[সকলকে জানাই নতুন বছরের শুভেচ্ছা। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন।
নিচের গল্পটি ঢাকা থেকে শ্রদ্ধেয় রতন সিদ্দীকি সম্পাদিত “আমাদের সম্প্রীতি” পত্রিকায়, জানুয়ারি ২০১৮তে প্রকাশিত।]
ভোরের দিকে ঘুম ভাঙে তমালের। কোথাও যেন পাখি ডাকছে। বড় বড় গাছের ছাউনিতে ঢাকা পথ। স্বাস্থ্য সচেতন মানুষেরা প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছে। তমালের ভালো লাগে। ইঁট কাঠের এই শহরে যেন একটুকরো সবুজ দ্বীপ। গোকুল আবাসন।
কর্মসুত্রে পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে বেড়ানোর সুযোগ হলেও, তমাল হাসানের কোলকাতায় আসা হয়নি। কোম্পানির নতুন প্রজেক্টের জন্য এখন তমালকে কোলকাতায় থাকতে হবে। প্রথম যখন খবরটা পায়, একটা অন্য রকম অনুভূতি হয়। সেটা ঠিক সুখের না দুঃখের বুঝতে পারেনা। ইতিহাসের পাতায় কোলকাতা আর ঢাকার এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। তমালের দাদাজান কোলকাতায় থাকতেন। বিভাজনের পরে সেই সংসারের সবাই ঢাকায় চলে আসেননি। তমাল নিশ্চিত জানে, খুঁজলে পরে এখনও অনেক জ্ঞাতিকে কোলকাতায় পাবে। সময়ের পথ বেয়ে, অত্যন্ত আপনার সম্পর্কের টান আজ শিথিল, অচেনা। ঢাকা কেন্দ্রিক বড় হয়ে ওঠা, তমালের কোলকাতা নিয়ে কোন আলাদা স্মৃতি নেই।
কোলকাতায় পৌঁছে কোম্পানি তাকে দুই সপ্তাহের জন্য গেস্ট হাউজের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এই দুই সপ্তাহের মধ্যে ওকে নিজের আস্তানা খুঁজে নিতে হবে। আপিসের কাছেই এই আবাসন, নাম গোকুল। শহরের অভিজাত এলাকায় এক বিশাল আবাসন। সেখানে দুটো ফ্ল্যাট নিয়ে কোম্পানির নিজস্ব গেস্ট হাউজ। তার লাগোয়া তমালের আপিস। এত কাছে যে, পায়ে হেঁটেই যাতায়াত করতে পারে। প্রথম কটা দিন এই আবাসনে কাটিয়ে তার এতটা ভালো লাগে যে, এই আবাসনেই একটা ফ্ল্যাট ভাড়ার কথা চিন্তা করে।
গোকুলের একটা নিজস্ব ওয়েবসাইট আছে। সেখানে প্রতিটি ফ্ল্যাটের নিজস্ব বিবরণ আছে। ফ্ল্যাটের মালিক চাইলে, ওখানে নিজের ফ্ল্যাটের ভাড়া দেওয়ার বিজ্ঞপ্তিও দিতে পারেন। আপিস থেকে ফিরে তমাল আলগোছে এমন সব বিজ্ঞপ্তিগুলো নজর করছিল। হঠাৎই চোখে পড়ে জাস্টিস প্রণবানন্দ গোস্বামীর একটি বার্তা। তিনি ত্রিপুরা থাকেন, বর্তমানে তাঁর ফ্ল্যাটটি খালি পড়ে আছে। কেউ যদি তাঁর ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিতে চান, তারই ঘোষনা। নম্বর দেখে বুঝতে পারে, দক্ষিণ দিকে লেকের ধারের পঁচিশ তলায় এই ফ্ল্যাটের অবস্থান। এই আবাসনের সবচেয়ে ভালো জায়গা। পছন্দ হওয়া মাত্র, প্রণবানন্দকে একটা ইমেল করে নিজের ইচ্ছা প্রকাশ করে।
পরদিন আপিসে থাকার সময়, গোকুল থেকে ফোন আসে। আবাসিকদের পরিচালন সভা থেকে কেউ একজন ফোন করে তমালের সাথে কথা বলতে চায়। আপিস থেকে ফিরে পরিচ্ছন্ন হয়ে তমাল আবাসিক পরিচালন সভার আপিসে উপস্থিত হয়। প্রকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় বলে একজন বয়স্ক মানুষ তমালকে নিজের পরিচয় দেন। তিনিই তমালকে ফোন করেছিলেন জাস্টিস গোস্বামীর ফ্ল্যাটের ব্যাপারে। প্রকাশ বাবুর মোটাসোটা চেহারা, গৌরবর্ণ। দেখলে মনে হয়, ভরসা করা যায়। তমাল প্রায় ছয়ফুট লম্বা, পেটানো চেহারা, দাড়িগোঁফ কামানো মসৃণ গাল, চোখে মুখে বুদ্ধির দীপ্তি। প্রাথমিক সৌজন্য বিনিময়ের পর প্রকাশ জিজ্ঞেস করেন,
- আপনি কি জাস্টিস গোস্বামীর পরিচিত?
- না, আপনাদের ওয়েবসাইট থেকেই ওনার খোঁজ পেলাম।
- দেখুন আমাদের আবাসনে কিছু নিয়ম কানুন আছে।
- হ্যাঁ বলুন।
- আমরা চাইলেই বাইরের কাউকে ভাড়া দিতে পারি না। আবসিক পরিচালন সমিতিতে নতুন ভাড়াটের সমন্ধে সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। আর তা সন্তোষজনক হলে তবেই ভাড়া দেওয়া হয়।
- এ তো খুব ভালো নিয়ম। আপনি বলুন কি কি জানতে চান?
- যেমন আপনার নাম ঠিকানা কর্মস্থল ইত্যাদি।
তমাল নিজের সম্পর্কে বলে আর লক্ষ্য করে প্রকাশবাবুর কপালে কুঞ্চনের রেখা। “আপনি বাংলাদেশী?”
- আজ্ঞে হ্যাঁ।
- আমি ভাবলাম আপনি বাঙালী। এখানে কেউ আপনাকে চেনে?
- চেনে মানে, আমি তো আপিসের কাজে এসেছি। আপিস থেকে তো আমায় এখানেই রেখেছে।
- দেখুন আপিসের গেস্ট হাউজে যতক্ষণ আছেন, ততক্ষণ দায়িত্ব আপনার আপিসের। কিন্তু যখন আপনি নিজে থাকতে চাইবেন, তখন আপনার পরিচিতের কাউকে গ্যারেন্টার হতে হবে। বিশেষ করে ল্যান্ডলর্ড জাস্টিস গোস্বামীও আপনাকে চেনেন না।
- আমি তো শহরে নতুন। আমার পাসপোর্ট দেখতে পারেন, আপিসেও খোঁজ নিতে পারেন।
প্রকাশ বাবু হেসে বলেন, “আসলে, বুঝতেই পারছেন দিনক্ষণ ভালো নয়। পাসপোর্ট জাল হতে আর কতসময় লাগে? কাগজ খুললেই রাশি রাশি খবর”।
- তবে আমায় কি করতে হবে?
- ওই তো বললাম, কাউকে একটা খুঁজে বার করুন। যাকে আমরা চিনি আর বিশ্বাস করতে পারি।
তমাল সত্যি মুশ্কিলে পড়ল। কি করবে বুঝতে পারে না। জায়গাটা খুব পছন্দ হয়েছে। আপিসের এত কাছে আর এত ভালো পরিবেশ। নতুন জায়গাতে পরিচিতও তেমন কেউ নেই। একজন সহকর্মীকেই গিয়ে নিজের সমস্যার কথা বলে। সব শুনে তিনি বললেন, “আপনি আর কোন আবাসন পেলেন না? গোকুলে গিয়েছেন? ওরা ভীষণ গোঁড়া, আপনি মুসলমান জেনে নানা অজুহাত দিচ্ছে”। শুনে হাত পা সেঁধিয়ে গেল তমালের। কথা বলার সময়, প্রকাশবাবু ‘বাঙালী’ কি না জিজ্ঞেস করেছিল, তখন মানে বুঝতে পারেনি। বিভিন্ন দেশ ঘুরে নিজের ধর্মীয় পরিচয়টাকে অত প্রধান্য দিতে শেখেনি। তমালের বাড়ির পরিবেশও অনেক আধুনিক। তমালের আব্বু কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, অগাধ পড়াশুনা। ছোট থেকে মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্য দিতে শিখিয়েছেন। আরবী নাম থাকলেও বাঙালী নাম ‘তমাল’ কেই স্কুলের খাতায় নথিভুক্ত করান। এখানে এসে বাংলায় কথা বলে, কোলকাতাকে কখনও বিদেশ মনে হয়নি। এখন দেখছে ‘বিদেশে’ এসে ওর ধর্মীয় পরিচয়টাই বড় হয়ে উঠল। বিকেলে ঠিক করে কাছাকাছি কোন মসজিদে গিয়ে বাসার খোঁজ নেবে। আপিস থেকে ফেরার রাস্তায় এক ফকিরকে দেখে মসজিদের খোঁজ করে। একটু ঘুর পথে গিয়ে সেই মসজিদে পৌঁছয়। জুম্মাবারে মুসল্লিদের ভীড় জমেছে। প্রার্থনা সেরে মুরুব্বিগোছের একজনকে নিজের সমস্যার কথা বলে। তিনি বেশ কয়কটা খোঁজ দিলেন বটে, তবে তা সব আপিস থেকে দূরে দূরে। তমাল বুঝতেই পারে এইগুলো মূলতঃ মুসলমান প্রধান এলাকা। ফোন নম্বরগুলো নিল বটে, কিন্তু মন থেকে সায় দেয় না। আজ এই সময়ে দাঁড়িয়ে ওকে কেন শুধু মুসলমান হয়ে পরিচিত হতে হবে?
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে গেস্ট হাউজে ফিরে আসে। ওদের বিল্ডিংএর গেটের কাছে একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে। এক বৃদ্ধা অনেক পোঁটলা পুঁটলি নিয়ে নামছেন। ট্যাক্সিওয়ালা ছেলেটি কেমন উদাসীন হয়ে দাঁড়িয়ে, যেন সওয়ারিকে পৌঁছে দেওয়ার অতিরিক্ত কোন দায়িত্ব নেই। তমাল নিজে থেকে এগিয়ে এসে স্যুটকেসটা নেয়। বৃদ্ধা যেন বল পেয়ে বলেন,
- হ্যাঁ বাবা একটু ধরো তো। ওই লিফ্ট অবধি পৌঁছে দাও।
তমাল সাগ্রহে সাহায্য করে। লক্ষ্য করে বৃদ্ধার মালপত্রের ভেতর একটা ছোট্টো টুকরি। সেখানে একটা পিতলের বিগ্রহ। জামাকাপড় পড়িয়ে যত্ন করে রাখা। সচেতনভাবে ওই টুকরিটাতে হাত লাগায় না। লিফ্টে উঠে বোঝে, তমালের একই ফ্লোরে বৃদ্ধার গন্তব্য। বৃদ্ধা তমালকে ভেতরে আসতে বলেন, “এসো বাবা একটু চা খেয়ে যাও”। তমালের তেমন কোন কাজ নেই, তাই ভেতরে ঢোকে। ঘরে ঢুকতেই কেমন স্নিগ্ধ পরিবেশ। মন ভরে গেল তমালের। “একটু বোসো বাবা, আগে গোপালকে একটু রেখে আসি”।
- গোপাল?
বৃদ্ধা সেই টুকরিটা তুলে দেখান। “আর বোলোনা। এই এনার জন্য কোথাও কি দুদিন দিয়ে থাকা যায়?” খানিক পরে দুই কাপে ধোঁয়া ওঠা চা নিয়ে আসেন। “এই গোপাল হল, আমার মায়ের। সেই কবেকার কথা। গোপালগঞ্জের কথা”।
- গোপালগঞ্জ?
- ফরিদপুরের গোপালগঞ্জ।
- ও মা, তাই নাকি?
- না তো কি? আমার জন্ম সাতচল্লিশ সালে। বাপ মা সাধ করে নাম রেখেছিল স্বাধীনা। কিসের স্বাধীনতা জানিনা, মার কাছে শুনেছি সব কিছু ফেলে কোলকাতায় চলে আসতে হয়েছে শুধু গোপালকে ছাড়েনি। মা চলে যাবার পর থেকে, তিনি আমার কাছেই থাকেন।
- আপনি এখানে একাই থাকেন?
- একা নয়তো কি? ছেলে আমেরিকায় আর মেয়ে গুজরাট। এই তো সেখান থেকেই এলাম। স্বামী চলে গেছেন আজ দশ বছর। সেই থেকে আমি আর গোপাল।
- ছেলেমেয়েরা আপনাকে নিয়ে যেতে চায় না?
- চায় তো। কিন্তু আমার গোপাল ঠাঁইনাড়া হয়ে বেশিদিন থাকতে পারেন না।
- কি রকম?
- রকম আর কি? ছেলেমানুষ তো, যে বাড়ি তে অধিষ্ঠান সেখানেই ভালো থাকেন। অন্যখানে গেলে কদিন পর থেকেই উশখুশ করতে থাকেন। আমায় সমানে বলেন বাড়ি নিয়ে যেতে।
তমালের হাসি পেয়ে যায়। হাসি গোপন করে জিজ্ঞেস করে, “আপনাকে বলে?” বৃদ্ধা সরল বিশ্বাসে বলে, “আমায় না তো, কাকে বলবে? মা বেটার আর তো কেউ নেই। তবে একেক সময় আমায় গোপালগঞ্জ নিয়ে যেতে বলে।”
- কেন?
- ওখানেই তো ওনার প্রথম প্রতিষ্ঠা। আমার বাহাত্তর বছর বয়স হয়ে গেল। এই এতগুলো দিন হয়ে গেল আর তো দেশে ফিরিনি।
- কেন যান নি?
- কি করে যাব বল? একা তো যেতে পারি না। কতবার ছেলে মেয়েদের বলেছি, ওদের সময় কই? তুমি ভাবো, আমার বাড়ি, আমার বাবা মায়ের বেড়ে ওঠা। আজ সেখানে যেতে আমার পাসপোর্ট ভিসা লাগবে? খুব মন খারাপ হয়ে যায়। ভীষণ ইচ্ছা করে, মরার আগে একবার আমার জন্মভূমির মাটিতে প্রণাম করে আসি।
বলতে বলতে স্বাধীনার চোখে জল এসে যায়। তমাল কেমন মোহাচ্ছন্ন হয়ে যায়। কোথাকার কোন মানুষের মন কোথায় আটকে পড়ে থাকে। সকালে বিদেশ বলে যে অস্বস্তি হচ্ছিল এখন যেন সেটা অনেক কম। তমাল বলে, “এখন গেলে আপনি গোপালগঞ্জ চিনতে পারবেন না। মস্ত জেলা শহর।” শুনে স্বাধীনা যেন চমকে ওঠেন, “তুমি গোপালগঞ্জ গিয়েছো?”
- আমার তো গোপালগঞ্জেই বাড়ি। আমার নাম তমাল হাসান। এখানে কোম্পানির কাজে এসেছি। এই ফ্লোরেই আমাদের গেস্ট হাউজ।
কথা শুনে বৃদ্ধা স্বাধীনা কেমন বিচলিত হয়ে ওঠেন। তমাল প্রমাদ গোণে, তবে কি নিজের পুরো নামটা বলা উচিত হয়নি? ঘরে গোপাল আছে, বৃদ্ধা কি তমালকে বিধর্মী ভেবে নতুন করে সমস্যায় পড়লেন? বলে ফেলা শব্দ কি করে ফেরত নেবে? তমাল কি করে অবস্থা সামাল দেবে, সেই কথা ভাবতে থাকে। তখন স্বাধীনা নিজের চেয়ার থেকে উঠে আসেন। তমালের কাছে এসে হঠাৎই পায়ে হাত দেন। তমাল এমনটা ঘটবে আশাই করেনি। একজন এত বয়স্ক মানুষ তার পায়ে হাত দেবেন, ভাবতেই পারেনি। লাফ দিয়ে ওঠে, “এ কি করছেন? আমার গুনাহ হবে। আমার পায়ে হাত দেবেন না।” বৃদ্ধার তখন চোখে জল, আবেগমথিত গলায় বলেন, “তুমি বাধা দিওনা বাবা, এ আমার গোপালের ইচ্ছা। তোমার পায়ে আমার গোপালগঞ্জের ধুলো লেগে আছে। আমায় মাথায় নিতে দাও।”
নিচের গল্পটি ঢাকা থেকে শ্রদ্ধেয় রতন সিদ্দীকি সম্পাদিত “আমাদের সম্প্রীতি” পত্রিকায়, জানুয়ারি ২০১৮তে প্রকাশিত।]
“ও আমার দেশের মাটি...”
---- সৌরভ হাওলাদার
কর্মসুত্রে পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে বেড়ানোর সুযোগ হলেও, তমাল হাসানের কোলকাতায় আসা হয়নি। কোম্পানির নতুন প্রজেক্টের জন্য এখন তমালকে কোলকাতায় থাকতে হবে। প্রথম যখন খবরটা পায়, একটা অন্য রকম অনুভূতি হয়। সেটা ঠিক সুখের না দুঃখের বুঝতে পারেনা। ইতিহাসের পাতায় কোলকাতা আর ঢাকার এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। তমালের দাদাজান কোলকাতায় থাকতেন। বিভাজনের পরে সেই সংসারের সবাই ঢাকায় চলে আসেননি। তমাল নিশ্চিত জানে, খুঁজলে পরে এখনও অনেক জ্ঞাতিকে কোলকাতায় পাবে। সময়ের পথ বেয়ে, অত্যন্ত আপনার সম্পর্কের টান আজ শিথিল, অচেনা। ঢাকা কেন্দ্রিক বড় হয়ে ওঠা, তমালের কোলকাতা নিয়ে কোন আলাদা স্মৃতি নেই।
কোলকাতায় পৌঁছে কোম্পানি তাকে দুই সপ্তাহের জন্য গেস্ট হাউজের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এই দুই সপ্তাহের মধ্যে ওকে নিজের আস্তানা খুঁজে নিতে হবে। আপিসের কাছেই এই আবাসন, নাম গোকুল। শহরের অভিজাত এলাকায় এক বিশাল আবাসন। সেখানে দুটো ফ্ল্যাট নিয়ে কোম্পানির নিজস্ব গেস্ট হাউজ। তার লাগোয়া তমালের আপিস। এত কাছে যে, পায়ে হেঁটেই যাতায়াত করতে পারে। প্রথম কটা দিন এই আবাসনে কাটিয়ে তার এতটা ভালো লাগে যে, এই আবাসনেই একটা ফ্ল্যাট ভাড়ার কথা চিন্তা করে।
গোকুলের একটা নিজস্ব ওয়েবসাইট আছে। সেখানে প্রতিটি ফ্ল্যাটের নিজস্ব বিবরণ আছে। ফ্ল্যাটের মালিক চাইলে, ওখানে নিজের ফ্ল্যাটের ভাড়া দেওয়ার বিজ্ঞপ্তিও দিতে পারেন। আপিস থেকে ফিরে তমাল আলগোছে এমন সব বিজ্ঞপ্তিগুলো নজর করছিল। হঠাৎই চোখে পড়ে জাস্টিস প্রণবানন্দ গোস্বামীর একটি বার্তা। তিনি ত্রিপুরা থাকেন, বর্তমানে তাঁর ফ্ল্যাটটি খালি পড়ে আছে। কেউ যদি তাঁর ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিতে চান, তারই ঘোষনা। নম্বর দেখে বুঝতে পারে, দক্ষিণ দিকে লেকের ধারের পঁচিশ তলায় এই ফ্ল্যাটের অবস্থান। এই আবাসনের সবচেয়ে ভালো জায়গা। পছন্দ হওয়া মাত্র, প্রণবানন্দকে একটা ইমেল করে নিজের ইচ্ছা প্রকাশ করে।
পরদিন আপিসে থাকার সময়, গোকুল থেকে ফোন আসে। আবাসিকদের পরিচালন সভা থেকে কেউ একজন ফোন করে তমালের সাথে কথা বলতে চায়। আপিস থেকে ফিরে পরিচ্ছন্ন হয়ে তমাল আবাসিক পরিচালন সভার আপিসে উপস্থিত হয়। প্রকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় বলে একজন বয়স্ক মানুষ তমালকে নিজের পরিচয় দেন। তিনিই তমালকে ফোন করেছিলেন জাস্টিস গোস্বামীর ফ্ল্যাটের ব্যাপারে। প্রকাশ বাবুর মোটাসোটা চেহারা, গৌরবর্ণ। দেখলে মনে হয়, ভরসা করা যায়। তমাল প্রায় ছয়ফুট লম্বা, পেটানো চেহারা, দাড়িগোঁফ কামানো মসৃণ গাল, চোখে মুখে বুদ্ধির দীপ্তি। প্রাথমিক সৌজন্য বিনিময়ের পর প্রকাশ জিজ্ঞেস করেন,
- আপনি কি জাস্টিস গোস্বামীর পরিচিত?
- না, আপনাদের ওয়েবসাইট থেকেই ওনার খোঁজ পেলাম।
- দেখুন আমাদের আবাসনে কিছু নিয়ম কানুন আছে।
- হ্যাঁ বলুন।
- আমরা চাইলেই বাইরের কাউকে ভাড়া দিতে পারি না। আবসিক পরিচালন সমিতিতে নতুন ভাড়াটের সমন্ধে সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। আর তা সন্তোষজনক হলে তবেই ভাড়া দেওয়া হয়।
- এ তো খুব ভালো নিয়ম। আপনি বলুন কি কি জানতে চান?
- যেমন আপনার নাম ঠিকানা কর্মস্থল ইত্যাদি।
তমাল নিজের সম্পর্কে বলে আর লক্ষ্য করে প্রকাশবাবুর কপালে কুঞ্চনের রেখা। “আপনি বাংলাদেশী?”
- আজ্ঞে হ্যাঁ।
- আমি ভাবলাম আপনি বাঙালী। এখানে কেউ আপনাকে চেনে?
- চেনে মানে, আমি তো আপিসের কাজে এসেছি। আপিস থেকে তো আমায় এখানেই রেখেছে।
- দেখুন আপিসের গেস্ট হাউজে যতক্ষণ আছেন, ততক্ষণ দায়িত্ব আপনার আপিসের। কিন্তু যখন আপনি নিজে থাকতে চাইবেন, তখন আপনার পরিচিতের কাউকে গ্যারেন্টার হতে হবে। বিশেষ করে ল্যান্ডলর্ড জাস্টিস গোস্বামীও আপনাকে চেনেন না।
- আমি তো শহরে নতুন। আমার পাসপোর্ট দেখতে পারেন, আপিসেও খোঁজ নিতে পারেন।
প্রকাশ বাবু হেসে বলেন, “আসলে, বুঝতেই পারছেন দিনক্ষণ ভালো নয়। পাসপোর্ট জাল হতে আর কতসময় লাগে? কাগজ খুললেই রাশি রাশি খবর”।
- তবে আমায় কি করতে হবে?
- ওই তো বললাম, কাউকে একটা খুঁজে বার করুন। যাকে আমরা চিনি আর বিশ্বাস করতে পারি।
তমাল সত্যি মুশ্কিলে পড়ল। কি করবে বুঝতে পারে না। জায়গাটা খুব পছন্দ হয়েছে। আপিসের এত কাছে আর এত ভালো পরিবেশ। নতুন জায়গাতে পরিচিতও তেমন কেউ নেই। একজন সহকর্মীকেই গিয়ে নিজের সমস্যার কথা বলে। সব শুনে তিনি বললেন, “আপনি আর কোন আবাসন পেলেন না? গোকুলে গিয়েছেন? ওরা ভীষণ গোঁড়া, আপনি মুসলমান জেনে নানা অজুহাত দিচ্ছে”। শুনে হাত পা সেঁধিয়ে গেল তমালের। কথা বলার সময়, প্রকাশবাবু ‘বাঙালী’ কি না জিজ্ঞেস করেছিল, তখন মানে বুঝতে পারেনি। বিভিন্ন দেশ ঘুরে নিজের ধর্মীয় পরিচয়টাকে অত প্রধান্য দিতে শেখেনি। তমালের বাড়ির পরিবেশও অনেক আধুনিক। তমালের আব্বু কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, অগাধ পড়াশুনা। ছোট থেকে মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্য দিতে শিখিয়েছেন। আরবী নাম থাকলেও বাঙালী নাম ‘তমাল’ কেই স্কুলের খাতায় নথিভুক্ত করান। এখানে এসে বাংলায় কথা বলে, কোলকাতাকে কখনও বিদেশ মনে হয়নি। এখন দেখছে ‘বিদেশে’ এসে ওর ধর্মীয় পরিচয়টাই বড় হয়ে উঠল। বিকেলে ঠিক করে কাছাকাছি কোন মসজিদে গিয়ে বাসার খোঁজ নেবে। আপিস থেকে ফেরার রাস্তায় এক ফকিরকে দেখে মসজিদের খোঁজ করে। একটু ঘুর পথে গিয়ে সেই মসজিদে পৌঁছয়। জুম্মাবারে মুসল্লিদের ভীড় জমেছে। প্রার্থনা সেরে মুরুব্বিগোছের একজনকে নিজের সমস্যার কথা বলে। তিনি বেশ কয়কটা খোঁজ দিলেন বটে, তবে তা সব আপিস থেকে দূরে দূরে। তমাল বুঝতেই পারে এইগুলো মূলতঃ মুসলমান প্রধান এলাকা। ফোন নম্বরগুলো নিল বটে, কিন্তু মন থেকে সায় দেয় না। আজ এই সময়ে দাঁড়িয়ে ওকে কেন শুধু মুসলমান হয়ে পরিচিত হতে হবে?
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে গেস্ট হাউজে ফিরে আসে। ওদের বিল্ডিংএর গেটের কাছে একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে। এক বৃদ্ধা অনেক পোঁটলা পুঁটলি নিয়ে নামছেন। ট্যাক্সিওয়ালা ছেলেটি কেমন উদাসীন হয়ে দাঁড়িয়ে, যেন সওয়ারিকে পৌঁছে দেওয়ার অতিরিক্ত কোন দায়িত্ব নেই। তমাল নিজে থেকে এগিয়ে এসে স্যুটকেসটা নেয়। বৃদ্ধা যেন বল পেয়ে বলেন,
- হ্যাঁ বাবা একটু ধরো তো। ওই লিফ্ট অবধি পৌঁছে দাও।
তমাল সাগ্রহে সাহায্য করে। লক্ষ্য করে বৃদ্ধার মালপত্রের ভেতর একটা ছোট্টো টুকরি। সেখানে একটা পিতলের বিগ্রহ। জামাকাপড় পড়িয়ে যত্ন করে রাখা। সচেতনভাবে ওই টুকরিটাতে হাত লাগায় না। লিফ্টে উঠে বোঝে, তমালের একই ফ্লোরে বৃদ্ধার গন্তব্য। বৃদ্ধা তমালকে ভেতরে আসতে বলেন, “এসো বাবা একটু চা খেয়ে যাও”। তমালের তেমন কোন কাজ নেই, তাই ভেতরে ঢোকে। ঘরে ঢুকতেই কেমন স্নিগ্ধ পরিবেশ। মন ভরে গেল তমালের। “একটু বোসো বাবা, আগে গোপালকে একটু রেখে আসি”।
- গোপাল?
বৃদ্ধা সেই টুকরিটা তুলে দেখান। “আর বোলোনা। এই এনার জন্য কোথাও কি দুদিন দিয়ে থাকা যায়?” খানিক পরে দুই কাপে ধোঁয়া ওঠা চা নিয়ে আসেন। “এই গোপাল হল, আমার মায়ের। সেই কবেকার কথা। গোপালগঞ্জের কথা”।
- গোপালগঞ্জ?
- ফরিদপুরের গোপালগঞ্জ।
- ও মা, তাই নাকি?
- না তো কি? আমার জন্ম সাতচল্লিশ সালে। বাপ মা সাধ করে নাম রেখেছিল স্বাধীনা। কিসের স্বাধীনতা জানিনা, মার কাছে শুনেছি সব কিছু ফেলে কোলকাতায় চলে আসতে হয়েছে শুধু গোপালকে ছাড়েনি। মা চলে যাবার পর থেকে, তিনি আমার কাছেই থাকেন।
- আপনি এখানে একাই থাকেন?
- একা নয়তো কি? ছেলে আমেরিকায় আর মেয়ে গুজরাট। এই তো সেখান থেকেই এলাম। স্বামী চলে গেছেন আজ দশ বছর। সেই থেকে আমি আর গোপাল।
- ছেলেমেয়েরা আপনাকে নিয়ে যেতে চায় না?
- চায় তো। কিন্তু আমার গোপাল ঠাঁইনাড়া হয়ে বেশিদিন থাকতে পারেন না।
- কি রকম?
- রকম আর কি? ছেলেমানুষ তো, যে বাড়ি তে অধিষ্ঠান সেখানেই ভালো থাকেন। অন্যখানে গেলে কদিন পর থেকেই উশখুশ করতে থাকেন। আমায় সমানে বলেন বাড়ি নিয়ে যেতে।
তমালের হাসি পেয়ে যায়। হাসি গোপন করে জিজ্ঞেস করে, “আপনাকে বলে?” বৃদ্ধা সরল বিশ্বাসে বলে, “আমায় না তো, কাকে বলবে? মা বেটার আর তো কেউ নেই। তবে একেক সময় আমায় গোপালগঞ্জ নিয়ে যেতে বলে।”
- কেন?
- ওখানেই তো ওনার প্রথম প্রতিষ্ঠা। আমার বাহাত্তর বছর বয়স হয়ে গেল। এই এতগুলো দিন হয়ে গেল আর তো দেশে ফিরিনি।
- কেন যান নি?
- কি করে যাব বল? একা তো যেতে পারি না। কতবার ছেলে মেয়েদের বলেছি, ওদের সময় কই? তুমি ভাবো, আমার বাড়ি, আমার বাবা মায়ের বেড়ে ওঠা। আজ সেখানে যেতে আমার পাসপোর্ট ভিসা লাগবে? খুব মন খারাপ হয়ে যায়। ভীষণ ইচ্ছা করে, মরার আগে একবার আমার জন্মভূমির মাটিতে প্রণাম করে আসি।
বলতে বলতে স্বাধীনার চোখে জল এসে যায়। তমাল কেমন মোহাচ্ছন্ন হয়ে যায়। কোথাকার কোন মানুষের মন কোথায় আটকে পড়ে থাকে। সকালে বিদেশ বলে যে অস্বস্তি হচ্ছিল এখন যেন সেটা অনেক কম। তমাল বলে, “এখন গেলে আপনি গোপালগঞ্জ চিনতে পারবেন না। মস্ত জেলা শহর।” শুনে স্বাধীনা যেন চমকে ওঠেন, “তুমি গোপালগঞ্জ গিয়েছো?”
- আমার তো গোপালগঞ্জেই বাড়ি। আমার নাম তমাল হাসান। এখানে কোম্পানির কাজে এসেছি। এই ফ্লোরেই আমাদের গেস্ট হাউজ।
কথা শুনে বৃদ্ধা স্বাধীনা কেমন বিচলিত হয়ে ওঠেন। তমাল প্রমাদ গোণে, তবে কি নিজের পুরো নামটা বলা উচিত হয়নি? ঘরে গোপাল আছে, বৃদ্ধা কি তমালকে বিধর্মী ভেবে নতুন করে সমস্যায় পড়লেন? বলে ফেলা শব্দ কি করে ফেরত নেবে? তমাল কি করে অবস্থা সামাল দেবে, সেই কথা ভাবতে থাকে। তখন স্বাধীনা নিজের চেয়ার থেকে উঠে আসেন। তমালের কাছে এসে হঠাৎই পায়ে হাত দেন। তমাল এমনটা ঘটবে আশাই করেনি। একজন এত বয়স্ক মানুষ তার পায়ে হাত দেবেন, ভাবতেই পারেনি। লাফ দিয়ে ওঠে, “এ কি করছেন? আমার গুনাহ হবে। আমার পায়ে হাত দেবেন না।” বৃদ্ধার তখন চোখে জল, আবেগমথিত গলায় বলেন, “তুমি বাধা দিওনা বাবা, এ আমার গোপালের ইচ্ছা। তোমার পায়ে আমার গোপালগঞ্জের ধুলো লেগে আছে। আমায় মাথায় নিতে দাও।”
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন