বুধবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৭

শিল্পীর মৃত্যু নেই








    একজন মানুষের থাকা আর না-থাকার মধ্যে ব্যবধান কতটুকু? কয়েকজন নিকট আত্মীয়র চোখের জল, বিলাপ, ধূপের ভারী গন্ধ পেরিয়ে, আর যেমন ছিল তেমন। কোথাও এতটুকু টোল পড়েনা। প্রতিদিনের অভ্যাসে পশ্চিমদিকে রঙ ছড়িয়ে সূর্য্য ডুবে যায়। কতিপয় শশ্মানযাত্রী পরস্পরের গা ঘেঁষে বসে থাকে। এক সময় চুল্লির ঘন্টা বেজে ওঠে, অর্থাৎ দাহ সাঙ্গ হল। পার্থিব সংগ্রহ বলতে কিছু সাদা ছাই, তখনও ধোঁয়া উঠছে।
    অথচ মেসোমশাইকে রেখে আসার সময় মনে হল, কোথাও গ্লানির চিহ্ন তো নেই। ওঁর রেখে যাওয়া ছবিগুলোতে রঙের উদ্ভাস। উজ্জ্বল রঙেরা সব হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে, অস্তিত্ব জানান দেয়। শিল্পীর মৃত্যু নেই। সে জীবন পেরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অবিচল, অবিনশ্বর। ব্যক্তিগত কষ্ট চোখের জলে ঢেকে যায়। শুনতে পাই তাঁর কথা, নিমেষে অতীত হয়ে যাওয়া মুহুর্তরা জড়িয়ে ধরে, তুমি কি সত্যিই 'নেই' হয়ে গেলে? এই তো হাতের ভেতরে মুঠো করা পেন্সিল, ইজেলে লাগানো এক নতুন ক্যানভাস। অপেক্ষায় আছে সবাই, কখন রঙের আঁচড়ে ভরে যাবে।


আমার বাবা



    বয়স তখন কত হবে? হয়তো পাঁচ। লাল জ্যাম মাখানো পাউরুটি ভালো লাগত। বাহাদুরের কোলে চড়ে সেই জ্যাম মাখা পাউরুটি খেয়েছি, দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কের কালীবাড়িতে। বাহাদুরের মুখ মনে নেই, অথচ কেমন প্রায় চার দশক পেরিয়ে সেই স্বাদ মনে আসে অবিকল। একটা খেলনা লাল গাড়ি ছিল। আমার নয়, খুব সম্ভব পাশের ঘরের ছেলেটির। আমায় দিতনা। আমার রোগাভোগা শরীরে অত জোর কোথায়, যে ভাগ বসাব? দূর থেকেই দেখতাম, ও খেলতো সামনের বারান্দা দিয়ে, আমায় দেখিয়ে দেখিয়ে।
    আর একজন সাইকেল চালিয়ে চলে যেত, জানালা দিয়ে দেখা যেত। আরও দূরে একটা ঘড়িওয়ালা মিনার। বোধহয় তাঁর আপিস। আমার মনে নেই। সাইকেল করে যেত, আবার সাইকেল করেই ফিরতো। দুপুরে খেয়ে যেত মনে হয়। শহরের নাম, মনে পড়ে জব্বলপুর। লাল গাড়ি হয়তো কেড়ে এনে দেয়নি, তবু এনে দিয়েছে পৃথিবী। আর কেউ কিছু না দিলেও, কিছু যায় আসে না। আমি জানি, সেই মানুষটা আমার কাছে সর্বশক্তিমান। আমার বাবা।

বুধবার, ১১ অক্টোবর, ২০১৭

ব্যাঙাচি




বাঙেরা জানে কিনা জানিনা, তবে বাংলার মানুষ একে আদর করে ব্যাঙাচি নাম দিয়েছে। বহুদিন ধরে অনেকে বোঝার চেষ্টায় আছেন, এই অত্যাশ্চার্য যানটি ঠিক কি? চালক সহ বারোজন কে নিয়ে এই গাড়িটি চলাফেরা করে, কোলের বাচ্চারা আলাদা। এ কি কোন গাড়ি কোম্পানির স্বীকৃত মডেল? নাকি জলের পাম্প আর সাইকেল ভ্যানের সমন্বয়ে নির্মিত কোনো হাঁসজারু? সামনের সারি তে দুজন যাত্রী বসবেন, একজন চালকের কোলে, দুই পায়ে ফাঁকে গিয়ার। এটাই দস্তুর। মাঝের সারি মুখোমুখি বসিবার, তিন তিন করে ছয়জনার। কিভাবে যে স্থান সঙ্কুলান হয়, মানুষগুলি গাড়ি থেকে বেরোনো পর বোঝা যায়। আর পিছনের সিটে আবার তিনজন। সেখানে উঠে পা দুমড়িয়ে বসা, খানিক ঝাঁকায় করে মুরগীদের চলাফেরা সাথে তুলনীয়। ঘাড়গুঁজে, হাঁটু ঘুরিয়ে, যাত্রীকে একইসাথে যোগ ব্যায়াম আর নাগরদোলার অনুভূতি জাগায়। কে এই অসামান্য গাড়িটির ডিজাইন করেছেন আর কোন রাস্তা সুরক্ষা পর্ষদ তাকে ছাড়পত্র দিয়েছে, জানতে পারলে জগতের কল্যাণ হয়। 

রবিবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৭

'হাটেবাজারে' পত্রিকা




বর্দ্ধমানে সব কিছু বর্ধিত হবে, এতো সকলের জানা। আজ আমি উপলব্ধি করলাম। মানবদের সাহিত্যসভায় গিয়ে দেখা হয়ে গেল 'হাটেবাজারে' পত্রিকার প্রকাশক শ্রী প্রণব কুমার চক্রবর্তীর সাথে। আমার হাতে তুলে দিলেন শারদীয়া সংখ্যা। এখানে আমার 'মেঘের বাড়ি' শিরোনামের গল্পটি প্রকাশিত হয়েছে। এ ঘটনাটা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত, তাই এর সুখ চারিয়ে গেল অন্য মাত্রায়। আমার বিশেষ বন্ধু দাদা মনোরঞ্জন বেপারিকে এই গল্পটি দিয়েছিলাম। তাঁর হাত ঘুরে 'হাটেবাজারে'র দপ্তরে পৌঁছয়। প্রকাশিত হবার খবর মাত্র দিন দুয়েক আগে ফেসবুক মারফৎ পাই। 

বর্দ্ধমানের সাহিত্যবাসরে


মানবরা ডেকেছে, "যাও পাখি বোলো তারে"। সে ডাকে জড়ো হয়েছে অনেক মানুষ, প্রতি বছর যেমন হয়। বর্দ্ধমানের সাহিত্যবাসরে, সকাল থেকে আড্ডা গান কবিতা, পত্রিকা প্রকাশ, প্রদর্শনী, দফায় দফায় চা, লুচি তরকারি, দুপুরে মাংসভাত। আর কাছে না গেলে যা বোঝা যায়না, তা হল উষ্ণতা। যা দিয়ে "হৃদয় থেকে হৃদয় জুড়ে যায়, ভাঙা চুড়ি দিয়ে গাঁথা মালার মতো", বললেন জয়া মিত্র, সঙ্গে অরুন ঘোষ, শুক্তি রায়। হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় আনলেন দুয়োরানী বুনোফুলের সুঘ্রাণ। চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় শোনালেন তাঁর সংগ্রহের মালায় ইতিহাস চয়নের কথা, সঙ্গত করলেন সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়। গানে গানে ছুঁয়ে দিলেন নূপুরছন্দা ঘোষ। রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলালের সে গানে ভেসে গেল সভা, আলুথালু মন। মানব বললেন তাঁদের আর্থিক অনটনের কথা, অথচ মহার্ঘ্য সভা নির্মিত হল ভালোবাসার তন্তুতে, এক অনন্য উজ্জ্বল রত্নের মতো। 






এ বৃহৎ কর্মকান্ডের ভেতর একটি ছোট্ট ব্যক্তিগত সুখ, আমার 'ঠিকানা' শিরোনামের গল্প আজকের পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে।

রবিবার, ১ অক্টোবর, ২০১৭

শুভ বিজয়া



বৃষ্টিতে নেতিয়ে গেছে রাস্তা। মিইয়ে গেছে মন। নবমী থেকেই যাই যাই। ভাসানে খানিক উদ্দাম উন্মাদনার ক্লাইম্যাক্সডিজে-বাবুর হাত ধরে প্রতিমা নিরঞ্জন সাঙ্গ হল। তারপর ক্রমে উৎসব রাত শেষ হয়। অস্পষ্ট হয়ে পড়ে উজ্জ্বল আলোর রোশনাই। সময়ের হাত ধরে আবার ফিরে আসা প্রতিদিনের শহরে। ইতস্ততঃ ভাঙা মন্ডপের কাঠামো জেগে থাকে। যেমন জেগে থাকে ভাঙা মন। এরপর আবার রোজকার আপিসযাত্রীর গায়ে নতুন পোশাক, তবু কর্মক্ষেত্রে যেতে মন লাগেনা। ফেলে আসা আলোর স্মৃতি বুকে নিয়ে আরেকবার অপেক্ষা শুরু 'আসছে বছর আবার হবে।' যে বাঙালী ঘরে ফিরেছিল, তার প্রবাস-ফেরার গাড়ির সময় হয়ে এল। তবু চলে যাওয়ার উৎসব পালন হয়, 'বিজয়া দশমী'। এত বিষাদের পরও কেন মিষ্টিমুখ? পৌরাণিক ব্যাখ্যায়, দশানন ধরাশায়ী আর রামচন্দ্রের বিজয়। সার্থক হল তাঁর অকাল বোধন। এই বিজয়া তাকেই স্মরণ করে। এরপর রাম দেশে ফিরবেন, ঠিক একমাস পর হবে আরেক দফা বিজয় উদযাপন দেওয়ালির আলোক মালায়। আর, যার এবারও পুজোতে ঘরে ফেরা হলনা, তাদের আশা, 'ঠিক পরের বার'। ফোন, হোয়াটসাপ, ফেসবুকে প্রীতি বিনিময় চলতেই থাকে, সামনে এলে উষ্ণ আলিঙ্গন।

বাঙলায় দুর্গার অবস্থান ঠিক 'পুজো' নয়, মেয়ের ঘরে ফেরা। তাকে আবার বিদায় জানাতে বাপ মায়ের কষ্ট হয়। একবার এমন আবেগে মথুরবাবু দশমীতেও মা-কে বিসর্জন দেবেন না বলে স্থির করেন। শ্রীরমকৃষ্ণ তাকে বুঝিয়ে বলেন, মায়ের কখনও সন্তানের সাথে বিচ্ছেদ হয়না, "এ ক'দিন বাইরের দালানে বসে মা পূজা নিয়েছেন, আজ থেকে হৃদয়মন্দিরে বসে পূজা নেবেন।" যার সাথে মায়ের দেখাই হল না, সেও হয়তো খুঁজতে থাকে। কোথাও মনের ভেতর মা অবস্থান করছেন, স্নেহময়ী আঁচল বিছিয়ে, সে আঁচল ভাগ হলেও কম পড়ে না।

শুভ বিজয়া, সবাই ভালো থাকবেন।

ব্লগ এবং বই পাওয়ার ঠিকানাঃ https://souravstory.com

 এখন থেকে ব্লগ সহ অন্যান্য সব খবর এবং বই পাওয়ার ঠিকানাঃ https://souravstory.com