তাঁর সাথে দেখা
---------------
"আরে নামুন
নামুন।"
ঠেলাঠেলি আর চিৎকারে
ঘুম ভেঙে গেল। হতভম্ব লাগছিল। কোথায় আছি, চারিদিকে হচ্ছেই বা কি? পরক্ষণে মনে পড়ল,
আমি বাসে। আর সবাই উদভ্রান্তের মতো দরজা দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নামছে। ব্যাপারখানা
কি? পুলিশে তাড়া করেছে নাকি? অ্যাক্সিডেন্ট হল কিছু? সবার ঠেলায় আমিও নামলাম। তবে
ঘুমটা এমনভাবে চটকে ভাঙাতে, মনটা তেতো লাগছে। সামনের দিকে যাবো? অ্যাক্সিডেন্ট
হলে, ওইসব রক্ত টক্ত দেখতে পারবো? তবু সামনের দিকে ঘাড় ঘোরাতে, দেখি ধোঁয়া আর
ধোঁয়া। আরিব্বাস বাসে আগুন লেগে গেছে? ভীড় ঠেলে সামনে যাই। বনেট তুলে জল ঢালছে
ড্রাইভার আর কনডাক্টর। তবেই হল আর কি। ঠা ঠা পোড়া দুপুরে এই রাস্তায় আর গাড়ি
কোথায়?
সাতচল্লিশের-ঘ বাস
চেপেছিলাম গুলঞ্চতলার মেলার মাঠ থেকে। চত্তির মাসের তিরিক্ষে রদ্দুর। আসব শহরে।
আপনারা যারা গুলঞ্চতলা চেনেন না, বা কোনদিন আসোনি, তাদের জানাই এ তেমন দূরবর্তী
কোন গ্রহ-টহ নয়, শহর থেকে পঞ্চান্ন কিলোমিটার এলেই হবে। তারপর পোয়াটাক মাইল হাঁটা
পথ। ওই শুনতে অমন সহজ। তবে এই রোদ্দুরের রদ্দা খেয়ে আলপথ দিয়ে হেঁটে আসা, সে যে
কেমন গা শনশন করা ব্যাপার, তা যারা আসোনি তারা আর কি করে বুঝবেন? এমনি সময় এই
রাস্তাটার দু ধারে শুধু ক্ষেত। অমন রোদেও ওই সবুজ দীঘল মাঠ দেখে মন জুড়িয়ে আসে।
মেলার জন্য বেশ কিছু অস্থায়ী দোকানপাট রয়েছে। তবে দোকানিরাও সব রোদমুড়ি দিয়ে
ঝিমোচ্ছে। বাসের জন্য বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। একটা লড়ঝড়ে টিনের বাক্স হেলতে দুলতে
এসে হাজির। ভেতরে গুচ্ছের লোক। যা হোক গাড়ি তো, লোকে চড়ছে, আবার পৌঁছেও দিচ্ছে।
কোন মতে একটা সিট জুটিয়ে ঘুম দিয়েছি কি দেইনি আগুন টাগুন লেগে একাক্কার। কি আর করি?
ছায়া খুঁজে বসবার চেষ্টা করি। কতক্ষণে এই টিনে বাক্স সারাই হবে, কে জানে? অনেকেই
এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছে। একটা প্রাচীন মেহগিনি গাছের নিচে সাদা পোশাক পড়া একজন বসে।
লম্বা সাদা চুল ঘাড়ের ওপর। বুক পর্যন্ত নেমে আসা সাদা দাড়ি। গুটি গুটি তার পাশে
গিয়ে বসি।
- কাকা কি শহর
যাচ্ছেন?
- তাই তো বাসনা আছিল।
এহন ক্যামনে হইবে, সেইডা জ্যানে কেডা?
- ওরা চেষ্টা করছে।
কিছু একটা নিশ্চিত হবে।
- আমারও তাড়া নাই।
- আপনি কি এদিকে থাকেন?
- এইদিক ওইদিক,
সর্বদিকে থাকোনের চেষ্টা আছিল। হয় তো আর না।
- এই রোদের মধ্যে
কোথায় গেছিলেন? গুলঞ্চতলায়।
- তা হেইখানেও গ্যাছালাম।
অরা আমার পুরান্ খদ্দের। কিন্ত এহন আর হ্যার কদর নাই।
- খদ্দের? মানে আপনি
এখানে কিছু বিক্রি করেন বুঝি?
- বিক্রি মানে আমার
গলা চেহারা, এইসব।
- আপনি কি গান টান
করেন?
- তা ঠিক নয়। আমি
অভিনেতা। তবে অইন্যরকম।
- বুঝলাম না।
- আমারে দেইখ্যা আপনের
কার কথা মনে লয়?
- কার কথা বলুন তো?
সান্তাক্লজ?
- বিদ্যাশের মানুষ নয়
দ্যাশি কাউরে মনে লয়?
- মানে দেশি? লোকনাথ
বাবা? তবে তার এরকম পোষাক পরা ফোটো দেখিনি।
- কত্তা কি ছেলেবেলায়
রবীন্দ্রনাথ পঅড়ছেন?
- হ্যাঁ থার্ড
লাঙ্গুয়েজ বেঙ্গলি। টেক্সটে ছিল।
- হয়। আমি হেই
রবীন্দ্রনাথের ভূমিকায় পার্ট করি।
- ওবাবা রবীন্দ্রনাথ?
তাই এই মেকাপ?
- এইগুলান মেকাপ না।
আমার চুলদাড়ি নিজস্ব।
- তবে কি পুরো মেক
ওভার?
- কি জ্যানি, যা খুশি
কইতে পারেন।
- তা এত লোক থাকতে
রবীন্দ্রনাথ কেন হতে গেলেন?
- ত্যামন কিছু কারন
নাই। সুভাষ বোস, বাঘা যতীন, মাস্টোরদা অনেকের পার্ট করছি। শ্যাষকালে এইহানে
খারাইয়া গেল। তখন মার্কেটও রবীন্দ্রনাথের।
- রবীন্দ্রনাথের
মার্কেট মানে?
- এই বোঝলেন না? তহন
সব ইস্কুলগুলান রবীন্দ্রজয়ন্তী করতো। পাড়ায় পাড়ায় হইত। এমন কি অই গুলাঞ্চতলায়
বহুরূপীর তাঁবু পড়তো। হেইহানে আমার ডাক আইতো হগলের আগে। বাপ ঠাহুরভাই কালী, কৃষ্ণ
সাজতো। আমি অইন্যরকম শুরু কঅরলাম। লোকে ভালোই পাইতো।
- তা অবশ্য, আগে আমি
গুলঞ্চতলায় বহুরূপীর তাঁবু দেখেছি। তবে আপনাকে কখনও দেখেনি।
- আপনের কি মনে হয় আমি
ফাটকি কথা কইলাম?
- না না তা কেন? আমি
আপনাকে বিশ্বাস করেছি। তবে নিজে কখনও বহুরূপীর তাঁবুতে ঢুকিনি।
- তবে আমারে চ্যানবেন
কি কইরা?
- আপনি রবীন্দ্রনাথ
সেজে কি করতেন?
- অনার কি করনের কিছু
কম আছিল? গান, পইদ্য, গইদ্য, নাটক। কিছু একটা করলেই হইল।
- একটা নমুনা শুনতে ইচ্ছে
করছে যে, অবশ্য আপনার যদি আপত্তি না হয়।
- অ আপত্তি ক্যান
হইবো?
"আমি ছেড়েই দিতে রাজি আছি
সুসভ্যতার আলোক
আমি চাইনা হতে নববঙ্গে নবযুগের চালক
আমি নাইবা গেলাম বিলাত
আমি নাইবা পেলাম রাজার খিলাত
যদি পরজন্মে পাইরে হতে ব্রজের রাখাল
বালক
তবে নিবিয়ে দেব নিজের ঘরে সুসভ্যতার
আলোক..."
এমন একটা গভীর গদ্যময়
পরিবেশে, এই কবিতা শুনতে পাবো, ভাবিনি। পুরোটা শেষ হতেও যেন রেশ রয়ে গেল।
কন্ঠস্বরেও বেশ মুন্সীয়ানা আছে। খানিক চুপ থাকার পর বললাম,
- ভারি সুন্দর। কবিতা
বলার সময় আপনার কথায় দেশের টান এলো না তো।
ভদ্রলোক দাড়ির ভেতর
সুন্দর করে হাসলেন। বলেন,
- আরে এইডা হইল গিয়া আমার
মাতৃভাষা। আমার মাটির ঘেরাণ। এইডারে ভুইল্যা গেলে হইব? আর কবিতাটা তো অভিনয়।
বহুরূপী তো আসলে একজন অভিনেতা।
- এবারে আপনার কেমন ব্যাবসা
হল?
- কোথায় আর হইল? মেলা
কমিটি বহুরূপীর ছাউনি রাহে নাই। হেইহানে অহন অন্ধকার কইরা জোনাক পোকার ন্যায় লাইড
লাগাইছে। বড় বড় বক্স লাগাইছে। আইটেম গান আর নাচের মেঝে। লোকে নাকি আজকাল পয়সা দিয়া
হেইয়া করতে আসে। বহুরূপীতে আর ব্যাবসা জমে না।
কথা বলতে বলতে উল্টো
দিক থেকে একটা মানুষ ঢাকা টেম্পো এসে হাজির। ওইটুকু গাড়ির ভেতর, বাইরে, ছাদে লোকের
পলেস্তরা। তার ভেতর থেকে কে যেন হেঁকে উঠল, "আরে রবীন দাদু তুমি এইহানে?
তোমার বাড়ি ঘুইর্যা আইলাম। ফোন ব্যবহার করো না ক্যান? চল চল আউশডিঙি যাবা
চল।"
- আরে গোপাইল্যা নাকি?
তগো অনুষ্ঠান এইবার হইবো?
- ক্যান হইবো না? যাবা
তো চলো।
ওই ভীড়ে বৃদ্ধ নিজের
ছোটো ব্যাগটা নিয়ে উঠে পরে। আমি ঘটনার আকস্মিকতায় একটু হকচকিয়ে গেছি। ধাতস্থ হয়ে
ভদ্রলোককে বিদায় জানিয়ে বলি,
- ঠিক আছে আবার দেখা
হবে। কিন্তু আপনার নামটা জানা হল না।
- আমার নাম
রবীন্দ্রনাথ
- সে কি? নামটাও?
আপনার কি ছোটবেলা থেকে এমন দাঁড়িগোফ ছিল, যে মা বাবা এই নাম দেন?
- কি কঅরব বলুন? বাপে
সাধ কইর্যা নাম রাখছে।
- তবে পদবি-টাও কি
ঠাকুর?
- না পদবি পাঠক।
- মানে?
- মানে আর কি? রবীন্দ্রনাথ
পাঠক।
একরাশ ধোঁয়া ধুলো
উড়িয়ে টেম্পোটি চলে যায়। আমি ধুলোটুকু মেখে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে। সব কিছুর মধ্যে
জেগে থাকে কটা শব্দ:
"... যদি
ননীছানার গাঁয়ে
কোথাও অশোকনীপের ছায়ে
আমি কোনো জন্মে পাইরে
হতে ব্রজের গোপবালক
তবে চাইনা হতে নববঙ্গে
নবযুগের চালক।"