাড়ি তাকে না নিয়ে চলে যায়। এর মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ কেউ একবারে ওকে নিয়ে ফেলে। তখন আহ্লাদে আনুগত্যে প্রায় জল এসে যাবার জোগাড়। পাশে বসে কত রকম মানুষ আর তাদের কত রকম চলন বলন। তার মধ্যে কেউ কেউ মনের ভিতর সেঁধিয়ে যায়।

গোবিন্দর আপিসপাড়া, চড়াইপুর। আপিস ফেরতা গাড়িতে বসে আছে। যাত্রী বোঝাই না হলে ছাড়বে না। আজ বেশ রাত হয়ে গেছে। যাত্রী ভরতে সময় বেশি লাগছে। যে কয়েকজন বসে গেছেন, তাঁরা অস্থির হয়ে আসে পাশে দেখছেন, কেউ আসছেন কিনা। দোকানপাটও বন্ধ । একটি সাতাশ আঠাশ বছরের ছেলে অনর্গল ফোনে কথা বলে যাচ্ছে। কথার ধরন দেখে বোঝা যায়, অন্যদিকে বিশেষ কেউ। যে হয়তো অনেক উৎকন্ঠা নিয়ে অপেক্ষায়। গোবিন্দ এই ফেরার সময় কিছুমিছু খায়। বাদাম, ঝালমুড়ি। আজ চিঁড়েভাজা পেয়েছিল। অপেক্ষার সময়টা চিঁড়ে দিয়ে ভরাট করছে, নির্লিপ্তভাবে। শুনতে পায় উল্টোদিকের ছেলেটি ফোনে বলছে, বড্ড খিদে পেয়ে গেছে। অথচ কাছাকাছি যে কটি খাবার দোকান ছিল, সবই ঝাঁপ ফেলেছে। প্রিয়জনের কষ্টের কথা শুনে, ওদিকের মানুষটি নিশ্চই উতলা হয়ে উঠছেন। ছেলেটিও খানিক যেন আনন্দ পাচ্ছে, কষ্ট দিয়ে। বারে বারে খিদের কথা তুলছে। কেউ আমার জন্য উতলা, এটা ভাবলেও তো নিজেকে দামী লাগে। হয়তো তাই। গোবিন্দর মুশ্কিল হল। সামনে ক্ষুধার্ত মানুষকে রেখে নিজে একা একা কি করে খায়? অথচ প্যাকেট মাত্র একটি, তাও ভেঙে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। নিজের এঁটোটা কাউকে দিতে যাওয়া কি সভ্যতা বোধ? এই ভাবতে ভাবতে গোবিন্দ আরও বার দুয়েক মুখে চিঁড়ে চালান করে। আর ছেলেটি যেন সেটি দেখে বেশি বেশি করে খিদে পাওয়ার কথা বলছে। শেষমেষ আর থাকতে পারে না। ছেলেটি গোবিন্দ কে বলেই ফেলে, “কি খাচ্ছেন, একটু দেবেন”। ওফ! গোবিন্দ হাঁফ ছাড়ে। নিজে থেকে কিছুতেই ডিঙোতে পারছিল না। অথচ বাধাটা যে কিসের কে জানে। ছেলেটি কেমন অবলীলায় চেয়ে ফেলল। গাড়ি ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে। গোবিন্দ নিজে এক আঁজলা নিয়ে পুরো প্যাকেটটা ছেলেটিকে দিয়ে দেয়। একটু না না করে, নিয়ে নেয়। খিদের চেয়ে বেশি সত্যি আর কি আছে? আর এসময়, চোখের সামনে কাউকে খেতে দেখলে, খিদে আরো বেড়ে যায়। তারপর থেকে অনেকদিন গোবিন্দ ছেলেটিকে খুঁজেছে, দেখেনি। আজকাল মুখটাও মনে পড়েনা। তবে ঘটনাটা গেঁথে রইল অনেক গভীরে।

কোনদিন সহযাত্রীটি যদি সুবেশা তরুনী হয়, তবে তো কথাই নেই। সেই কবেকার ট্রাম যাত্রার 'কমলা'কে মনে পড়ে যায় অনায়াসে। গোবিন্দর আজ সুখের দিন। “...আর কোন সম্বন্ধ না থাক্, ও তো আমার সহযাত্রিণী”। সেই ছোট তৃপ্তিটুকু নিয়ে চড়াইপুর পর্যন্ত এসে পড়ে। মেয়েটি একটু আগে নেমে পড়ে। গাড়ি ফাঁকা হতেই দেখে, সিটের ওপর একটা মোবাইল রাখা। বাকিরা বলল, নির্ঘাত ওই মেয়েটির। একজন বললে, “ড্রাইভারের কাছে রেখে দিন”, আরেকজন গোবিন্দকে দেখিয়ে বলে “আপনি রেখে দিন। যার ফোন সে তো ফোন করবেই। আপনার কাছাকাছি আপিস, ওনাকে ডেকে দিয়ে দেবেন। ড্রাইভার কে দিলে, কালকের আগে পাবে না”। গোবিন্দ একটু হকচকিয়ে যায়, সবার মুখের দিকে চেয়ে আমতা আমতা করে ফোনটা নিল। বুঝলনা ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে কিনা। আপিসে এসে অবধি অস্বস্তি। কখন ফোন আসবে? কিভাবে কথা বলবে? কোথায় আসতে বলবে? আসলে, কি চা খাওয়ার কথা বলবে? আরও অনেক পারমপর্য ভেবে ফেলে।  কাজের ফাঁকে একদুবার ড্রয়ার খুলে ফোনটা স্পর্শ করে। স্মার্টফোন। লক করা। গোবিন্দ অন করার কথা ভাবেনি। এমন সময় ফোন বেজে ওঠে। ফোন ধরতে অন্যপাশ থেকে পুরুষ কন্ঠ ভেসে আসে। তিনি বলেন, এটি তাঁর ফোন, গাড়িতে ফেলে এসেছেন। গোবিন্দর তালগোল পাকিয়ে যায়, তবে কি ফোনটা মেয়েটির নয়? মেয়েটির অন্যপাশে কে বসেছিলেন? তাকে কি গোবিন্দ চিনতে পারবে? সব গুলিয়ে যেতে থাকে। না কি এ আদপে ফোনের মালিক নয়?

ভদ্রলোক রিসেপশানে বসে। কাচের পাল্লার ওপাশ থেকে গোবিন্দ ওঁকে দেখে আর মেলাবার চেষ্টা করতে থাকে। কতশত মুখ রোজ দেখা হয়, কিন্তু একটাও যে মনে পড়ছে না। শুধু কিছু পারিবারিক পরিধির চেনা মুখ ভেসে আসছে। কিন্তু কোন ভাবেই মনে আসছে না আজকের গাড়িতে কারা ছিলেন।

শুক্রবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৬

পথকথা-৩ (রাতের সূর্য্য)

সাধ করে বাপ মা নাম দিয়েছিল দিবাকর। গ্রহের ফেরে এমন এক চাকরি জুটল, যেখানে শুধু নাইট ডিউটি। দিনের আলোর সাথে দেখা আর হয়না। এক বিদেশি কোম্পানির ব্যাক-অফিস সাপোর্ট। ওখানকার মানুষজন, তাঁদের সময়ে যখন দরকার, দিবাকর গোলার্ধের এদিকে বসে সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দেয়। তখন ওর নাম শুধু ডিবস্। সাহেবদের অমন জবাকুসুমের মতো নামে জিভ জড়িয়ে যেতে পারে। ছেলেটির আঠাশ বছর বয়স। এর মধ্যে ক্রমাগত রাতের তেল পুড়িয়ে আটত্রিশ বানিয়ে ফেলেছে। এই ডিবস্ যখন আপিসে আসে তখন চারিদিক শুনশান। রাস্তায় কিছু কুকুর মাতাল চোর বা পুলিশের চলাচল। গাড়ি পেতেও সমস্যা হয়। শুরুতে আপিস থেকে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। কতদিন সেটা চড়েই আসা যাওয়া। এই গাড়িগুলো সাধারনতঃ রাতচরা হয়। ফাঁকা রাস্তায় হাওয়ার সাথে কথা কইতে কইতে আসে। গাড়ি এবং চালকের এক অপূর্ব সমণ্বয়। দিবাকরদের গাড়ির চালক নৌসাদ। অত্যন্ত পাকা হাত। রাতের অন্ধকার চিরে, কালো পিচের ওপর খেলার ছলে চাকাগুলিকে যেন দৌড় করায়। ভারতবর্ষের বিভিন্ন শহরে নিশাচর গাড়িতে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার জেরে, এখন একজন করে নিরাপত্তা রক্ষী এই গাড়ি গুলোতে থাকেন।

শুধু একা ওর জন্য কোম্পানিও বা কতদিন গাড়ি দেবে। তাই ঠিক হল, আগের শিফ্টের যারা ওর বাড়ির ওদিকে থাকেন, তাদের যখন নামিয়ে দিয়ে গাড়ি ফিরবে, ডিবস্ সেই সময় গাড়ি চড়তে পারে। এতে করে দিবাকরের জীবনে সেই মহার্ঘ্য ক্ষণ এল, প্রেম। গাড়িতে আগের শিফ্টের দলবীরের সাথে আলাপ হল। দলবীর পাঞ্জাবের মেয়ে, অত্যন্ত স্মার্ট, আধুনিক, চোখে মুখে কথা বলে। দুই বছর হল দিবাকর এই আপিসে কাজ করছে, দলবীরের অস্তিত্ব সম্বন্ধেই অজ্ঞাত ছিল। রাতের আপিসে দুচার জন পুরুষ কর্মী ছিল। তাদের অধিকাংশ হাতের কাজ শেষ করে ঘুমোত। শুধু দিবাকরের ঘুম ছিলনা। নিজের কাজের প্রতি নিষ্ঠাই তাকে জাগিয়ে রাখত। এমন নির্বিরোধ শান্তশিষ্ট ছেলেটি যে দলবীরের ঝড়ে ঝরাপাতার মতো উড়ে যাবে, তা আর অসম্ভব কি?

রাতের আন্ধকারে, দলবীর দিনের মতো আলো নিয়ে এল। তবে গাড়িতে রক্ষী থাকায় তেমন আলাপচারিতা হয়না। আপিসের গাড়ির অপেক্ষা না করে, আগেই দিবাকর আপিস চলে আসতে লাগল, যাতে দলবীর কে আরকেটু বেশি পায়। এখন ফেরার পথে আপিসের গাড়িতে দলবীর একাই ফেরে। মাস ছয়েকের এক স্বপ্নের মধ্যে ঘুরপাক খায় দিবাকর। মাথায় পাগড়ি বেঁধে শিখ হওয়া যায় কিনা তার খোঁজখবর নিতে আরম্ভ করে।

এমন একদিন রাতে নৌসাদের সাথে দিবাকর আর দলবীর চলেছে। সামনের সিটে নিরাপত্তা রক্ষী। আর যে সব সহযাত্রীরা ছিল, তারা সব নেমে গেছে। সামনে দলবীরের বাড়ি। দলবীর কে নামিয়ে গাড়ি দিবাকরকে নিয়ে আপিস ফিরবে। এমন সময় রাস্তা আটকায় পুলিশের জিপ। দিবাকর লক্ষ্য করে আসেপাশে ওদের মতো আরো অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে। সব চালকরা কাগজ হাতে সার্জেন্টের সামনে লাইন দিয়ে। নৌসাদ বেজার মুখে অন্যদের মতো লাইন দিল। খানিক বাদে এক পুলিশ এসে দিবাকরদের জিজ্ঞেস করে কোথায় যাবে। শুনে, ওদের কে একটা পুলিশের জিপে নিয়ে বসায়। বলে, “আপনাদের গাড়ির কাগজ ঠিক নেই। ওটা আমরা সিজ করছি। তবে আপনাদের আমরা পৌঁছৈ দেব”।  পরে জেনেছিল প্রায় ত্রিশ হাজার টাকার ফাইন করেছে পুলিশ। ভাড়া খাটানোর অনুমতিই নাকি ওদের ছিলনা।

আপিসের এই গাড়িগুলো একটি তৃতীয় প্রতিষ্ঠানের। তারা চালক সমেত গাড়ি ভাড়া খাটায়। সেই রাতের পর নৌসাদ অনুপস্থিত। গাড়ি কোম্পানির মালিক নিজেই অন্য একটা গাড়ি চালিয়ে আসেন। অমন ছয়ফুটের জোয়ানকে দেখে, আপিসের নিরাপত্তা রক্ষী একটু ভয় পেয়ে যায়। আসলে গাড়ি কোম্পানির প্রকৃত মালিক যে কে, তিনি কখনও সামনে আসেননি। তারপর জানা গেল। এই ভদ্রলোকটি হল বেদি কার সার্ভিসের মালিক শ্রী হরপ্রীত বেদী। অতয়েব তাঁর প্রতি সম্ভ্রম বেড়ে গেল। সবাই প্রশংসা করল, “দেখ কেমন ডিউটি করছে”, “মালিক বলে একটুও অহঙ্কার নেই”, প্রভৃতি। ক্রমে দেখা গেল আগের চালক নৌসাদ আর রাতের ডিউটি ধরতে পারছে না। ওদিকে দিনের ডিউটি করেও ওদের বড্ড অসুবিধা। এত জ্যাম আর সিগন্যাল খেতে অভ্যস্থ নয়। নৌসাদের প্রায় পাগল পাগল অবস্থা। সবাই কে বলেই ফেলে, দিনের বেলায় ওর গাড়ি চালাতে কষ্ট হয়। বড্ড ঘুম ঘুম পায়। এসব শুনে অনেকে নৌসাদের গাড়িতে দিনের বেলাতে উঠতে ভয় পেতে আরম্ভ করে।  তবে এসব সমস্যা আর বেশিদিন রইল না। নৌসাদ আবার রাতের ডিউটিতে বহাল হল। তার কারন এখন আর হরপ্রীত আসছেন না। কদিনের মধ্যে দলবীরও কাজ ছেড়ে দিল। মাসখানেক পর পুরোন সহকর্মীদের বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে আসে দলবীর। গাড়ি কোম্পানির মালিক হরপ্রীতের গৃহিনী হতে চলেছে। অনেকেই উচ্ছাস প্রকাশ করে অভিনন্দন জানায়। বলা বাহল্য, সে নিমন্ত্রণের খবর রাতের শিফ্টেও পৌঁছে যায়।

দিবাকরের হয়তো আর শিখ হওয়া হল না। তবে ইদানিং লম্বা দাড়িতে, দিবাকরকে অন্য রকম লাগে। 

বুধবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৬

পথকথা-২



কথা জন্মায়, ঘাসের মতো। বুকের ওপর একটু রোদ পড়লেই দেখা যায় সবু্জ আভা। আবার কিছুদিন ঢেকে রাখলেই কেমন হলদেটে হয়ে যায়। সারাদিন মাঠে ঘাটে রাস্তায় বাড়িতে, এমনকি স্বপ্নের মধ্যেও বিজবিজ করতে থাকে কথা। যানবাহনে চলতে চলতে, কানে হেডফোন গোঁজা স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে কথার পাহাড় ডিঙিয়ে চলেছি। রাস্তা পার হই কথা বলতে বলতে, রেললাইন টপকাই কথার সাথে। এ নিয়ে দুর্ঘটনাও কম হয়নি। বিশিষ্ট মেকাপ শিল্পী প্রবীর দে চলে গেলেন দশ বছরের (২০০৫) ওপর হয়ে গেছে। তাঁর ছেড়ে যাওয়া কথাগুলো আগাছার মতো বেড়ে গেছে আজ। ঘাসের যত্ন না করলে যা হয়। সেই ঘাসে জড়িয়ে গেছে আরো অনেক নাম।

জানকী প্রসাদের বয়স হয়েছে। দিনকালের মাপজোক ঠিক ঠাহর করতে পারেন না। একদিন খুব খেদের সঙ্গে বড় ছেলেকে বললেন, “আজকালকার ছেলে মেয়েদের জন্য খুব দুঃখ হয়। খুব কাজের চাপ”। ছেলে পরাশর একটু অবাক হয়ে তাকায়। জানকী বলে চলেন, “পথ ঘাটে সব জায়গায় দেখি, সবার কানে যন্ত্র লাগানো, আর বিড়বিড় করে একা একা কথা বলে চলেছে”। পরাশর প্রথমটায় বুঝতে পারেনি, বাবার হতাশার কারন কি? পরে বোঝে, বাবাদের আমলে এমনি তার সহযোগে শ্রবন যন্ত্র ব্যবহৃত হত। ভেবে একটু হাসি পেলেও বাবার ভাবনাকে দূর করার চেষ্টা করে না। যুগের নিয়মে মেলাতে পারবে না।

সবাই যে বিড়বিড় করেন তা নয়। কান না পাতলেও অজস্র শব্দবিন্যাস জবরদস্তি কানের ভেতর দিয়ে মরম পোষন করে যাবে। পালাবার উপায় নেই। সকালবেলা আপিস যাবার গাড়ি। প্রতিটি মুহুর্ত মূল্যবান। উপস্থিতির খাতায় লেটমার্ক পড়ে যাবার ভয়। কোনরকমে সবাই এসে সিট দখল করে বসেছে। বসেই চালককে তাগাদা দিচ্ছে “চলো হে দেরি হয়ে গেল”, “চল্ চল‌্ আর টাইম খাস না”, “একটু টেনে চালা”, “কালকের মত জ্যাম খেয়ে গেল...”। এমনই নানা বাক্য ছুটে আসতে থাকে। গাড়ি চালু হয়ে গেলেই, যে যার যন্ত্রটি বার করে ফেলেন। কেউ গেম খেলেন, কেউ ফেসবুক-হোয়াটসাপ, কেউ কানে হেডফোন গুঁজে সঙ্গীতরসে ডুবে যান, কেউবা রেডিও। সিনেমাও দেখেন অনেকে। আবার কেউ কেউ বাড়িতে ধারাভাষ্য দেন, “এই গাড়িতে উঠেছি, রাস্তায় জ্যাম আছে, সামনেই চড়াইপুর যাচ্ছে” ইত্যাদি।

এক সুবেশা ভদ্রমহিলা। বোঝাই যাচ্ছে কোন বড় আপিসের কর্মী। খুব আন্তরিক মুখ করে ফোন কানে দেন। গাঢ় স্বরে কথোপকথন শুরু হয়। “তুমি কিন্তু আজও দেরী করে ফেললে"। ভাবলেন, বাঃ এবার বোধহয় প্রেমালাপ জমে যাবে। পরের বাক্যতেই বিষয়বস্তু জানতে অসুবিধা হয়না, অন্যপ্রান্তে জনৈক মালতী দি আছেন। “আমার বেরোনোর আগে কিছুতে আসোনা, দাদাকে চাওমিনটা করে দিও, পাঁচতলার প্রিয়াঙ্কা বৌদি আসতে পারে, ওর শাড়িটা নিয়ে নিও, বালতিতে জামাকাপড় ভিজানো রয়েছে, কলারগুলোতে সাবান দিও প্লিজ, রোজ মনে করাতে হয়, বাবলু স্কুল থেকে এসে ভাত খাবে, মাছে কালকের মতো নুন দিয়ে ফেল না…” ইত্যাদি প্রভৃতি। চলমান ইতিহাস ভুগোলসহ সংসার সংবেদ।

যাতায়াতের পথে অনেকের অনেক তথ্য সামনে চলে আসে, কার কে কোন হাসপাতালে ভর্তি? কার বৌয়ের সাথে কার গোপন সম্পর্ক তৈরি হল? কে কোথায় চাকরি পেল বা পেল না? চোখের সামনে সম্পর্ক গজিয়ে ওঠে, বড় হয়, আবার ধুলিস্যাত। নিবিড় কথাও চোখে আসে, তবে কানে পৌঁছায়না। নব্য তরুনীরা এক বিশেষ কন্ঠবিদ্যায় পারদর্শী হয়েছেন। গাড়ি্তে বসে অনর্গল দয়িতের সঙ্গে কথা বলে যাবেন, পাশের সিট থেকে শুধু ঠোঁট আর ভ্রূভঙ্গী চোখে পড়বে, একটি শব্দও কানে পৌঁছাবে না।

কানে ফোন বা তার গোঁজা থাকলে; তা দেখে বোঝা যায়, কথার মধ্যে আছেন। অনেকের ব্লুটুথ যন্ত্র। পাশে থেকেও প্রথমে আঁচ পাওয়া যায় না, কার সাথে কথা বলছে। হঠাৎ করে জোরালো আওয়াজ, “হ্যাঁ রে কেমন আছিস?” খুব স্বাভাবিক বন্ধু সুলভ সম্ভাষণ। হাসি মুখ করে, বিশেষ পরিচিত কাউকে দেখবার প্রতিক্রিয়ায় চোখ ফেরালে হতাশ হতে হবে। মানুষটির “হ্যাঁ রে”-টি হয়তো বিশ মাইল দুরে, কি তারও বেশি। নিশ্চিত সামনের মানুষটির দিকে তাকিয়ে কথা বলছে কিন্তু সংযুক্ত আছেন অন্যকোন সত্যের মধ্যে। নিঃসন্দেহে এক যোগীপুরুষের ভাব। এমনই আরেক যোগীপুরুষ বড় রাস্তার মুখে দাঁড়িয়ে কাউকে ওই ব্লুটুথের মাধ্যমে প্রচুর ধমকাচ্ছিলেন। তার কথার মধ্যে অজস্র শ-কার ব-কার এবং পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ। অদূরেই এক ট্রাফিক পুলিশ ডিউটি করছিলেন। যোগীপুরুষের মুখ সরাসরি পুলিশের দিকে ফেরানো। হঠাৎ করে ধেয়ে আসা গালিগালাজ শুনে অবাক হয়ে তাকান, বোঝার চেষ্টা করেন, কেন তাকে গালি শুনতে হচ্ছে? একটু তাকিয়ে বোঝেন, ব্লুটুথের মহিমা। কোনক্রমে তাৎক্ষণিক রাগ সংহত করে নিজের কাজে মন দেবার চেষ্টা করেন। কিন্তু যোগীপুরুষ তো অন্য এক পরাবাস্তবে বিরাজ করছেন। অব্যবহিত পরে আরো উত্তেজিত কন্ঠে ফোনের ওপারে থাকা মানুষটির উদ্দেশ্যে বাছা বাছা গাল পাড়তে থাকেন। এদিকে ঘটমান বাস্তবে যোগীপুরুষের সমানে পুলিশ মাত্র, আর কেউ নেই। এবার আর পুলিশকে ধরে রাখা দায়। উপর্যুপরি গালিগালাজ শুনে আর স্থির থাকতে পারেন না। হাতের লাঠিটি বাগিয়ে তেড়ে আসেন। এবং গলা উঁচিয়ে বলেন “তুই যাবি এখান থেকে? না হলে পিঠে ভাঙবো”। অবশেষে যোগীপুরুষের ধ্যান ভাঙে, তিনি ঘোর বাস্তবে নেমে দৌড়াতে শুরু করেন।

সে দৌড় আমাদের শব্দ সমুদ্রের জলোচ্ছাসের একটি ঢেউ মাত্র। এমন রাশি রাশি ঢেউ উঠছে ভাঙছে আবার ঊঠছে। তার নাগাল পাবে কে? হাওয়াতে বড় হয়ে যাওয়া ঘাস দোলে, জল পায় গাঢ় সবুজ হয়। বুকের ওপর একদিন আর কিছুই থাকবে না। শুধুই শব্দের প্রতিচ্ছবি।

মঙ্গলবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৬

চেয়ার



চেয়ার বা কেদারা আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তা সে ময়ুর সিংহাসন হোক বা রতনবাবুর চেয়ার। রতনবাবু আজ থেকে চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছর আগে কনিষ্ঠ কেরানী হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। সঠিক তারিখটা তাঁর নিজের তো মনে নেই, রেকর্ডেও নেই। প্রথমে ঠিকা কর্মী হিসেবে তাঁর নিয়োগ। যোগদানের প্রায় অব্যবহিত পরেই তার একটি কেদারা বা চেয়ার প্রাপ্তি হয়। সে কাঁঠাল কাঠের তৈরি, ভয়ানক মজবুত একটি নিদর্শন। সেবার যখন বেশকিছু ঠিকা কর্মীকে স্থায়ীপদে নেওয়া হচ্ছে, সাহেব রতনবাবু কে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন, “স্থায়ী তালিকায় নাম তুলতে হলে তো, বয়সের হিসেবটা দিতে হবে”। ততদিনে রতনবাবু হুঁশিয়ার হয়ে দিয়েছেন। সাত ঘাটের জল খেয়ে, যাকে বলে পোক্ত মানুষ।  অত্যন্ত লাজুক মুখে, নিজের পায়ের বুড়ো আঙুল নিরীক্ষণ করতে করতে জবাব দেন, “কত আর হবে? ওই আঠাশই লিখে দিন। সত্যি বলতে, আজ তো আমার পুনর্জন্ম হল”। সাহেব মুচকি হেসে রতনবাবুর দিকে তাকান। কারণ রতনবাবুর ছেলেই আঠারোর গন্ডী পেরিয়ে গেছে। রতনবাবুর দৃষ্টি তখনো নিজের পায়ের আঙুলে নিবদ্ধ। সাহেব কি বুঝলেন কে জানে, যা হোক ওই আঠাশের কাছাকাছি একটা বয়স দাগিয়ে দিয়েছিলেন।  সেই থেকে রতনবাবু আর তাঁর চেয়ার প্রায় সমার্থক।

এর মধ্যে বহুবার আপিসের খোলনলচে পাল্টছে। এসেছেন নতুন কর্মচারীর দল, এসেছে নতুন আসবাব। শুধু রয়ে গেছেন রতনবাবু আর তাঁর চেয়ার। এখনকার আপিস ঘর, বড় হলের মত। তার মধ্যে সার সার ঘনক। প্রতিটি ঘনকের সাথে যুক্ত মানানসই একেকটি চেয়ার। শুধু রতনবাবুর চেয়ারটি একই ভাবে আলোকিত করে রেখেছ। মহামতি ভরত যেমন চোদ্দ বছর সিংহাসনের পাশে বসেই কাটিয়ে দিলেন, রতনবাবুরও তেমনই তাঁর চেয়ারের প্রতি আনুগত্য। নতুন আসবাব আসার সাথে পুরোন আসবাব সরানোর ধুম পড়ে যায়। একবার তো নীলামের আয়োজন করা হয়। বেশ কিছু কর্মচারী রীতিমত মুটে ডেকে আপিস থেকে চেয়ার, টেবিল, আলমারি বাড়ি নিয়ে গেছেন। শোনা যায় আনেকে আবার নিজের মেয়ের বিয়েতে যৌতুক হিসেবে আপিসের নীলাম থেকে কেনা আসবাব দিয়ে পাত্রকুলে সুনাম অর্জন করেন। আপিসের আসবাব পুরোন হলেও কেতাদার। একমাত্র রতনবাবুর চেয়ার ধ্রবতারার মতো স্থির হয়ে থাকে। অন্যদের চেয়ার পাল্টেছে, রতনবাবু আপিস কে অনুরোধ করে চেয়ারটি নতুন করে পালিশ করিয়ে নিয়েছেন। তাই দেখতে হাল ফ্যাশানের না হলেও জেল্লা কিছু কম নয়।

চেয়ারের সাথে যে শুধুমাত্র রতনবাবুর সখ্যতা, এটা বলা ঠিক হবে না। ট্রেনের নিত্যযাত্রীদের মধ্যে নির্দিষ্ট কামরার নির্দিষ্ট চেয়ার না পেলে সারাদিন কেমন যেন লাগে। নির্দিষ্ট শৌচাগার না পেলে, অনেকেরই প্রাতকৃত্য পরিস্কার হয়না। খেতে বসার নির্দিষ্ট স্থান, সেলুনে বসবার নির্দিষ্ট চেয়ার বা গাছতলা, সব কিছুর অনুষঙ্গে এই নিরীহ আসবাবটি জড়িয়ে যায়। নতুন কর্মচারীদের মধ্যে কোন বিশেষ চেয়ার বা স্থানের প্রতি মোহ বজায় রাখার উপায় নেই। আধুনিক আপিস ব্যবস্থায়, ল্যাপটপ যন্ত্রটি থাকলেই নিজের আপিস তৈরী। কোনো বিশেষ ঘনকের ওপর নির্ভরশীল হবার দরকার নেই। একবার এক অল্পবয়সী মহিলা কর্মচারীর কাজের ক্ষেত্র বদল হয়। নতুন ক্ষেত্রটি একই আপিসের অন্য তলায়। নির্দিষ্ট দিন থেকে, তাঁর অন্য সহকর্মীদের সাথে গিয়ে বসতে হয়। কিন্তু দেখা গেল প্রতিদিন সকালে, সেই মহিলা কর্মচারীটি তাঁর পূর্বতন চেয়ারে এসে কিছুক্ষণ বসেন, চুল আঁচড়ান, তারপর ধীরে ধীরে নিজের নতুন আসনে চলে যান।

রতনবাবুর কথা আলাদা। ওনার দপ্তর আলাদা হয়েছে, বসার স্থানের বদল হয়েছে। কিন্তু যেখানেই গেছেন, নিজের চেয়ারটি সঙ্গে নিয়ে গেছেন। এই আপিসে থেকেই তাঁর ছেলে মেয়েদের বিবাহ হল। নাতি নাতনি হল। অবশেষে সেই দিনটি এসে উপস্থিত। রতনবাবুর অবসর। আজ বাড়ি থেকে তাঁর স্ত্রী, এক পুত্র, পুত্রবধু ও নাতনি এসেছে। আপিসের পর এক মিটিংরুমে সবাই জমায়েত হয়। রতনবাবু দৃশ্যতঃ আবেগপ্রবণ। বয়সের জল মেশানোর পরও, আজ সত্যি তাঁর সময় ফুরিয়ে এল। নানা বয়সোচিত উপহার পাওয়া, হাসি হাসি মুখে সবার সাথে ছবি তোলার পর্ব শেষ হবার পর রতনবাবু জনতার উদ্দেশ্যে দরবার করেন। প্রবীনত্বের কারণে কনিষ্ঠ কেরানী থেকে যতটা ওপরে ওঠা, তার বেশি তো নয়। নতুন যোগ দেওয়া ছেলে মেয়েগুলোও তাঁর চেয়ে বেশি মাইনে পায়। সেদিক দিয়ে খুব কুন্ঠিত থাকেন। আমতা আমতা করে বলেন, যদি চেয়ারটি কে তাঁকে উপহার হিসেবে দেওয়া হয়, উনি চিরকৃতজ্ঞ থাকবেন। বলাই বাহুল্য এহেন অনুরোধ আজকের এই বিশেষদিনে অনুমোদন পেতে বেশিক্ষণ লাগবে না।

সবকিছু মিটে যাবার পর পরিবার ও চেয়ার সমেত ছলছল চোখে, একটি মালবাহী গাড়িতে গিয়ে বসেন। ড্রাইভারের কেবিনে স্ত্রী ও নাতনি। বাকিরা সবাই পিছনের ডালাতে। মাঝখানে আলো করে আছে সেই কাঁঠাল কাঠের চেয়ার, যার ওপরে রাজার মতো বসে রতনবাবু। পুত্র ও পুত্র বধূ পায়ের কাছে।

রবিবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৬

পথকথা

তিন চাকার কি মহিমা। দেখতে কচ্ছপের মত হলেও চালচলন খরগোশ বা অন্য প্রাণী পতঙ্গের সাথে তুলনীয়। কাঁঠালের গন্ধে যেমন নীল মাছির দল ছুটে আসে, অবিকল সেই ক্ষিপ্রতা। সবেমাত্র সিগনালের হলুদ বা লাল দপদপিয়ে উঠল কি উঠল না, সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকে কোথায় কে ছিল, হুড়মুড়িয়ে অন্য সব যানকে ডিঙিয়ে সামনে চলে এল। অটোরিক্সা। কোথাও শুধু রিক্সা বা কোথাও আবার বেবি ট্যাক্সি। গলি থেকে রাজপথ প্রবল পরাক্রান্ত অস্তিত্ব। সবাই সমঝে চলে। এক সময় কাটাতেল। এখন পরিবেশ বান্ধব গ্যাস। যদিও শহরের শাসনের পরিধির বাইরে এখনও কাটাতেলে রাজত্ব অব্যাহত।

ভাবতে অবাক লাগে, যানের সাথে চালকের কি রাজযোটক? না হলে প্রায় প্রতিটি গাড়ি একই দ্রুততায় একই রকমভাবে নিয়ম ভাঙে, কি করে? নগর কলকাতার নবদিগন্তে কর্পোরেট গেট। উর্দিধারী দ্বাররক্ষী। সেখানে আপিসের তাড়ার সময় চালক অনায়াসে গাড়ি রাখে, যাত্রীর টাকা গোনে, খুচরো নিয়ে বচসা করে, খুব নির্লিপ্ত মুখে। পিছনে তখন সার দিয়ে অন্য গাড়ি দাঁড়িয়ে। দ্বারপাল গেট ছেড়ে দাঁড়াতে অনুরোধ করায়, মুহুর্তে তার বাক্যবিন্যাস চালু। বাছা বাছা কটু শব্দে বুঝিয়ে দেয়, গত দশ বছর এভাবেই চলেছে এবং আগামীতেও একই থাকবে।

অটোযানের একটি বিশেষ আসন, চালকের কোল। সামনের সারিতে বসে বিবিধ মানুষের মধ্যে যাকে সবচেয়ে অকিঞ্চিতকর বলে প্রতীয়মান হন, তিনিই চালক। প্রায় আসনের বাইরে বসে, ঝুলন্ত হয়ে এক অসামান্য প্রতিভায় গাড়ির নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করেন। বিজ্ঞানীরা বলতে পারবেন ওইটুকু পরিসরে, এতগুলো মানুষের স্থান সঙ্কুলান কি করে হয়? সব চালক একই রকম চেহারার নন। কেউ কৃশ কেউ স্থূল কেউ দীর্ঘ কেউবা খাটো। সে কারণে কিন্তু সামনের আসনের পরিবর্তন হয় না। কোথাও তিনজন, কোথাও চারজনের বিধান আছে। পিছনে মোটামুটি তিনজন বসতে পারেন। একবার এক শহরতলির বিশেষ রুটে যাত্রা করতে গিয়ে পিছনের সারিতে কোলে বসার অভিজ্ঞতাও হল। ওদেশে নাকি এমনটাই দস্তুর। আগু পিছু হয়ে বসুন। এ এক অদ্ভুত সমীকরণ। আর অনায়াসে ধরে যায় আট কিম্বা নয়জন। নামার পরও বিষ্ময় কাটে না, এতজন কোথায় ছিলাম? অনেকটা তেঁতুলপাতায় নয়জনের মতো। সবাই যে সুজন, বলাই বাহুল্য।

খুচরো নিয়ে অটো চালকদের নিত্য অভিযোগ। তার উপর এক বিন্দু থেকে আরেক বিন্দু ভাড়া কত হওয়া উচিত এই নিয়ে বিস্তর বাদ বিসম্বাদ। সকালবেলা মেজাজ অপেক্ষাকৃত মসৃণ থাকার কথা। তবু ঝামেলা লেগে গেল এক যাত্রীর সাথে। যাত্রীর মতে বিনিময় মুল্যে একটি টাকা বেশি চেয়েছে চালক। আর চালকের মতে তিনি সঠিক। এই বাদানুবাদে আমাদের দেরী হলেও মুখে প্রকাশ করতে সাহস হয়না। বেশ কিছু সময় ক্ষয় করার পর যাত্রীটি হার মানতে বাধ্য হয়। চালক, নিজের অধিকার ছিনিয়ে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসের সাথে চলতে থাকেন। এর মধ্যে আরেকটি যাত্রী ওঠেন। তাঁর গন্তব্য যে নাম করেন এই অটোটি সেদিকে যাবেনা। তা সত্বেও যাত্রীটিকে নিয়ে চলতে থাকে। বেশ কিছু সময় পর একটি স্থানে গাড়ি থামে। অটোচালক বলেন, এখান থেকে আপনি যে জায়গার কথা বললেন তার গাড়ি পাবেন। যাত্রীটি এ পথে নতুন বোঝাই যাচ্ছে। পার্স বার করে কত দিতে হবে জিজ্ঞেস করেন। চলকের সপাট উত্তর, ওটা আমার রুট নয়, ভাড়া লাগবে না। ঠিক মেলাতে পারছিলাম না, একটু আগে যে একটা টাকার জন্য তুমুল যুদ্ধ করল, সে অনায়াসে আরেক প্রাপ্তির সম্ভাবনা ছেড়ে দিচ্ছে।

চালকের কোলে বসার অতিরিক্ত সুবিধা। প্রথমতঃ সর্পিল পথে গতিময় যাত্রার অ্যাডভেঞ্চারের পূর্ণ স্বাদ। দ্বিতীয়তঃ জগৎ সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গী। রাস্তার ধারে অপেক্ষয়মান যাত্রীর মুখ দেখে বুঝে ফেলেন, উনি বাস না অটো? খুচরো আছে না নেই। কিম্বা আদৌ ভাড়া দেবেন কি না? অবাক লাগে তার দূরদৃষ্টি আর মানুষ চেনার চোখ দেখে। এরকম এক রাতে চালকের কোলের ছেলে হয়ে ফিরছি। সময়টা দুর্গাপুজোর পরের সপ্তাহ। রাত নটা টটা হবে। বাতাসে উৎসবের রেশ মেলায়নি। রাস্তাঘাট অপেক্ষাকৃত ফাঁকা। আমাদের অটোটিকে ঝড়ের বেগে অতিক্রম করে তিনটি বাইক। প্রতিটিতে তিনটি করে অল্পবয়সী বালক। কারো মাথায় শিরোস্ত্রাণ নেই। সাপের মতো এঁকে বেঁকে তাদের গতিপথ। একেক বাইকের ভাঁজে হাঁটু ছুঁয়ে যায়  রাস্তা। চালক বন্ধু উদাস গলায় বলে, এদের পুজো এখনও শেষ হয়নি। এরপর হয়তো আর দুই তিন কিলোমিটার এগিয়েছি। রাস্তার ধারে জটলা। ইতস্ততঃ ভাঙা বাইক আর রক্তের দাগ। দুতিন জন মিলে নিথর বাইক আরোহীদের শরীরগুলো রাস্তা থেকে পাশে নিয়ে যাচ্ছে। মুহুর্তে হাত পা অবশ হয়ে আসে। বুঝতে অসুবিধা হয়না, এই সেই তিনটে বাইক, যারা একটু আগে যৌবনের তুমুল উত্তেজনার ধ্বজা তুলে আমাদের অতিক্রম করেছিল। অটোচালক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, এবার বোধহয় পুজো শেষ হল। 

শনিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৬

অজানার আনন্দ

হিরক রাজের শিক্ষা মন্ত্রীর সেই অমোঘ বচন, "জানার কোন শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই।" একবার এই সত্য হৃদয়ঙ্গম করলে, তার সিদ্ধি রোধ করে কে?

চতুর্দিকে কুরু-পান্ডবের সাঁজোয়া গাড়ি দাঁড়িয়ে, সারি সারি। বেচারা অর্জুনের দাঁত কপাটি লেগে যাবার জোগাড়। অস্ত্র-শস্ত্র ফেলে দিয়ে নন্ প্লেয়েইং ক্যাপ্টেনের শরণাপন্ন।
- স্যার, এরকম হবে তো ভাবিনি। আমি পারবো না স্যার।
সোজা কথায় হাত-পা পেটে মধ্যে সেঁধিয়ে যাওয়া, আর কি? কিন্তু এত কান্ড করে, যিনি একটু একটু করে যুদ্ধের গুটি পাকিয়ে এনেছেন, তার কি হবে? সভ্যতার প্রতিটি ইনিংসে অবতীর্ণ হবেন বলে যিনি কথা দিয়েছেন, অর্জুনের মতো বালখিল্যের কারণে ওয়াক ওভার দিয়ে দেবেন? এমনটা হলে টি-আর-পির দফারফা। অগত্যা শুরু হল জ্ঞান বপন আর জ্ঞান উন্মেষ। মায়ার বাঁধন কাটিয়ে, সার উপলব্ধি। তুমি কেউ নও ভাই, কেবল নিমিত্ত মাত্র। কোন ওভারে কটা নো বল, প্রথম বলে চার হবে না শূণ্য- সব আগে থেকেই নির্ধারিত। অগত্যা বেচারা জনগণ যুদ্ধে মন দেয়। পাল্টা প্রশ্ন বারন আছে।
- স্যার যদি সব আগে থেকেই সেট করা থাকে, তবে আর আমাদের টানাটানি কেন?
জানা আর অজানার এই সূক্ষ্ম সুতোর সীমানা, আবহমান কালের। জ্ঞানবৃক্ষের ফলের স্বাদ কেমন? তা জানার অত কৌতুহল না থাকলেই ল্যাঠা চুকেই যেত।

পরীক্ষার হলে প্রশ্নপত্র অজানা। প্রশ্ন জানার পর উত্তর অজানা। সেখানে অবশ্য কিছু বিপদভঞ্জন বন্ধু উপস্থিত। জানালার পাশ অথবা শতাব্দী প্রাচীন ইউরিনালের ভিতর এত দিস্তা দিস্তা সাহায্যলিপি, সে তো সেই পরমারাধ্য "ফ্রেন্ড ইন নিড"-এর সমতুল।

এক তথাকথিত বিখ্যাত কলেজ হস্টেলের ঘরে একটি বালক অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে গাঁতিয়ে চলেছেন। কোন এক আপাত দূরুহ জ্ঞানান্বেষণে। দৃঢ়কল্প চোখে কেবল এবং কেবলমাত্র পরীক্ষারূপী পাখির চোখ। সেখানে জানার অবকাশ যত, তার বহুগুণ নম্বর পাবার অভিলাষ। অপর একটি অকালপক্ক আঁতেল বালক সহপাঠী, সেই ঘরে প্রবেশ করলে, আমাদের পড়ুয়া ছাত্রটি সামান্য বিরক্ত হয়। এই আঁতেল সম্প্রদায় যুগে যুগে অবতীর্ণ হয়। তাদের না থাকে চক্ষুলজ্জা, না থাকে পরকাল বা উত্তর-ছাত্র পর্বের ভাবনা। পরীক্ষা ও তার প্রস্তুতির পরোয়া না করে উচ্চৈঃস্বরে আবৃত্তি শুরু করে। নজরুলের 'বিদ্রোহী'। কিছু কিছু শব্দের ব্যঞ্জনায় এমন কিছু থাকে, যা অতি বড় নিরাসক্তের মন কে আকর্ষন করতে বাধ্য। শব্দব্রহ্ম বলে কথা। কাব্য নিরসনে পড়ুয়া ছাত্রটি সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকায়।

- তুই তো বেশ ভালো আবৃত্তি করিস।

আঁতেল খোকাটি নিজের আঁতেলত্ব নিয়ে অতি-অবহিত। যেকোন প্রশংসাকে কি করে কাঁধের কম্পনে গ্রহন বর্জনের মাঝামাঝি রাখতে হয়, সে জানে। কিন্তু এক অত্যাশ্চর্য বিষ্ফোরণ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে না, যখন শোনে পড়ুয়া বালকটি বলছে, "কবিতাটি কি তোর লেখা?"
সময়ের নিয়মে যদিবা বড় করে খুলে যাওয়া হাঁ প্রায় বুঁজে এল, তখন এল আরেক মোক্ষম বাণী, "জানিস, আমিও কবিতা লিখতাম।"

এরপর গঙ্গা দিয়ে প্রচুর জল প্রবাহিত। সমুদ্র উপচে সুনামি প্রকোপে সভ্যতার দিশাহারা চেহারা। এমত অবস্থায় কোন এক সাধারন পল্লীর বাজারে, এক আনাজ বিক্রেতা বিস্তর কাগজ চর্বন করে, একদিন ভরা সকালে, এক হাতে দাঁড়িপাল্লা নিয়ে ওজন করতে করতে আশ্বাস দিলেন, "আমাদের এখানে সুনামি আসবে না।"
পারিপার্শিক মানুষেরা কৌতুহলে ফিরে তাকায় বিশেষজ্ঞের মতামত জানার জন্য। জ্ঞানী সবজি বিক্রেতা অত্যন্ত সপ্রতিভ কন্ঠে পর্যালোচনা করেন, "আসলে এই সুনামির জন্য পৃথিবীর নিচ থেকে প্রচুর গ্যাস জন্মায়। আর আমাদের চারিদিক অনেক ইন্টারনেট আছে। সমস্ত গ্যাস ইন্টারনেট শোষন করে নেয়। তাই সুনামির ভয় নেই।"
শ্রোতৃমন্ডলী যারপরনায় স্তব্ধ হয়ে থাকে, জানা বা অজানার শাশ্বত অন্বেষণে। 

ভোটের বালাই

একটা বড় ঠোঁটের সারস। ছেয়ে রঙের শরীর। গলার কাছটিতে সাদা। লম্বা লম্বা পা ফেলে চলেছে। ছোট্ট নদীর আঁকে বাঁকে আসকলি আর উলু ঘাসের ঝোপ। টলটল জল নদীর নিচ পর্যন্ত দেখা যায়। বিকেলের এই সময়টা বেশ মনোরম। গনগনে রোদের তাপ একটু কমেছে। দক্ষিণের বাতাসে একটু যেন আরামের ঘ্রাণ।

সাতটা মহিষ নিয়ে জলে নামে বুড়ো। পাকানো দড়ির মতো চেহারা। বিচুলি দিয়ে ঘষে ঘষে প্রতিটি মহিষের গা পরিস্কার করতে থাকে। অতগুলো মহিষকে দেখে সারসটা থমকায়। একটু সরে জায়গা দেয়। পরম যত্নে বুড়ো মহিষদের স্নান করায়। শেষ নিজে স্নান সারে।

এরপর হেট হেট করতে করতে পোষ্য নিয়ে বাড়ির পথে। পাকা রাস্তা ছেড়ে মাটিতে। ঝরা পাতায় পুরো পথ ঢাকা। বাঁশ ঝাড় পেরতে, ওপাশ থেকে ডাক আসে, "কই ঠাকুর জামাই, ঝুড়িভাজা নিয়ে গেলে না?" ডাক শুনে মহিষদের ছেড়ে দেয়। বাকি পথটা ওরা একাই যেতে পারবে। পথ ছেড়ে বুড়ো পানুদের বাড়ির দিকে ঘোরে। নিকোনো উঠোন। একটা বড় আমগাছ তলায় রান্নাঘর। ভিতর থেকে ছাঁকা তেলের ভাজা গন্ধ ভেসে আসছে। পানুর মা একটা পাটি এগিয়ে দেয়। বুড়ো লম্বা পা মুড়ে বসে। একটা বিড়ি ধরায়। একটা মস্ত গামলায় বেসনের তাল ঠাসে পানু। পানুর মা আর বৌ সেই বেসন ঝাঁঝরি করা কৌটো দিয়ে কড়াইএর উপর ঘোরায়। গোল গোল ঝুড়ি ভাজা। তারপর তেল ঝারিয়ে বিটনুন দিয়ে প্যাকেটে মোড়া হচ্ছে। পানুর মা এক বাটিতে একটু মুড়ি, গরম ঝুড়িভাজা আর কাঁচালঙ্কা এনে বুড়োর সামনে রাখে। তারপর আমগাছের দিকে তাকিয়ে ডাকতে থাকে- "বুলবুলি ও বুলবুলি।" তীক্ষ্ণ শিসে উত্তর দিতে দিতে নেমে আসে, একটা সবুজ রঙের টিয়া। পাখিটা পানুদের পোষা, নাম বুলবুলি। তবে খাঁচায় রাখতে হয় না। ও গাছেই থাকে, খাবার সময় ডাকলে, নেমে আসে ঠিক। বুড়ো বুলবুলিকে একটা ঝুড়িভাজা দেয়। লাল ব্যাঁকা শক্ত ঠোঁটে খাবার কামড়ে ধরে। তারপর গাছ বেয়ে তরতর করে রান্নাঘরের চালে উঠে বসে।
বেসন মাখতে মাখতে পানু বলে, "পিসে, খবর কেমন বুঝছ?"
 - খবর আর কি?
 - পঞ্চায়েত অফিস থেকে এসেছিল?
 - হ্যাঁ তারা তো বাড়ি বাড়ি লিস্টি মেলাচ্ছে।
 - সে তো দু মাস ধরে হচ্ছে। নতুন খবর কি?
 - নতুন আবার কি?
 - কেন তুমি ভোট দিবা না?
 - হ, ভোট তো দিবোই। টিয়ারে বুলবুলি নাম দিবি। আর সে বেটাও সাত বোগদার এক বোগদা। ডাকলে সাড়াও দেয়।
 - তুমি কি ভাব? সে কি ডাক শুনে আসে? আসে ঝুড়ি ভাজার লোভে।
 - ভোটবাবুরাও আসে। ও তো অবলা পাখি!

সর্বশিক্ষা প্রজেক্টে পানুর নাম শিক্ষক হিসেবে লেখানো আছে। ঘরে গাদা বই ডাঁই করা। খাতা ভরা ছাত্রদের তালিকা। মাঝে মাঝে উপস্থিতির চিহ্ন বসিয়ে নেয়। বই পত্তর যেমন কি তেমন ধরা থাকে। একটা মোটা ডিক্সনারি আর একটা গ্লোব আছে। পানুর ছোট ছেলেটা গ্লোবটা নিয়ে খেলা করে। আর মোটা বইটা সেলাই-এর সময় কাঁথা চাপা দেবার কাজে লাগে। চাষের কাজ ছাড়া, ঝুড়ি ভেজে তেমন যুৎসই হয় না। কয়েক বছর হল, অধীর সর্বশিক্ষার কাজটা পাইয়ে দেয়। তার বদলে পতাকা নিয়ে মিছিলে হাঁটা বা কলকাতায় যাওয়া। কিন্তু আজকাল অধীর নিজেই যেন অন্য সুর গাইছে। পানু বোঝেনা। বুড়ো কিছু বোঝে কি না, তা বুড়োই জানে।

মুড়ি শেষ করে বুড়ো ওঠে। পানু ছয়টা, ডজনের প্যাকেট ধরিয়ে দেয়। বুড়ো মহিষের দুধ দিতে যায়, সাথে আজকাল ঝুড়িভাজাও রাখে। চায়ের দোকানগুলো নেয়। অধীর বলেছে, টাউনে কয়েকটা ক্যান্টিন ধরিয়ে দেবে। তবে বুড়ো খুব জানে, এখন কিছু হবার নয়। কেমন একটু ভয় ভয় করে। ভোটের পর কি আগের হিসেব মিলবে? ঘরে ফেরার পথে সারসটার দেখা পায় আবার। নদীর অন্য পাড় দিয়ে চলেছে, সতর্ক পায়ে।   

শুক্রবার, ১৫ এপ্রিল, ২০১৬

বিজয়া


আজ দশমী। এবার আমাদের পাড়ার থিম ছিল লাইভ ঠাকুর। মোড়ের মিষ্টির দোকানের ময়রা হয়েছিল গণেশ, বলিউডের স্বপ্নে বিভোর ঋত্বিক হয়েছিল কার্তিক, পাড়ার হার্টথ্রব চিনির বোন মিনি হয়েছিল সরস্বতী। চিনি রাজি হল না, তাই অপর্ণাদি লক্ষ্মী। জিম করা গুলেদা অসুর আর পাড়ার রাঙামাসি দুর্গা। সবাই কে হেব্বি মানিয়েছিল। ঋত্বিকটা মিনির দিকে কয়েকদিন যাবৎ একটু কার্নিক খাচ্ছিল। সুযোগটা পুরো কাজে লাগালো। মহালয়ার দিন থেকে ওদের রিহার্সাল। বেদান্ততীর্থ থেকে নিয়মিত যোগ আর ডায়েট চার্ট করে দিয়েছিল। দেবত্ব অর্জন যে সে কথা! দুবেলা সবাই "মা-মা" করে পুজো করল, অঞ্জলি দিল, ধুনুচি নাচল। শুধু বিসর্জন দেবার সময় দর্পণেই খেল খতমঋত্বিক দেবীপক্ষের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত মিনির পাশেকতটা চিঁড়ে ভিজেছে, তা সময় বলবে। ময়রার ভুঁড়ো পেট নিয়ে চলতে ফিরতে অসুবিধে। সেও কটিয়ে দিল কটা দিন। রাঙামাসির বড় বড় চোখ। এমনিতেই ভীষণ মা মা। দশহাতে বড় সুন্দর লাগছিল। দর্শকরা সবাই এমন করছিল, সত্যজিতের দেবী সিনামা মনে পড়ে যাচ্ছিল। গুলেদা স্পোর্টসম্যান। মাসল দেখাতে কোন আপত্তি নেই। চিনি না থাকায় ঋত্বিকের লাভগার্জেনগিরি ফলাবার কেউ ছিলনা মিনির সাথে চমৎকার সেটিং হল। কত ছবি যে একসাথে উঠল তার আর লেখাজোখা নেই।

কর্মকর্তারা খুশি। বিজ্ঞাপনে ভালো রোজগার হয়েছে। পাড়াতে খোলতাই মেজাজ। মিষ্টিমুখ আর কোলাকুলি চলছে। ক্লাব ঘরের এক কোনাতে ঋত্বিক আর মিনি প্রসাদের দৈ-চিঁড়ে খাচ্ছিল। ঋত্বিক একটু গলা নামিয়ে বলল, "কাল বিকেলে তো আর শো নেই। তোমার সাথে কি করে দেখা হবে?"

- কেন বলতো? কিছু জরুরি?

- তা একটু জরুরি তো বটেই।

- কিছু বলবে? সে তো এখানেই বলতে পারো?

- না এখানে সবার মাঝখানে একটু চাপ আছে।

- তোমাকেও আমার একটা জিনিস দেবার আছে।

- কি?

ঋত্বিক আগ্রহে ফেটে পরে। দশদিনের পাশাপাশি থাকা, মিনি নিশ্চই বুঝেছে

- দিচ্ছি বাবা দিচ্ছি। আমি নিয়েই এসেছিলাম। তেমন কিছু নয়, আমাদের এই শো-র একটা স্মারক। কার্তিক, সরস্বতীর ভাই না দাদা? যাই হোক, এখন থেকে আমি তোমার বোন হলাম কেমন?"। এই বলে ঋত্বিকের ডান হাতে রেশমের দড়ি বেঁধে দেয়। ঋত্বিকের মুখটা চুপসানো বেলুনের মতো নিভে যাচ্ছিল  

এম-ও-ডাব্লু-৩০১

ট্যাক্সি ধরলাম অফিসের সামনে থেকে। ক্লান্ত, তাই উঠেই সিটে শরীরটা এলিয়ে দিলাম। অনেক রাত হয়ে গেল আজ। হঠাৎ ড্রাইভারের সিটের পিছনে লেখা ট্যাক্সির নম্বরটা চোখে পড়তেই চমকে উঠলাম। এম-ও-ডাব্লু-৩০১। তিন মাসে চারটে খুন। প্রত্যেকটা লাশের কাছে পাওয়া গেছে, একটা বিশেষ নম্বর প্লেট। পুলিশ জানিয়েছে, নম্বরটার কোন অস্তিত্ব নেই। কাগজ আর টেলিভিশনে অনর্গল চর্চা, এম-ও-ডাব্লু-৩০১-র পরবর্তী নিশানা কে? পুলিশ প্রশাসন অন্ধকারে হাতড়ে চলেছে। অপরাধ সংগঠিত হয়েছে মধ্যরাতে কোন-না-কোন হাইওয়ের ধারে। পোস্টমর্টেম বলছে, মৃত্যুর কারণ বিষাক্ত গ্যাস। বুঝলাম ফাঁদে পড়েছি। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। এসি-র সাথে মিষ্টি গন্ধ। পকেট থেকে মোবাইল বার করি। ঘাড় না ঘুরিয়ে ড্রাইভার বলে, "স্যার জ্যামার আছে। নেটওয়ার্ক কাজ করবে না।" ড্রাইভিং মিরর দিয়ে চোখ দেখা যাচ্ছে। শান্ত মেজাজ। যেন কোন তাড়া নেই। আমার গলা দিয়ে স্বর বেরয় না।
- কি যা তা বলছেন?
- যা তা নয় স্যার। যা ভাবছেন, ঠিক তাই। মার্ডার-অন-হুইলে আপনাকে স্বাগত জানাই।
- কেন? আমি কি করেছি?
- আমরা কেউ কিছু করি স্যার? সবই আগে থেকে ঠিক। আমরা নিমিত্ত মাত্র।
- প্লিজ আমায় নামিয়ে দিন।
- এ ভাবে বলবেন না। দুর্বল লাগে। বিশ্বাস করুন, কোন কষ্ট হয় না। প্রথমে আমরা হাইওয়ের দিকে যাবো। তারপর এই এসি-র সাথে ঘুমের গন্ধটা আসবে। দেখবেন খুব ভালো লাগবে।
গাড়ীর হাতল টানাটানি করতে থাকি। আবার সে শান্ত গলায় বলে, "কোন লাভ নেই, সেন্ট্রাল লক। বিশেষ ভাবে বানানো। আমার এখান ছাড়া খুলবে না।"
রাস্তা হাইওয়েতে ওঠে। আমি বলি, "আপনার কত টাকা চাই?"
- টাকার জন্য মার্ডার-অন-হুইল কাজ করে না। এটা একটা মিশন। পৃথিবী কে ভার মুক্ত করতে হবে।
- আমি পৃথিবীর ভার! আপনাকে কে বলল?

লোকটি চোখ দিয়ে হাসল। কিন্তু চুপ করে থাকলে হবেনা। আজ সাথে ল্যাপটপের ব্যাগটাও নেই, যা দিয়ে আঘাত করা যায়। হঠাৎ একটা কালো বেড়াল দ্রুত রাস্তা পার হয়। প্রবল শব্দে ট্যাক্সি দাড়িয়ে যায়। ইগ্নিশন অফ করতেই সেন্ট্রাল লক খোলার শব্দ হয়। আমি কিছু না ভেবে দরজা খুলে বাইরে ঝাঁপ দিলাম। অদূরে একটা টহলদারি গাড়ী। ট্যাক্সিটা স্পীড তুলে অন্ধকারে হারিয়ে যায়।      

বাথটাব

মধ্যবিত্ত গেরস্ত ঘরে বাথটাব শব্দটি বিদেশি। একসময় বাথরুমেরও তেমন চল ছিল না। পাড়ার পুকুরে বা নদীতে গণস্নানের অনন্য মজা। পরে এল সার্বজনীন কল পাড়। যেখানে পাড়ার সবাই মিলে লাইন দিয়ে স্নানের আয়োজন। সম্পন্ন মানুষ নিজগৃহে তৈরি করলেন ব্যক্তিগত কলপাড়। সেখানেই বাসন মাজা গা মাজা দুই চলত। কোন কোন রাস্তার কলে গবাদিপশুর স্নানও সমান প্রচলিত।

ক্রমে কলপাড় হল কলঘর। সংযোজন হলে আরেকটি অবতারঃ চৌবাচ্চা। কেন যে এই অসামান্য শব্দটির উদ্ভাবন হল, সমাজ ও ভাষা বিজ্ঞানীরা বলতে পারবেন। কলঘরের চিত্রকল্প ও তার ব্যবহার বিভিন্ন শিল্প মাধ্যমে বারে বারে হয়েছে। ভবিষ্যতেও হবে। তার শ্যাওলা ধরা, নোনা লাগা শরীর। আধো অন্ধকারে একটি চল্লিশ পাওয়ারের বাতি। সব মিলিয়ে গল্পের আঁতুরঘর। সেই কলঘরে বা কল সংলগ্ন চৌবাচ্চায় গা ডুবিয়ে অবগাহন করার ভাবনায় সুখ আছে, তবে সেই সুখ কতজন পেয়েছেন জানা নেই।

পুলকদের বাড়িতে এমন একটি চৌবাচ্চা ছিল। পুকুরে নামতে পুলকের বড্ড ভয়। তাই রোজ স্বপ্ন দেখে, চৌবাচ্চায় ডুব দেবার। তবে ওদের চৌবাচ্চাটি ছিল এজমালি। অর্থাৎ কলঘরের বাইরে যেখানে আড়াল তো নেই, উপরন্তু এক দুই বা তিন তলার বারান্দা থেকে অনায়াসে দেখা যায়। আর দেখা গেলেই শরিকী বিদ্বেষের সানাই বেজে ওঠে। বুকের মধ্যে সেই স্নানটা জমিয়ে রেখে কোন রকমে কলঘরের অন্ধকারে মগ বালতি ব্যবহার করে পুলক।

সেবার পুলকের কাকা কোন এক সাহেবি বাড়ি ভাঙার কাজ পেয়েছিল। সেই বাড়িতে ছিল পেল্লায় এক বাথরুম। আর সেখানে ছিল এক বড়সড় বাথটাব। কাকা কি মনে করে প্রাণে ধরে ওই বস্তুটি বিক্রি করতে পারেননি। আদ্যিকালের ধাতব বাথটাব, না কি বিরাট আকার কড়াই! বাড়ির ছাদে তার অবস্থান হল। পুলক মাঝে মাঝে ছাদে এসে ওকে হাত বোলায়। এর মধ্যে একদিন তুমুল বৃষ্টির দিন। পুলককে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। বন্ধুরা যারা মাঠে বল পেটাচ্ছিল, তারাও ঘরে ফিরে এসেছে। পুরোন বাড়ি, তার দালান কোঠার আনাচ কানাচ ঢুঁড়ে কারা ছাদে এসে উপস্থিত। বৃষ্টির তোড় তখন ঝালাতে। ছাদের ওপর ফোঁটায় ফোঁটায় অজস্র জুঁইয়ের জন্ম হচ্ছে আবার নিভে যাচ্ছে। তার মধ্য সকলে অবাক হয়ে দেখে, অমন জলের ধারায় সেই সাহেবি বাথটাব কানায় কানায় পরিপূর্ণ। আর তাতে আকন্ঠ নিমগ্ন পুলক। যেন কতদিনের স্নান, যা এতদিন ধরে বুকের ভেতর জমিয়ে রেখেছিল। আগল খোলা বাঁধের মতো উছলে উঠছে। তাকে যে কেউ দেখছে, তার কোন হুঁশ নেই। যেন প্রথমবার পুলক নামের সার্থকতা খুঁজে পেল।

এখনও পুলকদের বাড়ি গেলে সেই বাথটাবটা দেখতে পাই। তবে সেটির ভেতর মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। লাগানো আছে লেবুগাছ। তাতে লেবু ধরেছে কতক। বর্ষায় লেবুফুলের থেকে কোন হারানো কৈশোরের তৃপ্ত স্নানের ঘ্রাণ ভেসে আসে।

বুধবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৬

বর্ষশেষের গাল গল্প

নষ্টলয়জ শব্দকে মানুষ ভালোবাসে। অনেকেই রোমন্থনমুলক শব্দসম্ভার লিখে প্রভুত আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। তাঁর পাঠকেরাও হয়তো সে আনন্দের ভাগ পান। সব পাঠক, লেখকের সাথে একই সময় সরণী ভাগ করেছেন, তা নয়। যাঁদের সেই তন্ত্রীতে সাড়া জাগে, তাঁদের ভালোলাগার মাত্রা অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র। কোনভাবে সেই লেখা সার্বজনীন হয়ে ওঠেনা। অন্যদিকে লেখা ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা থেকেও বিরত থাকে। কতকটা দূরে দাঁড়িয়ে, ব্যক্তিগত উপলব্ধির চারন। তা সে, "যার যেমন তার তেমন" গোছের।

ওদিকে বেলা তো বসে থাকে না। সে আসে যায়, আবার আসে। সাথে নতুনকে নিয়ে আসে, গরম শীত, বর্ষা সব। এমন কি তার সাথে পাল্লা থাকে খরা, বন্যা, দূর্বিষহ দূর্ঘটনা। ক্যালেন্ডার এক অসামান্য স্মারক। দিনের মেয়াদী পাতা। উল্টে গেলেই দিন শেষ।

এ নিয়ে বেশ চলে। চৈত্রশেষে সেল রোদ্দুরের সাথে নামতা মাপে। বাস চালক পরনের উর্ধাবাস খুলে রাখে। রাজপথের ধোঁয়া ওঠা পিচে, তার চরনচিহ্ন রেখে যায়। বন্ধ দোকানের গা ঘেঁষে রোঁয়া ওঠা সারমেয় ঝিমোচ্ছে। নগরায়নের তাগিদে গাছেরা চলে গেছে। পড়ে আছে ছায়াহীন অবয়ব। মানুষ, পশু, পাখি সকলেরই খিদে বড় বালাই। তার জন্য ছুটে চলা। দ্বিপ্রহরের দাব উপেক্ষা করে অনেকানেক মানুষ এখনও পথে। কেউ আখের রস খায়, কেউ চা। রঙিন পানীয়র দামি বোতলও হাত ঘুরে যায়। হাত অনুসারে দাম। চাষীর হাত, মজুরের হাত একেক রকম। শিল্পীর হাত? আড়ালই ভালো? সেখানে ধুলো পড়ে না? রঙ ওঠে না? কন্ডাকটারের অপরিসীম ধৈর্য্য আর বিরক্তির সহাবস্থান। "এখানে স্টপেজ নেই।" কার কোথায় থামা দরকার, পুলিশ বা ভগবান কে জানে? সে কথা কে বলবেন? ওদিকে অটো স্ট্যান্ডে মানুষ উঠে বসে আছে, চালক কে পাওয়া যাচ্ছে না। গরমের ত্রাসে সবাই যেন চালকহীন। একজন ছুটে এসে ইস্তাহার ধরিয়ে গেল। ভোটের প্রচার লিপি। পেটের মতো ভোটও বড় বালাই। চোখ বোলাতে কয়েকটি নাম চোখে পড়ে। যাঁরা জীবিত কিনা জানা ছিল না, গত ভোটের পর তো এঁদের দেখা বা শোনা যায়নি। সে যাই হোক, গাড়ি চালক ঘামতে ঘামতে দর্শন দিলেন। এক গাল হেসে বলেন, পান খেতে গিয়েছিলেন। রক্তাক্ত মুখ তাই বলে। পান করতে জাননি, জেনে ভালো লাগে।

সময় গড়িয়ে যায়। ধুলো পথ, জয়বাবা তারকনাথের দেখা দেয়না। চড়কের দল মুখ লুকিয়েছে। বড় মাল্টিপ্লেক্স বাতির রোশনাইতে সর্বস্য ঢেকে যায়। পঞ্জিকা কিনতে দর করতে নেই। ভবিতব্যের কি মূল্য হয়? সে তো এমনি আছে, অমনিও রইল।  তোমার আমার বছরভর প্রাপ্তি। নীল পুজো, অশোক ষষ্ঠী কোনরকমে টিঁকে থাকে। বাঙলার ঘর আদুর হয় ডুবে যাওয়া সূর্যের শেষ রশ্মিতে। সারাদিনের তিক্ততা ঘুরে বসে। সন্তানের শুভ কামনায় জড়ো হয় নতুন বালিশ ও পোশাকের ঘ্রাণ। 

সোমবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৬

গ্রাম শহর বিভাজন

সময় পাল্টেছে খুব দ্রুততায়। আজ গ্রাম আর শহরের সেই বিভাজন আর নেই। টেলিভিশনের দৌলতে প্রত্যেকের অন্দরমহলে পৌঁছে গেছে অত্যাধুনিক সংস্কৃতি বা অপসংস্কৃতির স্বাদ রূপ গন্ধ অতি সহজেই। উপগ্রহ চ্যানেলের উপস্থিতি চোখে পড়ে প্রতিটি বাড়িতেই। এমন কি যাঁরা দিন মজুরি করেন, তাঁদের ঝুপড়িতেও। সব যেন এক ছাঁচে ঢালা। সেই সময় যে মৌলিক বৈশিষ্ট ধরা পড়ত, তা সময়ের ক্ষমতা বলে বড়বেশি এক রঙা। আগে প্রতিটি নগর বা গ্রামের একটা নিজস্ব চরিত্র ছিল। সেই জায়গায় পৌঁছলেই, তা দৃ্শ্যত প্রতীয়মান হত। এখন যে ঘাটেই নোঙর ফেলি না কেন, পরিচিত বহুজাতিকের বিশালাকায় বিজ্ঞাপনের একই মুখ চোখে পড়ে। সে আমার শহর তোমার শহর, বা তোমার গ্রাম আমার গ্রাম সর্বত্র।

সেদিন আমার এক নিমন্ত্রণ ছিল। আমাদের বাড়ির রান্নামাসির নাতির অন্নপ্রাশন। ওদের বাড়ি, শহরাঞ্চলের পরিধি ছাড়িয়ে শহরতলির প্রান্তে। রান্নামাসির ছেলে গাড়ি চালায়, আর স্বামী রিক্সা। ছোট্ট বাড়ি, মাথার ওপর টিনের চাল। পরিপাটি, গুছোনো সংসার। ঘরে টেলিভিশন চলছে। আপ্যায়নে ফাঁক নেই। নিমন্ত্রিতরা বেশিরভাগ শ্রমজীবি মানুষ। লক্ষ্য করলাম, বেশিরভাগ মানুষের পোশাক, অত্যন্ত অধুনিক ছাঁচের। যেমনটি আমরা এখনকার সিনামা, সিরিয়াল বা বিজ্ঞাপনে দেখতে পাই। একটু ফারাক এই যে, পোশাকগুলি হয়তো নামি ব্র্যান্ডের নয়। তবে তার নক্সা এবং সৌন্দর্য্য কোন অংশে কম নয়। মহিলাদের চোখে মুখে প্রসাধন চর্চার প্রভাব সুস্পষ্ট। আমাদের রান্নামাসি, যিনি সম্পর্কে ঠাকুমা হয়েছেন, তিনি নিয়মিত দোকানে গিয়ে রূপচর্চা করেন। আর খুব লাজুকমুখে কবুল করলেন যে, আজকের জন্য তিনি বিশেষ পরিষেবা নিয়েছেন। সে সব মালিশ, চুলের নক্সা বা স্পা সম্পর্কে আমি বা আমার গৃহিনীরও সম্যক ধারনা নেই। পাত পেড়ে খাওয়া, উপহার দেওয়া তো রয়েছেই, সাথে ডিজে মিউজিক সহকারে ডান্স ফ্লোরের ব্যবস্থা। সেখানে নাতি, নাতনি, ছেলে, মেয়ে, বৌমা, আত্মীয়, নিমন্ত্রিত সবার সাথেই আমাদের রান্নামাসি ও তাঁর পরিবার অত্যন্ত সাবলীল। আমার নিজেকে যেন  পিছিয়ে পড়া মানুষ বলে মনে হল, যখন অত্যন্ত আন্তরিক ভাবে নাচের আঙিনায় যাবার অনুরোধ ফেরাতে হয়। কি করব ওই বিদ্যেটা তো তেমন রপ্ত হয়নি।

গৃহকর্ত্রী বেশ কড়া অনুশাসনে রেখেছে বোঝা গেল। এতসব আনন্দ উপাদানে উৎশৃঙ্খলা নজরে আসেনা। মদ্যপানের ব্যবস্থা অন্ততঃ খোলা চোখে পড়েনি। সব মিলিয়ে বেশ উপভোগ্য সন্ধ্যা কাটিয়ে এলাম। মাথার মধ্যে কিছু এলোমেলো চিন্তার বাতাস ঘোরাফেরা করে। এমনটা কি হবার কথা ছিল? না কি আমি বেশি ভাবছি? আমার তথাকথিত উন্নাসিক 'সভ্যতার' নিরিখে এই মানুষগুলো কে প্রত্নউপাদানের মতো, সময়ের ফসিল হিসেবে দেখতে না পেয়ে, কি বিচলিত হচ্ছি? বিদায় নেবার সময়, আমাদের নাচের আঙিনাতে পায়নি বলে বেশ আক্ষেপ শোনা গেল। আমার এ দূর্বলতা কে আমি কি প্রচ্ছন্ন গর্ব মনে করেছিলাম? যা আজ ধ্বসে যাচ্ছে বলে কষ্ট হল? 

ব্লগ এবং বই পাওয়ার ঠিকানাঃ https://souravstory.com

 এখন থেকে ব্লগ সহ অন্যান্য সব খবর এবং বই পাওয়ার ঠিকানাঃ https://souravstory.com