বুধবার, ২৭ জুলাই, ২০১৬

উৎসব

শ্রীরামকৃষ্ণের নামাঙ্কিত স্কুল। পড়াশুনার সাথে সাথে চিনতে শিখলাম স্বামীজী, মা সারদা, ভগনি নিবেদিতা, স্বামী ব্রহ্মানন্দ, লাটু মহারাজ থেকে রামকৃষ্ণানন্দজী আরও মনীষীদের। বাংলা অঙ্ক ইংরাজীর সাথে আরও একটা বিষয় আমাদের আগাগোড়া পড়ানো হত, তা হল ভারতীয় সংস্কৃতি। সেখানে শ্রীরামকৃষ্ণ স্বামীজীর কথা, জীবনীর পাশে পাশে উপনিষদের গল্প, গীতার শ্লোক, শঙ্করাচার্য্যের মোহমুদ্গর ইত্যাদি নানা বিষয় পড়তে হত। কতক বুঝে বা না বুঝে সেই সব কথার কিছু কিছু মনে ভেতর গেঁথে দিয়েছিল, যা পরিণত বয়সে চলার পথে আলো দেখায়। ছেলেবেলায় এই বিষয়টিকে অন্য পড়ার বিষয় হিসেবেই দেখেছি।  আর পাঁচটা স্কুলের থেকে আমাদের স্কুলের পরিবেশ নিঃসন্দেহে আলাদা। গাছগাছালিতে ঘেরা আশ্রমিক তপোবন যেন, গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীরা চতুর্দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কেউ ক্লাশ নেন তো কেউ পুজো করেন, তো কেউ অফিসের দেখাশোনা করেন। আমাদের বেড়ে ওঠা একটা অন্য আবহে। তবে সেখানে খুব বেশি ধর্মচর্চা হয়েছে, বলে কখনও মনে হয়নি। আমাদের মন্দিরে শ্রীরামকৃষ্ণের বিগ্রহের সাথে যীশুর ছবি, কাবার ছবি, বুদ্ধদেবের ছবি একই শ্রদ্ধায় পূজিত হত। আমাদের সাথে কয়েকজন অন্য ধর্মাবলম্বী সহপাঠিও পড়ত। ওই সময় তফাত বোঝার মতো মন ছিল না, বা আমাদের কখনও তফাত বোঝানোও হয়নি। যেমন মনে আছে শিবুদার কথা। নিম্নবুনিয়াদীর সহ প্রধান শিক্ষক। খুব বড় বাড়ির ছেলে। সংসার করেননি। স্কুলের ছেলেদের নিয়েই জীবন কাটালেন। শিবুদা বলতেন, "হয়তো তোদের বাবার ক্ষমতা আছে দামী কাপড়ের জামা কিনে দেবার, কিন্তু আমার আশ্রমের ছেলেদের কে দেবে?" তাই মোটা কাপড়ের পোষাক বরাদ্দ ছিল, আমাদের সকলের জন্যই।

শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মতিথি ফাল্গুন মাসে। ফি বছর ওই দিনটা ঘিরে আমাদের স্কুলে হত এক সপ্তাহব্যপী অনুষ্ঠান। মূল অনুষ্ঠানটা হত আমাদের নিম্নবুনিয়াদী বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে। পুরো মাঠ ঘিরে তৈরি হত প্যান্ডেল। যখন সেই প্যান্ডেল বাঁধার বাঁশ পড়তে আরম্ভ করত, আমাদের মনটা খুশিতে লাফিয়ে উঠত। নির্মীয়মান পান্ডেলের বাঁশ ধরে ঝুল খাওয়া ছিল পরম প্রাপ্তি। আর যারা ছিল আরেকটু ডাকাবুকো, তরতর করে এডাল ওডাল করে মগডালে উঠে যেত। প্রতিদিনের অনুষ্ঠানে একটি করে যাত্রা ছিল বাঁধা। আশ্রমের ছেলেরা একদিন করত, স্যারেরা করতেন একদিন, বাইরের প্রতিষ্ঠিত দলও আসত তাদের পালা নিয়ে। যারা পার্ট করত, অনুষ্ঠানের প্রায় একমাস আগে থেকে তাদের মহড়া চলত। কেমন ভিণগ্রহের প্রাণী বলে মনে হত। গোবিন্দ বলে একটি ছেলের কথা মনে পড়ে। আশ্রমে থাকত। আমাদের শ্রেণীতে পড়লেও, চেহারায় বেশ বড়সড় ছিল। ও একবার বোধহয় হিরণ্যকশিপু বা রাবণ হয়েছিল। টিফিন পিরিয়ডে মাঝে মাঝে চোখের কসরত আর অট্টহাসি সহ সংলাপ বলত। আমি তো চিরকেলে হাঁ-করা। সবকিছুতেই বিষ্ময়ে হতবাক হতাম। বিশেষ করে গোবিন্দকে যখন রাজপোশাকে মঞ্চে দেখলাম, কি বলব, বড় হয়ে ঠিক হিরণ্যকশিপু বা রাবণ হব বলে ঠিক করে ফেলেছিলাম।  দিন্দা স্যার কে মঞ্চে দেখার কৌতুহল ছিল খুব।

এই সপ্তাহটি আমাদের উৎসবের মেজাজ। উৎসব শব্দটি আমাদের বাল্য জীবনে এই অনুষ্ঠান ঘিরে আবর্তিত হত। পরে কথার মধ্যে, কোন বিশেষ আনন্দের অনুষঙ্গেও আমরা উৎসব বা শুধু উৎ শব্দটি ব্যবহার করে আমোদ পেতাম। উৎসব শুরু হত, এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা সহকারে। এই মিছিলে যোগ দেবার জন্য আমাদের সাতসকালে স্কুলে এসে হাজির হতে হত। মিশেনের প্রতিটি বিভাগ থেকে সবাই অংশগ্রহন করত। সে শোভাযাত্রার বহর আর বাহার ছিল দেখবার মতো। আজও একই উদ্দীপনার সাথে শোভাযাত্রা বার হয়। যার মাথাটি প্রায় এক কিলোমিটার এগিয়ে গিয়েছে, অথচ শেষটুকু স্কুল প্রাঙ্গন ছাড়েনি। আমাদের কাজ ছিল, ছোট ছোট প্লাকার্ডে মহাপুরুষদের বাণী লিখে আনা। আর শোভাযাত্রায় সেই প্লাকার্ডটি বয়ে নিয়ে যেতে হত। যারা গান গাইত, তাদের জায়গা হত গানের দলের সাথে। কেউ কেউ স্বামীজী, শ্রীরামকৃষ্ণ, বা রাম লক্ষণ ইত্যাদি বহু মনীষীদের মতো সেজে গুজে রথে চড়ে বসত। তাদের প্রতি শুরুতে প্রচ্ছন্ন ঈর্ষা হত, তবে পরে নিজেদের আনন্দ বিচারে, ওদের জন্য কষ্টই হত। আমরা যেমন খুশি বন্ধুদের সাথে মজা করতে করতে পুরো রাস্তা ঘুরতাম, ওরা বেচারা কাঠের পুতুলটি হয়ে ধরাচূড়া পরে বসে থাকত।

ওই সময়ে খুব বেশি বন্ধুরা গাড়ি চড়ে আসত না। স্কুলের দুটি বড় বাস ছিল, একটি টাটা কোম্পানীর অন্যটি অশোক লেল্যান্ড। যারা বাসে করে যাতায়াত করত, তাদের কাছে ওই বাসের সময়টি ছিল আরেক প্রস্থ আনন্দপীঠ। আমার কখনও সুযোগ হয়নি বাসে চড়ার। পথে যেতে কখনও স্কুলের নামাঙ্কিত বাসগুলোর দেখা পেলে, কেন জানিনা খুব রোমাঞ্চ হত। একটি লাল সাদা রঙ করা গোল মতো গাড়ি চড়ে একটি ছেলেকে আসতে দেখতাম। সম্ভবত ও তখন একাই অমন ব্যক্তিগত গাড়ি চড়ে আসত। আমাদের চেয়ে ছোট। পরে জেনেছি, বিখ্যাত যাত্রাশিল্পী শান্তিগোপালের ছেলে। শান্তিগোপাল কয়েকবার আমাদের উৎসব প্রাঙ্গনে পালাও করেছিলেন। মিলন স্যার গোঁফ কেটে, কোন স্ত্রী চরিত্রে অভিনয় করে ছিলেন। উৎসব শেষে তাঁকে গোঁফ ছাড়া গ্রহন করতে আমাদের বেশ মজা লাগত। বিরাট শোভাযাত্রায় আরেকটি মনে রাখার মত দৃশ্য ছিল, কবিদত্ত স্যারের ছবি তোলা। পুরো শোভাযাত্রাটির বিভিন্ন মুহুর্ত তাঁর ক্যামেরা বন্দী হয়ে থাকত। আর সে জন্য তিনি কখনও রাস্তার পাশে কোন গাছে চড়ছেন কখনওবা কারো বাড়ির ছাদে। শীর্ণকায় মানুষটির এই ছুটে ছুটে জায়গা বদল করাও আমাদের মনের খাতায় চির বন্দী হয়ে রয়েছে। এমন হাতে হাতে তখন ক্যামেরা ছিলনা, তার এই পরিশ্রম করে ছবি তোলার ছবি, কেউ তুলে রাখিনি।

সোমবার, ২৫ জুলাই, ২০১৬

লাস্ট বেঞ্চ

বিরাট বিরাট মাঠ আর বড় বড় আম কাঁঠালের ছায়ায় মোড়া, এক স্বপ্নের প্রাঙ্গনের নাম, স্কুল। সেই সময় ভয় করত। হয়তো এখনও করে। স্কুলে পৌঁছানোর নির্দেশ-লিখন প্রায় তিন চার কিলোমিটার দূরে দূরে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার মোড়ে টাঙানো থাকত। আজও আছে। সেই সময় ছিল ভোরের স্কুল। শুরুতে বাবার হাত ধরে এসেছি। তারপর হাত বদল হতে হতে, একা একা সহজ সাইকেলে। কোন এক কুয়াশা মোড়া শীতের সকালে জীবনের এই অধ্যায়টি শুরু হয়েছিল, কারণ তখন জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর ছিল পড়াশুনার বৎসর। বেশিরভাগ শিশুরই স্কুলে যাওয়ার আগে ও পরে এক উত্তেজনা ও অনীহা তৈরী হয়। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ভোরের আলো আধাঁরিতে যখন প্রথম রাস্তার মোড়ে স্কুলের নাম লেখা বড় নির্দেশ-লিখন চোখে পড়ত, বুকের ভেতর ধড়াস করে উঠত এক অজানা আশঙ্কায়। না জানি আজ আবার কি আছে অপেক্ষায়? ক্রমে ক্রমে স্কুল কাছে আসতে থাকে, আর সেই ধুকপুকানিও বাড়তে থাকে।

সেই সময় শীত আসত মরসুমি ফুলের হাত ধরে। স্কুলের প্রধান ফটক পার করার পর, চোখে ধাঁধা লাগানোর মতো বড় বড় ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকায় আলো হয়ে থাকত। এত আলোতেও কিন্তু মনের সেই ধুকপুকানিটা যেত না। শুরুতে সরাসরি মন্দির প্রাঙ্গন। সেখানে শ্রীরামকৃষ্ণের মর্মর মূর্তি। খুব চট করে একটা প্রণাম ঠুকে স্কুলের পথে পারি। বাঁদিকে সদর আপিস, মঙ্কস কোয়ার্টার, টেলারিং, ডাইনে বিবেকানন্দ হল, রাজকুমার পাঠাগার পার হয়ে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চৌহদ্দি। সেখানে এক দৌড় সমান মাঠ। ঊৎসব মাঠ। সেখানে আশৈশবের ধূলো ছড়ানো। লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে চলার সহজ দিনগুলো। একপাশে প্রাক্ প্রাথমিকের ঘর। উঁকি দিতাম। আমাদের থেকেও ছোট ছোট ছেলেগুলো একরাশ পুতুল সাজানো ঘরে। কখনও ঘুমোনোর ক্লাসও করত। চোখ পিটপিট করে ফাঁকিও দিত। যেমন আমরা ধ্যানের ক্লাস ফাঁকি দিতাম। কেউ কেউ ঢুলেও পড়ত।

আশ্রম আর বাহির। দুটো শব্দ কে যেন দেগে দিল। কালো বোর্ড থেকে মনের ভেতর, সবখানে। একটা বড় সংখ্যার অনাথ শিশুদের আশ্রয়, আমাদের স্কুল, সেটা বোধের ভেতর আসতে সময় লেগেছে। কেন স্কুলের নাম ‘বালকাশ্রম’, সেই সময় অনুধাবনের ক্ষমতা ছিলনা। ক্লাস মনিটর যখনই দুষ্ট ছেলেদের শাসন করেছে, বা কোন খেলাধূলা বা প্রতিযোগিতায় অংশ নেবার সময় হয়েছে, আশ্রম আর বাহির দুটো দল তৈরি হয়ে গেছে। অবচেতনেই আমাদের মনে গেঁথে গেল, আমরা বাহিরের ছেলে আর যারা আশ্রমে থাকে তারা ঘরের ছেলে। ওই বয়সেই আশ্রমের ছেলেদের দৃশ্যতঃ তফাত চোখে পড়ত। পোশাক পরিচ্ছেদ, বইখাতা, পেন্সিল সব কিছুই যেন স্বতন্ত্র। অনেক পরে বুঝেছি আমরা স্কুলের জন্য তৈরি হতাম মায়ের আদরে। ওদের স্কুলে আসার পিছনে সেই যত্নমাখা স্নেহময়ীর হাত থাকত না।

প্রথম স্কুল, প্রথম দিন ব্যক্তি মননে ছাপ রেখে যায়। যদিও বালকাশ্রমের আগে আমার আরেকটি স্কুলের অভিজ্ঞতা ছিল। সে গল্পও অতি চমৎকার। যথা সময় সেই ঝুলি খোলা হবে। রামকৃষ্ণ মিশন বালকাশ্রমের প্রথম দিন, মহারাজ অমরশঙ্করের ঘরে। এক অদ্ভুত দর্শন ঘড়ি। দেয়াল জুড়ে একটি শিশুর মুখ। ঘড়ির কাঁটার সাথে তার চোখ নড়ে, সম্ভবতঃ জিভ নড়ে। সৌম্য দর্শন মহারাজ। প্রথম এমন পোশাক পরা কোন সন্ন্যাসীর সাথে আলাপ হল। আমাদের প্রধান শিক্ষক। তাঁর কক্ষটিতে ছড়িয়ে রয়েছে অনেকগুলি স্বামীজীর ছবি। আজও মনে পড়ে, জিজ্ঞেস করেছিলেন, কতগুলো স্বমীজীর ছবি? গুণে বলেছি, কয়েকটি হয়তো বাদ গিয়েছিল, এখন আর মনে নেই। স্থান হল দ্বিতীয় শ্রেণীর খ বিভাগে। দোতলায় উঠে, লম্বা বারান্দা হয়ে শেষ দিকে। প্রথম ঘরটি ক-বিভাগ, দ্বিতীয়টি খ-বিভাগ। সেদিন ভাস্করও ভর্তি হল। ও বসল গ-বিভাগে। ক্লাস তখন শুরু হয়ে গেছিল। আমি নাকি দেবাশিসের পাশে গিয়ে বসেছিলাম।

সেই সময়কার কয়েকজন শিক্ষককে আজও মনে পড়ে। বিনয় স্যার। খালি পায়ে আসতেন। বয়স্ক, ময়লা সাদামাটা ধুতি পাঞ্জাবী। বোর্ড মোছার জন্য, বোধহয় ডাস্টারের শুধু কাপড় ব্যবহার করতেন। বাংলা পড়াতেন। কি পড়িয়েছিলেন মনে নেই। তবে তাঁর মলিন চেহারার নিরাভরণ বিমর্ষ রূপটি কেন জানিনা চিরস্থায়ী হয়ে রইল। আরেকজন বয়স্ক শিক্ষক ছিলেন, বন্ধুস্যার। নাম জানিনা, এই নামেই পরিচিত ছিলেন। তবে বন্ধুত্বের কোন লেশ উপলব্ধি করতে পারিনি। কোন এক অজগর সাপের, আর ডাইনি বুড়ির ঘরে আটকে রাখার ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর অনুশাসনের ভয় দেখাতেন। মাটির কাজের ক্লাস নিয়েছেন। আর প্রার্থনার সময়, কে কে চোখ খুলে রেখেছে, নিজে চোখখুলে সেই নিয়মভাঙা ছেলেদের পাহারা দিতেন।

রামু আর মলয় দুইজন আশ্রম বালকের সাথে ঘনিষ্ঠতা হয়। রামুর গালে একটা বড় পোড়া দাগ ছিল। খুব ছোটবেলার কোন ভয়ঙ্কর দিনের স্মৃতি চিহ্নরূপে। অনেকে ওকে মুখপোড়াও বলত। আমার শুনতে ভালো লাগত না। ও তো ইচ্ছে করে পোড়ায়নি। আশ্রমের ছেলেরা আমাদের চেয়ে অনেক স্বাবলম্বী। বাবা মা ছাড়া একা একা সব করে। প্রতিদিন স্কুলে আসার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে, পড়া তৈরি করে, বিছানা গোছায় আরো কত কি? গরমের সময় মলয় ছোট ছোট আমের কুশি নিয়ে আসত। আর পিছনের বেঞ্চে বসে ব্লেড দিয়ে সেই আম ছোলা হত। ওদের সাথে নুনও থাকত। সেই নুন সহযোগে কষটে আমের স্বাদ স্বর্গীয় অনুভূতি এনে দিত।

নিম্ন বুনিয়াদী বিদ্যালয়ে এক লহমায় যিনি মন জিতে নিয়েছিলেন, তিনি দিন্দা স্যার। এই নামেই পরিচিত ছিলেন, প্রথম নামটি জানা হয়নি। তাঁর গল্পের ক্লাসে মোহ মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। কপালকুন্ডলা গল্পে, সেই যখন নবকুমার কে ফেলে রেখে, নৌকা চলে গেল। নবকুমার হাঁটু জলে দৌড়ে গিয়ে চিৎকার করে, “মাঝি নৌকা ভিড়াও”, কেউ সাড়া দেয় না। দিন্দা স্যারের সেই ডাক আজও মনের ভেতর ডুবে রয়েছে। ছেলেবেলায় প্রথম বঙ্কিম পড়ার নেশায বীজ খুব সন্তর্পনে বপন করে দিয়েছিলেন। পরে দিন্দা স্যারকে স্কুলের নানা নাটক যাত্রায় অভিনয় করতে দেখেছি। মনে মনে তাঁকে দেখার একটা আলাদা আকাঙ্খা তৈরি হয়েছিল।

অঙ্ক করাতেন শ্রীধর স্যার। এছাড়া পরের ক্লাসে বৈদ্যনাথ স্যার, বা বৃত্তি ক্লাসে গাঙ্গুলি স্যারের কাছেও অঙ্ক করেছি। বৈদ্যনাথ স্যারের কাছে তৃতীয় শ্রেণীতে অঙ্ক করলাম। সে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। আঙুলের ফাঁকে পেন্সিল ঘোরানো, ঝুলপি ধরে উল্টোদিকে টান আর মাটিতে বসিয়ে রাখার শাস্তি। আর সেই অমোঘ বাণী, “খেয়ে পারো, না খেয়ে পারো, ঘুমিয়ে পারো, না ঘুমিয়ে পারো, আমার পড়া চাই”। শুরু হল স্কুলের সাথে নানাবিধ ভয়ের অনুসঙ্গ।

আরও একটি ভয় সেই নয় বৎসরের শিশু মনে গেঁথে গেল। একেবার অন্যরকম ভয়। শিক্ষকের নাম করতে চাই না, কারণ তিনি শিক্ষক। ভয়ে হোক বা ভক্তিতে তাঁর পড়ানো বিষয়ে হঠাৎ করেই ভালো নম্বর পেতে শুরু করি। তিনি মাঝে মাঝে বাড়িতেও আসতেন। নিয়মিত গৃহশিক্ষকরূপে নয়, তবে আসতেন। মনে আছে, ছাদে মাদুর পেতে বসে আছি। নানা কথায় আমার প্যান্টের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিতেন আর বলতেন, “তাড়াতাড়ি বড় হয়ে ওঠ, আমরা বন্ধু হয়ে যাবো”। কেমন লজ্জায় ভয়ে ঘেণ্ণায় সিঁটিয়ে যেতাম। সেই সময় কাউকে বলতে পারিনি। অনেক পরে অন্য বন্ধুদের কাছ থেকেও এক অভিজ্ঞতার কথা জানতে পেরেছি।

ক্রমে স্কুলজীবন এক ভয়জীবনে পরিণত হল। প্রায় প্রতিটি শিক্ষক নিজের নিজের মত করে ভীতিপ্রদ। ক্লাসে বহু স্যারই, চক ডাস্টারের সাথে বেত নিয়ে আসতেন। নিয়মানুবর্তিতা শেখাতে গিয়ে কত যে বেতের বাড়ি, কিল চড়, ঘুঁষি আসেপাশে পড়ছে তার লেখাজোকা নেই। নিজের গায়ে না পড়লেও, সেই শব্দে কাঁটা হয়ে থাকতাম সর্বদা। কি জানি, কোন পান থেকে চুন খসে পড়ল?

ছবি আঁকার ক্লাস নিতেন কবিদত্ত স্যার। স্কুল ছেড়ে আসার অনেক পর তাঁর সাথে অন্য ভাবে আলাপ হয়েছিল, একবার বাড়িতেও গেছিলাম। সারা বাড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে তাঁর শিল্পকীর্তি, আমায় অবাক করেছিল। তবে একটু খ্যাপাটে স্যারটি যেন স্কুলের চৌহদ্দিতে বড় বেমানান ছিলেন। তবে মুগ্ধ হতাম ওনার ছবি আঁকার নৈপুণ্য দেখে। কত অনায়াসে বোর্ড জুড়ে ক্লাস ওয়ার্ক দিতেন। তখন রাস্তার দেওয়াল জুড়ে নানা রকম রাজনৈতিক পোস্টার আঁকা হত। এখনকার মতো ফ্লেক্স নির্ভর ছিলনা। স্টেশন সংলগ্ন একটা দেওয়াল জোড়া বড় ছবি ছিল। একদিন আবিস্কার করলাম আমাদের কবিদত্ত স্যার সেই পোস্টারটি আঁকছেন। খুব উৎকৃষ্ট শিল্পসৃষ্টি হয়তো ছিল না, তবে সেই দিনের পর থেকে স্যার সম্বন্ধে একটু খারাপ ধারনা তৈরি হয়ে গেল। এ বাবা! আমাদের স্যার রাজনৈতিক ছবি আঁকেন? পরে বুঝেছি, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত বিশ্বাসের জায়গা। স্কুল-শিক্ষকের গন্ডীর বাইরের একটা পরিচিতি।

এমনি করে নানা মানুষ নানা ভাবে ছাপ ফেলে যেতে লাগলেন, আমাদের জীবনে। নীলমণি স্যার, প্রণয় স্যার, পাল স্যার। গানের স্যার ছিলেন দুজন। অত্যন্ত সুন্দর ভাষায় আমাদের রচনা লিখিয়ে মুখস্থ করাতেন নীলমণি স্যার। বিশেষ করে সেই সময় মুখস্থ করা শরৎকালের কথা হয়তো আজও মগজের কুলুঙ্গীতে পাওয়া যাবে। তবে মজার ব্যাপার হল, কিছুদিন পর, আবিস্কার করলাম যে, ওনার ওই লেখাগুলো উঁচুক্লাসের একটা বই থেকে হুবহু অনুকরণ করা। যে স্যারকে তাঁর জ্ঞান আর ভাষার পরিধির জন্য একটা বিশেষ আসনে বসিয়েছিলাম, খুব সহজেই তিনি হয়ে গেলেন অত্যন্ত সাধারন।

তৃতীয় শেণীর ক্লাস হত, একটা টিনের শেড ওয়ালা টানা বারান্দার বাড়িতে। বৃষ্টির সময়, টিনের চালে এক অলৌকিক শব্দ হত। আজও সেই ঝমঝম শব্দ কানে লেগে আছে। তার এক পাশে ছিল পাল স্যারের ঘর। রোগা শ্যাম বর্ণ মানুষটি কি পড়াতেন মনে নেই, তবে ক্লাসে আসতেন বোগনভেলিয়ার কাঁটাযুক্ত ডাল ভেঙে। এই বোগনভেলিয়া গাছটি ছিল বারান্দার সিঁড়ির পাশে। টিফিনের সময়, দেবাশিসের সাথে এই গাছের নিচে বসে টিফিন খেতাম। একবার মনে আছে, দেবাশিস ওর পায়ে স্কেলের দাগ দেখায়। বাড়িতে বাবার কাছে মার খাওয়ার অভিজ্ঞতা শোনায়। সময়টা কেমন অদ্ভুত ছিল। স্কুলে, বাড়িতে মার খেতে খেতে আমরা মানুষ হবার চেষ্টা করতাম। পরিণতি কতটা ফলপ্রসু হয়েছে, কে জানে? এই তৃতীয় শ্রেণীতে আরেকটি বন্ধুর কথা মনে পড়ে, নাম কৃষ্ণগোপাল। ভালো অঙ্ক করতে পারত। কিন্তু অনেকদিন স্কুলে আসতে পারত না, অসুস্থতার জন্য। ক্রমে পিছিয়ে পড়তে লাগল। বহু অঙ্ক করা বাকি থেকে গেল। ওর কি হয়েছিল বুঝতাম না। একবার এলো, অনেক মোটা আর ফ্যাকাশে হয়ে। তারপর আর এল না। একদিন হঠাৎ স্কুল ছুটি হয়ে গেল, কৃষ্ণ নাকি আর নেই। খুব খারাপ লেগেছে। বেঞ্চে আমার পাশেই বসতো। এখন ফাঁকা হয়ে গেল।

প্রণয় স্যার আমায় নাম দিয়েছিলেন মাংসরুটি। কেন জানিনা, হয়তো টিফিনে মাংস রুটি নিয়ে যাবার জন্য। যদিও সে সুযোগ তখন ছিলনা। বাড়িতে আশ্রিত আত্মীয় নিয়ে অনেক ভীড়, তাদের সামলে মানির পক্ষে রুটি তরকারির বেশি কিছু দেবার সম্ভবনা ক্ষীণ। সব বিভাগের ভালো ছেলেদের নিয়ে একটা আলাদা বিভাগ তৈরি হয়, বৃত্তি পরীক্ষার জন্য। কিভাবে আমি সেই বিভাগে বসার সুযোগ পেয়ে গেলাম। অনেকগুলো নতুন বন্ধুদের সাথে আলাপ হল। পরবর্তিকালে বুঝেছি, এই বন্ধুরা ছিল স্কুলের প্রথম সারির ছাত্র।

স্কুল প্রাঙ্গনে ছিল একটা বড় সিমেন্ট নির্মিত স্লীপ আর লোহার বড় ঘূর্ণী। ক্লাসের ফাঁকে সেই দুটি খেলার অবলম্বন নিয়ে আমাদের হুড়োহুড়ির শেষ ছিলনা। সিমেন্টের স্লীপ চড়ে চড়ে বহু ছেলেদের প্যান্টের পিছনে ফেঁসে গিয়েছিল। আমারও হয়েছিল। তবে সেটা যখন বুঝলাম, তখন থেকে আর চড়তাম না। এক বছরের মধ্যে বারবার বাবার পক্ষে প্যান্টের যোগান দেওয়া সম্ভব ছিলনা। মানি ওই প্যান্টটাই রিফু করে দিয়েছিলেন, সেই বছরটা মেরামত করা প্যান্ট পরেই চালাতে হয়েছিল।

বৃহস্পতিবার, ১৪ জুলাই, ২০১৬

দেরাজের ঘ্রাণ


আজ পুরোণ দেরাজ খুলে বসেছে গোবি। অনেকদিনকার না-ছোঁয়া কাগজপত্র ঘেঁটে দেখতে, মাঝে মাঝে মন্দ লাগে না। কেমন অন্য কারো গোপন তথ্যের মতো মনে হয়। এসব কাগজ তার নিজের সাথে সম্পর্কিত, আজ ভাবতেও কেমন লাগে। ছোট ছোট চিরকুট, বেশিরভাগ বাজারের ফর্দ। বাড়ির বাজার, আসেপাশের মানুষের চাহিদা। সময় অসময় গোবি ছাড়া তাদের আর কেইবা আছে? “গোবি একটু বাজারে যাবি বাবা?”, “গোবি ফাঁকা আছিস? একটু লন্ড্রিতে যেতে হত, শাড়িটা পালিশ করতে দেওয়া ছিল”। “গোবি দৌড়ে যা তো, নুন ফুরিয়ে গেছে”। এমন সব নানা অনুরোধ, উপরোধ, আদেশ। গোবির ভালোই লাগে। কত মানুষের কাজে আসছে, এটাও তো একটা কাজ, ব্রত বা সমাজসেবা, সে যাই নাম দেওয়া যাক।

চারিদিকে টুকরো কাগজ ছড়িয়ে তার মাঝখানে বসে ছিল। খুব হাবভাব, যেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত। আসলে সে সব কিছু নয়, পুরোণ সময়কে একটু ধরতে, হাতে নিয়ে নাড়তে চাড়তে ভালো লাগে। এই চিরকুট লেখকদের মধ্যে কয়েকজন মানুষ আছেন, যারা আর পৃথিবীতেই নেই। যেমন বোস বাড়ির রতন কাকা। গত বছর শীতে চলে গেলেন। আছেন বিন্দির ঠাকুমা। ফর্দতে বড়ি, কাসুন্দী, কালোজিরে আর হিঙ আনতে দিয়েছিলেন।

রতন কাকাদের বড় এজমালি বাড়ি। পুকুর বাগান। একসময় অনেক আয়-যায় ছিল। এখন লোকজন নেই। থাকার মধ্যে রতন কাকা, তার বিধবা দিদি, আর বাড়ির পুরোণ চাকর বংশী। সেদিন সকালে গোবি গিয়েছিল ওদের বাড়িতে খবরের কাগজ পড়তে। এমনি কোন মতে দিন গুজরান হয়, তবে তিনটে খবরের কাগজ রাখে। পাঁচিল ঘেরা চৌহদ্দি। জায়গায় জায়গায় ধসে গেছে। প্রায় দেড়শো বছরের তিন মহলা বাড়ি। বার দালান পেরিয়ে ভেতরে অন্দরমহল। বাড়ির বাইরে একটা পুকুর, আবার খিড়কী দুয়োরে আরেকটা। পিছনেরটা মূলতঃ বৌ-ঝিদের জন্য। চারিদিকে বড় বড় গাছের ছায়া। পুকুরের ঘাটে আবার একটা পাথরে নাম লেখা, পম্পা। রতনকাকা কে একবার গোবি জিগেস করেছিল, পম্পা কার নাম কাকা। কাকা হেসে জবাব দেন, “কোন মানুষের নাম নয়রে, পম্পা ওই পুকুরটার নাম। স্বর্গের পুকুরের নামও পম্পা”। গোবি ঘাড় নাড়ে, ভাবে তাহলে বাইরের পুকুরেরও একটা নাম হবে। জিজ্ঞেস করলে, রতন কাকা উত্তর করেন, “ওটা পুকুর নাকি? ওটাতে পাট জাঁক দেওয়া হত। এখন তো সে সব নেই, তাই ওভাবেই পড়ে আছে”। তবে শুধু শুধু ফেলে রাখার মানুষ নন, রতন কাকা। পুকুরে মাছ চাষ করান। সনাতন জেলে কে লিজ দেওয়া আছে। সনাতন নিজের নিয়মে আসে ভোর ভোর মাছেদের চারা ছেড়ে যায়। সপ্তায় একদিন করে পুকুরে নাড়াচাড়া দিয়ে দেখে, মাছেরা বাড়ছে কেমন। তারপর সময় হলে লোকলস্কর এনে জাল ফেলে মাছ তোলে। সে বাবাদ রতনকাকাদের প্রাপ্য টাকা আর কিছু মাছ ভেট করে যায়। সেদিন এমনি ছিল। গোবি ভেতর দালানে খবরের কাগজে মুখ গুঁজে আছে, একটা বেড়াল পায়ের কাছে চিৎপাত হয়ে ঘুমাচ্ছে। বুড়ি পিসি রান্না ঘরের পাট চুকিয়ে নিজের ঘরের ভেতর সেঁধিয়ে গেছে। বংশীকেও কাছে পিঠে দেখা যাচ্ছেনা। এত বড় বাড়ির বেশিভাগ ঘরেই তালা দেওয়া। এক ফালি রোদ এসে উঠানে এসে পড়েছে। যেন কোথাও আর যাওয়ার নেই। এখানে এসেই সময় স্থির হয়ে গিয়েছে। এবাড়িতে ঢোকার সময় দেখেছে পুকুর ধারে, মাদার গাছের নিচে একটা মোড়া পেতে রতন কাকা সনাতনের কাজ তদারক করছে। আজ সনাতন বোধহয় কিছু চারা ছেড়েছে। পুকুরে নেমে জলের মেরামত করতে গিয়ে পাকা জেলেরা এক আধটা মাছ ধরে নিজেদের গামছা বা কোমরের গেঁজে লুকিয়ে ফেলে। বিরাট কিছু নয়, ও সব নিয়ে কেউ তেমন ভাবে না। তবে রতন কাকা শুদ্ধাচারী মানুষ, চরিত্রের গোলমাল সহ্য করতে পারেন না। গোবি হঠাৎ শোনে বাইরে থেকে তার নাম ধরে রতনকাকা চিৎকার করে ডাকছে। আওয়াজ শুনে বেড়ালটা ধড়মড় করে উঠে পালাল। গোবি কাগজ ফেলে দৌড়ে বাইরে আসে। দেখে সনাতন হাত জোর করে কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আর রতন কাকা ডান হাতের আঙুল তুলে কি সব দেখাচ্ছে। বংশীও হাতের

কাজ রেখে ছুটে এসেছে। গোবি পৌঁছাতেই, রতন কাকা বলে উঠল,
- গোবি তুমি এখুনি পুলিশে খবর দাও, বংশী তুমি এখনি ওর হাত থেকে জাল কেড়ে নাও।
- কেন কি হয়েছে?
- কি হয়েছে? দেখ দেখ আমার সমস্ত মাছ চুরি করে নিয়েছে

গোবি তাকিয়ে দেখে, তিন চারটে বিঘৎ মাপের রুইমাছের বাচ্চা সনাতনের পায়ের কাছে পড়ে আছে। সনাতন হাত জোড় করে বলছে, “বাবু দুশোগ্রাম ওজনও হবে না”।
- ওজনের প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে? আমি কি বাজারের মাছওয়ালা? গোবি, বংশী ওকে এই মাদার গাছের সাথে বাঁধো।

গোবি আতান্তরে পরে। সনাতনের দশাসই নৌকা টানা শরীর, ওর সাথে পারবে কি করে? শেষে, রতন কাকার কথা মানতে গিয়ে নিজের হাড়গোড় ভাঙে আর কি? গোবিকে এগোতে না দেখে, রতনকাকা আরো রেগে যায়,
- এরা কেমন পেয়ে বসেছে, দিনে দুপুরে ডাকাতি? আমি তাই ভাবি প্রতিবার এত মাছ ছাড়া হয়, সব যায় কোথায়? এখন বোঝা যাচ্ছে, এই মালই সব হাতিয়ে নিয়েছে। কি ধরিবাজ! বাপরে!
সনাতন মিন মিন করে কিছু বলার চেষ্টা করে, রতনকাকা সেসব কানেই তুলল না। শেষমেষ জালটাল ফেলে সনাতন হঠাৎ করেই দৌড় মারে। জানে কদিন পর রতনকাকা এমনি ঠান্ডা হয়ে যাবে। তখন, হয়তো নিজে রতনের বাড়িতে জাল পৌঁছে দিয়ে আসবে।

রতনকাকার চিরকুটে লেখা ছিল, পাঁচ কিলো সরষের খোল, দুইগোছ বাংলাপাতা পান, একশো গ্রাম সুপুরী আর আড়াইশো বাতাসা।  মানুষটা চলে গেছে, তবু তার হাতে লেখা সামান্য কটা অক্ষর গোবি যত্ন করে তুলে রাখে। বন্ধ দেরাজের ঘ্রাণ একমুহুর্তে তাকে নিয়ে যায় কোন এক অপার্থিব আবহাওয়ায়।

মঙ্গলবার, ১২ জুলাই, ২০১৬

পথকথা-৭

মোর্তাজা সাহেব সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে স্থির হয়ে বসে। প্রত্যেকের শুভ্র পোশাক, গোছানো দাড়ি, মাথায় সুদৃশ তাজ। প্লেন নড়তে আরম্ভ করলে হাত জড়ো করে দুচার ছত্র আয়াৎ কবুল করিয়ে নেয়। হাজার মাইল আকাশ পথে পারি, কতরকম বিপদ আপদ হতে পারে। মুর্শেদ ছাড়া কার ওপরইবা এমন অখন্ড ভরসা রাখা যায়? কিন্তু একটু আধটু নড়ে উড়োজাহাজ আবার স্থির হয়ে গেল। কাপ্তেন সাহেব ঘোষনা করলেন, জমি-কর্মচারীর বিশেষ সাহায্য লাগবে। তাদের কাছে সাহায্য চাওয়া হয়েছে। আশা করা যায়, আগামী পনেরো মিনিটে সাহায্য এসে পৌঁছবে, তারপর ছাড়বে। সকলে বেশ আবার একটু ঢিলা হয়ে বসে। এমনি করে পনের মিনিট, তিরিশ মিনিট, এক ঘন্টা পার হয়ে গেল অবস্থার কোন পরিবর্তন হল না। সকলে উশখুশ করছে। আর কোন ঘোষনাও নেই। বিমান সেবিকাদেরও আর ধারে কাছে দেখা যাচ্ছে না। মোর্তাজা সাহেবের পাশের সিটগুলো ফাঁকা ছিল। তিনি সেইগুলো জুড়ে শুয়ে পড়লেন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে মৃদু মৃদু নাসিকাধ্বনি জানান দিল, তাঁর নিদ্রা অবতীর্ণ। তা হবে নাই বা কেন? রাত তো কম হল না। এই আন্তর্জাতিক উড়ানগুলো রাত করেই ছাড়ে। আজ তো আরো দেরী করছে, ওদিকে পরের বিমান ছুটে না যায়। বিসমিল্লা বলে হজের পথে পাড়ি দিয়েছেন। দলের অন্য সদস্যরা নতুন। শুধু তাই নয়, বাকিরা এই প্রথমবার বিমানে চড়ছেন। মোর্তাজা সাহেব আগে একবার ঘুরে এসেছেন। তাই প্রত্যাশিত ভাবে তিনিই এই দলের নায়ক। প্রায় আরো আধ ঘন্টা কাটল। হঠাৎ মোর্তাজা সাহেব ধরমড় করে উঠে বসলেন, হয়তো স্বপ্ন টপ্ন কিছু। জেগে উঠে দেখেন, গাড়ি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। এবারে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তার কারণ স্বাভাবিক, ওদিকে দুবাই থেকে সৌদি যাবার নির্দিষ্ট প্লেন ছেড়ে যাবে। শুনে বাকিরা অত্যন্ত দুশ্চিন্তায় পড়েন। তবে কি হবে? মোর্তাজা সাহেব আশ্বস্ত করেন, বিমান কোম্পানি পরের ফ্লাইটের ব্যবস্থা করে দেবে, চিন্তার কিছু নেই। নিজের সিটে উঠে বসে, সুন্দর মেহেদি করা দাড়ি আঁচড়িয়ে নিলেন। তারপর সাগরেদকে হুকুম করেন খানা লাগাতে। সাগরেদ এদিক ওদিক তাকায়, প্লেনে কি এমন ট্রেনের মতো নিয়ম আছে? যদি কোন গুনাহ হয়ে যায়। মোর্তাজা সাহেবের ক্ষুধা পেয়েছে, তাই তিনি খেতেই চান। আবশেষে টিফিন কৌটের ঢাকনা খোলা হল। উফ, অপরূপ বিরিয়ানির খোশবাই সারা উড়োজাহাজ ছড়িয়ে পড়ল। সাথে রেজালার হাল্কা আভিজত্য মাখা ঘ্রাণ। খাওয়ার মধ্যেই বাইরে ব্যস্ততা বোঝা যায়। প্লেনটিকে ঠেলে পিছনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। খুব বেশি নয়, হাত দশেক পিছোনোর পর, জমির গাড়িগুলো রানওয়ে ছেড়ে চলে গেল। এবার উড়োজাহাজ গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। নির্দিষ্ট সময়ের দু-ঘন্টা পর, প্রায় সাড়ে আটশো যাত্রীকে নিয়ে টুক করে আকাশে উঠে পড়ে। মোর্তাজা সাহেবের দল আরেকবার সমস্বরে বিসমিল্লাহ ই-রহমান ই-রহিম বলে দোয়া প্রার্থনা করে। নিচে পড়ে থাকে রাতের কলকাতা শহর, ঝপঝপ করে আলোগুলো ছোট হতে হতে মিলিয়ে যায়। মেঘেদের পেরিয়ে আরো ওপরে উঠে যায় ধাতব পাখি।   
 
একটা অপরিণত আলো ভাঙচুর হয়ে ছুঁয়ে যায়। কিছুতে বোঝা যায়না তার অস্তিত্বর অবয়ব কোথায়। চারিদিক কেমন সুসজ্জিত, বেশ লাগে! কেমন সুচারু পোশাক, পাটভাঙা স্যুট, মার্জিত নেকটাই! এসবের মধ্যেও একটা হেরে যাওয়া, ভয় পাওয়া অনুভব, যেখানে পা ফেলার অবলম্বন নেই। নেই মানে কখনওই যেন ছিলনা। এই যে এত আলো, এসব বানিয়ে তোলা আলেয়া। এত উচ্চকিত জগতে নিজের রঙের উদ্ভাস কতোটা এবং কোথায়? খুব সচেতন ভাবে ঠেলে দেওয়া মুহুর্ত, তারা সব কোথায় গেল? কখনও কাউকে জায়গা ছেড়ে দেওয়া হয়না। অধিকার করতে একটু লড়াই। যেমন সেকালের ক্রীতদাসেরা করেছে। মানুষে-মানুষে বা মানুষে-জানোয়ারে। কালের চলন বড় নির্মম। সেই ক্ষণগুলো অনায়াসে ঝুলি থেকে বার করে আনে। এই সময়ের গন্ডীতেও বকলেসের ঝুমঝুমি শোনা যায়। অলক্ষ্যে সেই বাজনা বাজে, দামী ডিজাইনার নেকটাইএর ভেতর, সোনার কাফলিংএর অন্দরে। এখানেও লড়াই চলতে থাকে। আর গ্যালারির অলিন্দ জুড়ে দর্শক বসে থাকে। প্রতিটা চাল মেপে নিচ্ছে। সরাসরি বাহবা না দিলেও, অতি সচতনতায় গুণে নিচ্ছে এগিয়ে বা পিছিয়ে যাওয়ার পরিমাপ। সেখানে আমি তুমির তুচ্ছতা ছাপিয়ে ওঠে, না-থাকা বা না-হয়ে ওঠার বোধ, যেখানে মাটির আলপনায় শুধু ঘাস নয়, থাকে রক্ত আর প্রতিহিংসার পান্ডুলিপি।



মার্থা ফিরছেন ছেলেমেয়েকে নিয়ে। দুবাইএ ওদের বাবা কাজ করেন। ভ্যাকেশান কাটাতে বাচ্চাদের সাথে কিছুদিন। ছুটির ছুটোছুটিতে ক্লান্তি আসে, বিশেষ করে ছুটি যখন ফুরিয়ে যায়। দুবাই থেকে ওয়াশিংটন ডিসি। লম্বা পথ। মধ্যে দুটি দুরন্ত শিশুকে নিয়ে মার্থা যে কি করে পৌঁছবে, সেই চিন্তাই সমানে ঘুরছে। ছেলেমেয়ে দুটির বয়স তিন থেকে পাঁচ। ছেলেটি বড়। দুজনের দৌরাত্মি এর মধ্যেই বিমানের এই অংশের যাত্রীরা টের পেয়ে গেছেন। খানিক পর পরই নানা বিষয় নিয়ে দুই ভাইবোনে খুনসুটি। দূর থেকে দেখে আনন্দ পেলেও, মার্থার যে কি যাচ্ছে, তা সেই-ই জানে। বিমান সেবিকারা ঘুরে ঘুরে নজরদারি করছেন, কার কি লাগবে। বাচ্চাদের খুশি করার জন্য নানা রকম পুতুলের সম্ভার এনে উপস্থিত। মার্থার ছেলে মেয়েরাও পেল। তবে সবাই যখন ঘুমোবার উদ্যোগ করছে, ওদের তখন চিল চিৎকার। লজ্জায় মাটিতে মিশে যাবা জোগাড়। মাথা ঠান্ডা রাখে। তিনটে পাশাপাশি সিটের, এপাশ ওপাশ কোন খালি সিটও নেই। বোঝাই যাচ্ছে পুরো গাড়ি ভরপুর। কোন রকমে বাচ্চাদের লম্বা করিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করে। এত অল্প পরিসরে কি আর শোয়া যায়! ওদের চেঁচামেচিতে এক বিমানসেবিকা চকোলেট নিয়ে আসে। মার্থা খুব নিরুপায় মুখ করে নেয় আর বলে, “আর দিও না। ওরা এতে আরো পেয়ে বসবে”। ক্লান্তি বড় বিষম দায়। হাজার চেঁচামেচিতেও এক সময় ঘুম ঠিক এসে যায়। দেখা গেল দুই বাচ্চাকে ধরে মার্থাও গভীর ঘুমে মগ্ন। এক সময় একজন বিমান সেবিকা এসে পরম যত্নে একটা চাদর দিয়ে ঢেকে দেয় তিনজন কে। ক্রমে আটলান্টিক পার হয়ে, উড়োজাহাজ ওয়াশিংটন পৌঁছয়। খুব বড় এয়ারপোর্ট তবে চেহারায় তেমন দম্ভ নেই। কেমন খালি খালি এক গ্রাম্য সরলতা নিয়ে দাঁড়িয়ে। মার্থা তখন মাল তোলার বেল্ট থেকে গুণে গুণে সাত সাতটা ঢাউস স্যুটকেস তুলছে। ছেলে মেয়েদুটি সারারাত কাটিয়ে আবার তরতাজা। আগের মতোই খুনসুটি চলে। একে সামলাতে গিয়ে অন্যজন ফস্কে যায়। কোনক্রমে সব কিছু গুছিয়ে যখন কাস্টমসের লাইনে দাঁড়ায়, দেখা গেল সারা পথ ছড়াতে ছড়াতে এসেছে, পুতুলের ছোট্ট ছোট্ট ঘর বাড়ি, কাপ ডিস, চামচ, ঘর গেরস্থালির নানা উপকরণ। সেই দেখে মায়ের মাথায় হাত। ট্রলির উপর সাতটা স্যুটকেস, তার ওপর দুটো বাচ্চাকে জড়ো করে, সে আবার চলল পিছন দিকে, একে একে সবকটি খেলনা কুড়িয়ে আনার জন্য। কষ্ট হলেও, এগুলে ফেলে যেতে একেবারেই মন চায়না। দুবাই থেকে ওদের বাবা শখ করে কিনে দিল। অন্ততঃ বাড়ি অবধি চলুক। এমনি করে সব কুড়িয়ে নিতে নিতেই দিন চলে যায়। কতক থাকে, কতক সঙ্গে চলে। সেও আবার কিছুদিন পর আপনা থেকেই পুরাণো হয়ে যায়। প্রয়োজনীয়তা হারায়। এমন একটা কিছু যে আদৌ ছিল, কারও আর মনেই পড়েনা। 

ব্লগ এবং বই পাওয়ার ঠিকানাঃ https://souravstory.com

 এখন থেকে ব্লগ সহ অন্যান্য সব খবর এবং বই পাওয়ার ঠিকানাঃ https://souravstory.com