রবিবার, ২৭ মার্চ, ২০১৬

তাঁর সাথে দেখা



তাঁর সাথে দেখা
---------------
"আরে নামুন নামুন।"
ঠেলাঠেলি আর চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল। হতভম্ব লাগছিল। কোথায় আছি, চারিদিকে হচ্ছেই বা কি? পরক্ষণে মনে পড়ল, আমি বাসে। আর সবাই উদভ্রান্তের মতো দরজা দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নামছে। ব্যাপারখানা কি? পুলিশে তাড়া করেছে নাকি? অ্যাক্সিডেন্ট হল কিছু? সবার ঠেলায় আমিও নামলাম। তবে ঘুমটা এমনভাবে চটকে ভাঙাতে, মনটা তেতো লাগছে। সামনের দিকে যাবো? অ্যাক্সিডেন্ট হলে, ওইসব রক্ত টক্ত দেখতে পারবো? তবু সামনের দিকে ঘাড় ঘোরাতে, দেখি ধোঁয়া আর ধোঁয়া। আরিব্বাস বাসে আগুন লেগে গেছে? ভীড় ঠেলে সামনে যাই। বনেট তুলে জল ঢালছে ড্রাইভার আর কনডাক্টর। তবেই হল আর কি। ঠা ঠা পোড়া দুপুরে এই রাস্তায় আর গাড়ি কোথায়?

সাতচল্লিশের-ঘ বাস চেপেছিলাম গুলঞ্চতলার মেলার মাঠ থেকে। চত্তির মাসের তিরিক্ষে রদ্দুর। আসব শহরে। আপনারা যারা গুলঞ্চতলা চেনেন না, বা কোনদিন আসোনি, তাদের জানাই এ তেমন দূরবর্তী কোন গ্রহ-টহ নয়, শহর থেকে পঞ্চান্ন কিলোমিটার এলেই হবে। তারপর পোয়াটাক মাইল হাঁটা পথ। ওই শুনতে অমন সহজ। তবে এই রোদ্দুরের রদ্দা খেয়ে আলপথ দিয়ে হেঁটে আসা, সে যে কেমন গা শনশন করা ব্যাপার, তা যারা আসোনি তারা আর কি করে বুঝবেন? এমনি সময় এই রাস্তাটার দু ধারে শুধু ক্ষেত। অমন রোদেও ওই সবুজ দীঘল মাঠ দেখে মন জুড়িয়ে আসে। মেলার জন্য বেশ কিছু অস্থায়ী দোকানপাট রয়েছে। তবে দোকানিরাও সব রোদমুড়ি দিয়ে ঝিমোচ্ছে। বাসের জন্য বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। একটা লড়ঝড়ে টিনের বাক্স হেলতে দুলতে এসে হাজির। ভেতরে গুচ্ছের লোক। যা হোক গাড়ি তো, লোকে চড়ছে, আবার পৌঁছেও দিচ্ছে। কোন মতে একটা সিট জুটিয়ে ঘুম দিয়েছি কি দেইনি আগুন টাগুন লেগে একাক্কার। কি আর করি? ছায়া খুঁজে বসবার চেষ্টা করি। কতক্ষণে এই টিনে বাক্স সারাই হবে, কে জানে? অনেকেই এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছে। একটা প্রাচীন মেহগিনি গাছের নিচে সাদা পোশাক পড়া একজন বসে। লম্বা সাদা চুল ঘাড়ের ওপর। বুক পর্যন্ত নেমে আসা সাদা দাড়ি। গুটি গুটি তার পাশে গিয়ে বসি।
- কাকা কি শহর যাচ্ছেন?
- তাই তো বাসনা আছিল। এহন ক্যামনে হইবে, সেইডা জ্যানে কেডা?
- ওরা চেষ্টা করছে। কিছু একটা নিশ্চিত হবে।
- আমারও তাড়া নাই।
- আপনি কি এদিকে থাকেন?
- এইদিক ওইদিক, সর্বদিকে থাকোনের চেষ্টা আছিল। হয় তো আর না।
- এই রোদের মধ্যে কোথায় গেছিলেন? গুলঞ্চতলায়।
- তা হেইখানেও গ্যাছালাম। অরা আমার পুরান্ খদ্দের। কিন্ত এহন আর হ্যার কদর নাই।
- খদ্দের? মানে আপনি এখানে কিছু বিক্রি করেন বুঝি?
- বিক্রি মানে আমার গলা চেহারা, এইসব।
- আপনি কি গান টান করেন?
- তা ঠিক নয়। আমি অভিনেতাতবে অইন্যরকম।
- বুঝলাম না।
- আমারে দেইখ্যা আপনের কার কথা মনে লয়?
- কার কথা বলুন তো? সান্তাক্লজ?
- বিদ্যাশের মানুষ নয় দ্যাশি কাউরে মনে লয়?
- মানে দেশি? লোকনাথ বাবা? তবে তার এরকম পোষাক পরা ফোটো দেখিনি।
- কত্তা কি ছেলেবেলায় রবীন্দ্রনাথ পঅড়ছেন?
- হ্যাঁ থার্ড লাঙ্গুয়েজ বেঙ্গলিটেক্সটে ছিল।
- হয়। আমি হেই রবীন্দ্রনাথের ভূমিকায় পার্ট করি।
- ওবাবা রবীন্দ্রনাথ? তাই এই মেকাপ?          
- এইগুলান মেকাপ না। আমার চুলদাড়ি নিজস্ব।
- তবে কি পুরো মেক ওভার?
- কি জ্যানি, যা খুশি কইতে পারেন।
- তা এত লোক থাকতে রবীন্দ্রনাথ কেন হতে গেলেন?
- ত্যামন কিছু কারন নাই। সুভাষ বোস, বাঘা যতীন, মাস্টোরদা অনেকের পার্ট করছি। শ্যাষকালে এইহানে খারাইয়া গেল। তখন মার্কেটও রবীন্দ্রনাথের
- রবীন্দ্রনাথের মার্কেট মানে?
- এই বোঝলেন না? তহন সব ইস্কুলগুলান রবীন্দ্রজয়ন্তী করতো। পাড়ায় পাড়ায় হইত। এমন কি অই গুলাঞ্চতলায় বহুরূপীর তাঁবু পড়তো। হেইহানে আমার ডাক আইতো হগলের আগে। বাপ ঠাহুরভাই কালী, কৃষ্ণ সাজতো। আমি অইন্যরকম শুরু কঅরলাম। লোকে ভালোই পাইতো।
- তা অবশ্য, আগে আমি গুলঞ্চতলায় বহুরূপীর তাঁবু দেখেছি। তবে আপনাকে কখনও দেখেনি।
- আপনের কি মনে হয় আমি ফাটকি কথা কইলাম?
- না না তা কেন? আমি আপনাকে বিশ্বাস করেছি। তবে নিজে কখনও বহুরূপীর তাঁবুতে ঢুকিনি।
- তবে আমারে চ্যানবেন কি কইরা?
- আপনি রবীন্দ্রনাথ সেজে কি করতেন?
- অনার কি করনের কিছু কম আছিল? গান, পইদ্য, গইদ্য, নাটক। কিছু একটা করলেই হইল।
- একটা নমুনা শুনতে ইচ্ছে করছে যে, অবশ্য আপনার যদি আপত্তি না হয়।
- অ আপত্তি ক্যান হইবো?
          "আমি ছেড়েই দিতে রাজি আছি সুসভ্যতার আলোক
          আমি চাইনা হতে নববঙ্গে নবযুগের চালক
          আমি নাইবা গেলাম বিলাত
          আমি নাইবা পেলাম রাজার খিলাত
          যদি পরজন্মে পাইরে হতে ব্রজের রাখাল বালক
          তবে নিবিয়ে দেব নিজের ঘরে সুসভ্যতার আলোক..."

এমন একটা গভীর গদ্যময় পরিবেশে, এই কবিতা শুনতে পাবো, ভাবিনি। পুরোটা শেষ হতেও যেন রেশ রয়ে গেল। কন্ঠস্বরেও বেশ মুন্সীয়ানা আছে। খানিক চুপ থাকার পর বললাম,
- ভারি সুন্দর। কবিতা বলার সময় আপনার কথায় দেশের টান এলো না তো।
ভদ্রলোক দাড়ির ভেতর সুন্দর করে হাসলেন। বলেন,
- আরে এইডা হইল গিয়া আমার মাতৃভাষা। আমার মাটির ঘেরাণ। এইডারে ভুইল্যা গেলে হইব? আর কবিতাটা তো অভিনয়। বহুরূপী তো আসলে একজন অভিনেতা।
- এবারে আপনার কেমন ব্যাবসা হল?
- কোথায় আর হইল? মেলা কমিটি বহুরূপীর ছাউনি রাহে নাই। হেইহানে অহন অন্ধকার কইরা জোনাক পোকার ন্যায় লাইড লাগাইছে। বড় বড় বক্স লাগাইছে। আইটেম গান আর নাচের মেঝে। লোকে নাকি আজকাল পয়সা দিয়া হেইয়া করতে আসে। বহুরূপীতে আর ব্যাবসা জমে না।

কথা বলতে বলতে উল্টো দিক থেকে একটা মানুষ ঢাকা টেম্পো এসে হাজির। ওইটুকু গাড়ির ভেতর, বাইরে, ছাদে লোকের পলেস্তরা। তার ভেতর থেকে কে যেন হেঁকে উঠল, "আরে রবীন দাদু তুমি এইহানে? তোমার বাড়ি ঘুইর‍্যা আইলাম। ফোন ব্যবহার করো না ক্যান? চল চল আউশডিঙি যাবা চল।" 
- আরে গোপাইল্যা নাকি? তগো অনুষ্ঠান এইবার হইবো?
- ক্যান হইবো না? যাবা তো চলো।
ওই ভীড়ে বৃদ্ধ নিজের ছোটো ব্যাগটা নিয়ে উঠে পরে। আমি ঘটনার আকস্মিকতায় একটু হকচকিয়ে গেছি। ধাতস্থ হয়ে ভদ্রলোককে বিদায় জানিয়ে বলি,
- ঠিক আছে আবার দেখা হবে। কিন্তু আপনার নামটা জানা হল না।
- আমার নাম রবীন্দ্রনাথ
- সে কি? নামটাও? আপনার কি ছোটবেলা থেকে এমন দাঁড়িগোফ ছিল, যে মা বাবা এই নাম দেন?
- কি কঅরব বলুন? বাপে সাধ কইর‍্যা নাম রাখছে।
- তবে পদবি-টাও কি ঠাকুর?
- না পদবি পাঠক।                                                             
- মানে?
- মানে আর কি? রবীন্দ্রনাথ পাঠক।
একরাশ ধোঁয়া ধুলো উড়িয়ে টেম্পোটি চলে যায়। আমি ধুলোটুকু মেখে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে। সব কিছুর মধ্যে জেগে থাকে কটা শব্দ:
                                                                                                                                                              
"... যদি ননীছানার গাঁয়ে
কোথাও অশোকনীপের ছায়ে
আমি কোনো জন্মে পাইরে হতে ব্রজের গোপবালক

তবে চাইনা হতে নববঙ্গে নবযুগের চালক।"

মঙ্গলবার, ২২ মার্চ, ২০১৬

অভিযোজন

অভিযোজন

দোয়েলপাড়ার মাঠে পুজোর বাঁশ পড়েছে। এই অঞ্চলে এটাই সবচেয়ে বড় পুজো। আর প্রতি বছর ঠিক পনেরোই অগাষ্ট মাঠে প্যান্ডেলের বাঁশ পড়ে। দিগিন এ পাড়ার আশ্রিত। রোগা দড়ি পাকানো চেহারা। তা দেখে বয়স আন্দাজ করা খুব মুশকিল। পঞ্চাশ থেকে সত্তর যা খুশি হতে পারে। মাঠের পাশেই বিশাল দিঘি। তার ভাঙাচোরা ঘাটে সন্ধ্যেবেলার বাবার প্রসাদ চড়িয়ে বসে আছে। মনের মধ্যে বেশ রঙ ধরেছে। স্বাধীনতা দিবসের সকালে কয়েক পশলা বৃষ্টির পর বিকেলটা বেশ মনোরম। দিগিনের বড় সুখ হচ্ছে। এ পাড়ায় সে ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো। কখনও ইস্ত্রিওয়ালা, কখনও কারো বাজার সরকার, কখনওবা শ্মশান যাত্রী বা হাসপাতালে রাত জাগার লোক। সন্ধ্যের মুখে, এই ঘাটে কেউ বড় একটা আসেনা। হঠাৎ দিগিনের খেয়াল হয়, কে একটা যেন জলের কাছে বসে। কি রে বাবা! সুইসাইড কেস না কি? দিগিন এমন অনেক দেখেছে। ভোম্বলদার ছোট মেয়ে, বিয়ের আগের দিন রাতে এই ঘাটেই ডুব দিয়েছিল। দিগিন তখনও এমন বোম ভোলা হয়ে ছিল। ভেবেছিল, মেয়েটি বোধহয় নাইতে এসেছে। তা পরদিন দারোগা যখন ওকে জিজ্ঞেস করে, ওর খুব কষ্ট হয়েছিল। আহা রে! আগে জানলে নিশ্চই বাঁচাতে পারত। আজ আর দেরী করেনা পায় পায়, সিঁড়ি ভেঙে নামে। বিশাল পালোয়ানি চেহারা। জলের দিকে মুখ করে বসা। পরনে টাইট গেঞ্জী আর প্যান্ট। বাবা, এত স্বাস্থ্যবান লোক, নিশ্চই সুইসাইড করতে আসেনি। নিজেকে আস্বস্ত করে দিগিন।

- দাদা কি পাড়ায় নতুন?

মিহি সুরে দিগিন জিজ্ঞেস করে। কিন্তু ওপাশ থেকে কোন উত্তর আসেনা। শুধু লোকটা পাশ ফিরে চায়। যেমন রাক্ষসের মতো চেহারা, তেমনি জাঁদরেল মুখ। পাকানো গালপাট্টা আর কোঁকরা চুল। কোথায় যেন দেখেছে। কিন্তু এই মুহুর্তে মনে করতে পারেনা। গঞ্জিকায় রঙ ধরলে তখন আলু আর আলুবোখরায় তফাত করা একটু মুশকিল হয়। চেনা পরিচিতি না হাতড়ানোই ভালো। আবার জিজ্ঞেস করে,

- স্যার কি পাড়ায় নতুন?

- কেন তোমারা কি নতুন লোকের কাছে ট্যাক্স নাও?

- না স্যার কি বলছেন? আপনারা হলেন গণ্যমান্য ব্যক্তি।

- কি করে বুঝলে? তুমি তো আমায় আগে কোনদিন দেখনি।

- সে কি কথা স্যার? আপনাদের মতো লোককে কি চিনতে হয়? আপানাদের শরীর থেকে একটা জ্যোতি বার হয়।

- ভ্যাট। বাজে কথা যত। ও সব জ্যোতি ফোতি ফালতু।

-  তা আপনি যাই বলুন, আপনার চেহারার মধ্যে কিন্তু একটা ব্যাপার আছে।

- সে যাই হোক, তুমি বল তোমাদের এই পাড়ায়, এটা কি দূর্গা পূজার প্যান্ডেল?

- হ্যাঁ স্যার, এটা দূর্গা পূজার প্যান্ডেল।

- তুমি স্যার স্যার করছো কেন বল তো?

- না মানে ওই বললাম না, আপনার চেহারার মধ্যে একটা ব্যাপার আছে। সে বার এই দোয়েল পাড়ায় একটা হাতি এসেছিল। তা ছেলে বুড়ো, সবাই সেই হাতির ছবি তুলতে লেগেছিল পটাপট করে।

- তা তে কি প্রমান হয়?

- না তেমন কিছু নয়। মানে হাতি টা কিন্তু কারো ছবি তোলেনি।

- হাতি আবার ছবি তুলবে কেন?

- না মানে সবার হাতিকে বিশেষ লেগেছিল কিন্তু হাতির কাউকে মনে লাগেনি।

- এমন বলছো, যেন মনে লাগলেই সে ক্যামেরা বাগিয়ে ছবি তুলতে লেগে যেত?

- ও সেটা হতো না বুঝি?

- তোমার কি তার কাটা আছে?

- স্যার কি পুলিশ?

- কেন বলতো?

- না কেমন ঠিক ঠিক আন্দাজ করে ফেল্লেন?

- মানে?

- না এমনি তে ঠিক থাকে, ওই সন্ধ্যের পর আমার একটু আলুথালু হয়ে যায়।

- তার মানে তোমার আলুর এখন পটল তোলার অবস্থা?

- যা বলেন। আপনারা সব গণ্যমান্য ব্যক্তি।

- আবার সেই এক কথা?

- তার মানে আপনি এখানে নতুন।

- নতুন আবার পুরোণও বটে।

- নতুন কিন্তু পুরোণ? কি করে হয়?

- তা তুমি এখন বুঝবে না। দিনের বেলা বুঝে নিও।

- বেশ না হয় দিনের বেলায় জিজ্ঞেস করবেন। কিন্তু আপনাকে কখনও দেখেছি বলে তো মনে পড়েনা। অথচ আপনার মুখটা খুবই পরিচিত।

- বছ্ছরের চারটা দিন তো আমাকেও দেখ। না চেনার তো কিছু নেই।

- ও আপনি বুঝি ক্লাবের প্যান্ডেলওয়ালা? তা তখনই ঠাহর হয়ছে, আপনি যেমন তেমন লোক নন।

-  কি বল্লে? প্যান্ডেলওয়ালা? হো: হো: হো:

 

এই বলে সেই পালোয়ান ভয়ানক জোরে হেসে ওঠে। দিগিনের পিলে পর্যন্ত নড়ে যায়। কুঁই কুঁই করে বলে, "ওমন করে হাসবেন না স্যার। আমার নেশাটা ফেটে যাবে।"

- বাবা তোমার তো দেখছি তুরীয় অবস্থা।

- ওই যা একটু আধটু প্রসাদ পাই। তা আপনি কোথা থেকে আসছেন?

- পাতাল থেকে।

- পাতাল রেল? তা ভালো। ওখানে বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা থাকে। তবে বিড়ি সিগারেট খেতে দেয় না।

- আচ্ছা নিরেট তো? বল্লাম পাতাল থেকে, বলে কিনা পাতাল রেল?

- ওই হল পাতাল আর রেল। উনিশ আর বিশ। তা কি করতে এখানে এলেন স্যার?

- জেরা করছ না কি?

- বালাই ষাট। আপনি স্যার গণ্যমান্য, আপনাকে জেরা করার আমার কি ক্ষমতা?

- তা করলেও কিছু যায় আসে না। আমি এসেছি ময়না করতে।

- ময়না? ভোম্বলদার ছোট মেয়ে? সে তো গত বছর এই ঘাট থেকেই।

- ধুস। ময়না মানে তদন্ত।

- ও বাবা। তবে তো পুলিশ। তখন ঠিক বলেছিলাম।

- না না পুলিশ টুলিশ নয়। প্রতিটা প্যান্ডেলে ঘুরে দেখতে হয় সব সেফ কিনা?

- তবে তো তাই হল স্যার।

- না তাই হল না। পুলিশ কে গভর্মেন্ট পাঠায়। আমায় পাঠায় স্বয়ং ভোলানাথ।

- ভোলাদা? আপনি ভোলাদার লোক? তাই বলুন। পেটো ভোলার নামে এখানে সবাই বান্ডিল হয়ে যায়।

- আচ্ছা গেরো তো? বলছি ভোলা মহেশ্বর, তোমাদের দূর্গা মায়ের হাজব্যান্ড। গেঁজেলটা বলে পেটো ভোলা।

দিগিনের এবার সত্যি মনে হয় নেশা টা ফেটে যাবে। বলে কি লোকটা? ও দেবলোক থেকে আসছে? কি জানি, এও হয়তো ছিলিমে টান দিয়ে এসেছে। তাই আর তর্ক করে না।

- তা সব দেখে শুনে কি বুঝলেন? সব ঠিক ঠাক তো?

- সব ঠিক কি আর কোন কালে হয়? আমরা আছি না?

- আপনারা মানে?

- আরে টিউব লাইট, আমরা মানে মহিষাসুর।

- আরিব্বাস আপনি মহিষাসুর?

- ন্যাকা তবে কি ভেবেছো, তোমার মতো সিরিঙ্গাসুর?

- স্যার শরীর তুলে কথা বলবেন না। বড্ড ইয়ে লাগে।

- অত সেন্টি যদি, মুগুর ভাঁজো না কেন?

- ওসব কথা থাক, তবে তো স্যার, কি বলে, সেলিব্রিটি।

- সেসব ভালো লোকেরা হয়। আমরা খারাপের দলে।

- বেশ। খারাপ না হলে, ভালো টা বুঝবো কি করে?

- ঠিক, আমারও সম্ভবানি যুগে যুগে।

- তা স্যার এই যুগে কি বুঝলেন?

- ঠিক-ই আছে। অপরাধ আর অপরাধী মার্কেটে না থাকলে, তাদের ঠেঙিয়ে গ্লোরিফাই হবে কি করে? তবে কিনা তোমাদের এখনকার অপরাধের একটা বেসিক পাল্টে গেছে।

- সেটা কি রকম?

- এই দেখ আমি তোমাদের দুগ্গা মা-র কাছে কেমন ধোলাই টা খাই, কিন্তু এখনকার অসুররা মেয়েদের কে পাল্টা দিচ্ছে। চার পাঁচ জন মিলে একসাথে। তারপর আবার পুড়িয়ে টুড়িয়ে দিচ্ছে।

 

শুনে, দিগিন কেমন ব্যোম খেয়ে গেল। লোকটা বলে কি?

 

- তা স্যার সেটা ভালো না খারাপ?

- জানিনা। তবে অভিযোজন বোঝ?

- অত বিদ্যে থাকলে, কি এই দশা হয়? তবে স্যার আপনার দেখা পেয়ে রোমাঞ্চ লাগছে।

- থাক, অত আদিখ্যেতায় কাজ নেই। যাও একটা ছিলিম সেজে আনো।


এটা দিগিনের সবচেয়ে পছন্দের কাজ। লাফ দিয়ে উঠে যায়। একটু পর যত্ন করে ছিলিম সাজিয়ে লাফাতে লাফাতে ফিরে আসে। দেখে কেউ কোথাও নেই। শুধু ঘাটের নিচটাতে একটা বড়সড় মোষ, বসে বসে জাবর কাটছে। অনেকটাই রাত নেমেছে। দোয়েলপাড়ায় সকালে কারা পতাকা তুলেছিল, সেটা নামাতে ভুলে গেছে। অন্ধকার আকাশের গায়ে একা একা পতকাটা অভাগার মতো ঝুলে আছে।

 

ভাই রবীন্দ্রনাথ


ভাই রবীন্দ্রনাথ,

দিন কে দিন, তুমি কিন্তু কেমন একটা হয়ে উঠেছ। যেখানে যাচ্ছি, সেখানে তুমি। কি মুশ্কিল বল দেখি। তোমার জন্য, আর কেউ তো হালে পানি-ই পেল না। সে তোমার সময়কালে হোক বা উত্তরকালে। এটা কিন্তু ভাই তোমার বড্ড এক বগ্গা চাল। আচ্ছা শুধু কি একজনই ব্যাটিং করবে? এই যে তোমায় নিয়ে দুচার বাইট যা হোক লিখছি, তা দেখে তোমার গুণমুগ্ধরা রে রে করে তেড়ে এল বলে। কেউ কেউ আবার নাক সিঁটকিয়ে বলবে, ফুটেজ খাবার জন্য এই অপচেষ্টা। আমি জানি গুরু (দেব), তুমি না বললে কি, বুঝবো না ভাবছো? ওই দেখ, শুরু তে ভাই বলে সম্বোধন করলাম বলে কত শত প্রানে যে ফোস্কা পড়ল, তার আর হিসেব নেই। সেই ছেলেবেলা থেকে তোমার কোটেশান মুখস্থ করে করে চালাচ্ছি। ইস্কুলে মাস্টারবাবু বলতেন, ছেলে রবীন্দ্র জয়ন্তী করছে, কি না নারীসঙ্গ করতে পারবে, সেই জন্য। তা মাস্টারবাবু কিছু ভুল বলতেন না। এই একটু সুন্দরীদের সাথে থাকা যাবে। এক দুবার চিত্রাঙ্গদা বা শ্যামাতে কোরাসে লিপ দিতে পারব। তার জন্য বেশ কিছুদিন রিহার্সাল। একটু রাত বেশী হয়ে গেল, সুন্দরীকে বাড়ী অবধি পৌঁছে দেবার নির্দেশ। আর আমার তেমন শিকে ছেড়েনি হয়তো, কিন্তু কত জনের তো হিল্লে হতে, চোখের সামনে দেখেছি। আরে বাবা অব্যর্থ কেস স্টাডি। তোমার সেই, “একটুকু ছোঁয়া লাগে”। সত্যি বস, মনের মত করে আর কেউ বলল না। কেন বলল না বল তো?

সেই যে ট্রামের সহযাত্রীণী (বানান ঠিক লিখলাম কি?) নিয়ে তুমি অমন করে বললে, “নাম তার কমলা, দেখেছি তার খাতা উপরে লেখা”। আমি ট্রামে তেমন করে চড়ার সুযোগ পাইনি তবে, গল্পটা একঘর। ওমন চিন্তা আমার লোকাল ট্রেন বা বাস, সবেতেই হয়েছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, বুক ঢিপ ঢিপ করছে। মনে হচ্ছে ভীড়ের জন্য গায়ের সাথে চিপ্টে যে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে, সেও নিশ্চিত আমার হার্টবিট শুনতে পেল। তারপর যথারীতি একটা স্মার্ট আর চকচকে ছেলের সাথে মালটা কোন বিদর্ভ নগরে হারিয়ে গেল। এই, মাল বললাম বলে রাগ করো না। তোমার মত অত বৈদিক শুদ্ধ আচার কোথায় পাবো? আচ্ছা তুমি বাইক চড়তে? বা সাইকেল? সাইকেল নিয়ে তোমার প্রেম বা প্রশান্তিমুলক কোন লেখা আছে? জানি না তবে, আমাদের সময় এই দুই চক্রযানের মহিমা অপার। তোমার শান্তিনিকেতনেও তো এর প্রভুত প্রচলন। আহা সেই সঙ্গীনী সহকারে সাইকেল নিয়ে খোয়াই বা কোপাই অভিযান। মনে রাখার মতো।

তোমার নাটকে, গল্পে, গানে, কবিতায় তুমি ঘুরে ফিরে অচলায়তন ভাঙার গল্প করেছ। একটু পাশ ফিরলে যারা দোষ ধরে, যারা স্বপ্নেরও প্রায়শ্চিত্য করায়, তাদের কে নিয়ে তোমার অশান্তির শেষ নেই। আবার তোমার গানের সুর নিয়ে, সমাজের জ্যাঠামশাইদের কি দুশ্চিন্তা! সে একবার তোমার গানের সময় জিন্স পরে স্টেজে ওঠার জন্য কি বকুনি যে খেয়ে ছিলাম, কি বলব। আচ্ছা আমি না হয় অর্বাচিন, কিন্তু আজ এত বচ্ছর পরে যদি তোমার গান কেউ জিন্স করে গায়, তাহলে তোমার গানটাই তো জিতে যায়, নাকি? আচ্ছা প্রত্যেক যুগে এই দায়িত্ববান জ্যাঠামশাইরা ঠিক চলে আসেন, কেমন করে?

আমাদের সময়ে বিশেষভাবে ক্ষমতাবান লোককে আমরা ভাই বলি। তারা সবাই সব কিছুর উর্দ্ধে। তাদের ছোঁয়া যায়না কিন্তু তারা বিরাজ করেন। তোমার সম্বন্ধে এরকম একটা অরণ্যদেব মার্কা অনুভূতি হয়। তুমি যেন চলমান অশরীরী। আচ্ছা সেটা ভালো না খারাপ? যাই হোক অনেক গাঁজাগুল্লি গল্প হল, এবার থামি। তুমি আর ঠাকুর হয়ে উঠোনা, প্লিজ। এমনিতেই ন্যাতানো শিরদাঁড়াওয়ালা লোক আমি, তার উপর চতুর্দিকে গুচ্ছের দেবী দেবতার হুঙ্কার। তার মধ্যে তুমিও আবার দেবতা হয়ে গেলে আবার একটা পাঁচালি আর সিন্নির ব্যবস্থা করতে হবে। আজ তবে আসি, মাঝে মঝে পিং করে যাই, ওই আর কি “শুধু যাওয়া আসা শুধু স্রোতে ভাসা”।

ভালো থেকো।

ভয়ের রঙ

ভয়ের রঙ


স্টেশনের পাশ দিয়ে নির্জন গলিপথ। সেখান থেকে একটু আঁকাবাঁকা গেলে লাল আলোয় দেগে দেওয়া পাড়া। যারা সেখান দিয়ে শর্টকাট করে, তারা জানে। যারা সওদা করতে যায়, তারা তো জানেই। অন্ধকার মাখা ঝুপড়িগুলোতে মানুষের দাম ধরা আছে। আছে আরো অন্যরকম পণ্যের হদিশ। নাড়ু দেড়শো টাকা পিস, দানা দুশো টাকা। দেশি গোপাল বারোশো আর বিলিতি নয় হজার টাকা। বিন্দির দোকানে এই সব সওদাগরেরাও আনাগোনা করে। তারা চা খায়, নির্দোষ বেকারি বিস্কুট। আলাদা করে প্যাকেটও খায় অনেকে। তবে সে সব বিন্দি বিক্রি করে না। লাইনের ওদিকের জঙ্গলের পাশ থেকে আনে। বিন্দি চেনে সবাই কে। কে খোচর, কে পুলিশ, কে এ পার্টি, কে অন্য। কখনো কখনো বেড়া ডিঙিয়ে আসে। বিন্দির সবাই খদ্দের, তাই কারো কোন কথা, কানে বা মনে কোথাও নেয় না। সে জানে এটা তার ব্যাবসা। ওরা আসে বলে দুটো উপরি হয়। মাঝে মধ্যে যখন ভোট আসে তখন বিক্রি বেড়ে যায় তিন চারগুণ। সবার লাভ। দামী পোশাকের বাবুরাও আসে। বিন্দির দোকানের কোণেতে মিটিং হয়। গোপন কথার মিটিং। তখন রোজকার তরকারি বা মাছওলারা এদিক ঘেঁষার সুযোগ পায়না। একটা বুথ দখলে যদি এত টাকার রসদ লাগে। গোটা দেশ দখলে কত খরচ হয়? সেই মুরুব্বিরা কোথায় মিটিং করে? কে তাদের চা জোগায়? যে পার্টি জিতুক, লাভ হয় দানাদারদের।

তবে আজকের গল্পে বিন্দির কেমন ভয় ধরে। মাছ বিক্রি করে যে, তার সাথে ফুলওয়ালার চাবিড়ির সম্পর্ক। কিন্তু আজ কেমন দূরে দূরে বসেছে। ফুল বিক্রি করছিস কর, অন্যদের নিয়ে অমন করে বলার কিছু ছিলনা। ও তো আর সেদেশে গুলি ফোটাতে যায়নি? কিন্তু কেউ যেন চাইছে গন্ডগোলটা বাধুক। যেমন ভোটবাবুরা চায়। বিন্দি বুঝতে পারে। বারুদের যে অনেক দাম। বিক্রি হলেই টাকা। ঘেন্না থেকে রাগ, আর রাগ থেকেই তো আগুন। বেড়ার ওধারেও ধোঁয়া ধোঁয়া লাগে। অঙ্কগুলো বড় সহজ লাগে বিন্দির। এই খবরেই কেমন কাগজ বেশি বিক্রি হচ্ছে। রোজের হিন্দিগানের চ্যানেল না দেখে লোকে খবর দেখছে। সবার রোজগার বেড়ে যাচ্ছে। আরো খবর, তো আরো বিক্রি। লাগিয়ে দিতে পারলেই হল। আর খটাখটির তো অন্ত নেই। জামা আলাদা, ভাষা আলাদা, আদব কায়দা, খাওয়া দাওয়া সব আলাদা। কোন একটার ধুয়ো ধরে ক্ষেপিয়ে তুলতে আর কতক্ষণ! আর ক্ষেপে উঠলেই বিক্রি বাড়বে।

সেদিন টিভিতে রাতের গানের অনুষ্ঠান দেখছিল। কারা জিতবে, সেটা নাকি ঠিক করাই থাকে। কান্নাকাটি ঝগড়াঝাঁটি সে সব নাকি বানানো, মেকি। পাবলিক খায়। আর খেলেই বিক্রি। চা বিক্রি করতে করতে বিন্দি কেমন করে পুরোটা বুঝে ফেলে। দু পক্ষের লড়াইএ একটি তিন নম্বর লোক থাকে, যে সব সাজায় আর লভের টাকা ঘরে তোলে। কিন্তু সমস্যা একটা। জাত, ধম্ম, ভাষা সব আলাদা হলেও রক্তের রঙটা তো এক। সেখানে তো পুরোটাই ঢ্যাঁড়া। বারুদ কি রঙ দেখে পোড়ায়? নিজের চালে লাগতে কতক্ষণ?

ব্লগ এবং বই পাওয়ার ঠিকানাঃ https://souravstory.com

 এখন থেকে ব্লগ সহ অন্যান্য সব খবর এবং বই পাওয়ার ঠিকানাঃ https://souravstory.com