বুধবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৬

বর্ষা দিনে

পশ্চিম পাড়ার ঝাঁকড়া কদম গাছটার নিচে বৃষ্টি অপেক্ষা করত। ছাতা খোলার অবসর নেই, ঝমঝম ঝমঝম। আর যেই বাঁক ঘুরে ব্যাঙ্কে-র মোড় পার হলাম, কোথায় কি? খটখট রোদে চারিদিক ঝকঝকে। অথচ ততক্ষণে অনেকেরেই পোশাকে জলছাপ, জুতো সপসপ। মনের কোণে রেইনি-ডের ইচ্ছের বাতিরা জ্বলতে শুরু করেছে। কিন্তু রেইনি-ডে হত না। স্কুলের খাতায় একটা নিয়ম ছিল, একটা নির্দিষ্ট শতাংশ অনুপস্থিতি হলে, তবেই নাকি রেইনি-ডে দেওয়া যায়। ব্যাস ওইখানেই আমরা মাত। আমাদের প্রায় এক তৃতীয়াংশ ছাত্র আশ্রমে থাকে। তাই বৃষ্টি হোক বা জলোচ্ছাস, তাদের তো স্কুল পৌঁছান আটকায় না, কারণ তারা স্কুলের মধ্যেই থাকে। বিভিন্ন ক্লাসে বাংলা বা ইংরাজিতে রচনা লিখেছি রেইনি-ডে, তবে পুরো স্কুলজীবনে একবারও  বৃষ্টিতে ক্লাস ছুটি হয়নি। আরেকবার তো এমন হল বেশির ভাগ ছেলে ভিজে সপসপে হয়ে এসে, ভাবল বুঝি অন্ততঃ তারা ছুটি পেয়ে যাবে। কয়েকজন তো, নিজে থেকে কলের নিচে দাঁড়িয়ে ভিজিয়ে নিল শরীর। ও বাবা! মহারাজ আশ্রম থেকে প্রত্যেকের জন্য শুকনো পোশাক আনিয়ে দিলেন। আমাদের ছুটি পাওয়ার ইচ্ছেগুলো ভিজে গলে ধুয়ে গেল।


বৃষ্টিদিন নানা অনুষঙ্গে ধরা দিত কৈশোরের দিনগুলোতে। ঝাঁকড়া হয়ে আসা কদমের ডাল আর নাগকেশরের গভীর কেশর সমৃদ্ধ বর্ষাবেলা আমাদের নতুন করে সিক্ত করত প্রতি বছর। টিফিনের সময় কদমের ফুল নিয়ে ফুটবল খেলা। হাতে পায়ে কদমের রেণু লেগে থাকত বুঝি। একদিন ঝপসা হয়ে আসা বৃষ্টিদিনে আপাদমস্তক বর্ষাতিতে ঢেকে চলেছি। পায়ে পায়ে জল ছপছপ। পাশ দিয়ে এক রিক্সা বোঝাই কিশোরীর দল। আমাদের লাগোয়া স্কুল ভবনাথের ছাত্রী সব। আমায় অমন বৃষ্টি-একা দেখে কেমন অকারণ হেসে ওঠে। সময়ের প্রলেপের ওপার থেকে সেই মুখগুলির কোনটাই মনে নেই। তবে রাস্তায় জল মেখে চলা বালককে দেখে কেন অমন হাস্যস্পদ মনে হয়েছিল, জানার উপায় নেই।


প্রত্যেক ক্লাসে বড়বড় নারকেল কাঠির এক জোড়া ঝাঁটা রাখা থাকত। আর পালা করে আমাদের দায়িত্ব পড়ত। সকালে দুজন আর স্কুল ছুটির পর দুজন। বেশ মজাই লাগত। বেঞ্চ সরিয়ে সরিয়ে ঝাঁট দিতে। একটা গুরুদায়িত্ব পড়েছে এমন ভাব। কখনও এদিক ওদিক কিছু ময়লা পরে থাকলে, দায়িত্ব প্রাপ্ত ছাত্রদের তলব করা হত। সেও ছিল বেশ ভয়ের ব্যপার।


ক্রমে আমাদের নিম্ন বুনিয়াদীর সময় ফুরিয়ে আসতে আরম্ভ করল। শুনলাম, আমরা সিক্সে উঠলে অন্য স্কুলে যাবো। সেখানে অন্য মাস্টারমশাই। তাদের সম্পর্কে অনেক রকম গা ছমছমে কথা ভেসে আসত। ‘মাঠের স্কুল’ আর ‘হাই স্কুল’, দুরকম নাম শুনলাম। সেগুলো কেন, কি জন্য বুঝিনি। তবে আমার যেসব সহপাঠীদের অভিভাবকরা, বিশেষ করে মায়েরা নিয়মিত স্কুলে আসতেন, তাঁরা জানতেন। আমায় সেই কোন কালে বাবা স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে গিয়েছিলেন। শুরুতে কয়েকদিন বাবা নিয়ে আসতেন, ক্রমে হাত বদল হয়ে গেল। মনে আছে শঙ্করদা বলে একজন আমায় পৌঁছে দেওয়া নেওয়া করতেন। তাই মাঠের স্কুল না হাইস্কুল, কোনটা আখেরে ভালো হবে, বোঝার উপায় ছিলনা। আজও জানিনা এই দুই স্কুলে ছেলেদের বিভাজনের কি নিয়ম ছিল। আমার ঠাঁই হল, জুনিয়ার হাই স্কুলে। যা মাঠের স্কুল বলে বিখ্যাত। তার কারণ, স্কুল সংলগ্ন বিরাট মাঠ। সেখানে আবার খেলা দেখার জন্য গ্যালারির ব্যবস্থাও আছে। এই মাঠে নাকি জেলার খেলাও হয়। তখনকার দিনের কলকাতা মাঠের বেশ কয়েকজন ফুটবলারের খড়দহ রহড়া অঞ্চলে বাড়ি ছিল। তাঁরা অনেকেই এই মাঠে নিয়মিত অনুশীলন করতেন। ওই বয়সে তারকা ফুটবলারদের দেখতে পাওয়া যেন পরম প্রাপ্তি।


ফুটবলপ্রমী বন্ধুরা মাঠের-স্কুলে এসে যেন প্রাণ পেল। এখন বুঝতে পারি, অমন সুন্দর মাঠওয়ালা স্কুল খুব কম জনের ভাগ্যেই জোটে। ফুটবলের সাথে বৃষ্টির যোগ চিরন্তন। কাদা মাঠে বলের সাথে সড়াৎ করে পিছলে যাওয়া, তারপর আর চিনতে না পারা কে কোন জন। আমার যেন মাঠের গ্যালারিটাই বেশি পছন্দ। ওখানে বসেই খেলা দেখতাম। গোল হলে চিৎকার করে গলা ফাটাতাম, মাঠে খুব কমই নামতাম। একমাত্র যখন ওদের খেলোয়াড় কম পড়ত, টেনে এনে গোলকিপার করে দাঁড় করিয়ে দিত।

গোলপোস্টের সুরক্ষার চেয়ে যেন আমার নিজের লুকিয়ে থাকাটাই বড়। যারা রক্ষণার্ধে দাঁড়িয়ে, তারাই গোল বাঁচানোর যাবতীয় কারসাজি করত। আমি কতকটা সাক্ষীগোপাল হয়ে, পুরো খেলাটা দেখতাম। এমনি করে গোটা জীবনে খানিক দূর থেকে খেলা দেখার একটা অভ্যেস কেমন করে তৈরি হয়ে গেল। সেখানে আমি যেন আমি নই, মাঠে ছুটোছুটি করা কোন তৃতীয় পক্ষ। গ্যালারি তে বসে, নিজেরই খেলা দেখছি। সে আমার থেকে বিযুক্ত হয়ে অন্যকেউ।

ব্লগ এবং বই পাওয়ার ঠিকানাঃ https://souravstory.com

 এখন থেকে ব্লগ সহ অন্যান্য সব খবর এবং বই পাওয়ার ঠিকানাঃ https://souravstory.com